বিদায়ের পরে
‘চললুম’ বলে বেরিয়ে এলাম
চেনা ঘেরাটোপ থেকে।
রাত প্রায় ন’টা।
আমার সমস্ত আশঙ্কাকে
অমূলক প্রতিপন্ন করে
ঘেরাটোপের বাইরের পৃথিবী
একেবারে আগের মতন।
রুটির দোকানের সামনে ভিড়,
ফুটপাথের দোকানি
শালপাতায় সাজিয়ে দিচ্ছে
ধোঁয়াওঠা গরম ডিমভাজা,
গন্ধটা বড় লোভনীয়।
বাসের খালাসি সেই একসুরেই
প্যাসেঞ্জার ডাকছে।
জানলার ধারের একটা সিটে এঁটে বসি,
রাস্তা এখন ফাঁকা,
চেনা চলমান দৃশ্য।
খুব দ্রুত ভুলতে হবে
বেশ খানিকটা সময়,
নির্মম হয়ে মুছে ফেলতে হবে
বেশ কিছু সম্পর্ক আর অভ্যেস।
সম্পর্কের অভ্যেস কিংবা
অভ্যেসের সম্পর্ক।
ক্ষতটা পুরো মেলাতে লাগবে কয়েকদিন।
তারপর দীর্ঘ অতীত হয়ে যাবে
পূর্বজন্মের স্মৃতির মত— আবছায়া।
প্রথমে ঘটনার পরম্পরা গুলিয়ে যাবে,
তারপর বিস্মৃতিতে তলিয়ে যাবে
বহু নাম আর চেহারা।
ঘেরাটোপের ভেতর থেকে ভেসে আসা
বিদ্রূপ আর ধিক্কারগুলো
প্রথম ক’দিন আমাকে উত্তেজিত করবে,
তারপর সেগুলো ভারী
আমোদ যোগাবে।
তারপর সেগুলো পর্যবসিত হবে
নিছকই অর্থহীন শব্দে।
জীবনের ওপর পূর্ণ আস্থা আছে আমার,
প্রতিনিয়ত দুনিয়াদারি
সে আমাকে দেখাবেই,
আমি আবারও মজে যাব
আমার মতন ছোট ছোট মানুষদের
অকল্পনীয় জীবনগাথায়,
তুচ্ছাতিতুচ্ছ ইতিহাস
উজ্জ্বল দিনলিপি লিখবে
আমার চেতনা জুড়ে।
আরও খুঁটিয়ে দেখার ক্ষমতা চাই।
কোনও মহাজীবনের
চোখ-ধাঁধানো করিশ্মা নয়,
আমি আরও স্পষ্ট করে জানতে চাই,
আটপৌরে মানুষদের
বেঁচে থাকার আশ্চর্য রূপকথাকে।
সম্মতি
এখনও কলম হয়নি দুর্বিনীত
কবিতা এখনও নিছকই ব্যক্তিগত
যৌবন শোনে শিবতাণ্ডব স্তোত্র
মিথ্যে এখন জলের মতনই সত্য।
নির্ভীক মানে উলঙ্গ চাটুকার,
বুঝিয়ে ছাড়বে, ধর্ম থাকতে
ভাতের কী দরকার?
প্রগতিশীলেরা জল মাপে বুঝেশুনে
দালালি তো তারা করবেই প্রতিবার।
স্বাধীন হয়েছি কত যুগ কত কাল
নির্বাচনের গুরুতর ইস্যু
বিনে পয়সার চাল।
ছড়িয়ে দিলেই আজও অগুন্তি কাক,
খালিপেটে ভারী মনোরম লাগে
প্রগতির হাঁকডাক।
শুধু মোচ্ছবে কোথাও অভাব নেই
নেশার পয়সা ভূতের বাপেরা
যোগাবেই যোগাবেই।
বুঁদ হয়ে থাকা মদে বা ধর্মে
যার যেদিকেতে ঝোঁক
ড্যাঞ্চি দরেতে স্নায়ু ও মগজ
বেচছে বেবাক লোক।
কাল কি জুটবে? জানা নেই,
জানা নেই।
কান ঝালাপালা
নিলামের আওয়াজেই।
জুয়াচোরদের দাঁও মারা ছাড়া
কোত্থাও কিছু নেই।
কেন রয়েছে তো জঙ্গিবিমান
আনকোরা একদম
সীমান্তজোড়া অশান্তি খুব
হরবখত, হরদম।
কেন রয়েছে তো নিদারুণ ঘৃণা
পরধর্মের প্রতি,
সর্বনাশের পথ বেছে নিতে
আমাদের সম্মতি।
আসুন, পাপ করি
আসুন চরিত্রবানের দল—
একটু গায়েগতরে পাপ করা যাক।
মনের ভেতরে তো মারাঠা ডিচের পাঁক।
দুবেলা যত্ন করে রসকলি কেটে
আর কত চুরি ভাবের ঘরে হবে?
না, না। ব্যস্ত হবেন না দৃঢ় চরিত্রবানরা—
আমি আপনাদের ও পাড়ায় যেতে
বা লিভারের বারোটা বাজাতে বলছি না।
ও ব্যাপারে আপনার দৌড়
মাঝরাত্তিরে ফোনে নটি আমেরিকা,
আর শনিবারে শনিবারে
একটা 180 ML অবধি।
সে আমার বিলক্ষণ জানা আছে।
আমি একটু লরমসরম পাপের কথাই বলছি,
প্রথমে বাবা মা মাস্টারমশাই
পরে শাশুড়ি বউ আর বড়লোক ভায়রা
ওদিকে গুরুদেব পাড়ার দাদা
আর ডাক্তারবাবুর বাধ্য হয়ে তো
বেশ নিমপাতা নিমপাতা জীবন কাটাচ্ছেন।
সকলের কাছ থেকে কী ভাল কী ভাল
শুনতে শুনতে আত্মধিক্কার জন্মাচ্ছে না?
এবার একটু অবাধ্যতার পাপই করুন।
ছোট জিনিস থেকেই
শুরু করে দেখুন না।
ধাপে ধাপে না হয় পাপ বাড়াবেন।
শনি-মঙ্গলবার ডিমের কষা খেয়েই
পাপের হাতেখড়ি হোক।
ভগবানের সিংহাসনে লাথি মারার কথা
এক্ষুনি বলছি না।
কিন্তু ঈশ্বর নিয়ে একটু অজ্ঞেয়বাদী
হওয়ার পাপটুকু অন্তত করুন।
যারা পাথর দিয়ে ভাগ্য ফেরায়
তাদের চিটিংবাজ বলতে
এমন কিছু বুকের পাটা লাগে না।
ধম্মেকম্মে মতি থেকেই বা কী
আর না থেকেই বা কী?
ভাতের থেকে জাত বড় করে দেখার
পুণ্যটা আর নাই বা কুড়োলেন।
হে অপাপবিদ্ধ চরিত্রবানের দল
জীবনে একবার অন্তত
অর্ণব, সুধীর, সুমনদের
অবিশ্বাসের পাপ করুন।
ইউটিউব চ্যানেল আর সহ ডেলি প্যাসেঞ্জার
ভবতোষদার বক্তৃতায় বিশ্বাস না করে
একবার পাপের ভাগী হন।
দুটো চোখ আছে একটা মন।
অন্ধ আর অনুগত থাকলে
প্রশংসার অভাব হয় না।
সুনামের লোভ ছেড়ে একবার
অন্তত একবার, চোখে দেখার পাপ করুন।
চিন্তা করার পাপ করুন একবার।
একবার ছুঁয়ে দেখুন নিষিদ্ধ ইস্তেহারকে।
বাধ্য নাগরিকের বাত্সরিক
গণতান্ত্রিক অধিকার পালন করতে করতে
দেশটাকে তো খাদের কিনারায়
টেনে নিয়ে এসেছি আমরা।
এবার ঘুরে দাঁড়াবার পাপ করা যাক।
একবার অন্তত চিত্কারের পাপ করুন।
এখনই সময়, চিত্কার করে বলুন,
‘তোমার ভারী বুটটা
আমার মুখের ওপর থেকে সরাও,
আমার লাগছে।’
নইলে ভবিষ্যতে
কেবলই আর্তনাদ করতে হবে
স্বদেশ নামের কোনও বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে।
আর সে-আর্তনাদ শোনার মত
পাপ করার আর কেউ থাকবে না।
স্বয়ং ঈশ্বর
হয়েছি নতজানু
রেখেছি বিশ্বাস
আমার ঈশ্বরে
অচলা ভক্তি।
বড়ই অভাবেতে
কাটছে এ জীবন
তাই তো পরকালে
ভারী আসক্তি।
চাইনি বেশি কিছু
দুবেলা ডালভাত
সুস্থ হয়ে বাঁচা
একটি পাকা ঘর,
আমার সে-চাওয়া
নামঞ্জুর করে
বুঝিয়ে দিয়েছেন
স্বয়ং ঈশ্বর:
ভীষণ পাপ ছিল
আগের জন্মেতে
তাই তো আধপেটা
হল বরাদ্দ,
প্রায়শ্চিত্তর সময়
এটা ভাই
তাই তো বেঁচে থাকা
আদ্যশ্রাদ্ধ।
মেনে তো নিয়েছি
পাপের খণ্ডনে
কাটবে এ জীবন
অভাবী নাগপাশে,
যদিও জানা আছে
আমার ঈশ্বর
গরিব ভক্তকে
বেশিই ভালবাসে ।
তাই তো মুখ বুজে
শুধুই খেটে যাই—
গাধার খাটুনি
খেতে বা চটকলে
সাজিয়ে রেখেছে
আমারই জন্যে
স্বয়ং ঈশ্বর
স্বর্গ পরকালে।
তবুও মাঝে মাঝে
শুধু নিজের কাছে
করেছি প্রশ্ন
ভীষণই চুপিচুপি,
আমার চারধারে
যারাই ভোগ করে
তারা কি প্রত্যেকে
পুণ্যে গড়া ঢেঁকি?
আগের জন্মেতে
তারা কি সক্কলে
ছিল কি যিশু নবী
কৃষ্ণ অবতার?
তবে যে বলে লোকে
পাপের ভারী ভারে
পৃথিবী হয়েছে
কেবলই ছারখার।
সরল এই মনে
তবুও নিয়মিত
অভাব ঝেড়ে ফেলে
বাঁচার লোভ আসে।
কী আর হবে ক্ষতি
স্বয়ং ঈশ্বর
আমাকে যদি আর
নাই বা ভালবাসে?
রঙিন
কালো পাথরে কোঁদা
মূর্তির মত স্বাস্থ্যর সন্তান
কামনা করুক গর্ভবতী মা।
ছোটরা খেলুক
কালো বাদামি হলুদ রঙের
ডলপুতুল নিয়ে।
কালোবাজার আর কালোটাকা নয়,
আসুন বলি—
চোরাবাজার আর চোরাই টাকা।
অর্থটাও সঠিক হয়।
ব্ল্যাকমানি তো এখন স্ট্যাটাস সিম্বল।
সাদা মন হোক সোজা মন,
কালোজাদুকে কুজাদু করলে
একটা অক্ষর বাঁচে।
চরিত্র সাদা না হয়ে
স্বচ্ছ হতেই পারে।
কালো অতীতকে বদলাক
খারাপ অতীত।
কলঙ্ক কি রং দিয়ে
বোঝানো যায়?
সাম্রাজ্যবাদ মানে
পশ্চিম ইউরোপ আর আমেরিকা—
তবে সাম্রাজ্যবাদের হাত
কেন কালো হবে?
শোক আর শান্তির পতাকার
রং বদল হোক।
মানুষের গায়ের চামড়া হয় না
এমন রং আসুক।
পৃথিবীজুড়ে অনেক রং,
আর সাদা-কালো ছকে
আটকে থাকা নয়।
আসুন মননে রঙিন হই,
আর তার সহায় হোক ভাষা।
অপূর্ব। আরো পড়তে চাই।