Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

ছোটগল্প: বাঁদরওয়ালা

দুনিয়াতে কোথাও শান্তি নেই। বিশেষত আমার মত অপয়া লোকের। ঢেঁকি তুমি যেখানেই যাও ধান ভানতেই হবে। চেনাপরিচিত আত্মীয়স্বজন যার বাড়িতেই যাই মিনিট দশেক বসতে না বসতে কেউ না কেউ একটা মোবাইল আমার হাতে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘দেখো তো একটু, হিসবুকটা কাজ করছে না।’

কেউ তো আবার এককাঠি এগিয়ে, সোজা জিজ্ঞেস করে বসে যে, আমি তার জন্মছক থেকে রাহুকে তাড়িয়ে দিতে পারব কিনা। এইরকম হাজারো আবদারের চক্করে পড়ে কারওর বাড়ি যাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। কিন্তু সেদিন যেতেই হল। হাজার হোক কলেজ জীবনের বন্ধু, তার বিপদের দিনে না গেলে নিজের কাছেই ছোট হয়ে যেতে হয়। বন্ধু ফোন করে বারবার বলে দিয়েছে যে সে খুবই সঙ্কটাপন্ন, আমি উদ্ধার না করলে ফটো হয়ে যাবে নির্ঘাত।

বন্ধুকে ফটো হতে দেওয়া যায় না। বরং বন্ধুর জন্য ফটো হওয়া যায়। হাজার বন্ধুরতা অতিক্রম করা যায়। তাই আশ্বাস দিয়ে বললাম, ‘মাভৈঃ! তোকে উদ্ধার আমি করবই। একমাত্র ধার দিতেই যা পারব না।’

বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোর থেকে ধার চাইছে কে রে? আমার বউয়ের জিভের যা ধার ওই যথেষ্ট। ইষ্টনাম ভুলিয়ে দেয়। সে যাই হোক, তুই চলে আয় চটপট।’

বন্ধু প্রতীকের বউ রুষা ঈষৎ মুখরা। তার ভয়ে চালে কাক বসার সাহস পায় না। যে বেচারি সাতসকালে ছেলের মুখে কাকা ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়েছে তার মেজাজ যে গরম থাকবেই এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কাকেরা সেরকম নয়, তাদের মেজাজ এমনিতেই গরম থাকে। আর তাদের মস্তিষ্কের গরম বাষ্প সুতীক্ষ্ণ কা-কা রবে উদঘোষিত হয়। আর সেই ডাক মনুষ্যকর্ণের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে।

তো বেচারা কাক ভুল করেই ভুল চালে বসেছিল। বলা যায় চালে ভুল করেছিল। কিন্তু ঘরের ভেতর থেকে গৃহকর্ত্রীর জিহ্বানিঃসৃত যা সব বেরিয়ে এল, তাতে কাকের কাকত্ব ধুলোয় মিশে গেল। সে বারকয়েক গলা ফুলিয়ে প্রতিস্পর্ধার চেষ্টা করেছিল কিন্তু সফল হয়নি। পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে পারে না কাকেরা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসেছিল দলবল নিয়ে। কিন্তু এঁটে উঠতে পারেনি। শোনা যায় নাকি সেই কাক এখন আন্দামানের কাছাকাছি কোনও এক দ্বীপে নির্বাসিত আছে। গোষ্ঠীপতি তাকে নির্বাসনের সাজা শুনিয়ে বলেছে, ‘যে কাক তার দলবলকে অ্যাটম বোমের মুখে নিয়ে যায় তাকে কোনওভাবেই দলে রাখা যায় না। মরতে মরতে বেঁচেছি। আর ও বাড়ির ধারেকাছেও নয়।’

তো সেই বাড়িতেই চলেছি সজ্ঞানে এবং সুস্থ শরীরে। বেরোনোর সময় ইনসুরেন্সের কাগজপত্র সব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি বউকে। আর বলেছি, ‘যদি বেঁচে ফিরি তো আমাকে রাঁচিতেই দিয়ো। পুরোনো পাগলখানা তো, চিকিৎসা ভাল হয়।’

দুরুদুরু বুকে বন্ধুর ঘরে গিয়ে পৌঁছলাম। তিনটে ঘরের পরে একটা বকুলগাছে কাক ডাকছে তারস্বরে। বোধহয় সতর্ক করে দিতে চাইছে। কিন্তু সংকল্প করে পূরণ না করলে নরকে যেতে হয়। ওজন্যই আগেভাগে সংকল্প করিয়ে নেয় নাম-গোত্র ধরে, যাতে পিছিয়ে আসতে না পারে কেউ। ‘যায় যাক প্রাণ’ বলেই ঢুকে পড়লাম। মনে মনে গিন্নি আর ছেলেমেয়েদের মুখগুলো স্মরণ করে নিলাম আর-একবার।

‘এই যে সুপ্রকাশ এসেছিস দেখছি। আয় আয়। পথে কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’ একমুখ হেসে বলল বন্ধুবর। আমি মনে মনে বললাম, ‘তোর তো গোটাটাই আয়, আর আমার জীবন ব্যয় হতে বসেছে।’ বাইরে বললাম, ‘কী কেস রে প্রতীক?’

প্রতীক বলল, ‘কী কেস আন্দাজ করতে পারছিস না?’

‘না তো? আরে দাঁড়া দাঁড়া, গোটা বাড়িতে এত নৈঃশব্দ্য কেন? এ তো শ্মশানের শান্তি ভাই।’

প্রতীক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এ সব ওই হতভাগা বাঁদরওয়ালার কেরামতি।’

‘বাঁদরওয়ালা?’ আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কালা জাদু করেছে নাকি?’

প্রতীক শুরু করল সেই ইতিহাস। একদা এক সকালে রুষা প্রতীককে চায়ে চিনির পরিমাণ আর শাশুড়িকে কতখানি সভ্য হতে হয় এই দুটি বিষয়ে সদুপদেশ দিচ্ছিল। টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট সেই উপদেশামৃত শ্রবণের পর একখানা উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ খেল প্রতীক। উপদেশামৃত তখনও চলছে। আর প্রতীকের বিপি বেড়েই চলেছে ক্রমাগত। ওষুধ কাজ করছে না। মাথার শিরাগুলো টনটন করছে। স্ট্রোক হল বলে।

এমত অবস্থায় বাইরে ডুগডুগি বেজে উঠল। রুষা তার প্রবচনসভা শেষ করে সেই দিকে কান পাতল। তারপর দরজা খুলে ছুটে গেল বাঁদরওয়ালার কাছে। কিছু উপদেশ তাকেও দিতে যাচ্ছিল কিন্তু বাঁদরওয়ালা জগৎসংসার চরিয়ে খাওয়া লোক। সে অপরপক্ষকে সুযোগ না দিয়েই শুরু করল, ‘লে মেরা রূপকুমার ইসকি কিসমত বাতা। মা জননীর ভবিষ্যৎ বলে দে তো বাপ। একটা ভাল মানুষের উপকার কর। মা জননী, এ বান্দর বলছে কী, আপনি খুব ভালমানুষ কিন্তু কেউ আপনাকে বোঝে না। আপনি সবার ভাল করেন কিন্তু কেউ আপনার ভাল চায় না। আপনার স্বামী, আপনার হাজবেন্ড আপনার কথা বুঝতে চায় না। আপনার মনে কষ্ট বোঝে না।’

এই দীর্ঘ বক্তৃতার মধ্যেই স্ত্রীর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রতীক। সে বুঝেছে যে, এই বাঁদরওয়ালার জন্যই তার সর্বনাশ হবে। তাই শুকনো মুখে হাতজোড় করেছে বাঁদরওয়ালার উদ্দেশে। বাঁদরওয়ালা বিষয়ী লোক, সর্বোপরি বিবাহিত। তাই প্রতীকের ওপর তার করুণা হল। সে ঈশারায় বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আর তার পরেই সেই কেলোর কীর্তি। বক্তৃতা শুরু করল বাঁদরওয়ালা। ঝাড়া একঘণ্টা বক্তৃতা। আর পুরোটা সময়ই প্রতীকের বউ চুপ। একাগ্রমনে কথা শুনছে। ঠিক ময়াল আবিষ্ট হরিণীর মত। একদম শেষকালে বাঁদরওয়ালা চালল সেই চাল। রুষার কপালের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর মৃত্যুযোগ আছে মা। এর আগে দু’-দুবার তুই বেঁচেছিস। তবে এবার বাঁচার আশা কম।’

‘আমি মরতে চাই না বাবা, আমাকে বাঁচান। আমি মরে গেলে ওই শয়তানটা একটা শয়তানি ধরে আনবে। আমার আত্মা শান্তি পাবে না বাবা। এত টাকাপয়সা গয়নাগাটি সব পরে ভোগ করবে।’ ডুকরে কেঁদে উঠল রুষা। কন্যাবিদায়ের পর এই দ্বিতীয়বার তার চোখে জল দেখছে প্রতীক।

বাঁদরওয়ালা তার বাঁদরকে বলল, ‘মাঈজিকে বাঁচাতে হবে তো। বাঁচা মাঈজিকে। সীতা মাঈয়ার মত উদ্ধার কর।’

বাঁদর প্রশিক্ষিত ও বুদ্ধিমান, সে বাঁদরওয়ালার ঝোলা থেকে একটা তাবিজ বের করে রুষার হাতে দিল। মাত্র চার হাজার টাকা। একটা মূল্যবান জীবনের দাম। তবে শর্ত একটাই, কথা কম বলতে হবে। এক-একটা শব্দ মানে মৃত্যুর দিকে এক সেন্টিমিটার এগিয়ে যাওয়া। আর সেদিন থেকেই রুষা চুপ। প্রয়োজনেও কথা বলতে চায় না। ঈশারায় জানিয়ে দেয়। প্রতীক প্ররোচিত করলেও মুখের অর্গল খোলে না। জীবন সবার উপরে, তার নিচে সব। কোনওভাবেই মুখ খুলবে না সে।

সব শুনে বললাম, ‘এতে সমস্যা কোথায়? মাত্র চার হাজার টাকার বিনিময়ে ঘরে শান্তি ফিরেছে।’

প্রতীক বলল, ‘বড় একা লাগে রে। মনে হয় শ্মশানে বসে আছি। ও চিৎকার-চেঁচামেচি করলেও সংসারে একটা প্রাণ ছিল। সেই আগের রুষাকে ফিরিয়ে দে ভাই। আমি জানি তুই সব পারিস। আমি ওকে বলেছি যে, বাঁদরওয়ালা ফ্রড কিন্তু ও আমার কথা বিশ্বাস করে না। ভাবে ওর উপর বিরক্ত হয়ে আমি ওকে মারার ষড়যন্ত্র করছি।’

বললাম, ‘বাঁদরওয়ালা কোথায় থাকে জানিস?’

প্রতীক উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, রেলস্টেশনের পাশে একটা শেডে। সামনের মাসেই চলে যাবে অন্যত্র।’

আমি আর একমিনিটও দাঁড়ালাম না। পরের সংসারে শান্তিভঙ্গ করে কী লাভ! আমার দরকার ওই বাঁদরওয়ালাকে। খিটখিটে বসটাকে টাইট দিতে হবে।

চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × three =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »