Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

দুনিয়া কারও ইচ্ছে মতো চলে না। দুনিয়া চলে তার নিজের ইচ্ছে মতো। আমি যতই যা কিছু ভাবি না কেন, ক্ষমতা নেই যে সে সবগুলো করি। যা হবার তাই হয়। আমার কাছে জিজ্ঞাসা করলে আমি কি বলব? বলার আমার কিছুই নেই।

তোমরা নাছোড় হলে যত দূর মনে করতে পারি বলছি। বহু দিন কেটে গেছে, হয়তো অনেক কিছুই অবচেতনে চলে গেছে, তাদের খুঁচিয়ে টেনে বের করে আনা খুব সহজ নয়, তবে চেষ্টা করা যায়।

এক অদ্ভুতুড়ে গ্রাম — নাম তার ভাতুড়ে — সেই গ্রামে বাড়ি ছিল এককালে। অবশ্য আমার জন্ম অন্য জায়গায়। জন্ম আমার মামাবাড়িতে — খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে। এগুলো আমার পরে শোনা কথা, মায়ের কাছে, অন্য গুরুজনদের কাছে। যাই হোক আমার জন্ম খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামে ১৩২৮ সালের (বঙ্গাব্দ) ১৬ই কার্তিক বুধবার রাত আড়াইটের সময়।

আমাদের আদি বাড়ি ছিল খুলনা জেলারই বাগেরহাট মহকুমার খানকা গ্রামে। সেখানে খানকার চাটুজ্যেরা এককালে খুব নামকরা বিত্তশালী ছিল। এই বংশেরই আধমনি কৈলাস বিখ্যাত খাইয়ে। সেই খানকায় আমাদের আদি-বাড়ি ছিল।

সেনহাটিতে জন্ম হলে কি হবে আমার অন্নপ্রাশন হয়েছিল সেই খানকা গ্রামে। আমাদের বাড়িটা ছিল ভৈরবের পাড়ে। সেই ভৈরব নদী মাঝেমাঝেই পাড়, বাড়ি-ঘর — সব ভেঙে চুরমার করে দিত। এখন আর সেই চাটুজ্যে বাড়ির কিছু আছে কিনা তা আমি জানি না, বহু বছর আর ওদিকে যাতায়াত নেই।

আমার ঠাকুর্দার যে বাড়ি ছিল সে বাড়ি পরপর তিনবার ভৈরব ভেঙে দেয়। ফলে ঠাকুর্দা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হন, পণ করলেন যে এমন দেশে গিয়ে বাড়ি করবেন যেখানে নদীই নেই। ভাঙনের কোনো প্রশ্নই থাকবে না। এই ঠিক করে তিনি এলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির দেশে। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল যশোর জেলার কোতোয়ালি থানার ভেতরেই ভাতুড়িয়া নামে একটি গ্রামে। গ্রামের লোকের মুখে মুখে নাম হয়ে গেছিল ভাতুড়ে। আশে পাশে যারা ছিল তারা ভাতুড়েকে ভূতুড়ে বলতো।

কিন্তু পাশের গ্রাম ছিল চাঁচড়া। সেই চাঁচড়া খুব নামকরা গ্রাম। সেখানে দশ-মহাবিদ্যার মন্দির ছিল। সেখানকার রাজারা (জমিদার আর কি। জমিদাররা ‘রাজা’ উপাধি পেয়েছিলেন। তা সেই জমিদাররা) ছিল খুব বিখ্যাত।

সেই চাঁচড়ার পাশে ভাতুড়িয়া গ্রামে আমার ছোটবেলা কাটে। তবে ছোটবেলার কথা আমার এই বুড়ো বয়সে আর বেশি মনে পড়ে না।

আমার মনে পড়ে আমার যখন খুব অল্প বয়স, আমাদের গ্রামে তখন ছিল ভীষণ কাদা। বর্ষাকালে তো সেখান দিয়ে হাঁটাচলা করাই ছিল দুর্ঘট এবং সে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করার ফলে আমি ছোট্টবেলা থেকেই যে অসুখে ভুগতাম তা আর কহতব্য নয়। এবং তার ফল হতো এই যে বর্ষার কয়েকমাস আমাকে গ্রাম থেকে আমার কাকার যে দোকান ছিল পুলেরহাটে সেই দোকানে এসে থাকতে হতো। কাকা বাড়িতে খেতে যেতেন। খেয়ে ফিরে আসবার সময় আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। আমি ওইখানেই খেতাম, ওইখানেই পড়াশুনো করতাম আর ওইখানেই ঘুমোতাম। বর্ষার কয়েকমাস আমার আর বাড়ি যাওয়া হতোই না। শেষ পর্যন্ত আমাকে ভর্তি করেছিলেন যশোহর জিলা স্কুলে। যশোর-জেলা-ইস্কুল, সাংঘাতিক! খুব নামডাক ছিল।

আচ্ছা, এর মাঝে আর একটু কথা বলে নেবার আছে। কাকার দোকানে আমি কাকার পাশে বসে থাকতাম। তিনি জিনিসপত্র বিক্রি করতেন, দাম-টাম নিতেন, তবিল-টবিল মেলাতেন, বাড়ি চলে যেতেন। আমি ওই দোকানেই থাকতাম। দোকানের এক কর্মচারীও থাকত। নাম সীতানাথ। আমরা দুজন দোকানেই রাত কাটাতাম।

তখন আমি দেখেছি, আমার মনে আছে এক পয়সার নুন বিক্রি হত। দুই পয়সায় মোটা চালের সের ছিল এবং ভাল চাল তিন পয়সা সের ছিল। এক পয়সায় পাওয়া যেত আটখানা বিস্কুট — সেসব দিনগুলোর কথা মনে হলে মনে হয় সে যেন গল্প। গল্প না হলে পাগলের প্রলাপ, আর কিছুই তো বলবে না কেউ।

তা যাই হোক, যে কথা বলছিলাম — যশোর জেলা স্কুলে আমায় ভর্তি করে দেওয়া হলো। স্কুলে যাওয়া ছিল দুষ্কর। স্কুল ছিল বাড়ি থেকে এক মাইল দূরে।

ভর্তি হবার দিন একবার গেছি, আর তারপর সারা বছরের মধ্যে পাঁচ দিন কি সাত দিন স্কুলে গেছি আর স্কুল থেকে ফিরে এসেছি। খুব কষ্ট হত। তার ফলে আর পরীক্ষা-টরিক্ষা দেওয়াই হয় না।

প্রস্তুতি নেই তবু জোর করে সে বছর আমায় বসানো হলো। আমিও মহানন্দে গিয়ে বসলাম। বসে-টসে কি যে দিলাম তা আমিই জানি। তারপরে……যখন ফল বেরল……বাংলায় এক, ইংরেজিতে এক আর অঙ্কে রসগোল্লা — শূণ্য।

এই সব দেখে-শুনে তো বোঝা গেল আমার বিদ্যে ওই পর্যন্তই। তা এই যখন অবস্থা ঠিক সেই সময় কার মাথায় এল — আমাকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক মামাবাড়িতে। সেখানে থেকে গ্রামের স্কুলে পড়ব।

তা গেলাম সেনহাটি গ্রামে, মামাবাড়িতে। সঙ্গে করে মা-ই নিয়ে গেলেন। নিয়ে গিয়ে দাদামশাইকে, হ্যাঁ দাদামশাই তখনও বেঁচে ছিলেন — তা দাদামশাইকে বললেন, “বাবা! এই একটা পাঁঠা জন্মেছে আমার পেটে — বিদ্যে-বুদ্ধি কিছুই নেই। এই পেয়েছে পরীক্ষায়…(আমার দুর্দান্ত সব নম্বর আগাগোড়া বললেন।) তুমি এটাকে একটু ভর্তি-টর্তি করে দেবার ব্যবস্থা করো।”

দাদামশাই পাড়ার একটি ছেলেকে বলে দিলেন, “এই এরে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিস তো।”

ভর্তি হয়ে গেলাম, পড়াশুনো করতে লাগলাম। অবশেষে পরীক্ষায় দেখা গেল আমি সব বিষয়ে পুরো নম্বর। বাংলায় একশতে একশ, অঙ্কে একশতে একশ, ইংরেজিতে একশয় একশ, ইতিহাসে একশয় একশ — সব বিষয়ে একশতে একশ। হাতের লেখায় পঁচিশে পঁচিশ, এবং……আমি ফা-র্স্ট!! ‘ফার্স্ট’! সে আবার কি?

যাই হোক, সে সময় থেকে আমার পড়াশুনোয় খুব মন লেগে গেল। আমি তখন যেখানে যা পেয়েছি প্রাণপণে পড়েছি।

স্কুলের বই-টই দু-তিন মাসের মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেলতাম। তখন আমি বাইরের বই — গল্পের বই পড়তাম। মামাবাড়িতে ছিল একখানা ‘রামায়ণ’ আর একখানা ‘মহাভারত’। রামায়ণখানা ওই বাল্যকাল থেকেই আমি অন্তত দু-শ বার পড়ে শেষ করেছি। মহাভারতখানা সেই বাল্যেই স্কুলের ছাত্র থাকা অবস্থায় অন্তত পঁচিশ-তিরিশ বার পড়েছি। পড়ার ওপরে আমার সেই একটা প্রচণ্ড লোভ ছিল। এবং হঠাৎ দেখা গেল যে লোকটা, থুড়ি যে ছেলেটা প্রথমে সব জায়গায় গিয়ে শূণ্য পেয়ে এসেছে, সে ছেলেটা এখন সমস্ত পরীক্ষাতে পুরো পুরো নম্বর পাচ্ছে — শুধু তাই নয় সে যে বই একবার ধরেছে, সেই বইয়েরই আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত তার ঝরঝরে মুখস্ত। ক্লাসের ছেলেদের ডেকে ডেকে সে শোনাতো এবং ক্লাসের ছেলেরাও খুব মুগ্ধ হয়ে তার কাছ থেকে শুনতো, মাস্টারমশাইরাও ছেলেটাকে ভালই বাসতেন, সবাই যত্ন করে পড়াতেন। তা এরকমভাবেই স্কুলের জীবন কেটে গেছে।

স্কুলের অবশ্য অনেক কীর্তি আছে, পাড়ারও কীর্তি আছে। সব বলা যাবে না এখন।

কি বললি, শুনতেই হবে। আমিও বলছি, বলব আমি, এক কাপ চা করে দিবি — তাও না। কি বললি? দার্জিলিং টী — ওরেব্বাবা — তবে তো না বলে উপায় নেই।

না শুনে ছাড়লিই না। কই দেখি চায়ের কাপটা দে। আহ্, কি গন্ধ! শুনেই ছাড়লি তো। এমন নাছোড়বান্দা দুটো দেখিনি। শুনেই বা তোর কি মোক্ষলাভ হবে। তবু শুনতে চাস, শোন তবে।

আস্তে আস্তে যত বয়স বেড়েছে ততই কাজের ভার এসে পড়েছে — এই বাজারটা করে আনা — এই গরুটাকে একটু চরিয়ে নিয়ে আসা — এই ওবাড়ি থেকে একটু এই জিনিসটা আনা, সেই বাড়ি থেকে সেই জিনিসটা আনা — খুব ইয়ে হতো, মানে আমার খুব অসুবিধা হতো……আমি পড়ছি তখন বলে — এই জিনিসটা করে দে — ওই জিনিসটা করে দে। এইরকম লাগাতার ফরমাস করলে — পড়ার সময় ফরমাস করলে আমার মেজাজ যেত বিগড়ে।

যাই হোক, এই রকম বয়সে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো। বন্ধুদের নিয়ে একটা লাইব্রেরী করলাম আমরা। নাম দিলাম আ-ন-ন্দ পা-ঠা-গা-র। সেটা আমার মামাদের চণ্ডীমণ্ডপেই প্রথম বসল। স্কুলে যেসব বই প্রাইজ-টাইজ পেতাম আর বন্ধুরাও যেসব প্রাইজ পেত সেইসব বই, তারপর এবাড়ি ওবাড়ি চেয়ে-চিন্তে যোগাড় করে আমরা আনন্দ লাইব্রেরী তৈরি করলাম। সেই আনন্দ লাইব্রেরী সেখানে কিছুদিন চলল।

তারপর আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’। তা সেই ক্লাবে ফুটবল খেলা হতো। গোল্লাছুট খেলা হতো। দড়িবাঁধা খেলা হতো। তখন তো হাডুডুকে আমরা হাডুডু বলতাম না, বলতাম যেন কি একটা — বোধ হয় গোল্লাছুট।

ছেলেবেলার কিছু ঘটনা এখনও আমাকে পীড়া দেয় — তখন দাদামশাই অসুস্থ, দিদিমা বললেন — “নন্দ যা তো মালার বাড়ি থেকে দু-টো ডাব এনে দে, খেলে লোকটা একটু শান্তি পাবে” — আমি বললাম, “আমি এখন পড়ছি — এখন পারব না।” আমি তখন রামায়ণের অনুচ্ছেদ বারবার পড়ছি “হিতোপদেশ কি বুঝিবি শোন রে বেটা গরু, তুই বাঁচিলে আমার বাপের কীর্তিকল্পতরু, নইলে তোরে বেঁচে থাকতে সাধ করে কি বলি, লোকে বলবে এই বেটাকে বেঁধেছিল বালি।” পড়া ছেড়ে আমি উঠলাম না। আধ ঘন্টা বাদে মালা দু-টো ডাব নিয়ে হাজির।

প্রসঙ্গত এমনি আর একটা গুরুতর ত্রুটির কথা বলে রাখি; বহুদিন পরে মায়ের মৃত্যুর আগে আমি নিয়মিত একদিন করে বাড়ি যেতাম মাকে প্রণামী দিতে। তেমনি একবার বাড়ি গিয়ে দুপুরে খাবার পর শুয়ে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি — হঠাৎ মা জিজ্ঞাসা করলেন, “নন্দ, বৈদেহী বলতে সীতার কথা বলেছেন তো?” প্রশ্ন শুনে আমি ঘাবড়ে গেলাম, আমার মা বাংলায় খুবই জ্ঞানী ছিলেন, তাঁর এই সংশয়ের কারণ কী আমি চিন্তা করলাম আবিল তন্দ্রায় — বিদেহ শব্দের উত্তর ষ্ণিক প্রত্যয় করে পাওয়া যায় বৈদেহী — কিছুতেই মনে করতে পারলাম না — যে স্ত্রীয়াম ঈপ প্রত্যয়ে সীতাই বৈদেহী — সেদিন থেকে এখনও রোজ মায়ের কাছে ভুল বলার অপরাধের ভারে আমি ভুগছি। রোজ বহুবার করে ভুল স্বীকার করে যাচ্ছি, যতদিন বেঁচে থাকব করে যাব।

ভুল তো অনেক করেছি; কিন্তু ন্যায় কাজও কিছু যে করিনি তাও নয়। যেমন একবার হেডমাস্টার গিরিজা প্রসন্ন দাশগুপ্ত মশাইয়ের প্রচণ্ড জ্বর হলো, আমি টিফিনে দেখা করতে গিয়ে দেখি তিনি জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে কেবল মাথা নাড়াচ্ছেন। গায়ে দেখি প্রচণ্ড জ্বর, হাঁসফাস করছেন; আমি শশীদাকে (দপ্তরী) বললাম টিউবওয়েল থেকে জল আনতে। তিনি-চার বালতি জল মাথায় ধারানি করতে দেখলাম কাঁপুনি একটু কমেছে। কিন্তু মাথায় তখনও গরম আগুন। শশীদাকে বললাম, গরম দুধ হোক বা বার্লি হোক যোগাড় করতে। শশীদা গরম বার্লি (তখন ছিল রবিন্সন বার্লি) আনতে ওই গরম বার্লি আর দুধ খাওয়াতে কাঁপুনি থামল — তারপর ঘণ্টাখানেক মাথা টিপে দিতে একটু হুঁস হলো। বললেন, “তুই ক্লাসে যা। যাবার সময় একবার দেখে যাস।” ছুটির পর গেলে বললেন, “আমি ডাক্তারের কাছে শশীকে পাঠিয়েছি — কিন্তু খবর পেলাম, বীরেনবাবু এমনি জ্বরে পড়েছেন। একা সেনেদের একখানা ঘরে পড়ে আছেন। ওকে একটু দেখে যাস, তোদের বাড়ির কাছেই তো।”

গিয়ে দেখি বীরেনবাবুরও একই অবস্থা। মাথায় কয়েক বালতি জল ঢেলে গরম বার্লি খাইয়ে তাঁকেও তাউত করলাম। খুকু, বুবুদের বাড়ি থেকে তাঁকে দেখাশোনার ব্যবস্থা করে ডাক্তারকে খবর পাঠালাম।

বাংলার শিক্ষক শ্যামাপদ সেন, তাঁর দুই মেয়ে অঞ্জলি আর বীরু; তাঁর দাদা কালীপদ সেনের এক মেয়ে — তিনজন একই সঙ্গে কলেরায় পড়ল। ততদিনে সেবক হিসাবে আমার নাম একটু হয়েছে সম্ভবত মাস্টারমশাইদের প্রচারের গুণে। সুতরাং দে ওকে খবর — পেলাম রোগী তিনটি একই বিছানায় পড়ে, পায়খানা করে তার মধ্যেই পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চেষ্টা করলাম তাদের তাউত করতে। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা, কোনো ফল হলো না। সন্ধ্যা নাগাদ তিনটিই গত হলো। হিন্দু পাড়ার দেবেন ভট্টাচার্যের বৌয়ের কলেরা হলো। গিয়ে দেখি বাড়ির বাইরে গোয়াল ঘরে তাকে মেঝের ওপর ফেলে রাখা হয়েছে — দেখেই মনে হলো — কাল ঘনিয়েছে — সন্ধ্যায় মারা গেল। এমনি অনেক তখন আমার নাম, কারো কোনো অসুখ হলেই — খবর দে ঐ ব্যাটাকে; তারাপদ, জ্যোতিষ ওরা এড়িয়ে থাকত, একমাত্র নিরঞ্জন ছিল সবসময় সঙ্গী। ডাকাবুকো, কোনো কিছুতে পরোয়া ছিল না।

সবচেয়ে বড় বেহাল হলো ছোটমামীর অসুখ হলে, মামা গেলেন মামীকে নিয়ে হাওয়া বদলাতে পুরীতে। সেখানেই তাকে বিসর্জন দিয়ে ফিরে তিন মাসের মাথায় আবার নতুন মামী নিয়ে এলেন। মামার ছেলে সিদ্ধেশ্বর আক্রান্ত হলো বসন্তে, তিন-চার দিন ছট্ফট্ করে বেচারি নেতিয়ে পড়ল, মামা বললেন — “যা আজ একটু বাজার করে নিয়ে আয়, সিধু আজ একটু ঘুমোচ্ছে।” আমি বাজারে গিয়ে মাছ-তরকারি কিনে ফিরছি — রাস্তায় শ্যামদার সঙ্গে দেখা, খবর দিলো — “সিধে এক্সপায়ার্ড” — দৌড়ে এলাম বাড়ি।

আচ্ছন্ন সিধুকে বিছানাপত্র সমেত কোলে করে এক মাইল হেঁটে গেলাম তালতলা শ্মশানঘাটে। সঙ্গে দু-চারটি বন্ধু। পুড়িয়ে ফিরলাম বটে, সব সময় কানে বাজতে লাগল তার কচি গলার আধো আধো ডাক — “ছোড়দা গো বড় কষ্ট”। মাসখানেক শ্মশানঘাটে গভীর রাতে একা একা যেতাম। টের পেয়ে নিরঞ্জন জোর করে সঙ্গ নিল।

সময় সব ভুলিয়ে দেয় — “Time is the best healer” — পুরাতন প্রবচন কিন্তু সত্যিই তাই। আবার পড়াশুনায় ডুবে গেলাম।

(বানান, যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত)

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

4.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সুমন্ত রায়
সুমন্ত রায়
3 months ago

পরের পর্ব কবে আসবে?

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব ছয়]

রবীন্দ্রভাবনায় যে নৃত্যধারা গড়ে উঠল তা দেশিবিদেশি নৃত্যের সমন্বয়ে এক মিশ্র নৃত্যধারা, তৎকালীন শিক্ষিত শহুরে বাঙালির সংস্কৃতিতে যা নতুন মাত্রা যোগ করল। নাচের প্রতি একরকম আগ্রহ তৈরি করল, কিছু প্রাচীন সংস্কার ভাঙল, মেয়েরা খানিক শরীরের ভাষা প্রকাশে সক্ষম হল। এ কম বড় পাওনা নয়। আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় হল, শিল্পক্ষেত্রে ভাবের সাথে ভাবনার মিল ঘটিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টির প্রচেষ্টা। গতে বাঁধা প্র্যাক্টিস নয়। নিজের গড়ে নেওয়া নাচ নিজের বোধ অনুযায়ী।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব পাঁচ]

বাংলার মাটি থেকে একদা এই সুদূর দ্বীপপুঞ্জে ভেসে যেত আসত সপ্তডিঙা মধুকর। আর রবীন্দ্রনাথের পিতামহ, যাঁর কথা তিনি কোথাও প্রায় উল্লেখই করেন না, সেই দ্বারকানাথ-ও বাংলার তৎকালীন ব্যবসায়ীকুলের মধ্যে প্রধান ছিলেন। শুধু তাই-ই নয়, একদা তাঁর প্রিয় জ্যোতিদাদাও স্টিমারের ব্যবসা করতে গিয়ে ডুবিয়েছেন ঠাকুর পরিবারের সম্পদ। নিজে রবীন্দ্রনাথ বাণিজ্য সেভাবে না করলেও, জমির সম্পর্কে যুক্ত থাকলেও একদা বাংলার সাম্রাজ্য বিস্তার, বাণিজ্য-বিস্তার কী তাঁরও মাথার মধ্যে ছাপ ফেলে রেখেছিল? তাই ইউরোপ থেকে আনা বাল্মিকী প্রতিভার ধারাকে প্রতিস্থাপন করলেন জাভা বালির কৌমনৃত্য দিয়ে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »