Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

[প্রথম পর্বের পর…]

কথায় আছে না— “সুকার্যে হইলে ইচ্ছা, সাধিও সত্বর, কুকার্যে করিও কাল বিলম্ব বিস্তর।” রাবণ মৃত্যুশয্যায়, তখন রাম তাঁর কাছে গেলেন— কিছু উপদেশের জন্যে। উপদেশ দিতে গিয়ে রাবণ বললেন, “আমি ভেবেছিলাম স্বর্গের সিঁড়ি গড়ে দেবো যাতে সকলেই সশরীরে স্বর্গে যেতে পারে। যেদিন ইচ্ছা যখন খুশি করলেই হবে; করছি করব করে গড়িমসি করে সে কাজ আর আমার করাই হলো না— কিন্তু যখনি সূর্পনখার নালিশে জ্বলে উঠে সীতাহরণ করলাম— যার ফলে এক লক্ষ পুত্র যার, সোয়া লক্ষ নাতি একজনও না রহিল বংশে দিতে বাতি।” এই ফাঁকে একটা প্রক্ষেপ শুনাই— আমার মেজভাই আমাকে একদিন বলল— “দাদা, আমার একটা গল্প আছে, আমাকে একটু এটা লিখে দেবে— আমার কাছে আমার এক যজমান চেয়েছে— সে কোনো কাগজে দেবে।” আমারও হলো রাবণের দশা— হলে তো হয়েই গেল— কিন্তু সেই হওয়াটা গত পাঁচ বছরেও হয়নি। তার গল্পটাই বলে নি— আমাদের বাড়ি থেকে স্টেশনে যাবার পথে কয়েকটা গেরো আছে— প্রথমে শিববাড়ি, একটা ঢিপি তখন অবশিষ্ট ছিল— তারপরে পুলেরহাট— ওইখান থেকেই টানা যশোর রোড— খানিক দূর গেলে বাজনদার পাড়া (মা বেরিয়ে গেলেন— তাকে বিদায় দিতে গিয়ে লেখার প্রবাহটা কেতরে গেল)।
এই বাজনদার পাড়ার বেশ নাম ছিল— কোনো লোক আসতে দেখলেই তারা জোর বাজনা বাজাতো— কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেই তারা মওকা পেয়ে আরও জোরে বাজাতে শুরু করতো যাতে শিকারের আর্তনাদ কেউ শুনতে না পায়— তারপর বিবস্ত্র দেহটাকে মরগায় ঠেসে দিত। মরগাকে এখন বলা হয় কালভার্ট। হঠাৎই ওরা বাজনা বন্ধ করে দিলো— “ওরে থাম, থাম। পরণাম রাজাবাবু পরণাম।”
হঠাৎই আমার পাশে একমাথা সাদা চুলের এক বুড়ো একটা এক্কাগাড়ি চালিয়ে এসে আমার আর ওদের মাঝখানে এসে গেল— তারপর আমার সঙ্গে সঙ্গেই চলতে লাগল।
সামনেই দশ-মহাবিদ্যার মোড়— যশোর রোড সোজা চলে গেছে, বাঁ-দিকে মোড় নিয়ে স্টেশনে যাবার রাস্তা গেছে। এক্কাটা আমার সাথে সাথেই চলছে। আমি জোরে হাঁটলে সেও জোরে চলছে— আস্তে চললে সেও আস্তে হয়ে যাচ্ছে। বাঁ-দিকে মোড় ঘুরেই একটা রাস্তা বেরিয়ে গিয়ে রাজবাড়ির পাশ দিয়ে গিয়ে আবার যশোর রোডে মিশেছে। এখান থেকে স্টেশনের রাস্তা সোজা বাঁ-দিকে গেছে। ওখানে এসেই এক্কাগাড়িটা আমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বৃদ্ধ বললেন— “বাপু হে তোমার পেছনে ফেউ লেগেছে— তুমি এক কাজ করো— আমার ঘোড়াটার পেছনে গিয়ে তোমার জামা-কাপড় সব খুলে ফেলে ঝেড়ে ঝুড়ে আবার পরে নাও— চোখের ঘোর কেটে যাবে।” তাঁর কথামতো জামা-কাপড় ঝেড়ে পরে নিয়ে সামনে তাকাতেই দেখি স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে— গেটের আলো। গা ঝাড়া দিয়ে সোজা গেট পেরিয়ে বাঁ-দিকের চায়ের দোকানে বসে পরপর দু-কাপ চা গিলে ধড়ে প্রাণ এল। গাড়ির বাঁশি শুনতে প্ল্যাটফর্মে উঠে দাঁড়ালাম, গাড়ি এলে উঠব।
জীবানন্দ এগল্প অনেকের কাছে করেছেন, তাদের কেউ কেউ বলেছিলেন— “গল্পটি লিখে দিন— কাগজে ছাপিয়ে দেবো।” কেউ দিয়েছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি গল্পটাকে লিখে ফেলে এত দিনে দায়মুক্ত হলাম।

প্রতিবেশিনী রমা বাগচী— খুবই হাঁকডাক তার— সেদিন দেখি তাকে একজন হাত ধরে এনে বাড়ি নিয়ে এলেন— লাইন পার হতে গিয়ে গাড়ি আসছে দেখে লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে লেগেছে— লেংচে হাঁটছেন, মরবার ভয়ে লাফ দিতে গিয়ে পায়ে আঘাত পেয়েছেন— মরবার ভয়ে লাফ দিয়েছিলেন। মরণ কী এতো সোজা জিনিস! আমি মরণকে প্রত্যক্ষ করেছি বেশ কয়েকবার— একবার নাতিকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে তিনটি সিঁড়ি টপকে পড়লাম হুমড়ি খেয়ে— নাতি আমার বগলদাবায়— তার কিছুই লাগেনি— আমার গোড়ালিতে একটু চোট লাগল— ও জায়গাটা আগেই চোট ছিল। সেও এক ইতিহাস— সকালে গাড়ি-ঘোড়ার ভিড়— অফিসে ঠিক সময়ে পৌঁছতে হবে— ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির কাছে চলন্ত ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে লাফ দিলাম, পায়ে বেশ লাগল— ঐ পা নিয়েই নেংচাতে নেংচাতে অফিসে গেলাম— অফিসে ডাক্তার এলেন এগারটায়। তিনি গুলার্ড লোশন তৈরি করে দিলেন— গোড়ালিতে পটি বেঁধে দিলেন— ব্যবস্থা দিলেন পটি শুকিয়ে গেলেই যেন ভিজিয়ে দিই। সারাদিন পটি ভিজিয়ে বিকেলের দিকে ব্যথা বেশ কমে গেল— কিন্তু আজও মাঝে মাঝে টের পাই। পরেও মাঝে মাঝে ওই ব্যথা চাগাড় দেয়।
এরপরে মরণকে মুখোমুখি করেছি আরও অন্তত তিন তিন বার। তখন আমার নাতি বেশ বড় হচ্ছে। নাতির কথাই হবে সাতকাহন। ও তখন একদম বাচ্চা— একদিন রাত বারোটার সময় ওর বাপ আমাকে ঘুম থেকে তুলে বলল— “তুমি একবার ওবাড়ি [নাতির মামাবাড়ি, তখন সে সেখানে ছিল] যাও— ওরা কান্নাকাটি করছে”— আমি ছুটতে ছুটতে গেলাম। গিয়ে দেখি নাতি ঘুমাচ্ছে— নাড়ি দেখলাম বেশ স্বাভাবিক— নাড়া দিলাম— হাসল, বুক ওঠানামা করছে। আমি ওদের জানালাম ভয়ের কিছু নেই— ওকে ঘুমাতে দিন। লম্বা ঘুম দিয়ে পরদিন দুপুরে তার ঘুম ভাঙল। আর একবার এক রাত্রে উনি পরিত্রাহি কান্না ছুড়ে দিলেন— মা-বাবা কোলে করে হয়রান হয়ে আমাকে ডাকল। আমি বললাম— “বোধহয় পেট ব্যথা করছে— গ্রাইপ ওয়াটার খাইয়ে দাও”— ওরা জানাল খাইয়েছে তবু থামছে না। আমি কোলে নিয়ে বার-দুই পায়চারি করে আসি। সোফা-কাম-বেডে শুয়ে আমার কোলের কাছে খাঁজে ওকে চেপে দিলাম— উডওয়ার্ডস গ্রাইপ ওয়াটারের জন্যেই হোক বা আমার গায়ের গরমেই হোক ও ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙল পরদিন দুপুরে। ওর যত খুনসুটি আমার সঙ্গে। এর পরে প্রথম যেবার আমরা দার্জিলিং গেলাম। প্রকাণ্ড বোঝা পিঠে নিয়ে ও তরতর করে চড়াই ওঠা-নামা করে। একটা গাড়ি নিয়ে আমরা গেলাম সূর্য ওঠা দেখতে টাইগার হিল— সেখানে গিয়ে দেখি যেখানে তিনি উঠবেন সেখানে এক প্রকাণ্ড মেঘ— যাঃ কপালে নেই। শুনলাম অনেকেই দু-তিন দিনেও দেখতে পায় না। ওদিকে নাতি কান্না জুড়েছে কিছুতে থামে না— আমি ওকে কোলে নিয়ে ভি-আই-পি কামরার মুখে এসে ঘোরাঘুরি করছি— দারোয়ানের মর্জি হলো ঘর খুলে দিয়ে বলল “ওকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ান— যদি কপালে থাকে— দেখতে পাবেন।” ঘরের ভেতরে ঠাণ্ডা অনেক কম। নাতির কান্না থামল বটে— আশঙ্কা কাটল না। হঠাৎ পেছনে ফিরে দেখি কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরে শিখরে লাফিয়ে ছুটছে সূর্যের আলো— আমরা হাঁ করে ওই নাচন দেখছি— হঠাৎ হইচই শুনে পেছনে ফিরে দেখি মেঘের চিহ্নমাত্র নেই— এক লাফে দিনমণি উঠে পড়েছেন। কপালের জোর ছিল— না হলে সেদিনের প্রথম প্রয়াসেই দুর্লভ দর্শন ঘটতো না। সেদিন ওখান থেকে নেমে কাঞ্চীদের কাছ থেকে পরপর দুই ভাঁড় চা খেয়ে খানিকটা গরম হলাম।
আসল চমক ছিল পরদিন। টাইগার হিল থেকে ফিরে সারাদিন হোমেই কাটালাম। ড্রাইভারকে বলা হলো পরদিন ভোরে আসতে যাতে সিকিম পর্যন্ত ঘুরে আসা যায়। ছেলের ছুটি শেষ হয়ে যাবে। তাকে সেদিন বাসে করেই ফিরতে হবে অফিস করতে।
প্রথম চমকঃ- ভোরে অন্ধকার কাটবার আগেই চালক হর্ণ বাজাল— আমরাও সাজ-পোষাক পরে তৈরি ছিলাম, নেমে এলাম— চালক তাড়া দিলো— “চট করে উঠে পড়ুন।” যথারীতি উঠে পড়লাম। চালক গাড়ি ঘোরাবার জন্য চেষ্টা করতেই বাঁ-দিকের সামনের চাকাটা পথ থেকে বেরিয়ে গেল। নাতিকে বগলে নিয়ে মনে মনে দুর্গানাম জপছি— চালক ব্যাকগিয়ার দিয়ে সামনের ডানদিকের চাকা আর পেছনের চাকায় ভর করে গাড়ি পেছিয়ে নিল— দেওয়ালের পাথরে ধাক্কা খেয়ে গাড়ি গড়গড়িয়ে নামতে লাগল— খুবই ধীর গতিতে গড়িয়ে এসে ম্যালের রাস্তায় পড়ল। চৌরাস্তায় যেতে হবে ঘোড়ায় চড়ে ছবি তুলতে, সে কাজের পরেই দৌড় সিকিমের উদ্দেশ্যে। গাড়ি খানিকটা এগোতেই পেছনে হইচই শোনা গেল— ঘাড় ফিরিয়ে দেখা গেল একখানা গাড়ি…
দ্বিতীয় চমকঃ- মরি-বাঁচি করে ছুটে এসে আমাদের গাড়ির গা ঘেঁষে বেগে বেরিয়ে গেল। ধাক্কাটা একটু জোর হলেই ফুট তিরিশেক নীচে গাড়ি সমেত পড়তে হতো।
তৃতীয় চমকঃ- সেদিন দিনটা ছিল গাঢ় কুয়াশায় ঢাকা। লাইন পার হতে গিয়ে তিন নম্বর লাইনে উঠে দেখছি এক দুই নম্বর লাইন খালি। ভাবছি আপ ডাউন দুটিই এক আর দুইয়ে যাবে। হঠাৎ দেখি একটি মহিলা চিৎকার করছেন— “গাড়ি আসছে, চলে আসুন শিগ্গির” বলতে বলতেই তিনি ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে লাইন থেকে বের করে নিলেন একেবারে বুকের মধ্যে— কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই গাড়ি তিন নম্বর লাইন দিয়ে চলে গেল, প্ল্যাটফর্মে উঠে ভাবতে লাগলাম— কী কেলেঙ্কারিটাই না হতে যাচ্ছিল।
চতুর্থ চমকঃ- তখন আমি বাল্যবন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে নিউ ব্যারাকপুর যেতাম মাসে অন্তত একবার করে। এখানে [দমদম ক্যান্টনমেন্টে] যেমন মাইকে বলে দেয় কোন গাড়ি কত নম্বরে আসবে নিউ ব্যারাকপুরে সে ব্যাবস্থা ছিল না— এখনও বোধহয় নেই। যাই হোক, আমি একদিন দুই নম্বরে নেমে অভ্যাস মতো লাফিয়ে উঠলাম— বোধহয় দশ সেকেন্ডের মধ্যে নিঃশব্দে ডাউন ট্রেন এসে হাজির— আমি লাফিয়ে উঠতেই এক মহিলা চেঁচিয়ে উঠলেন— “দাদুর কী সাহস” বলেই তিনি আমার হাত ধরে টেনে তুলে নিলেন একেবারে তার বুকের মধ্যে— “দাদু, এমন সাহস আর করবেন না।” সেই থেকে লাইন পারাপার করা ছেড়ে দিয়েছি— ওভারব্রিজ থাকলে তাই ব্যবহার করি।
তাই ভেবে দেখলাম সময় না হলে কিছুই ঘটে না।
না হলে আমার নাতিকে নিয়ে দু-আড়াই মাইল হেঁটে মতিঝিলে কে কে হিন্দু একাডেমিতে দিয়ে আসতাম— আবার দুপুরে খেয়ে গিয়ে নিয়ে আসতাম। নাতি বলতো, “পা ব্যথা করে— ঠাকুর্দা, চল রিক্সা করে যাই”— আমি বলতাম— “ভাই— ব্যথাকে প্রশ্রয় দিলে সে চেপে বসবে— ওকে অস্বীকার করে হারিয়ে দিতে হবে।” দু-তিন দিনে তার রপ্ত হয়ে গেল।
একবার বড় মজা হলো— এখন বলছি মজা, সেদিন কিন্তু মজা ছিল না। তখন নাতি হিন্দু স্কুলে পড়ে। লোকালে [ডাউন দমদম ক্যান্টনমেন্ট লোকাল] যাতায়াত করি। একদিন গাড়ির মধ্যে ঝিমুনি এসেছিল। নেমে ঘুম চোখে গেটের দিকে না গিয়ে আমি উল্টোদিকে যেতে শুরু করি— শেষে প্ল্যাটফর্মের মাথায় পৌঁছে চটকা ভাঙে। ফিরে এসে নাতির হদিস পাই না। বাধ্য হয়ে বাড়িতে ফোন করি— মায়ের মুখে শুনলাম এক পড়শীর ছেলে নাতিকে একলা দেখে ওকে শুধু যে স্কুলে পৌঁছেই দিয়েছে তাই নয় ফোন করে মাকে জানিয়েও দিয়েছে। আমি ছুটে বাড়ি এসে ওর টিফিন নিয়ে আবার ছুটলাম। স্কুলে গিয়ে দেখি শ্রীমান তেতলা থেকে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে তাড়াতাড়ি নেমে এল।
এবার একটা মজার কথা বলা যাক। নাতি তখন বড় হয়েছে— আমি সঙ্গী হয়ে তার অসুবিধা ঘটাচ্ছি— সে হয়তো দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে উঠতে পারে— আমি সঙ্গে থাকায় তাকে একটা গাড়ি ছেড়ে দিতে হচ্ছে। নাতিই তখন আমাকে নিয়ে যায়— নিয়ে আসে। মাধ্যমিক পরীক্ষা ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এই ভাবে চলল। পরে ভেবে দেখলাম নাতি ঠিকই বলে। একদিন গাড়ির জন্যে প্ল্যাটফর্মে বসে আছি— হঠাৎ একজন এসে প্রশ্ন করলেন— “দিনে কতক্ষণ আসন করেন? অন্তত তিন ঘন্টা নিশ্চয়ই।” প্রাণায়াম আহ্নিক করতে আমাকে ওই রকম সময়ই দিতে হয়। সেদিন দুধের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি— একজন যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করলেন— “দাদু, আপনি এখনও গেলেন না?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম “কোথায়?” তিনি বললেন— “ওপরে।” জবাব দিলাম— “সময় হলে ঘাড় ধরে তুলে নিয়ে যাবে— যেতে না চাইলেও ছাড়বে না।”
ছয়/দুই/পাঁচ তারিখে আমি প্ল্যাটফর্মে না গিয়ে সোজা ভেতর দিয়ে দুধের ডিপোতে গিয়ে লাইন দিয়েছি। দেখি দশরথ মণ্ডল আর গোপাল দে এসে হাজির। দুধের লাইনে আমি আছি কিনা?
একটা প্রাসঙ্গিক কথা বলা যাক। প্রথম চমকের পর আমরা ফিরে এলাম বাগডোগরা। এসে হা হতোস্মি— প্লেন খারাপ হয়েছে সকালে। শিলং থেকে পার্টস এবং কর্মী এসে ঠিক করে দিলে তারপর ফেরার প্রশ্ন। কর্তারা ওদের গাড়ি করে আমাদের পৌঁছে দিলেন পাঁচ তারা হোটেল সিনক্লিয়ার্সে। জন্ম সার্থক হলো, ঠাণ্ডা এবং গরম জলের শাওয়ার— বাথরুমের সঙ্গেই পায়খানা আর পোষাকের ঘর। রাতে কম্বলের নীচে শুয়ে গজালি। ছেলে বলল— সে রাতেই বাসে করে চলে আসবে যাতে মাঝপথে নেমে অফিস ধরতে পারে। আলোচনায় আমি প্রথম চমকের কথা বলতেই বৌমা একটি আপ্তবাক্য ছাড়লেন— “বাবা, অত চিন্তার কী ছিল— আমরা সবাই তো একসঙ্গে ছিলাম।” আমি তর্কের মধ্যে গেলাম না।
একসঙ্গে ছিলাম বলে যে সবারই একই গতি হবে এমন না ভাবলেও চলতো— বিশেষ করে আমার নাতিটি। ওর যে একটা দিকপাল দিগ্বিজয়ী ছেলে হবার কথা। আমি বিশ্বাস করি—
“মন্ত্রে তীর্থে দ্বিজে দেবে দৈবজ্ঞে ভেষজে গুরৌ
যাদৃশীর্ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী।”
যাকগে, একটু ছেলেবেলার কথায় যাওয়া যাক। তখন আমি খুব খোস-পাঁচড়ায় ভুগতাম। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে একটি বেদের ছেলে আমাকে ছুঁয়ে দেবে বলে ভয় দেখায়— আমি ছোঁয়াচ এড়াতে গিয়ে পাশের জোলের মধ্যে পড়ে গিয়ে পাঁচড়ায় ঘষা লেগে রক্তপাত হয়— অগতির গতি বন্ধু নিরঞ্জন আমার হাত ধরে জোল থেকে টেনে তোলে। ফেরবার পথে আমাকে বোঝায় “এমন দুর্বল শরীরে তো কিছুই করতে পারবি না।” আমি বললাম “কী করে শরীর ভাল করা যায়?” সে বলল “কুস্তি করলে খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি হয়।” ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই কাজে নেমে গেলাম। তারাপদদের বাগানের একপাশে জায়গা কুপিয়ে মাটি চৌরস করে নিম পাতা আর খোল ঢেলে তার ওপরে গিয়ে দাঁড়ালাম— নিরঞ্জনের সঙ্গে— সে বলল— “আগে হ্যান্ডশেক করতে হয়”— বলেই আচমকা তার গোড়ালি আমার হাঁটুর নীচের গুলে এমন গোত্তা দিলো যে আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম— অবশ্য আমাকে টেনে খাড়া করল সে-ই। বলল— “ওঠ, ব্যথাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। প্রশ্রয় পেলে সারতে লাগবে আট-দশ দিন— কেয়ার না করলে তিন-চার দিনেই ঠিক হয়ে যাবে।” আমার থেকে বয়সে খুব বড় না হলেও অভিজ্ঞতা তার অনেক বেশি। নাতিকে আমি পরে তাই শেখাবার চেষ্টা করেছি। যাক, পুরানো কথা আর একটু বলে নি। পাড়ার মাটির রাস্তা, দুপাশেই গভীর আড়া (জোল)— তার পাড়ে বসে কোঁথ দিয়ে দিয়ে পায়খানা, উল্টোদিকের পুকুরে শৌচকর্ম সেরে চলে যেতাম আখড়ায়— বন্ধুরা কেউই নিয়মিত যেত না। ঘন্টাখানেক কোস্তাকুস্তি করে আধ ঘন্টা জিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম হাটখোলায়। ভৈরব নদীতে চান করে উঠে এলেই ঘোষরা এক তাল মাখন আর একটু মিছরি দিয়ে দিত। তাই মুখে ফেলে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম। এসেই রাতে ভিজিয়ে রাখা ছোলা (গুণে গুণে চল্লিশটা দিয়ে আরম্ভ করেছিলাম) ক্রমে পরিমান বেড়ে একমুঠ হয়ে গেল।
তাই খেয়েও খিদে মিটত না। এদিকে নিম পাতা আর খোল ঢালার গুণ কোথায় যাবে? ঘা-পাঁচড়া আর দুর্বলতা কোথায় উবে গেল। নিয়মিত কুস্তি করার ফলে যেমন স্বাস্থ্য ভাল হলো তেমনি বেড়ে গেল মনের জোর। আমার চেয়ে যারা বয়সে বড় তারাও আমার কাছে হেরে যেত। তারপদদের বাড়িতে আখড়া হওয়া সত্বেও ওর কোনোদিন গা ব্যথা— কোনোদিন ঘুম থেকে উঠতে আলস্য— সেই থেকে বুঝলাম— আলস্যকে লাই দিলে সে চেপে বসে। বুঝলাম আরাম সত্যিই হারাম। আগেই বলেছি ক-টা ছোলা খেয়ে খিদে মিটত না।
কোমরে একখানা চাকু গুঁজে গিয়ে উঠতাম নারকেল গাছে। গোটাপাঁচেক ডাবের জলে যেমন শরীর ঠাণ্ডা হতো পেটটাও ভরতো।
এইখানে আর একটা ভুলের কথা বলতে হবে। পেছনের বাড়িতে আদিত্য ভট্টাচার্য বলে এক অধ্যাপকের বাস ছিল। তাঁর মা ছিলেন এক খাণ্ডারনি। তাঁর মেয়ে একদিন মামাদের বাড়ির উপর দিয়ে ডাকবাক্সে চিঠি ফেলতে যাচ্ছিল। তাকে আমি গেট আটকে বললাম— “এবাড়ির ওপর দিয়ে যাওয়া যাবে না— বড়রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে।” কেন, কেন? তার খাণ্ডারনি ঠাকুমা সুধামামীকে যে খোয়ার করেছে তার দায় তাকেই পোয়াতে হবে।
আগেই বলেছি কুস্তি করার ফলে আমার শরীরের ঘা-পাঁচড়া কোথায় মিলিয়ে গেল— গায়ে রীতিমতো জোর বেড়ে গেল— আর বাড়ল ক্ষুধা (খিদে)— একমুঠ ছোলা আর এক ডেলা মাখনে তা মিটতো না— কী খাব কী খাব ভাবতে ভাবতে একখানা চাকু পকেটে নিয়ে রাস্তায় যেতে যেতে পরমেশ্বর মুখুজ্যের নারকেল গাছে উঠে পড়লাম। ছুরি দিয়ে নারকেলের মুখটা ছাড়িয়ে মানানসই ফুটো করে— জল খেয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললাম— আরও গোটা কতক না খেলে পেট ভরবে না— কিন্তু কপালের ফের কোথায় যাবে— পরমেশ্বর মুখুজ্যে এসে হাজির— “এই গাছে কেডা রে?” জবাব দিলাম— “আমি খড়কির ছেলে নন্দ।”— “ও, তুই বাণীদার দুইত্তুর। তা খাচ্ছ খাও, কিন্তু দাদা আমার শিবকে চান করাবার জন্যে দু-টো ডাব পাড়ে দিও।” আমি কলাম— “ডাব যদি নীচে ফেলি জল সব মাটিতেই যাবে। একখানা দা আর দড়ি যদি দিতি পারেন তালি ডাব পাড়ে দিতি পারি।”
সঙ্গে সঙ্গে তিনি কলেন— “দাঁড়াও দাদা, আনে দিচ্ছি।” গোয়ালের গোরুর দড়ি আর দা নিয়ে খানিক বাদে হাজির। ততক্ষণে আমার পেট ভরেছে। ওর ডাব পেড়ে দিয়ে এসেই জামা-কাপড় পরে স্কুলে যাব বেরোচ্ছি— পেছন থেকে হাঁক— “ওরে খেয়ে যাবি তো”— তখন সময়ও নেই আর পেটেও জায়গা নেই। দাদামশাই একটা আনি দিয়ে বললেন— “এক পয়সার মুড়ি-বাতাসা খেয়ে নিস।” সেই দিন থেকেই আমার টিফিন খরচ বরাদ্দ হলো এক আনা করে। ক-দিন পর দাদু বললেন— “আমার একটা কাজ করিস তো। বাজারের মুখেই উপেন কুরির দোকান। বছর দুই হলো উপেন আমার কাছে কিছু টাকা ধার চাইল। আমি ওকে বললাম— “আমার তো সংসার খরচের বাইরে বাড়তি টাকা নেই—
“তবে আমার মেয়ের কিছু টাকা আমার কাছে গচ্ছিত আছে। তাই দিয়ে তোমার যদি উপকার হয় নিতে পার, কিন্তু মাসে এক পয়সা করে সুদ দিতে হবে।” দাদু আমাকে বললেন— “ওর কাছে তোর মায়ের কিছু টাকা আছে— তাগাদা দিয়ে যদি কিছু আদায় করতে পারিস।”
গালদা পর্বঃ আমি বাজারের মুখে উপেন কুরির দোকানে গিয়ে বললাম— “দাদু বলেছেন তার কী টাকা পাওনা আছে তা দিয়ে দিতে।” উপেন বলল— “ও, তুমি মাস্টারমশায়ের নাতি— তা এখন তো টাকা দিতে পারছি না— তুমি এই নাও, খাও।” এক ঠোঙা মুড়িতে এক হাতা বুঁদে মিশিয়ে গোটা আষ্টেক আঠা-কদমা মিশিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি বললাম— “আমার তো পয়সা নেই— দাম দেবো কী করে?” উপেন বলল— “পয়সা কে চায়— উলটে তো তোমাকে দেবার কথা— তুমি মাস্টারমশায়ের নাতি— তোমার কাছ থেকে আমি পয়সা নেব ভাবলে কী করে— যাও, দাদুকে বোলো এখন হাতে টাকা নেই— সুযোগ হলেই কিছু দিয়ে হালকা হব।”
সেই আমার শুরু হলো মিষ্টি খাওয়া— কোনোদিন দুটো রসগোল্লা— কোনোদিন এক হাতা ঘি-মাখা কাঁচাগোল্লা আমার বরাদ্দ হয়ে গেল। দাদামশাই যে এক আনা দিতেন তা দিয়ে নিমরের বাজার থেকে এক পয়সার পাটালি কিনে খেতে খেতে স্কুলে যেতাম— আবার টিফিনের সময় শেষ বাজারে আর এক পয়সার পাটালি নিয়ে খেতে খেতে বাড়ি ফিরতাম। দুপুরে দোকান বন্ধ করবার সময় একটু বেশিই পাওয়া যেত।
বাবা কদাচিৎ সেনহাটি এলে ছোটমামী রঙ্গ করে বলতেন— “তোমার তো হাত দিয়ে জল গলে না— কোঁথ পেড়ে পেট খালি করো না— পাছে খাবার খরচ বাড়ে।”
শুনতে শুনতে দাদামশাইয়ের মনে বোধহয় ক্ষোভ হতো। একদিন তিনি বাবাকে বললেন ছাত্র ঠেঙান গলায় জোরে জোরেই সবাইকে শুনিয়ে— “কেষ্ট, তোমাকে তো আমি কিছুই দিইনি খড়কিকে শাখা-শাড়ি ছাড়া— তা তুমি এক কাজ করো— আমার একটা ছোট জোত আছে গালদায়— এখন তো আমার বয়স হয়েছে— আর দৌড়ঝাঁপ করতে পারি না— তোমার বাড়ির কাছে— আমি খড়কির নামে ওটা লিখে দিচ্ছি— তুমিই এখন থেকে আদায়-উশুল কোরো।” বাবা তখন পেটজোড়া পিলে আর বাতে ভোগেন— এমন ভোগেন যে কোলে করে চ্যাংদোলা করে তাঁকে নিয়ে যেতে হয় বক্রেশ্বরে উষ্ণকুণ্ডে চান করাতে। আস্তে আস্তে জলে নামিয়ে দিলে বাবা নিজেই চান করে উঠে আসেন। ধর্মরাজতলায় সেবাইত তাঁকে বলেন— “শিঙি মাছ, মুসুর ডাল খাবেন না, আর এই এক শিশি তেল দিলাম নিয়মিত মালিশ করবেন, পুরো সুস্থ হয়ে যাবেন।”
যাই হোক, বাবা আমাকে গালদা পাঠালেন দাদুর দেওয়া জোতের আদায় উশুল করতে, তখনও এক পয়সার পোস্টকার্ড ঠিকানায় পৌঁছে যেত— বাবা আমার হাতেও একটা হাত-চিঠি দিয়ে দিলেন, বলে দিলেন— “সকাল সকাল যাও রোদ চড়ার আগেই যাতে ফিরতে পার।”
সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।” বাড়ির ভেতরে হাঁক দিয়ে বললেন— “কোথায় গেলে সব— শিগগির এক ঘটি জল নিয়ে এস”— মাঝবয়সী এক প্রৌঢ়া এক ঘটি জল এনে আমার পায়ে ঢেলে পা ধুয়ে দিলেন— আঁচল দিয়ে পা মুছিয়ে দিয়ে বললেন— “দাদুঠাকুর ভাল হয়ে বসুন— জল এনে দিচ্ছি। ওরে বিজয়, গাছ থেকে দু-টো ডাব পেড়ে দে তো বাবা। দাদুঠাকুর এই রোদ্দুরে পুড়ে এসে জল খেতে চেয়েছেন— আমরা তো ওঁকে জল দিতে পারব না— উনি গাছের জলই খাবেন।” পা দু-খানা ধুয়ে দু-টো ডাব খেয়ে আমি বললাম— “টাকা পয়সা কী দেবেন দিন— আমি সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ি।” আঁৎকে উঠে প্রৌঢ় বললেন— “তা কী হয় দাদুঠাকুর— আপনি এই ঠা ঠা রোদ্দুরে বেরুলে নিজে তো কষ্ট পাবেনই— আমার গুষ্টিও। বসুন, রান্নাবান্না করে খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করে বেলাবেলি বেরিয়ে বিকাল বেলায় বাড়ি পৌঁছে যাবেন। তাছাড়া আমাকে তো সবার কাছ থেকে টাকাকড়ি যোগাড় করতে হবে।”
পা ধুয়ে আমি খুব আরাম পেলাম। মনে পড়ল— মা বলতেন “পাদয়োর্ভিদ্যেৎ ক্রোশান্তরম্‌।” অগত্যা— কথাটা তো বেঠিক নয়। আমি তো দিনক্ষণ জানিয়ে ওদের দিইনি। যোগাড়ের সময় চাইই।
বিজয়ের বৌ দু-টো উনুন জ্বালিয়ে একটাতে প্রকাণ্ড এক হাড়ি— আর একটাতে এক কড়াই চাপিয়ে দিলো। প্রৌঢ় বললেন— “দাদুঠাকুর, ওই পুকুর থেকে এক কলসি জল আপনাকে আনতে হবে রান্নার জন্যে। ভাবতে হবে না— বৌমা আপনাকে সব দেখিয়ে দেবেন।”
বুঝে ফেললাম— বাক্য ব্যয় বৃথা— পড়েছি যবনের হাতে। হাড়ি ভরতি জল দিয়ে চাল চাইলাম। বিজয়ের বৌ দেখলাম মিটি মিটি হাসছে, বলল— “হাড়ির অর্ধেকটা জল এই কড়ায় ঢালুন— এইবারে হাড়িতে চাল দিন। ক্ষেতের কোটা তরকারি কলসির জলে ধুয়ে কড়াইতে দিন। এই খুন্তিখানা ধুয়ে কড়াইতে নাড়বেন।”
যাই হোক বিজয়ের বৌয়ের কথামতো রান্না তো করলাম।
দু-খানা কলাপাতা জুড়ে তার ওপর ওই হাড়ি ভর্তি ভাত ঢেলে দিলো— তরকারির কড়াইটা এনে পাতার সঙ্গে জুড়ে দিলো— “এবার ভোজন শুরু করুন।” আমি বললাম— “এত ভাত তো আমি ক-দিনে খাব?” প্রৌঢ় বললেন— “আপনি একা খাবেন আর আমরা গুষ্টিশুদ্ধ উপোষ দেবো নাকি? কপালে আজ বাহ্মণের প্রসাদ আছে— ঠেকাবে কে? কত দিনে এমন ভাগ্য হয়?”
যাই হোক, কিছু ভাত আর তরকারি হাতায় করে তুলে নিলাম। খাওয়া হতেই বিজয়ের বৌ একটা নতুন পাটি পেতে দিলো। বিজয়ের বাবা বললেন— “ঠাকুরদাদু, এবার আপনি বিশ্রাম করুন। আমরা প্রসাদ পাব। তারপর বেলাবেলি আপনার রওনা হওয়ার আয়োজন করা আছে।” রওনা হয়ে মাইল ছয়েক এসে এক গরুর গাড়িকে পাশ দিয়ে দাঁড়িয়েছি— গরুর ঢাউস পেটটা আমাকে একটু ঘেঁষে দিয়ে চলে গেল আর আমি গড়গড়িয়ে নেমে গেলাম ঢালে— গাড়ি চলে গেলে উঠে দেখলাম যিনি এতক্ষণ আমাকে বয়ে নিয়ে এসেছেন এখন তিনিই আমাকে তার বাহন করলেন। যাই হোক সাইকেল বয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল— বাবা বললেন— “টাকা কত এনেছিস আগে হিসেব দে।” “ছেলেটা এল একটু হাতে-মুখে জল দিক” বলে মা আমাকে এক ঘটি জল এনে দিলেন। আমি চোখে-মুখে জল দিয়ে ঢক ঢক বাকি জলটা গিলে নিলাম। মা বললেন— “খালি পেটে এক ঘটি জল খেয়ে নিলি? আমি তো খাবার আনতে গেছি?”
বললাম— “মা, আমি বিজয়ের দুই ছেলেকে এক টাকা করে জলপানি দিয়েছি।” বাবা চটে গিয়ে বললেন— “আমাকে আদায় উশুলের হিসাব মেলাতে হবে না? ওর নামে দু-টাকা খরচা লিখে দেবো। তা ছাড়া সাইকেল মেরামত করতে হবে তো— সকালে গিয়ে যেন সাইকেল সারিয়ে আনে।”

[চলবে]

(বানান, যতিচিহ্ন অপরিবর্তিত)

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

5 4 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সুমন্ত রায়
সুমন্ত রায়
23 days ago

বড় বেশি অনিয়মিত। এত দেরিতে এলে পাঠক হিসাবে ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। প্রথম পর্বের পর দ্বিতীয় পর্ব এসেছিল দুই মাসের ব্যবধানে। তারপর তিনমাস পার হয়ে গেল, নতুন কিছু এল না! এর কি আর কোনো পর্ব আছে নাকি এটি অসমাপ্ত হিসেবে এখানেই শেষ?

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »