আজ আষাঢ়ের পহেলা, ষড়ঋতুর অন্যতম বর্ষার সূচনালগ্ন। প্রকৃতিকে শস্যশ্যামলা করে এই ঋতু, আবার মানবহৃদয়কেও রঞ্জিত করে ভাবে ও কল্পনায়। তাই কবিদের কাছে বর্ষাঋতু সতত স্বাগত। রবীন্দ্রনাথ গেয়ে ওঠেন, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে’। বৈষ্ণব কবিরা বর্ষাকে অমর করে রেখে গেছেন রাধাকৃষ্ণের বিরহমিলনের পদের পর পদ রচনা করে। আসন্ন বর্ষায় রাধা যাবেন শ্রীকৃষ্ণের অভিসারে। রাধা তাই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কীভাবে? পড়া যাক গোবিন্দদাসের এই পদটি, ‘কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি,/ গাগরি বারি ঢারি করি পিছল চলতহি অঙ্গুলি চাপি’— অর্থাৎ পায়ে কাঁটা বেঁধাচ্ছেন (অভিসারে যেতে পথে কাঁটা বিঁধবে তো! তাই অভ্যস্ত হয়ে নিচ্ছেন)! পায়ের নূপুর ছিন্নবস্ত্র দিয়ে বাঁধছেন, (যাতে অভিসারে যেতে নূপুরের শব্দ কারও কানে না যায়), কলসির জল ঢালছেন মেঝেতে, আর তার ওপর দিয়ে আঙুল চেপে চেপে হাঁটার অভ্যেস করছেন, কেননা বর্ষার পথ পিচ্ছিল হয়ে থাকবে! আবার অভিসারকালে বজ্রবিদ্যুৎকে উপেক্ষা রাধার, ‘কোটি কুসুমশর বরিখয়ে যছু পরি/ তাহে কি বজরক আগি?’— যার মাথায় কোটি কুসুমের তির বেঁধা, বজ্রের আগুনে কী-ই বা হবে তার?
অপর এক কবি রায়শেখর। অভিসার যে কতখানি প্রতিকূল, তা ফুটে উঠেছে তাঁর পদটিতে— ‘তরল জলধর বরিখে ঝরঝর/ গরজে ঘন ঘন ঘোর /শ্যাম মোহনে একিল কৈছনে/ পন্থ হেরই মোর!’
বাংলা সাহিত্যে বর্ষার অনুষঙ্গ দেদার, অনিঃশেষ। এক রবীন্দ্রনাথ-ই তো তাঁর গানে আর কবিতার মধ্যে বর্ষার বিচিত্র অনুভূতিমালা গেঁথে দিয়েছেন। মধ্যযুগে চণ্ডীমঙ্গল-রচয়িতা মুকুন্দরামের কাব্যে পাই বর্ষায় মানুষের দুর্গতির কথা, ‘—আষাঢ়ে পূরিল মহী নবমেঘে জল।/ বড়ো বড়ো গৃহস্থের টুটিল সম্বল।।/—/ শ্রাবণে বরিখে মেঘ দিবসরজনী।/ সিতাসিত দুই পক্ষ এক-ই না জানি।।’ বর্ষার উল্লেখ ময়মনসিংহগীতিকায় প্রচুর, সুপ্রচুর। ‘দেওয়ানা মদিনা’ পালা থেকে সামান্য অংশ: ‘আইলো আষাঢ় মাস লইয়া মেঘের রাণী/ নদীনালা বাইয়া আসে আষাঢ়িয়া পানি। শকুনা নদীতে ঢেউয়ে তোলপাড় করে—’।
বর্ষাকাল গৃহস্থের পক্ষে দুর্বিষহ কষ্টের মাস, কেননা কৃষিভিত্তিক দেশে এসময় চাষ বন্ধ থাকে। অন্নাভাব নিত্যকার ঘটনা। অন্যদিকে কবিরা তাঁদের আবেগ-উচ্ছ্বাসকে কিন্তু বলগাহীন প্রকাশ করেন এই ঋতুটিকে কেন্দ্র করেই। কবিকল্পনায় বর্ষার স্থান সর্বাগ্রে, তারপর বসন্তের স্থান। রবীন্দ্রনাথ বর্ষার গান লিখেছেন সবচেয়ে বেশি, তারপর বসন্তের।
পয়লা আষাঢ় বলতে অবধারিতভাবে যে কবিকে মনে না এসে পারে না, তিনি হলেন মহাকবি কালিদাস। তিনি তাঁর ‘মেঘদূত’ কাব্যে পয়লা আষাঢ়কে অমরত্ব দিয়ে গেছেন। এর কাহিনি যক্ষের বিধুর ও মর্মভেদী বেদনায় আকীর্ণ। কুবেরের উদ্যানপালক যক্ষের কর্মে অবহেলা দেখে কুবের তাকে একবছরের নির্বাসনদণ্ড দেয় রামগিরি পর্বতে। যক্ষের নির্বাসনের মেয়াদ পূর্তির দিকে, এমন সময় সে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং/ বপ্রক্রীড়াপরিণতগজপ্রেক্ষণীয়ং দদর্শ’,— পয়লা আষাঢ় পাহাড়ের ওপর থেকে বর্ষার জল নেমে আসছে দেখল। এতদিন কায়ক্লেশে যক্ষ স্ত্রীর বিরহ সহ্য করেছে, কিন্তু বর্ষা তাকে বিরহে আকুল করে তুলল। মেঘকে দূত করে পাঠাল সে অলকায়। অলকা, স্বর্গের রাজধানী, যেখানে যক্ষপ্রিয়া একা বিরহে দিনযাপন করছে। মেঘ তাকে গিয়ে জানাবে, যক্ষ বেঁচে আছে।
কাব্যটির অভিনবত্ব হল মেঘকে দূত করে পাঠানো, আর বর্ষায় প্রিয়বিরহ যে দুঃসহ হয়ে ওঠে, তা অসাধারণ করে প্রকাশ করা। ‘মেঘালোকে ভবতি সুখিনোহপ্যন্যথাবৃত্তি চেতঃ/ কণ্ঠাশ্লেষপ্রণয়িনীজনে কিং পুনর্দুরসংস্থে’। অর্থাৎ মেঘ দেখলে সাধারণ মানুষ-ও উদাস হয়ে পড়ে। আর গলায় গলা জড়িয়ে কাটাত যারা, তাহলে তাদের (বিরহে) কী দশা হতে পারে?
‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে/ কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/ লিখেছিলে মেঘদূত—’। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং একটি কিংবদন্তীর জন্ম দিলেন এভাবে। এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না যে, কালিদাস একেবারে দিনক্ষণ হিসেব করে আষাঢ়ের পয়লা তারিখটিতেই মেঘদূত লিখতে বসে গিয়েছিলেন, এবং সে-কাব্যের একশো দশটির মতো শ্লোক (এ-কাব্যের প্রকৃত শ্লোকসংখ্যা নিয়ে সংশয় আছে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একদা এর কয়েকটি শ্লোক কালিদাস-রচিত নয় বলে শনাক্ত করেন। পরবর্তীকালে তা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে) ওইদিনের মধ্যে লিখে শেষ করেন। মন্দাক্রান্তা ছন্দে লেখা কাব্যটি, যে ছন্দ অত্যন্ত কঠিন। একদিন কেন, এক-দু’মাসেও সম্ভব নয় মন্দাক্রান্তাছন্দের কঠিন অনুশাসন মেনে অত দ্রুত এমন কালজয়ী কাব্যরচন। প্রসঙ্গত, কালিদাসের অনুকরণে অজস্র এজাতীয় পবনদূত, কাকদূত, ময়ূরদূত ইত্যাদি লেখা হয়েছিল। যাদের ‘দূতকাব্য’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। আজ তা কেউ ছুঁয়েও দেখে না।
কিন্তু পয়লা আষাঢ় পেয়ে গেল অমরত্ব। এবং তা এমন-ই, যে আজ ওই তারিখটি মহাকবি কালিদাসের জন্মদিনরূপে ভারতে পালিত হয়। কালিদাসের জন্মস্থান বা জন্মের সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে ঘোর মতবিরোধ। অথচ পয়লা আষাঢ়কে তাঁর জন্মদিন সাব্যস্ত করায় আপত্তি উঠল না কারও। এইভাবেই হয়তো কিংবদন্তী ইতিহাসের মান্যতা পায়।
আমাদের বঙ্গভাষার আর এক কবি তাঁর বিরহকে বাণীরূপ দিয়ে গেছেন তাঁর অসংখ্য গানে। ‘মোরা আর জনমে হংসমিথুন ছিলাম’, অথবা ‘কেন আসিলে ভালোবাসিলে’, ‘তুমি আমারে কাঁদাও নিজেরে আড়াল রাখি’, বা ‘ঝরলো যে ফুল ফোটার আগেই’ ইত্যাদি গানের পর গানে যে বেদনার সীমাহারা দীর্ঘশ্বাস, তার পেছনেও যে রয়েছে যক্ষপ্রিয়ার মতোই এক নারী,— নার্গিস! একদা তাঁকে যে চিঠি দিয়েছিলেন নজরুল, নার্গিসকে লেখা সেই একমাত্র চিঠিটি লেখা হয়েছিল, আশ্চর্যের বিষয়, পয়লা আষাঢ়! এবং সে-চিঠিতে মেঘদূতের উল্লেখ ছিল। বিরহ নয়, তাতে সান্ত্বনাবাক্য-ও ছিল, ছিল স্বস্তিবচন: লাইলা মজনুকে পায় নি। কিন্তু এমন করে কে-ই বা কাকে পেয়েছে?
পয়লা আষাঢ় কালিদাস-রবীন্দ্রনাথ- নজরুলকে একসুতোয় বেঁধেছে।