Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নবনারী কুঞ্জর

আজ একটা অন্যরকম বিষয়ে আলোচনা করব, যা হয়তো অনেকেরই অজানা। প্রথমেই বলে রাখি, কুঞ্জর মানে হাতি। শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রসিকতা করে শ্রীরাধা তাঁর অষ্টসখীর সঙ্গে মিলে যে রূপ ধারণ করেছিলেন, তা-ই নবনারী কুঞ্জর। কৃষ্ণের সঙ্গে রাসলীলা করার নিমিত্তে রাধা তাঁর অষ্টসখীর সঙ্গে যে হস্তীরূপ ধারণ করেছিলেন বৈষ্ণব সাহিত্যে তাকেই নবনারী-কুঞ্জর বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

এখন দুটো কথা আসে এই প্রসঙ্গে। প্রথমত, কারা এই অষ্টসখী এবং দ্বিতীয়ত, কীভাবে এই হাতির রূপ ধারণ করা সম্ভব হল?

এই অষ্টসখীর নাম যথাক্রমে ললিতা, বিশাখা, চম্পকলতিকা, চিত্রা, তুঙ্গবিদ্যা, ইন্দুলেখা, রঙ্গদেবী এবং সুদেবী। এই অষ্ট নায়িকা আর শ্রীরাধা মিলে তাঁদের শরীর এমন নমনীয়তায় ও দক্ষতায় সংস্থাপন করলেন যে, তা একটি হাতির রূপ নিল।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে যে, শ্রীকৃষ্ণ যখন লীলা করতে এসে তাঁর প্রাণসখীকে দেখতে পেলেন না এবং ওই স্থানে একটি হাতি দণ্ডায়মান দেখলেন, তখন সেই হাতি তাঁর সঙ্গীকে বধ করেছে ভেবে নিয়ে ওই হাতিকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন, তখন সখীদের অট্টহাসিতে তাঁর সম্বিত ফিরল এবং তাঁদের অনুরোধে তিনি এ হস্তীতে আরোহণ করে তাঁর কামিনীকে খুঁজতে লাগলেন। শেষে হাতি থেকে নেমে রাধিকাকে খুঁজে পেয়ে তাঁর হাত ধরে প্রেম নিবেদন করেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি এবং পাঁচালিকার দাশরথী রায় (১৮০৬-৫৭) তাঁর পাঁচালির পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৭৭-এ এই নবনারী কুঞ্জর অর্থাৎ হস্তীরূপ ধারণের খুব সুন্দর বর্ণনা করেছেন। আসুন, আমরা দেখি সেই অপরূপ বর্ণনা:

শুন ভাই বিচক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের উপাখ্যান
ব্রজের অপূর্ব লীলা,— কিঞ্চিৎ বর্ণনা করিতেছি।
একদিন সখীসহ শ্রীমতী রাধায়।
মন্ত্রণা করিল সবে বসিয়া কুঞ্জায়।। ১
হরিকে ভুলাবে আজ করি রূপ হয়্যা।
দেখি, কৃষ্ণ কি করেন কুঞ্জায় আসিয়া।। ২
প্রথমেতে নটবরে দেখা নাহি দিব।
প্রকার প্রবন্ধে সবে সন্মুখে রহিব।। ৩
তোমরা ত অষ্ট সখী, আমি একজন।
নয়জনে একত্রেতে হইব মিলন।। ৪
নবনারী মিলে হব অপূর্ব কুঞ্জর।
কুঞ্জর রূপেতে রব কুঞ্জের ভিতর।। ৫
করী রূপে প্রাণকান্তে পৃষ্ঠেতে করিয়া।
ব্রজের বিপিন মাঝে বেড়াব ভ্রমিয়া।। ৬
শুনি রাধায় অনুমতি দিল সর্বজন।
নবনারী কুঞ্জর রূপ করয়ে রচন।। ৭

বৈষ্ণব সাহিত্যে এই বিষয়ে বলা হয়েছে, যে শ্রীহরির মায়াতে সমস্ত জীব আবদ্ধ, শ্রীমতী রাধার মায়াতে তিনিও বোকা বনে গেছেন। এই কুঞ্জরকে বিশেষজ্ঞরা এভাবে বলেছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ যেমন বহুতে এক আবার একের মধ্যে বহু, এই নবনারী কুঞ্জরও তারই রূপক অর্থাৎ একের মধ্যে বহু।

এখন কথা হচ্ছে, কীভাবে এই হাতির রূপ ধারণ করা সম্ভব হল?

নবনারী কুঞ্জর বানাতে দেহে অবিশ্বাস্য নমনীয়তা লাগে যা একমাত্র বর্তমান যুগের সার্কাসের ট্রাপিজের খেলা দেখান যে মেয়েরা, তাদের দ্বারা সম্ভব হলেও হতে পারে। নবনারী কুঞ্জর বানাতে প্রথম চারজন নীচে দাঁড়াবে, তারা হাতির পায়ের কাজ করবে। তাদের হাত উপরে মেলে ধরবে, যার ওপর আরও দুজন শুয়ে পড়ে হাতির দেহের আকার নেবে। এই দুজনের ওপর সপ্তম জন উপুড় হয়ে শুয়ে হাতির পিঠের আকার সম্পূর্ণ করবে। তারপর বাকি দুজনের একজন ওর দু’পা ধরে পেছনে ঝুলে যাবে হাতির লেজের রূপ নিয়ে এবং নবম অর্থাৎ শেষজন সামনের দিকে ওর গলা ধরে ঝুলে হাতির শুঁড় সম্পূর্ণ করবে।

আগেকার দিনে অনেক নারী অসম্ভব দক্ষতায় এই রূপ ধারণ করতে পারঙ্গম ছিলেন। প্রাচীনকাল থেকে নবনারী কুঞ্জর, অষ্টনারী তুরঙ্গ (ঘোড়া) নির্মিতিতে মেয়েরা ওস্তাদ ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, এদের ওপর চড়ে অনেক রাজা নাকি বিহার করতেন! বিশিষ্ট ফরাসি পর্যটক ট্যাভার্নিয়ার (Jean-Baptiste Tavernier, ১৬০৫-৮৯) তাঁর ভারত-ভ্রমণের অবকাশে তখনকার গোলকুন্ডা নগরীর সুলতান কুতুব শাহের (১৬২৬-৭২) কথা উল্লেখ করে লিখেছেন যে, সুলতান নবনারী কুঞ্জর-এর পিঠে হাওদা চাপিয়ে নগর পরিভ্রমণে বেরতেন। তাঁর লেখা ‘Travels in India’ ভ্রমণকাহিনিতে (মূল ফরাসি, অনুবাদ ইংরেজি, পৃষ্ঠা: ১৫৮) এর উল্লেখ আছে।

দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের সহস্রাব্দপ্রাচীন দুটি বিষ্ণুমন্দিরে [১. তিরুনেলভেলি জেলার থিরুক্কুরুনগুডি গ্রামে বৈষ্ণব নাম্বি মন্দির ও থিরুকুরুঙ্গুদিভাল্লি নাচিয়ার মন্দির এবং ২. থুথুকুডি জেলার শ্রীবৈকুণ্ঠম শহরের শ্রীবৈকুণ্ঠনাথন পেরুমল মন্দির (শ্রীবৈকুন্তম মন্দির ও কাল্লাপিরান মন্দিরও বলা হয়)] নবনারী কুঞ্জর স্থাপত্য রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ওর্ছা দুর্গের প্রাচীন চিত্রকলাতেও নবনারী কুঞ্জর দেখতে পাওয়া যায়।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেবী চৌধুরাণী-তেও নবনারী কুঞ্জর-এর কথা লেখা আছে।

এই নবনারী কুঞ্জর রূপের পুজোও অনুষ্ঠিত হত এবং কোনও কোনও জায়গায় এখনও হয়। নবনারী কুঞ্জর-এর মেলাও হয়। এরকম এক পুজো ও মেলার সন্ধান পাওয়া যায় পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার বাকসাড়া অঞ্চলে। এই বাকসাড়াকে সাতঘরাও বলা হয়। শোনা যায়, প্রাচীনকালে এই বাকসাড়া বনাকীর্ণ ছিল এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মোট সাতটি পরিবার ওখানে থাকত বলে কালক্রমে গ্রামের নাম সাতঘরা হয়ে যায়। বর্তমানে অবশ্য গ্রামের চিহ্নও বিলুপ্ত, শুধু সাতঘরা পল্লি বিদ্যমান। শোনা যায়, ওই গ্রামের এক কৃষ্ণভক্ত পরিবারের আদিপুরুষ রাসলীলা দেখার জন্য বৃন্দাবন রওনা হয়ে আর ফিরে আসেননি। কিন্তু কয়েক বছর পরে তাঁর বড়ছেলে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন। দেখেন যে, শ্রীকৃষ্ণ ব্রজধামে এক অদ্ভুত রাসলীলায় মত্ত। এক অদ্ভুতদর্শন হাতির পিঠে শ্রীরাধা সহ আসীন আর হাতির অঙ্গ জুড়ে অষ্টসখী বিরাজিত। আর স্বপ্নাদেশ হয় যে, ওই রূপের পুজো প্রতিষ্ঠা করতে।
পরদিন বাকি সব পরিবারের সঙ্গে স্বপ্নাদেশ নিয়ে কথা বলে শুরু হয় নবনারী কুঞ্জর পুজো। এই পুজোর প্রথম সন্ধান পাওয়া যায় ১৯০৪ সালে এবং মনে হয় প্রায় ৩০০ বছর থেকে এই পুজো প্রচলিত।

আসলে, হাওড়া অঞ্চল পূর্বকালে বেতোড় নামে পরিচিত ছিল। কলকাতা তখন সামান্য গ্রাম মাত্র, তখন হাওড়ার ছিল রমরমা, সব শেঠ-বসাকরা বেতোড়ে থাকতেন। এমনকি ১৫৭৮ সালে আসা এক ভেনিসীয় বণিকের লেখাতেও বেতোড়ের উল্লেখ আছে। তাঁর লেখায় পাওয়া যায় যে, বেতোড় নাকি সপ্তগ্রামের সহায়ক বন্দর ছিল।

তাই মনে হয়, এই পুজোর উৎপত্তি সপ্তদশ শতকের কোনও একটা সময়ে হয়েছে এবং আজ অব্দি চলে আসছে। মন্দির বহুবার ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও জনসাধারণের দাক্ষিণ্যে মন্দির পুনরায় নির্মিত হয়েছে। শেষবার তৈরি হয় পাকা করে ১৯৯১ সালে। বৈশাখী পূর্ণিমা থেকে নবনারী কুঞ্জর-এর পুজো এবং তৎসংলগ্ন মেলা শুরু হয় এবং শ্রাবণ মাসের শেষ রবিবার পুজো শেষ করে প্রতিমা বিসর্জন হয় আর দীর্ঘ ক’মাসের মেলারও সমাপ্তি ঘটে।

চিত্র: তামিলনাড়ুর সহস্রাব্দপ্রাচীন মন্দিরগাত্রের স্থাপত্যে নবনারী কুঞ্জর।

One Response

  1. নবনারী কুঞ্জর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেলাম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × five =

Recent Posts

মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনচক্রের মহাকাব্য নবান্ন: শ্রম, প্রকৃতি ও নবজন্মের দ্বান্দ্বিকতা

নবান্ন। এটি কেবল একটি ঋতুভিত্তিক পার্বণ নয়; এটি সেই বৈদিক পূর্ব কাল থেকে ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্ন ধারায় (যা প্রাচীন পুথি ও পাল আমলের লোক-আচারে চিত্রিত) এই সুবিস্তীর্ণ বদ্বীপ অঞ্চলের মানুষের ‘অন্নময় ব্রহ্মের’ প্রতি নিবেদিত এক গভীর নান্দনিক অর্ঘ্য, যেখানে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে শস্যের অধিষ্ঠাত্রী লোকদেবতার আহ্বানও লুকিয়ে থাকে। নবান্ন হল জীবন ও প্রকৃতির এক বিশাল মহাকাব্য, যা মানুষ, তার ধৈর্য, শ্রম এবং প্রকৃতির উদারতাকে এক মঞ্চে তুলে ধরে মানব-অস্তিত্বের শ্রম-মহিমা ঘোষণা করে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বুদ্ধদেব বসু: কালে কালান্তরে

বুদ্ধদেব বসুর অন্যতম অবদান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Literature) বিষয়টির প্রবর্তন। সারা ভারতে বিশ্ববিদ্যালয়-মানে এ বিষয়ে পড়ানোর সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এর ফলে তিনি যে বেশ কয়েকজন সার্থক আন্তর্জাতিক সাহিত্যবোধসম্পন্ন সাহিত্যিক তৈরি করেছিলেন তা-ই নয়, বিশ্বসাহিত্যের বহু ধ্রুপদী রচনা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে তাঁরা বাংলা অনুবাদসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন। অনুবাদকদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবীর রায়চৌধুরী প্রমুখ। এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব।

Read More »
দেবময় ঘোষ

দেবময় ঘোষের ছোটগল্প

দরজায় আটকানো কাগজটার থেকে চোখ সরিয়ে নিল বিজয়া। ওসব আইনের বুলি তার মুখস্থ। নতুন করে আর শেখার কিছু নেই। এরপর, লিফটের দিকে না গিয়ে সে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। চোখের সামনে পরপর ভেসে উঠছে স্মৃতির জলছবি। নিজের সুখের ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে ‘ডিফল্ট ইএমআই’-এর নোটিস পড়তে মনের জোর চাই। অনেক কষ্ট করে সে দৃশ্য দেখে নিচে নেমে আসতে হল বিজয়াকে।

Read More »
সব্যসাচী সরকার

তালিবানি কবিতাগুচ্ছ

তালিবান। জঙ্গিগোষ্ঠী বলেই দুনিয়াজোড়া ডাক। আফগানিস্তানের ঊষর মরুভূমি, সশস্ত্র যোদ্ধা চলেছে হননের উদ্দেশ্যে। মানে, স্বাধীন হতে… দিনান্তে তাঁদের কেউ কেউ কবিতা লিখতেন। ২০১২ সালে লন্ডনের প্রকাশনা C. Hurst & Co Publishers Ltd প্রথম সংকলন প্রকাশ করে ‘Poetry of the Taliban’। সেই সম্ভার থেকে নির্বাচিত তিনটি কবিতার অনুবাদ।

Read More »
নিখিল চিত্রকর

নিখিল চিত্রকরের কবিতাগুচ্ছ

দূর পাহাড়ের গায়ে ডানা মেলে/ বসে আছে একটুকরো মেঘ। বৈরাগী প্রজাপতি।/ সন্ন্যাস-মৌনতা ভেঙে যে পাহাড় একদিন/ অশ্রাব্য-মুখর হবে, ছল-কোলাহলে ভেসে যাবে তার/ ভার্জিন-ফুলগোছা, হয়তো বা কোনও খরস্রোতা/ শুকিয়ে শুকিয়ে হবে কাঠ,/ অনভিপ্রেত প্রত্যয়-অসদ্গতি!

Read More »
শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »