শ ঙ্খ দী প ভ ট্টা চা র্য
ভগীরথ সাহা। সবাই বলত ভোগেন স্যর, কারণ সবার ধারণা ছিল স্যর সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগেন। কমপ্লেক্সটা ছিল অঙ্কে। হ্যাঁ, স্কুলের সকল মাস্টারের থেকে তিনি সুপিরিয়র ছিলেন বইকী। রুটিনে লেখা থাকত থার্ড পিরিয়ড, অঙ্ক, বি এস।
প্রায় সাত কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে স্কুলে আসতেন। সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি। এই পোশাক ছাড়া অন্য কিছুতে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। এমনিতে ক্লাসের প্রায় সবাই ভগীরথ স্যরকে ভয়ই পেত। তাঁর ক্লাস মানে কারও না কারও পিঠে স্কেলের দাগ পড়বেই। আমার নাম অবশ্য স্কুলে বরাবরই এক থেকে তিনের মধ্যে ছিল। অঙ্কে ভাল হাত, অতএব স্কেলের ভয় তো দূরের কথা, স্যরের সবচেয়ে পছন্দের ছাত্র ছিলাম আমি। স্যর ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক লিখে দিতেন। ইশারায় আমার ডাক পড়ত। মাথা উঁচু করে অবলীলায় বোর্ড ভরে তুলতাম ঐকিক নিয়ম, সুদকষা, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার থেকে সাইন থিটা কস থিটার এমন এক ভাষায় যা বিকাশ, অনুপম, মলয়, সুব্রতর কাছে হামেশাই ভারী খটোমটো ঠেকত। হাতে লেগে থাকা চকের গুঁড়ো ফুঁ মেরে উড়িয়ে ফার্স্ট বেঞ্চে গিয়ে বসতাম সদর্পে। স্যর বোর্ডে গিয়ে বিকাশ, অনুপমদের ভাল করে বুঝিয়ে দিতেন কীভাবে অঙ্কটা সল্ভ করা হল। তারপর বলতেন, ‘মলয়, কাল কিন্তু তোকেই বোর্ডে আসতে হবে। না পারলে নতুন স্কেলটা তোর পিঠেই ভাঙব।’
স্যরের কাছেই আমার অঙ্কে হাতেখড়ি। অঙ্কের ভীতি দূর করেছিলেন তিনিই। চাইতেন ক্লাসের সকলেই অঙ্কে আমার মতো তুখোড় হয়ে উঠুক। এক্সট্রা ক্লাসও নিতেন অনুপমদের জন্য। বকাবকি কানমলার সঙ্গে কীভাবে যে ত্রিকোণমিতি মিশে গিয়েছিল তা তখন থোড়াই বুঝেছিলাম।
ইলেভেনে ওঠার পর অনেক ছেলেমেয়েদের মনেই একধরনের হামবড়া ভাব তৈরি হয়। শরীরের ভাষায় চলকে ওঠে ম্যাচিওর-ম্যাচিওর ভাব। ক্লাসে আমি হাই তুলতাম, জানলার দিকে তাকিয়ে স্যরদের একঘেয়ে পড়ানো এড়িয়ে যেতাম। বিশেষ করে ফিজিক্স। সেই একই ধরন, একই রকম মেথডে সব কিছু বোঝানোর চেষ্টা।
ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে, এই স্বপ্ন তো অধিকাংশ বাবা-মায়ের মনে গিজগিজ করে সর্বক্ষণ। তখন তো এই ঝোঁক আরও বেশি জোরালো। আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম, জয়েন্ট এন্ট্রান্স ক্র্যাক করতে হলে দরকার নতুন নতুন শর্টকাট মেথড। চট করে অঙ্ক সল্ভ করে ফেলা। কত কম সময়ে কত ধরনের অঙ্ক কষতে হয়। ট্রিক না জানলে চলে! শুভেন্দু একদিন বেশ কঠিন একটা বাইনোমিয়ালের অঙ্ক চারটে স্টেপে শেষ করে আমায় তাক লাগিয়ে দিল। বললাম, ‘দারুণ তো। কে শেখাল তোকে?’
‘অরুণাভদা। অরুণাভ দাশগুপ্ত। একমাস হল ভর্তি হয়েছি। যা অঙ্ক করায় না! আই আই টি-র জন্যও পড়ায় মেইনলি। তুই ঢুকবি?’
‘কত নেয়?’
‘সপ্তাহে একদিন। তিনশো। তোর মতো ক্রিম ক্রিম ছেলেরা সব এক ব্যাচে। আই আই টি না হলেও জয়েন্ট তো পাক্কা। খান্না গুপ্ত থেকে ধরে ধরে করায়। এক একটা যা ট্রিক শিখিয়েছে না! পাগলা হয়ে যাবি।’
আমি মুগ্ধ হয়ে শুভেন্দুর শ্রদ্ধাভক্তি গিললাম। হঠাৎ মনে হল ইঞ্জিনিয়ারিং আমার দোরগোড়ায় এসে কড়া নাড়ছে। একটা পা বাড়ালেই আমি মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার। দুটোতে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। ভর্তি হয়ে গেলাম। আমার ব্যাচে দশ জন। এটা ক্রিম স্টুডেন্টদের ব্যাচ। একটার পর একটা কঠিন অঙ্ক মেশিনের মতো সল্ভ করে চলেছি। আর অরুণাভদা! ব্রিলিয়ান্ট টিচার! শুনলাম, আই আই টি-তে চান্স পেয়েছিলেন কিন্তু কালার ব্লাইন্ড হওয়ায় শেষে এই প্রাইভেট টিউশন। তবে মাসে যা কামায়, তা একটা আই আই টি ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কী দারুণ কথা বলেন! একটা অঙ্ককে পাঁচ রকমভাবে সল্ভ করে দেখালেন। মনে হল এতদিন আমি প্রাগৈতিহাসিক যুগের ছাত্র ছিলাম। কিছুই তেমন শিখিনি। কতরকম ট্রিক শেখার আছে! মাস ছয়েকের মধ্যে আমি অরুণাভদারও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলাম। বাড়ি ফিরে একদিন শুনলাম অরুণাভদা নাকি বাবাকে বলেছে, আমি নাকি খুব শার্প ছেলে। আই আই টি পাওয়ার মতো ক্ষমতা রাখি।
জুন মাসের গরম। স্কুলে যাওয়ার সময় দেখলাম ভগীরথ স্যার সাইকেল প্যাডেলে হাত দিয়ে এদিক-ওদিক করছেন। চেনটা পড়ে গিয়েছে। ঘেমেনেয়ে একশা। এই কাঠফাটা রোদে সাদা পাঞ্জাবি-ধুতিতে গায়ের কালো রংটা আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে। কানের ওপর দিকে জমে থাকা ঘাম কাঁধের পাঞ্জাবি টেনে মুছতে মুছতে সাইকেলের চেন পরাচ্ছেন। সাইকেলটার বয়সও স্যরের মতোই। কেন যে একটা স্কুটার-ফুটার কেনেন না কে জানে!
ফার্স্ট পিরিয়ডেই আজ ভগীরথ স্যরের ক্লাস। ক্লাস শেষ হতেই আমাকে ডাকলেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘প্রিপারেশন ঠিক চলছে তো?’
‘হ্যাঁ স্যর।’
‘অরুণাভদা কেমন পড়াচ্ছেন?’
স্যরের মুখে হঠাৎ অরুণাভদার নামটা শুনে আমি কিন্তু ঠিক লজ্জিত হইনি। ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জা চকিতে এলেও তৎক্ষণাৎ উড়িয়ে দিয়েছি। আজ না হোক কাল খবরটা তো জানতেই পারতেন। স্যরকেও দেখে মনে হল না তিনি ব্যাপারটা খারাপ চোখে দেখছেন। স্কুলের সব স্যররাই তো প্রাইভেট টিউশন করেন। ভগীরথ স্যার অবশ্য একদমই পছন্দ করতেন না। বিরোধিতাই করেছিলেন স্টাফরুমে। আড়ি পেতে শুনেছিলাম। ‘আপনারা স্কুলে যদি নিষ্ঠার সাথে পড়ান, পড়ানোয় যদি ফাঁকি না থাকে, ছাত্ররা কেন যাবে বলুন তো প্রাইভেট টিউশনে? এটা কি সঠিক প্র্যাকটিস?’ স্যরের কথা সেদিন কেউ শোনেননি। বলতে বলতে একদিন স্যর চুপ করেই গিয়েছিলেন। মেনেই নিয়েছিলেন মনে হয়, তাই এত হালকা চালেই প্রশ্নটা সেদিন করতে পেরেছিলেন।
বললাম, ‘ভাল। খুব ভাল স্যর।’
‘ডিফারেন্সিয়ালের অঙ্কটা যেভাবে করেছিস, ওটা কিন্তু সঠিক পদ্ধতি নয়। দু-একটা হয়তো মিলিয়ে দিবি কিন্তু একটু ঘুরিয়ে দিলেই মুশকিল। বেসিক কিন্তু এখনও তোর নড়বড়ে আছে। বইয়ের অঙ্কগুলো ভাল করে কর আগে। বুঝে বুঝে। কনসেপ্ট তৈরি কর। তাড়াহুড়ো করিস না।’
‘ওগুলো তো আমার স্যর কবে হয়ে গেছে। আগের তিন বছরের পেপারে একটাও ওই ধরনের অঙ্ক আসেনি। অনেক টাফ অঙ্ক থাকে। অরুণাভদা…’
আটকে গেলাম। স্যর হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। সেদিনই মনে মনে অরুণাভদার সঙ্গে স্যরের একটা প্রতিযোগিতা গড়ে ফেললাম আর আমি হলাম গিয়ে জাজ।
টেস্ট পরীক্ষার পরেই সেন্ট মাইকেল গার্লস স্কুলের ফার্স্ট গার্ল ভর্তি হল অরুণাভদার কোচিং-এ। প্রিয়াঙ্কা। সুন্দর। ফর্সা। স্মার্ট। আরও বেশি করে মন বসে গেল অরুণাভদার ক্লাসে। কিন্তু একটা প্রশ্ন মাথায় ভনভন করছে। ভগীরথ স্যর না অরুণাভদা, কে বেশি মহান? আগারওয়ালের বই থেকে খুঁজে খুঁজে কোয়াড্রাটিক ইকুশেনের ওপর জাঁদরেল গোছের একটা অঙ্ক বার করলাম। আই আই টি, নাইন্টি টু। এগিয়ে দিলাম অরুণাভদাকে। এটা কিছুতেই ক্র্যাক করতে পারছি না অরুণাভদা। একটু হেল্প করো না, প্লিস। অরুণাভদার মাস্টার স্ট্রোক। ট্রিক। যেন অঙ্কটা মুখস্থ ছিল। দশটা স্টেপে সলিউশন।
পরের দিন ক্লাসে ওই অঙ্কটাই ভগীরথ স্যরকে কষতে বললাম। টুকে নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যর বললেন, ‘জ্যামিতির ক্লাসে বীজগণিত? কেন রে?’
‘স্যর করে দিন না।’
আমি জানতাম স্যরের ক্ষমতার বাইরে অঙ্কটা। করতে না পারলে দুটো সুবিধা। অরুণাভদার কোচিং-এ স্যরের মুখটা দুমদাম ভেসে উঠে অযথা আমাকে আর চিমটি কাটবে না। স্যারকেও বুঝিয়ে দেওয়া যাবে আজকাল ট্রিক ছাড়া কিছুই হয় না।
স্যর অঙ্কটা কষতে শুরু করলেন। সেই পুরনো কায়দা। পাঁচ মিনিট কেটে গিয়েছে। এখনও লড়ে যাচ্ছেন। বললাম, ‘স্যার ওভাবে মনে হয় হবে না। একটা ট্রিক আছে। আমি করব?’
স্যর উত্তর দিলেন না। কষে চললেন। সঠিক উত্তর শেষমেশ মিলিয়েও দিলেন। আমিও হাল ছাড়িনি। বললাম, ‘কিন্তু স্যর, এটা অনেক ইজি ওয়েতে হয়ে যাবে। এত খাটতেই হবে না।’ বলেই আমি ডাস্টার নিয়ে স্যরের অঙ্কটা মুছে অরুণাভদার দশটা স্টেপ বোর্ডে এঁকে ফেললাম।
অনুপম-সুব্রতরা আমাকে দেখে চমকে গিয়েছে। তারা নিশ্চয় ভাবছে কে বেশি মহান? আমি না ভগীরথ স্যর। স্যর বললেন, ‘ভেরি গুড। এবার আমি যেভাবে অঙ্কটা করেছিলাম সেটা করে দে তো বাবু।’
আমি চুপ। স্যারের সলিউসনটা আমি থোড়াই দেখেছি। বললাম, ‘এই তো করলাম স্যর।’ আমার গলায় আই আই টি-তে আসা অঙ্কের দশটা স্টেপে করা সলিউসনের প্রবল আত্মবিশ্বাস।
থাপ্পড়।
আমার হাত থেকে চকটা ছিটকে পড়ল। অনুপম-সুব্রতদের সামনে স্কুলজীবনে এই প্রথমবার। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। আমার কানটা একশ আশি ডিগ্রি মুলে স্যর বললেন, ‘বেরিয়ে যা ক্লাস থেকে। ট্রিক দেখাচ্ছিস! হতচ্ছাড়া ফাঁকিবাজ! যা বেরো। নিল ডাউন হ যা।’
আমি মাথা নিচু করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলাম। হাঁটু গেড়ে বসলাম। মাথা ভুলেও ওপরে তুললাম না। স্কুলের জুনিয়ররা আমাকে দেখুক। দেখছেই তো। আমি তাদের দেখতে চাই না। বুকের ভেতরটা খালি হয়ে এল। মনে হল আমার ওজন নেই। টোকা দিলেই পড়ে যাব। প্রিয়াঙ্কা, অরুণাভদা, অনুপম, স্কুলের আগের বছরের মার্কশিট… সেকেন্ড হয়েছিলাম… বাবা মা… ভগীরথ স্যর, রাগ, অভিমান সবকিছু মিলেমিশে জট পাকিয়ে গিয়েছে। কাঁদলাম, ভীষণ কাঁদলাম কিন্তু নিঃশব্দে।
স্কুল ছুটি হওয়ার পরেই সাইকেল স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। ভগীরথ স্যর সাইকেল নিতে এলেই ক্ষমা চাইব। আমি ভুল বুঝতে পেরেছি। স্যর আসার পর আমি কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যর—’
স্যর আমার দিকে তাকালেনই না। সাইকেলে উঠে চলে গেলেন। আমি এবার কী করি! সাইকেলের পেছনে দৌড়তে শুরু করলাম। স্যর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন কিন্তু থামলেন না। আরও জোরে সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দিলেন। আমি জানতাম স্যর এমনিতে খুব রসিক মানুষ। ক্লাসে কত মজার গল্প বলতেন। হো হো করে নিজেই হেসে উঠতেন তালে-বেতালে। হাসাতেনও খুব। আমাকে পেছনে দৌড়াতে দেখে সাইকেলের গতি ওভাবে বাড়িয়ে দেওয়াটা মনে হল তাঁর আজব সব রসিকতারই একটা দিক। আমি কিন্তু হাল ছাড়লাম না। দৌড়াতেই থাকলাম। মিনিট দশেক পর সাইকেল থামল। আমি হাঁটুতে হাত রেখে ঝুঁকে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। ভ্যাপসা গরম। ঘেমেনেয়ে আমি একশা। স্যর ইশারায় ডাকলেন। বললেন, ‘আয় দেখি বাবু আমার সাথে। মিষ্টি খাবি?’ কাছেই মিষ্টির দোকান। মানিব্যাগ থেকে কুড়ি টাকার একটা ন্যাতানো নোট বার করলেন। দেখলাম ব্যাগে কুড়ি টাকাই ছিল। আমার হাতে মিষ্টির প্যাকেট ধরিয়ে বললেন, ‘লেগেছে না রে খুব?’
আমার চোখে জল। আমতা আমতা করে বললাম, ‘না স্যর।’
স্যর হাসলেন। বললেন, ‘তাই নাকি? তাহলে তো স্কেলটাই তোর পিঠে ভাঙতে হত। হতচ্ছাড়া! যা এবার বাড়ি যা।’ এই বলে মাথায় হাত বুলিয়ে ধুতিটা সামান্য তুলে প্যাডেলে পা রেখে সাইকেলে উঠে পড়লেন। আমার চোখ তখন বড় রাস্তায়। তাকিয়ে থাকলাম যতক্ষণ পর্যন্ত ভগীরথ স্যরকে দেখতে পাওয়া যায়।
তেইশ বছর কেটে গিয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আমি আজ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। স্যালারি এতটাই বেশি যে মাল্টিপ্লেক্স, রেস্টুরেন্টে গিয়ে খরচের অজুহাত খুঁজতে হয়। ফেসবুকে আপডেট পাই, বন্ধুদের, আত্মীয়স্বজনের, স্ত্রীর, ছেলের এমনকি নিজেরও। দশ বছর আগে এই দিনটায় আমি কী করেছিলাম জানতে পারি। শেয়ার করি সকলের সাথে।
আজ হঠাৎ স্কুলের বন্ধুর মেসেজ হোয়াটসঅ্যাপে। স্রেফ একটা ছবি। ছবিটা জুম করে খানিকক্ষণ দেখেই বুঝলাম, ভগীরথ স্যর। সেই ধুতি আর পাঞ্জাবি। বেঞ্চে বসে আছেন। চারপাশটা সরকারি হসপিটালের মতো। স্যরের চেহারা দেখে চমকে গেলাম। মনে হল ব্লটিং পেপারে স্যরের সেই সুপিরিয়রিটি কেউ যেন আগাগোড়াই শুষে নিয়েছে। গাল চুপসে অনেকটাই ভিতরের দিকে। চোখের নিচে কালি। কণ্ঠনালি বেরিয়ে আসতে চায়। গায়ের রং আগের চেয়ে ঢের বেশি কালো। বেঞ্চের সঙ্গে যেন মিশে গিয়েছে শরীরটা। মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছেন। নিশ্চয়ই ডাক্তারের জন্য।
বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ ছবি কোথায় পেলি? কে তুলেছে? স্যর এখন কোথায়?’
সে বলল, ‘নো আইডিয়া বস। গ্রুপে পোস্ট হয়েছে আজ। তুই তো আর আমাদের গ্রুপে নেই। তাই ফরোয়ার্ড করলাম।’
বুঝলাম বন্ধুদের হাতে ফরোয়ার্ড হতে হতে আজ স্যর আমার মোবাইলে। এদিক-ওদিক হোয়াটসঅ্যাপ করে স্যরকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। কেউ তেমন কিছুই বলতে পারছে না। শুধু জানতে পারলাম আমরা স্কুল ছাড়ার পর আরও দশ বছর পড়িয়েছিলেন ওই স্কুলেই। তারপর আর কোনও হদিশ নেই। আমার খুব ইচ্ছে হল স্যরকে খুঁজে বার করি। খুব একটা কঠিন কিছুই নয়। একটু কাঠখড় পোড়ালেই স্যর কোথায় থাকেন, অন্ততপক্ষে সেটা বের করে ফেলা যাবে। আরও একটু কষ্ট করলে বাড়িটা কোন পাড়ায় তাও হয়তো জেনে নেওয়া যাবে। ব্যস তারপর সেখানে পৌঁছে জিজ্ঞেস করব, ‘আচ্ছা এখানে ভগীরথ সাহা বলে কেউ থাকেন?’ উত্তর আসবে, ‘কে? ভগীরথ কী?’ ‘সাহা সাহা।’ ‘সাহা, আচ্ছা… পোমোটার?’ ‘না না, প্রোমোটার না। শিক্ষক। আগে স্কুলে পড়াতেন।’ ‘না না, ওনামে শিক্ষক-ফিক্ষক এখানে কেউ থাকে না।’ হতাশ হয়ে অগত্যা আমি ফিরে আসার কথা ভাবতেই পেছন থেকে কেউ একজন নিশ্চয়ই বলে উঠবেন, ‘ভগীরথ স্যরকে খুঁজছেন? অঙ্ক স্যর?’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি চেনেন?’ ‘হ্যাঁ চিনি তো, এই ব্লকটার পরের পরের ব্লক। বাঁদিকে ঢুকে তিন নম্বর বাড়ি। সামনে ফুলের বাগান। রক্তকরবী গাছ আছে গেটের সামনে।’ আমি রক্তকরবী চিনি না। তবু এইটুকুই যথেষ্ট। আমি দৌড়ে গিয়ে বেল বাজাব। স্যর বেরিয়ে আসবেন। আমাকে প্রথমে চিনতে পারবেন না। ‘আমি বলব, স্যর চিনতে পারছেন? আমি সৌরভ। তন্ময়দের ব্যচ। তন্ময় ডাক্তার হল এন আর এস থেকে। মনে পড়ছে?’ আমি তো স্যরের প্রিয় ছাত্র ছিলাম। স্যর আমাকে আলবাত চিনবেন। চিনতে পেরেই বলে উঠবেন, ‘সৌরভ। তুই!’ আমার চোখে জল আসবে। আমি ঝুঁকে প্রণাম করতে যেতেই স্যর আমাকে বুকে টেনে নেবেন। জড়িয়ে ধরবেন।
কিন্তু এই পথ দীর্ঘ। প্রচুর খাটাখাটনির পর আদৌ স্যরকে খুঁজে পাব কিনা তা কিন্তু একেবারেই নিশ্চিত করে বলা যায় না। আমি ভগীরথ স্যরের ছাত্র। স্যর প্রবাবিলিটি শিখিয়েছিলেন। সম্ভাব্যতার মধুর খেলা। এক্ষেত্রে যা খুবই কম। তাই স্যরের এই একটি মাত্র ছবি এখানে দিলাম। অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ছে। নস্টালজিয়া যাকে বলে আর কী। খুব ভাল লাগছে। আবার খারাপও লাগছে একইসঙ্গে। স্যর আপনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকবেন।
ওপরে এতক্ষণ যা লিখলাম, মানে সেই ভগীরথ স্যর কেন ভোগেন স্যর, সেখান থেকে শুরু করে পুরোটাই কপি করে এইমাত্র ফেসবুকে পোস্ট করলাম। সঙ্গে স্যরের ছবিটাও। আপলোড হয়ে গিয়েছে। আমার চোখ এখন মোবাইল স্ক্রিনে।
এক মিনিট। তিনটে লাইক।
দুমিনিট। সাতটা লাইক। দুটো কমেন্ট।
‘অসাম পোস্ট। হ্যাটস্ অফ।’
‘দারুণ লিখেছেন। পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। আমাদেরও একজন স্যর ছিলেন জানেন। এখন তিনি কোথায় কেউ জানে না। ইতিহাস পড়াতেন। আপনার কি বাংলা মিডিয়াম ছিল? কোন স্কুল?’
আমি লাইক দেখছি। স্যরকে দেখছি। কমেন্ট। লাইক। তারপর আবার স্যর। স্যরের মাথা নিচু। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবিতে কালো ভগীরথ স্যর এখন আরও অনেক বেশি কালো। একটু যেন নড়লেন। তাকালেন আমার দিকে। লম্বা হাতটা বাড়িয়ে আমার কানটা একশো আশি ডিগ্রি মুলে বললেন, ‘ট্রিক দেখাচ্ছিস! হতচ্ছাড়া ফাঁকিবাজ!’