Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রম্যগদ্য : তাল

স্ব প ন  না গ

‘ত’ আর ‘ল’ বর্ণদুটোকে জুড়লে যে-শব্দ তৈরি হয়, জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে তার হদিস পেতে অনেকের ক্ষেত্রেই একটা জীবন কম পড়ে যায়। আ-কার, ই-কার, এ-কার বা উ-কার এসে তাকে যখন তাল তেল তিল তালি তালু বানিয়ে ছাড়ে। শব্দনির্মাণের ইতিহাস নিয়ে ভাবতে বসেও তার তল পাওয়া বেশ দুরূহ হয়ে ওঠে। এ যেন অতল জলের আহ্বান।

তবে তল নয়, কথা হচ্ছে তাল নিয়ে। এই তালরহস্যের তল পাওয়াও চাট্টিখানি কথা নয়। অফিসের বসই হোক কিংবা ঘরের গিন্নি— জীবনকে স্মুথ রাখার তাগিদে কত তালই না ঠুকে চলতে হয় মানুষকে। সবকিছু তালে বাজলে ঠিক আছে, আর তা না-হলেই ঘরে বাইরে অনিবার্য সংঘাত। বাপের বাড়ি চলে যাবার হুমকি অথবা ইনক্রিমেন্ট স্টপের শাসানি। এ-সব নিয়েই তবু মধ্যবিত্তের গেরস্থ জীবন। বেতাল পঞ্চবিংশতির মতো তিল-কে তাল বানানোর ক্ষমতা আমাদের মতো ছাপোষা মানুষদের আর ক’জনেরই বা থাকে! প্রতি মুহূর্তে ছিঁড়ে পড়ার সম্ভাবনা নিয়ে ঝুলতে-থাকা দিনগুলোতেও যখন টিভির পর্দায় লাস্যময়ী ভঙ্গিতে ঐশ্বরিয়া রাই নেচেন ওঠে ‘তাল সে তাল মিলা’ বলে, তখন অস্থির মনে খানিক শান্তির ঢেউ ওঠে বৈকী! সুখপাখিকে ধরে রাখতে তাই বেতাল কিছু ভাবতে নেই, বেতাল কথা কইতে নেই।

তালগাছ নিয়ে আমার এক বন্ধু চমৎকার একটা ক্যাপশনের কথা বলেছিল, আমাদের কোনও শাখা নেই। সত্যিই তো, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়— একেবারে উড়ে যায়— কোথা পাবে পাখা সে?’ এ এমন একটি গাছ, ফল গুঁড়ি পাতা কোনওটাই তার ফেলনা নয়। পাতা থেকে তৈরি চাটাই কিংবা হাতপাখা আজও গ্রামবাংলার অনেক ঘরেই অপরিহার্য এক সামগ্রী। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাথায় তালপাতার ‘পেখে’ চাপিয়ে তাল কুড়নোর মজা গ্রাম ছাড়া আর কোথায়? এমনকি কোলকাতার তালতলাতেও নয়। ছেলেবেলায় শুনেছি তাল নাকি কানা। তাল কুড়োতে এসে কারওর মাথায় তাল পড়েছে এমন কাণ্ড আজ অব্দি ঘটেনি। ফলে মাথায় তাল পড়ে মৃত্যু, নিদেনপক্ষে সামান্য আহত হওয়ার ঘটনার উদাহরণ এ পৃথিবীতে নেই। তালকানা শব্দের জন্মও নাকি তা থেকে। সত্যিমিথ্যে জানি না, তবে দৈনন্দিন কাজে আমার অহরহ ভুলগুলো দেখে তো আমার বউ কথায় কথায় আমাকে তালকানা বলতে ছাড়ে না।

যা দেখা যাচ্ছে, তা হল তাল বা তালগাছের যত সম্পর্ক— সব গ্রামের সঙ্গে। খুব কাছ থেকে গ্রাম দেখেনি যে, সে কী বুঝবে তালমাহাত্ম্য! কী জানে তালনবমীর? গ্রীষ্মশেষে আম জাম লিচুর রমরমার পড়তি শুরু হলেই বাজারে হাজির তাল। সারা বর্ষা জুড়েই তালের দাদাগিরি। বাজারে এলেও তাল কিন্তু এখনও সেভাবে গ্ল্যামারে উঠতে পারেনি। ঠাঁই হয়নি মল-এর শো-কেসে। এখনও বাজারের প্রান্তে মাসির আগলানো আওতায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে ক্রেতার অপেক্ষায় নিঃশব্দে নির্জনে। অথচ বাজারে আসার আগেও তাল কতই না সার্ভিস দিয়েছে আপামর গ্রামবাসীকে। সকাল সকাল গ্লাস দুই তালের রস যদি উদরস্থ হয়, তার অনুভূতি ভুক্তভোগীরাই জানে। বেলা বাড়লে গেঁজিয়ে যাওয়া রস মানে তাড়ির মাহাত্ম্যর তো কথাই নেই। ঢুলুঢুলু চোখে টলোমলো পদচারণায় বিন্দাস ঢোলারহাটের নাজিম কিংবা গড়ভবানীপুরের বেচারামকে দেখলেও সে স্বর্গীয় আনন্দকে আন্দাজ করা কঠিন নয়।

মা মাটি মানুষকে চিনুক এই অহংকারে একবার আমার বছর আটেকের নাতিকে খাইয়েছিলাম তালশাঁস। সে জানিয়েছিল, এর চেয়ে ভাল সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের জলভরা সন্দেশ। তালপাতার সেপাই আমার রোগে-ভোগা নাতি এর পরেই এই সব উল্টোপাল্টা জিনিস খাওয়ার অপকার নিয়ে লেকচার দিতে ব্যাগ্র হয়ে ওঠে। লোকেরা বোধহয় একেই বলে জেনারেশন গ্যাপ। ‘হায় তাল বাদামি রঙের তাল’ বলে গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করে শোকসঙ্গীত তখন। অথচ এই তালগাছই তাকে ড্রইংয়ের পরীক্ষায় কতবার উতরে দিয়েছে। ডুবন্ত সূর্যের গায়ে কালো রঙে দাগ টেনে মাথায় একঝাঁক চুলের মতো ইকরিমিকরি করে দিলেই কেল্লাফতে। আমি অপটু সেই সব দাগেও দেখতে পাই দিঘার তালসারির অপরূপ দৃশ্য, যেখানে সারি সারি তালগাছগুলো না থাকলে ছবিটি কিছুতেই যেন পূর্ণতা পায় না।

আমাদের গ্রামের মাটির দোতলা বাড়িটির ওপরতলার ভার ধরে রেখেছিল তালসাঁড়া। এমনকি তার ওপরের টিনের আচ্ছাদনটিও রাখা ছিল যে স্ট্রাকচারের ওপর তাও তৈরি তালসাঁড়া দিয়ে। লম্বালম্বি কেটে রোদজল খাইয়ে সিজ়নড্ করে আলকাতরার পোছে সেই সব তালসাঁড়ার শক্তি অনুমান করা যেতে পারে এটা জেনে যে, গ্রামের সেই বাড়ি টিকেছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর। সেই গ্রাম আর নেই। বাড়িটিও নেই। তালগাছের গুঁড়ি ধাপে ধাপে সাজিয়ে সিঁড়ি— বাড়ির পেছনের পুকুরের সেই সিঁড়ি ভেঙে নেমে জলে ডুব দেওয়ার দিনও আজ অতীত। তবে গ্রাম ছেড়ে খুব সহজেই শহরে পাড়ি দিতে পেরেছে যে বস্তুটি, তা হল তালপাটালি। এবং তালমিছরি। যতই ঝগড়া থাকুক সই দেখে নেবার সতর্কবার্তা কিংবা সই দেখে প্রতারিত না হবার সাবধানবাণী, এই তালমিছরিই সম্ভবত বলবার মতো তালের একমাত্র শহুরে প্রতিনিধি।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জনগণের সেবায় নিয়োজিত এমন গাছ আর কোথায়? বর্ষা এল, বাজারের অখ্যাত কোনও এক কোণে হাজিরাও দিল, তাকে থলেয় ভরে বছরের একটা দিনও অন্তত তালের বড়ার স্বাদ নেব না, এমন নিস্পৃহ মানুষ আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। তা সে ছাপোষা মধ্যবিত্তই হোক বা কোন তালেবর। তাল আসলে নিতান্ত নিরহংকারী আত্মবলিদানকারী যেন অলৌকিক এক ফল। তালের পায়েস (তালক্ষীর) তালের পিঠে তালের বড়া… স্বাদের রসটুকু নিঙড়ে ফেলে দিয়েও নিস্তার কই! তালের আঁটি! অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকেও তার ভেতর বেড়ে উঠছে ফোঁপরা। তা না হলে যে লক্ষ্মীপুজোর নৈবেদ্যও অসম্পূর্ণ। বরিশালের লক্ষ্মীপুজোয় এই ফোঁপরা অপরিহার্য এক উপকরণ, বলেছিল আমার এক বরিশালী বন্ধুপত্নী।

আরও কি রইল কিছু! যেটুক থাকল, রেখে দাও, রোদে শুকোক। জ্বালানির কাজে লেগে যাবে।

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »