হিমাদ্রি বর্মণ ও নিলুফা মল্লিক
সদ্যপ্রকাশিত রণবীর সিং-এর ন্যুড ফোটোশুট নিয়ে আলোড়ন পড়েছে এবং অনেক সমসাময়িক অভিনেত্রীরা প্রশ্ন করেছেন যে রণবীর পুরুষ হওয়ার দৌলতে এ যাত্রা বেঁচে গেলেন, কিন্তু মহিলা হলে সহজে জনরোষ থেকে নিস্তার পেতেন কিনা। এ ভয় খুব অস্বাভাবিক নয়। কারণ যখন এর আগে মিলিন্দ সোমান ৫৫ পেরিয়ে সমুদ্রসৈকতে দৌড়ে এলেন কিংবা পিকে ছবিতে আমির খান ফুল মন্টি হলেন, তাতে যা আলোড়ন হয়েছিল নিমেষেই স্তিমিত হয়ে যায়। অথচ এর আগে পাওলি দাম, স্বস্তিকা মুখার্জি এবং আরও অভিনেত্রী বা মডেলদের নগ্ন বা খোলামেলা পোশাকের জন্য প্রচুর সমালোচনার স্বীকার হতে হয়েছে। আজকের স্মার্টফোনের যুগে সমস্যা হয় যখন নেটিজেনরা ট্রোল করেন, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেক কম।
খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, নগ্নতার আঁচ কেন অন্যের গায়ে লাগবে? কারণ, অনেক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে আমরা দিন কাটাই। আসুন সেগুলোকে নগ্ন করে দেখি ভেতরে কোনও সারবস্তু আছে কিনা।
নগ্ন মানে অশ্লীল
যেহেতু পোশাক পরে চলা সভ্য সমাজের সভ্য রীতি, তাই সেখানে কোথাও নগ্নতার প্রকাশ দেখলে আমরা আঁতকে উঠি। অথচ নগ্নতা যে দৈহিক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায় তা আমরা বিশ্বের বরেণ্য কবির কবিতা ও শিল্পীর তুলিতে পরিচয় পেয়েছি। পোশাকাবৃত মোনা লিসা-র সঙ্গে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি অনাবৃতা মোনা ভান্না বা ভিট্রুভিয়াস ম্যান-এর ছবি এঁকেছেন। আমাদের দেশে রাজা রবি বর্মা বা অমৃতা শেরগিলের নগ্ন ছবি সমাদৃত হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ উর্বশী, বিজয়িনী কাব্যে নগ্নকান্তির গুণ গেয়েছেন। শুধু তাই নয়, ফরাসি বিপ্লবের পতাকাধারী মহিলা কিংবা নোবেল প্রাইজ মেডাল-এ গডেস অফ নেচার-এর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃতই দেখি। এ নিয়ে কারও মনে অশ্লীলতার প্রশ্ন জাগেনি কখনও? সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী তাঁর চরিত্র দোপদী মেঝেন-এর নগ্নতাকে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন। প্রতিবাদের মানব শরীরের প্রাকৃতিক স্বাভাবিকত্বকে অশ্লীল দাগিয়ে দেওয়ার আমরা কে? সেটা নিয়ে ভাবার সময় হয়তো এসেছে।
নগ্ন মানে চরিত্রহীনতা
এটাও অনেকের ধারণা, কেউ একটু নগ্ন হলে বা খোলামেলা পোশাক পরলে সে যৌন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। যদিও যৌনতা জীবনের অঙ্গ এবং তাতে খারাপ কিছু নেই, কিন্তু কে কেন কীভাবে পোশাক পরবে সে দায়ভার অন্যরা নেবে কেন? আর ঠিক কতটা আবরণ থাকলে বা না থাকলে সেটাকে যৌন ইঙ্গিত বলে ধরা হবে? আর সত্যি কি কারুর স্কার্টের দৈর্ঘ্য দেখে চরিত্র মাপা সম্ভব? ধর্ষণ হলে অনেক সময় আমরা এভাবেই ভিক্টিম-ব্লেমিং করি— ‘‘ওই পোশাক পরে যদি না বেরোত তাহলে ওকে কেউ কিছু করত না।’’ কিন্তু আদপে ধর্ষণের দায় কেবলমাত্র ধর্ষকের ওপর আর সমাজের সেই মানসিকতা যা ধর্ষককে শেখায় যে আধুনিক পোশাক পরা মেয়েরা চরিত্রহীন এবং সেকারণে তাদের ধর্ষণ করা যেতেই পারে। পোশাক একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হতে পারে, কিন্তু চরিত্রের মাপকাঠি হতে পারে না।
সব শরীরে নগ্নতা মানায় না
যখন কেউ কোনও তারকার মত স্টাইল করে তখন চারপাশের লোকজনই কটাক্ষ করে বলে— ‘‘ওঁদের সেরকম দেহসৌষ্ঠব আছে, তাই তাঁরা পরতে পারে, তুমি পরতে পারো না।’’ মানে যেটা কিনা একধরনের দেহ-সমালোচনা বা বডি-শেমিং। কিংবা ‘‘ওঁরা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের, ওঁদের মানায়, তুমি ক্যারি করতে পারবে না। তোমার আত্মীয়-স্বজন দেখলে কী বলবে?’’ অর্থাৎ কেউ তার নিজের দেহকে নিজের মত করে ভালবাসতে পারবে না। ভালবাসতে হলে এমন পোশাকের আড়ালে করতে হবে যেটা তার ‘সুশীল’ সমাজ অনুমোদন দেয়। কিন্তু এ ধারণা আমাদের নিজেদের শরীর ভালবাসতে ভয় দেখায়, এবং অনেক ক্ষেত্রে এতটাই দেখায় যে লজ্জায় অনেক বিবাহিত দম্পতি অন্ধকারেই সহবাসের সুখ মেটান। তাই তথাকথিত পারফেক্ট দেহ যাদের নেই, তারা নগ্নতার কদর তো করতেই পারেন না, বরং একধরনের হীনমন্যতার স্বীকার হন।
আমরা কেন পারি না নগ্ন হতে?
সবশেষে এটাই দাঁড়ায় যে, আমাদের সমাজ ‘‘মাই বডি, মাই রাইট’’ কথাটি অনুশীলন করার অনুমোদন দেয় না, যদিও এতে কেউ কারও ক্ষতি ঘটায় না। যাঁরা একটু সাহস করেন, তাঁরা একটু খ্যাতির জোরে করে কিংবা বোল্ড তকমা পেয়ে তীব্র সমালোচনা বা মানসিক চাপের স্বীকার হন। নগ্ন হওয়া হয়তো জীবনযাপনের জন্য জরুরি কিছু নয়, কিন্তু নিজের মত করে নিজের দেহকে দেখতে বা সাজাতে চাইলে, সে বাধা পাবে কেন? পশ্চিমী দেশে এ ব্যাপারে উদাসীনতা থাকলে, এদেশে এত চাঞ্চল্য কেন? এ একধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমাবদ্ধকরণ নয় কি? স্টার ট্রেক খ্যাত অভিনেত্রী জোলিন ব্ল্যালক এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন— “Nudity is natural but not until a person accepts and loves who they are.”
নগ্ন হতে আমরা সবাই হয়তো ইচ্ছেপ্রকাশ করি না, কিন্তু নিজ দেহকে ভালবাসা এবং ভালবেসে প্রকাশ করার অধিকার যেন থাকে। যে সাহস রণবীর দেখিয়েছেন, সে সাহসকে যেন একদিন আমাদের সাহস নয়, স্বাভাবিক লাগে।
একমতও যেমন হয়নি তেমনি দ্বিমতও পোষণ করেছি না তবে সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার সুযোগ ভোগ করার পক্ষে । ধন্যবাদ।