Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

নগ্নতার অধিকার

হিমাদ্রি বর্মণ ও নিলুফা মল্লিক

সদ্যপ্রকাশিত রণবীর সিং-এর ন্যুড ফোটোশুট নিয়ে আলোড়ন পড়েছে এবং অনেক সমসাময়িক অভিনেত্রীরা প্রশ্ন করেছেন যে রণবীর পুরুষ হওয়ার দৌলতে এ যাত্রা বেঁচে গেলেন, কিন্তু মহিলা হলে সহজে জনরোষ থেকে নিস্তার পেতেন কিনা। এ ভয় খুব অস্বাভাবিক নয়। কারণ যখন এর আগে মিলিন্দ সোমান ৫৫ পেরিয়ে সমুদ্রসৈকতে দৌড়ে এলেন কিংবা পিকে ছবিতে আমির খান ফুল মন্টি হলেন, তাতে যা আলোড়ন হয়েছিল নিমেষেই স্তিমিত হয়ে যায়। অথচ এর আগে পাওলি দাম, স্বস্তিকা মুখার্জি এবং আরও অভিনেত্রী বা মডেলদের নগ্ন বা খোলামেলা পোশাকের জন্য প্রচুর সমালোচনার স্বীকার হতে হয়েছে। আজকের স্মার্টফোনের যুগে সমস্যা হয় যখন নেটিজেনরা ট্রোল করেন, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে অনেক কম।

খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, নগ্নতার আঁচ কেন অন্যের গায়ে লাগবে? কারণ, অনেক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে আমরা দিন কাটাই। আসুন সেগুলোকে নগ্ন করে দেখি ভেতরে কোনও সারবস্তু আছে কিনা।

নগ্ন মানে অশ্লীল

যেহেতু পোশাক পরে চলা সভ্য সমাজের সভ্য রীতি, তাই সেখানে কোথাও নগ্নতার প্রকাশ দেখলে আমরা আঁতকে উঠি। অথচ নগ্নতা যে দৈহিক সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটায় তা আমরা বিশ্বের বরেণ্য কবির কবিতা ও শিল্পীর তুলিতে পরিচয় পেয়েছি। পোশাকাবৃত মোনা লিসা-র সঙ্গে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি অনাবৃতা মোনা ভান্না বা ভিট্রুভিয়াস ম্যান-এর ছবি এঁকেছেন। আমাদের দেশে রাজা রবি বর্মা বা অমৃতা শেরগিলের নগ্ন ছবি সমাদৃত হয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ উর্বশী, বিজয়িনী কাব্যে নগ্নকান্তির গুণ গেয়েছেন। শুধু তাই নয়, ফরাসি বিপ্লবের পতাকাধারী মহিলা কিংবা নোবেল প্রাইজ মেডাল-এ গডেস অফ নেচার-এর ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃতই দেখি। এ নিয়ে কারও মনে অশ্লীলতার প্রশ্ন জাগেনি কখনও? সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী তাঁর চরিত্র দোপদী মেঝেন-এর নগ্নতাকে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন। প্রতিবাদের মানব শরীরের প্রাকৃতিক স্বাভাবিকত্বকে অশ্লীল দাগিয়ে দেওয়ার আমরা কে? সেটা নিয়ে ভাবার সময় হয়তো এসেছে।

নগ্ন মানে চরিত্রহীনতা

এটাও অনেকের ধারণা, কেউ একটু নগ্ন হলে বা খোলামেলা পোশাক পরলে সে যৌন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। যদিও যৌনতা জীবনের অঙ্গ এবং তাতে খারাপ কিছু নেই, কিন্তু কে কেন কীভাবে পোশাক পরবে সে দায়ভার অন্যরা নেবে কেন? আর ঠিক কতটা আবরণ থাকলে বা না থাকলে সেটাকে যৌন ইঙ্গিত বলে ধরা হবে? আর সত্যি কি কারুর স্কার্টের দৈর্ঘ্য দেখে চরিত্র মাপা সম্ভব? ধর্ষণ হলে অনেক সময় আমরা এভাবেই ভিক্টিম-ব্লেমিং করি— ‘‘ওই পোশাক পরে যদি না বেরোত তাহলে ওকে কেউ কিছু করত না।’’ কিন্তু আদপে ধর্ষণের দায় কেবলমাত্র ধর্ষকের ওপর আর সমাজের সেই মানসিকতা যা ধর্ষককে শেখায় যে আধুনিক পোশাক পরা মেয়েরা চরিত্রহীন এবং সেকারণে তাদের ধর্ষণ করা যেতেই পারে। পোশাক একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হতে পারে, কিন্তু চরিত্রের মাপকাঠি হতে পারে না।

সব শরীরে নগ্নতা মানায় না

যখন কেউ কোনও তারকার মত স্টাইল করে তখন চারপাশের লোকজনই কটাক্ষ করে বলে— ‘‘ওঁদের সেরকম দেহসৌষ্ঠব আছে, তাই তাঁরা পরতে পারে, তুমি পরতে পারো না।’’ মানে যেটা কিনা একধরনের দেহ-সমালোচনা বা বডি-শেমিং। কিংবা ‘‘ওঁরা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের, ওঁদের মানায়, তুমি ক্যারি করতে পারবে না। তোমার আত্মীয়-স্বজন দেখলে কী বলবে?’’ অর্থাৎ কেউ তার নিজের দেহকে নিজের মত করে ভালবাসতে পারবে না। ভালবাসতে হলে এমন পোশাকের আড়ালে করতে হবে যেটা তার ‘সুশীল’ সমাজ অনুমোদন দেয়। কিন্তু এ ধারণা আমাদের নিজেদের শরীর ভালবাসতে ভয় দেখায়, এবং অনেক ক্ষেত্রে এতটাই দেখায় যে লজ্জায় অনেক বিবাহিত দম্পতি অন্ধকারেই সহবাসের সুখ মেটান। তাই তথাকথিত পারফেক্ট দেহ যাদের নেই, তারা নগ্নতার কদর তো করতেই পারেন না, বরং একধরনের হীনমন্যতার স্বীকার হন।

আমরা কেন পারি না নগ্ন হতে?

সবশেষে এটাই দাঁড়ায় যে, আমাদের সমাজ ‘‘মাই বডি, মাই রাইট’’ কথাটি অনুশীলন করার অনুমোদন দেয় না, যদিও এতে কেউ কারও ক্ষতি ঘটায় না। যাঁরা একটু সাহস করেন, তাঁরা একটু খ্যাতির জোরে করে কিংবা বোল্ড তকমা পেয়ে তীব্র সমালোচনা বা মানসিক চাপের স্বীকার হন। নগ্ন হওয়া হয়তো জীবনযাপনের জন্য জরুরি কিছু নয়, কিন্তু নিজের মত করে নিজের দেহকে দেখতে বা সাজাতে চাইলে, সে বাধা পাবে কেন? পশ্চিমী দেশে এ ব্যাপারে উদাসীনতা থাকলে, এদেশে এত চাঞ্চল্য কেন? এ একধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমাবদ্ধকরণ নয় কি? স্টার ট্রেক খ্যাত অভিনেত্রী জোলিন ব্ল্যালক এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন— “Nudity is natural but not until a person accepts and loves who they are.”

নগ্ন হতে আমরা সবাই হয়তো ইচ্ছেপ্রকাশ করি না, কিন্তু নিজ দেহকে ভালবাসা এবং ভালবেসে প্রকাশ করার অধিকার যেন থাকে। যে সাহস রণবীর দেখিয়েছেন, সে সাহসকে যেন একদিন আমাদের সাহস নয়, স্বাভাবিক লাগে।

চিত্র: গুগল
3 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Iaak Azad
Iaak Azad
2 years ago

একমতও যেমন হয়নি তেমনি দ্বিমতও পোষণ করেছি না তবে সব ক্ষেত্রেই স্বাধীনতার সুযোগ ভোগ করার পক্ষে । ধন্যবাদ।

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

ভূতের একটি বাজে গল্প

দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিতেই প্রথমে যেটি চোখে পড়ল, সেটি সেই লাল-হলুদ মাফলার, খাটের পাশে ঝোলানো। তাহলে সিড়িঙ্গেবাবু নিশ্চয়ই এই ঘরেই অধিষ্ঠান করেন, তালা দিয়ে কোথাও বেরিয়েছেন। হঠাৎ আমি ভূতগ্রস্তের মত করিডর ধরে হাঁটছি আর এক-একটা করে ঘরের দরজা ঠেলে ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছি। কী আশ্চর্য, প্রতিটি ঘরেই কোথাও না কোথাও দেখছি একটা করে ওই লাল-হলুদ মাফলার ঝুলছে। যত দ্রুত পারি দোতলায় ঘরগুলোর দরজা ঠেলে উঁকি দিলাম। সবখানেই এক ছবি।

Read More »
সুজিত বসু

কবিতা: জীবনের নানা দিক

ট্রেনের জানালা থেকে চোখে পড়ে ঘাসের গালিচা/ কোমল রোদের স্নেহে ইংল্যান্ডের গ্রামাঞ্চল শান্তির নিদ্রায়/ সমুদ্রে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়িগুলি ঘাসের শয্যায়/ অতি দ্রুত বদলে যায় দৃশ্যাবলি, ট্রেন থামে ব্রাসেলস স্টেশনে/ বেলজিয়ামের মোহ দূরে রেখে ট্রেন চলে স্থির নিশানায়/ অভ্রান্ত লক্ষ্যের দিকে, আমস্টারডাম ডাকে কুহকী মায়ায়/ নগরে পৌঁছেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য, সুন্দরী ট্রামেরা/ হাতছানি দিয়ে ডাকে, বহু বহুদিন পরে প্রিয় বাহনের/ ডাকে সাড়া দিয়ে আমি পৌঁছে যাই মহার্ঘ নিবাসে

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »