Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

স্তন্যপানের বিকল্প শুধুমাত্র স্তন্যপানই

‘স্তন’। নিষিদ্ধ ফলের মতই ভীষণ আকর্ষক অথচ নিষিদ্ধ এক শব্দ। পুরুষের কল্পনা এবং কামনার এক দুর্নিবার কেন্দ্রস্থল নারীর স্তন। শুধু পুরুষের কল্পনা কেন নারী শরীরের সৌন্দর্য, কৌমার্য্যের এক উত্তুঙ্গ প্রকাশও নারীর বুকের ওই দুটি মাংসপিণ্ড।

লো-কাট পোশাকের আড়াল থেকে উঁকি দেওয়া বিভাজিকা অথবা শরীরে আঁটসাঁট হয়ে থাকা পোশাক ছাপিয়ে উদ্ধত স্তনযুগল ঝড় তোলে অনেক পুরুষেরই বুকে। কখনও কখনও আমার-আপনার আপনজনেরাই রাস্তায় উন্নত বক্ষযুগলকে দেখে ছুড়ে দেন দুচারটে মধুবাক্যও, যা শুনে লজ্জায়, ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠতে হয় মাঝে মাঝেই, কখনও বা রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করে।

অথচ এই ‘স্তন’ সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাট এবং মাংসের পিণ্ড ছাড়া আর কিছু নয়। নারীশরীরের এই উল্লেখযোগ্য অঙ্গটির সৌন্দর্যায়ন ছাড়াও একটি বিশেষ কাজ আছে, সেটি হল শিশুর জন্মের পর তার খাবার (মাতৃদুগ্ধ) প্রদান করা।
আমাদের সমাজ নারীর উন্মুক্ত বুক একটিবার দেখবার জন্য ভীষণ লালায়িত, জনসমক্ষে অশ্লীল মন্তব্যেও পারদর্শী অথচ এই শহরেই মা শপিংমলে তার ক্ষুধার্ত শিশুকে জনসমক্ষে স্তন্যপান করাতে গেলে তাকে শুনতে হয় কটুবাক্য, উপদেশ দেওয়া হয় ওয়াশরুমে গিয়ে ব্রেস্ট ফিড করাতে।

যাইহোক, এবার আসি স্তন্যপানের প্রসঙ্গে। মায়ের বুকের দুধ, একটি সহজাত এবং সহজলভ্য উপাদান যার বিকল্প সে শুধু নিজেই। এখনও পর্যন্ত কোনও ইনফ্যান্ট মিল্ক সাবস্টিটিউট বুকের দুধের জায়গা নিতে পারেনি। বাচ্চার জন্মের পর তার প্ৰয়োজনীয় পুষ্টি মেটাতে মায়ের বুকের দুধ অদ্বিতীয়। WHO-র নির্দেশিকা অনুযায়ী, বাচ্চার জন্মের পর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ বাচ্চাকে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি দেবার পাশাপাশি তৈরি করে তার রোগপ্রতিরোধক ক্ষমতা। ৬ মাস বয়সের পরে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার শুরু করতে হবে।

বুকের দুধ খাওয়ানোর উল্লেখযোগ্য উপকারিতাগুলোর মধ্যে যেগুলো না বললেই নয়:

১. বুকের দুধ সাশ্রয়ী, কারণ এটা মায়ের শরীরেই তৈরি হয়।
২. বাচ্চার প্রয়োজন অনুযায়ী শরীর দুধ তৈরি করে এবং তাতে সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ থাকে, এমনকি preterm ডেলিভারির ক্ষেত্রেও বুকের দুধ সেই বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ীই শরীর তৈরি করে।
৩. মায়ের প্রথম দুধ অর্থাৎ শালদুধ বাচ্চার প্রথম প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে
৪. মায়ের বুকের দুধ সহজপাচ্য, যা শিশু সহজেই হজম করতে পারে।
৫. টিনড মিল্ক-এর মত তৈরি করার, জল গরম করার, বোতল বাটি গরমজলে ফোটানোর দরকার পড়ে না।
৬. ইনফেকশনের সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।

শুধু বাচ্চা নয় মায়ের নিজের জন্যও স্তন্যপান খুব উপকারী:
১. গর্ভকালীন সময়ে শরীরে যে অতিরিক্ত ফ্যাট জমা হয় তা ঝরিয়ে শরীরকে আগের অবস্থায় আনতে সাহায্য করে।
২. শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ালে তা প্রথম কয়েকমাস গর্ভধারণ হওয়ার থেকে বাঁচায়।
৩. বাচ্চা বুকের দুধ খেলে মায়ের স্নায়ুতন্ত্র আমাদের ব্রেনকে সংকেত দেয় অক্সিটোসিন এবং প্রোল্যাকটিন ক্ষরণ করার জন্য। এই অক্সিটোসিন হরমোন জরায়ুর সংকোচনে সাহায্য করে এবং পোস্টপার্টাম হেমারেজের সম্ভাবনাকে কমায়। পোস্টপার্টাম হেমারেজ এখনও পর্যন্ত মেটারনাল ডেথ-এর সবচেয়ে বড় কারণ, এমনকি উন্নত পশ্চিমা দেশগুলিতেও।
৪. বাচ্চার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক সুদৃঢ় করে।
৫. আমাদের দেশে মেয়েদের হওয়া ক্যানসারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যা হল ব্রেস্ট ক্যানসার এবং জরায়ুমুখের ক্যানসার। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে এই দুই ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা কমে।

এই এত উপকার সত্ত্বেও আমাদের দেশের মায়েরা, বিশেষত নব্য-আধুনিক মায়েরা শারীরিক সৌন্দর্যহানির দোহাই দিয়ে অনেকেই বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান না। তাছাড়াও বড় বড় স্বনামধন্য কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে কোথাও কোথাও জন্মের পরে বাচ্চাকে মায়ের কাছে না দিয়ে বেবি নার্সারি নামক আলাদা ওয়ার্ডে রাখবার ধারা এখনও বহাল তবিয়তে চলছে। সেখানে সারাদিনে দু’বার, তিনবার বা চারবার মায়েরা গিয়ে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। সব সময় সমস্ত মায়েদের পক্ষে প্রসবকালীন ধকল সামলে সেটুকুও সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই সুযোগে চলে infant milk sunstitute-এর যথেচ্ছ ব্যবহার। এর কারণ কী তা আমাদের অজানা। হাসপাতাল পলিসির দোহাই দিয়ে কর্মীরা দায় সারেন। তাহলে সেই হাসপাতাল পলিসি কি আলাদা ওয়ার্ড-এর নামে ব্যবসায়িক লাভের হিসেব! বেবি ফুডের প্রমোশন। বুকের দুধের থেকে মিষ্টি এবং কষ্ট করে টেনে খেতে না হওয়ায় ফর্মুলা ফিডিং খাওয়ার পর সেই বাচ্চা আর বুকের দুধ খেতে চায় না। ফর্মুলা ফিড-এ বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হয়। এছাড়াও ভবিষ্যতে ওবেসিটি, ডায়াবেটিস-এর মত অসুখকে ডেকে আনে।

শিশুকে জন্মের পর ৬ মাস বয়স পর্যন্ত এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিংকে উৎসাহিত করতে WABA, WHO, UNICEF-এর মত অর্গানাইজেশন ১৯৯১ সাল থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পালন করছে ‘বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ’ বা ‘World Breast Feeding Week’। সেইমত এবছরও ১ আগস্ট থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত পৃথিবীর ১২০টিরও বেশি দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব স্তন্যপান সপ্তাহ। এই বছরের ‘World Breast Feeding Week’-এর থিম ঠিক করা হয়েছে ‘Step up for breast feeding : educate and support’। গোটা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও সব হাসপাতালে পুরো সপ্তাহ ধরেই বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, যাতে করে শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই প্রত্যেকটি শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো শুরু করা যায়।

এক্ষেত্রে দায়িত্ব শুধুমাত্র সদ্য মা হওয়া নারীটির নয়। তার বাড়ির লোকজন সর্বোপরি তার জীবনসঙ্গীকেও দায়িত্ব নিতে হবে, যাতে করে তাদের বাচ্চাটি ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধই খেতে পারে। আর যে সমস্ত কর্পোরেট হাসপাতাল ‘baby friendly hospital initiative’-এর এগ্রিমেন্ট সই করার পরেও বিধি মেনে চলছে না, তাদের চিহ্নিত করে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন যাতে শিশুর জন্মগত অধিকার রক্ষা করা যায়।

আসুন না, নারীর স্তনযুগলকে নিয়ে ফ্যান্টাসি করবার সঙ্গে সঙ্গে আমরা এই অমূল্য অঙ্গটির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করি। কার বুকের মাপ কত, মনে মনে তা ভেবে শিহরিত হওয়া, একবার ছুঁতে চাওয়ার সুযোগ খোঁজা তো আমাদের রক্তে মিশেই আছে। তার সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যতের শিশুটিকে সুস্থ, রোগহীন ভবিষ্যৎ উপহার দিই।

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »