লতা মঙ্গেশকর এমন একজন গায়িকা, যিনি কখনও নিজের গাওয়া কোনও গান আর দ্বিতীয়বার শুনতে চাইতেন না। কারণ হিসাবে তিনি অনেককেই জানাতেন, তিনি যদি নিজের গাওয়া কোনও গানের রেকর্ড শোনেন, তবে তাঁর কানে নাকি হাজারটা খুঁত ধরা পড়বে। তিনি নিজেই নিজের গাওয়া গানের এই খুঁতগুলো খুঁজে পাবেন। তাই একবার যে গানের রেকর্ড তিনি গেয়ে ফেলেছেন, সেই গাওয়া গান আর শুনতে চাইতেন না লতা মঙ্গেশকর (২৮ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ – ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২)। এই নিজের ‘কাজে’-র কাজে, নিজের খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য তিনি দীর্ঘ জীবনের প্রায় সম্পূর্ণ সময় ধরে গানের জগতে খ্যাতির শীর্ষে রয়ে গিয়েছেন।
লতা মঙ্গেশকর সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। প্রায় ছোটবেলা থেকে তাঁকে রীতিমত লড়াই করে এগিয়ে যেতে হয়েছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই তিনি গান গাওয়া শুরু করেছিলেন। স্বাধীনতার পরে তিনিই প্রথম ভারতীয় গায়িকা, যিনি ইউনাইটেড কিংডমের লন্ডন শহরের বিখ্যাত রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে ওরেন অর্কেস্ট্রার সঙ্গে গানের অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সময়টা ছিল সত্তর দশকের শেষের দিকে। প্রায় সোয়া ঘণ্টার এই গানের অনুষ্ঠানেও লতাজির কণ্ঠে দর্শকরা শুনতে পেয়েছিলেন, ‘অ্যায় মেরি ওয়াতন কি লোগো’-ও। লন্ডনের মাটিতে দাঁড়িয়েও ‘জয় হিন্দ’ বলতে একটুও দ্বিধা হয়নি লতাজির। এমনই দেশপ্রেমিক ছিলেন তিনি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি, মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে লতাজির অন্তিমযাত্রার সময়ও এই গানটি বাজানো হয়েছিল মাইকে।
শুধু কি হিন্দি গান! কত প্রাদেশিক ভাষাতে যে লতাজি গান গেয়েছেন, তার সংখ্যা অগুন্তি। তাঁর বাংলার প্রতি ছিল এক অস্বাভাবিক টান। লতাজি যেসময় বোম্বাইতে (এখনকার মুম্বই) প্লেব্যাক সিঙ্গার, তখন গানের দুনিয়া শাসন করছেন একঝাঁক বাঙালি সুরকার, গীতিকার। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি থেকে গায়ক মান্না দে, কিশোর কুমাররা। ফলে লতাজির সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে শোনা গিয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে বা কিশোর কুমারের গলাও। বাংলা গান শুধু কেন, লতাজি ভাল বাংলা ভাষা বুঝতেই শুধু পারতেন না, তিনি বাংলায় কথাও বলতে পারতেন।

সেসময় ‘পুজোর গান’ হিসাবে শিল্পীদের গাওয়া গানের রেকর্ড বের হত প্রতি বছর দুর্গাপুজোর আগে। সেসময়ের শিল্পীদের পুজোর গান যথেষ্ট অন্যমাত্রার হলেও, সব গানকে ছাপিয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল, লতাজির গাওয়া প্রথম বাংলা আধুনিক গান, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে, দূরের তারার পানে চেয়ে’ গানটি। এই গানটি অবশ্য পুজোর গান নয়। শারদীয়া উপলক্ষ্যে এই গানটি প্রকাশও হয়নি। পবিত্র মিত্রের কথায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে এই গানটি গেয়ে লতাজি রাতারাতি বাংলা আধুনিক গানের জগতে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন বটেই। উপরন্তু বাংলা আধুনিক গানের জগতে নিজের আসনটি পাকা করে নিয়েছিলেন। সেই গান এখনও সারা বাংলাতে তো বটেই, প্রবাসী বাঙালিদের কাছেও জনপ্রিয়।
হিন্দি গানের জগতেও কে এল সায়গল থেকে শুরু করে বাপি লাহিড়ী— এমন কোনও সুরকার নেই, যে যাঁর সুরে তিনি কণ্ঠ দেননি। হিন্দি সিনেমার ক্ষেত্রেও সেই নার্গিস থেকে মধুবালা, ওয়াহেদা রহমান বা শর্মিলা ঠাকুর থেকে আজকের রেকর্ড বাণিজ্য করা ছবি ‘দিলওয়ালা দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’ ছবিতে হিন্দি নায়িকা কাজলের ‘লিপ’-এ কিংবা মাধুরী দীক্ষিতের ছবির গান ‘দিদি তেরা দেবর দিবানা’-তেও সমানভাবে প্লেব্যাক করেছেন।
লতা মঙ্গেশকর যখন লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে প্রথম ভারতীয় হিসাবে গানের অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেয়েছিলেন, সেসময় মুম্বইতে হিন্দি ছবি সেভাবে রঙিন হতে শুরু করেনি। সাদা-কালো ছবিতে শুরু করে রঙিন ছবি, রেডিও, রেকর্ড প্লেয়ার, টেলিভিশন, এমনকি সিডির যুগ ছাড়িয়ে এখন পেন ড্রাইভের যুগেও লতাজি সমান জনপ্রিয়। আগে লতাজির গান শুনতে লোকে কাঁধে রেডিও নিয়ে রাস্তায় ঘুরতেন। সে যুগের অবসান অনেকদিন আগেই শেষ হয়েছে। কিন্তু রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে গান করা এই শিল্পীর জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র কমেনি, উলটে বেড়েছে।
শুধু কি বাংলা আধুনিক গান, লতাজির গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল অসাধারণ। নরেশ মিত্রের পরিচালনায় বাংলা ছবি ‘বৌ ঠাকুরানির হাট’ ছবিতে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছিলেন লতাজি। গানটি ছিল, ‘শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা’। সেটাও এককথায় একটি মাইলস্টোন। অজস্র সুপার হিট গান গেয়েছেন লতাজি। তাঁর গাওয়া গানের জোরেই সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই গান সুপার ডুপার হিট হয়েছে।
আবার ফিরে আসছি লন্ডনের সেই রয়্যাল অ্যালবার্ট হলের অনুষ্ঠানের কথায়। যেখানে লতাজির পরিচয় দেওয়ার সময় ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্টিস্ট’ হিসাবে। ‘শানদার নাগরিক’ হিসাবেও ঘোষণা করা হয়েছিল। এই অনুষ্ঠানে লতাজির সঙ্গে ছিলেন হিন্দি ছবির নায়ক দিলীপ কুমারও। সেসময়ই লতাজির পরিচয় দেওয়া হয়েছিল লন্ডনের বাসিন্দাদের কাছে এই ভাষায় যে, ‘লতা মঙ্গেশকর এমন একজন গায়িকা, যিনি দেশের যেকোনও সমস্যায় এগিয়ে আসেন।’ এই অনুষ্ঠানের আগে এবং পরে লতাজি যে কতবার দেশের নানা সমস্যায় এগিয়ে এসে নিজের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ তুলে করে দিয়েছেন, তার ইয়ত্তা নেই। সেই অনুষ্ঠানে লতাজির প্রথম গান ছিল, একটি সংস্কৃত স্লোকের সুর। তারপরেই শুরু করেন ‘ইঙ্গিলো বনেরে নিলাঙ্গ দোপট্টা মেরা’। সেই দিয়ে শুরু করে এক ঘণ্টারও বেশি টানা একভাবে গেয়ে গিয়েছিলেন। ‘বাহো মে চলি অ্যায়’ থেকে শুরু করে ‘অ্যায় মেরে ওয়াতন কি লোগো’। লতাজি বলেছিলেন, ‘এই গানটি নেহরুজি আমার কাছে শুনে বলেছিলেন, প্রকৃত ভারতীয় হলে এই গান শুনে তাঁর চোখে জল আসবেই।’
প্রথম যৌবনে রোজগারের জন্য ছবিতে অভিনয়ও করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সবমিলিয়ে আটটি মারাঠি ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন তিনি। কিন্তু অভিনয় পেশাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি কখনও। কিন্তু সিনেমার প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবেই তিনি ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। লতাজি প্রথম ভারতীয় গায়িকা হিসেবে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলের অনুষ্ঠানমঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশভক্তির অসাধারণ নমুনা পেশ করেছিলেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর সেই দেশভক্তি অটুট ছিল। তাঁর মৃত্যুতেও দেশে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালনের মধ্যে দিয়েই এই মহান গায়িকাকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল সুরসম্রাজ্ঞীকে।
লতা মঙ্গেশকরের সুগন্ধী-প্রীতি ছিল অসাধারণ। দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে গড়ে তুলেছিলেন নিজের সুগন্ধীর বিশাল সংগ্রহ। তাঁর প্রতি সম্মান জানাতে ১৯৯৯ সালে ‘Lata Eau de Parfum’ নামে একটি সুগন্ধীও বাজারে আসে। চাইলে সেই সুগন্ধী নিজের সংগ্রহে নিতে পারেন। দাম পড়বে ৬৪ হাজার টাকার মত। সুরসম্রাজ্ঞী স্বয়ং ‘স্বরাঞ্জলি’ নামে একটি হিরের গহনার কালেকশনের নকশাও করেছিলেন ভারতীয় হিরা রপ্তানি সংস্থা ‘অ্যাডোরা’-র জন্য। ‘নাইটিঙ্গেল অব ইন্ডিয়া’-কে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।