আজ থেকে প্রায় একশো তিয়াত্তর বছর আগের লেখা ‘জীবনচরিত’ নামের একটি গ্রন্থ (১৮৪৯)। চেম্বার্স-এর ‘বায়োগ্রাফিজ’ অবলম্বনে রচিত হয় এই বই। মনে রাখতে হবে সময়টা ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রাক-স্বাধীনতা যুগ। ভারতবর্ষে কায়েম রয়েছে ব্রিটিশ শাসন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও সমাজের গোঁড়ামি মানুষের মধ্যে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে আছে। সেসময় প্রকাশিত হচ্ছে কীর্তিমান বিজ্ঞানবিৎ, জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞান-গবেষক এবং মহতী মানুষের জীবনকথার সংকলন। উল্লেখিত ইংরেজি বইটি থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন লেখক। তবে শুধু অনুবাদ বললে ভুল হবে। সংকলক ও লেখকের স্বকীয় মনস্বিতা এবং টীকাটিপ্পনী যুক্ত করে লেখা হয় জীবনীমূলক এই বই।
জেনে নেওয়া যাক কাদের কথা রয়েছে এই বইয়ে? নিকোলাস কোপার্নিকাস, আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যার স্থপতি হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে তাঁকে। কোপার্নিকাসই বলেছিলেন, ‘হেলিসেন্ট্রিক কসমোলজি’-র কথা, অর্থাৎ পৃথিবী সহ অন্য গ্রহগুলি সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির রয়েছে সূর্য। আছে গ্যালিলিও গ্যালিলির কথা। যিনি গ্রহ নক্ষত্র এবং সূর্য কেন্দ্রিকতা নিয়ে বলেছিলেন। গ্রন্থিত হয়েছে আইজাক নিউটনের কথা। আলোকবিদ্যা এবং অভিকর্ষজ সংক্রান্ত যুগান্তকারী তত্ত্ব আবিষ্কার ছাড়াও যিনি গণিত ও পদার্থবিদ্যার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তিস্থাপনকারী হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে আজ যাঁকে। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম জনক উইলিয়াম হার্শেলের কথা। যিনি নিজের তৈরি টেলিস্কোপে চোখ রেখে আবিষ্কার করেছেন ‘ইউরেনাস’ নক্ষত্র। যিনি চিহ্নিত করেছেন শতাধিক নক্ষত্রপুঞ্জ এবং গ্যালাক্সি। নির্ভুলভাবে আগাম ধারণা দিয়েছিলেন ‘ইনফ্রা-রশ্মি–রেডিয়েশন’-এর বেশ কিছু ধর্ম সম্পর্কে। এছাড়াও আছে চিকিৎসক লিনিয়সের জীবনকথা— যিনি জীব ও উদ্ভিদ জগতের বিজ্ঞানভিত্তিক নতুন নামকরণ করেছিলেন। রয়েছে গণিতবিদ গ্রোশ্যস প্রমুখের কথা।
আমরা আজ অনেকেই জানি, এই সব মনীষীদের অনেকেই প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে তদানীন্তন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিষনজরে পড়ে অশেষ লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কাউকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। কাউকে বা আজীবন বন্দি করা হয়েছিল। উপড়ে নেওয়া হয়েছিল কারও চোখ। এমনকি কারও মা’-কেও ‘ডাইনি’ অপবাদ দিয়ে বন্দি করে রেখে চরম নির্যাতন করা হয়েছিল। কী অপরাধ ছিল তাঁদের? কারণ, তাঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য উন্মোচন করে পরমসত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে আপত্তি কীসের? আসলে প্রকৃতির রহস্যের সত্যকে উন্মোচন করা হলে, তা যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবে। সত্য উন্মোচন করার অর্থ তো অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের মূলে আঘাত। যে কারণে, তদানীন্তন ধর্মযাজক তথা ‘ঈশ্বরের দূত’ বলে মান্য যারা, প্রকৃতির রহস্যের সত্য উন্মোচনকে মেনে নেননি।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, অশিক্ষা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে আচ্ছন্ন পরাধীন ভারতবর্ষে বাংলায় প্রকাশিত হচ্ছে এমন একটি পুস্তক, যেখানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, কেপলার, নিউটন প্রমুখ যুক্তিবাদী, মুক্তমনা এবং বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু মনীষীদের জীবন ও কাজ। যে বইয়ের কথা বলা হচ্ছে, তা রচিত হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচেতনা জাগানোর জন্যে। বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসু হিসেবে গড়ে ওঠার জন্যে।
আর ‘জীবনচরিত’ নামের এই গোত্রের একটি গ্রন্থের লেখক কে? শুনতে অবাক লাগবে, যে এই গ্রন্থর রচয়িতা স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর মহতী কর্মযজ্ঞের দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি পাশ্চাত্য বিজ্ঞানমুখী উদার সংস্কারমুক্ত শিক্ষা, জনশিক্ষা এবং সমাজ ও প্রগতি আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ছিলেন যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। বলা বাহুল্য যে, সচেতনভাবেই এইসব মনীষীদের জীবন নির্বাচন করেছিলেন তিনি। দেশের তদানীন্তন মানুষের উপযোগী করে বাস্তবসম্মতভাবে এই সংকলন প্রকাশ করেছিলেন।
বিজ্ঞানের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের আগ্রহ ও অনুরাগের আর একটি প্রামাণ্য দলিল হল ‘বোধোদয়’ নামের অন্য আর একটি গ্রন্থ। যেটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৮৮১ সালে। ‘জীবনচরিত’ বইটি ঊনত্রিশ বছর বয়সে লেখা আর ‘বোধোদয়’ লিখেছেন পরিণত বয়সে। প্রথম প্রকাশের ছ’মাসের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল ‘বোধোদয়’। শুধু তাই নয়, ঈশ্বরচন্দ্রের জীবিতাবস্থাতেই ৯৬টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল এই বইয়ের। এর থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, যাদের জন্যে এই পুস্তক রচনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র, সেই পাঠকদের কাছে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছিল এই বই।
নানান প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা ‘বোধোদয়’ বইটি। এই বইয়ে রয়েছে চেতনপদার্থ, মানবজাতি, পঞ্চ ইন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিভ, ত্বক), গণনা-অংক ইত্যাদি বিষয়। এছাড়াও নানান বস্তুর (যেমন, ধাতু: সোনা, রূপা, পারদ, সিসা, তামা, লোহা, দস্তা প্রভৃতি) বিজ্ঞানভিত্তিক বর্ণনা। লেখা হয়েছে হীরা, কাচ, জল, নদী, সমুদ্র, উদ্ভিদ ইত্যাদি নানান চিত্তাকর্ষক বিষয় নিয়ে। ঈশ্বরচন্দ্র বুঝেছিলেন, মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার এবং বিজ্ঞানমনস্কতার বিস্তার ঘটাতে পারলে একদিকে যেমন শিক্ষার প্রসার ঘটবে, অন্যদিকে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের ধর্মীয় নিপীড়ন এবং মানুষের মনে প্রোথিত হয়ে থাকা প্রচলিত কুসংস্কারগুলিও দূর হবে।
‘বোধোদয়’ গ্রন্থে ‘উদ্ভিদ’ নামের লেখাটির কয়েকটি লাইন পড়ি। “কতকগুলি বৃক্ষের ছালে আমাদের অনেক উপকার হয়।… আমেরিকার ‘পেরু’ প্রদেশস্থ ‘সিঙ্কোনা’ নামক বৃক্ষের ত্বক সিদ্ধ করিলে যে ক্কাথ হয়, তাহা হইতে ‘কুইনাইন’ উৎপন্ন হয়। ইদানীং দার্জিলিঙ অঞ্চলে সিঙ্কোনার চাষ হইতেছে।’’
বিজ্ঞানচরিত বইয়ের শেষে ঈশ্বরচন্দ্র বেশ কিছু বিজ্ঞানের দুরূহ ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা সন্নিবেশিত করেন। Botany- উদ্ভিদবিদ্যা, Orbit- কক্ষ, Centre- কেন্দ্র, Milky way- ছায়াপথ, Optics- দৃষ্টি বিজ্ঞান, Elasticity- স্থিতিস্থাপক, Planetary nebulae- গ্রহ নীহারিকা, Telescope- দূরবীক্ষণ ইত্যাদি।
ঈশ্বরচন্দ্রের অধীতবিদ্যা যে বিজ্ঞান ছিল না, তা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু তাঁর বিজ্ঞান অনুরাগ ও আগ্রহ ছিল সমীহ জাগানোর মত। চিকিৎসাবিদ্যা না-পড়েও লিখেছেন জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত বেশ কিছু রচনা, যাতে সহজভাবে বিজ্ঞানভাবনা ফুটে উঠেছে।
উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ সরকারের অধীনে অবিভক্ত বাংলায় সমসাময়িক আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষার আরও একটি কথা উল্লেখযোগ্য তা হল, ১৮৭০ সালে ডা. মহেন্দ্রলাল সরকারের বিজ্ঞানসভায় ঈশ্বরচন্দ্র এক হাজার টাকা দান করেছিলেন।
তাঁর হাত ধরেই আমাদের পরিচয় হয়েছে বাংলা বর্ণের কিংবা বিধবা বিবাহ দেওয়ায় যে পাহাড়সমান বাধা ছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনিই। কিন্তু তাঁর পরিচয় শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁকে শুধু ‘ঈশ্বর’ আর ‘দয়ার সাগর’ বলে বেদির উচ্চাসনে বসিয়ে পুজো করলেই হবে না। ২৬ সেপ্টেম্বর পেরিয়ে গেল। তাঁর দুশো দুইতম জন্মদিনে আমরা বর্ণপরিচয়-এর ছবি দিয়ে সোসাল-মিডিয়া ভরিয়ে তুললাম। পত্রপত্রিকাতে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ হল। তাঁর ছবিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করাও হল। শুধু ২৬ নয়, বছরের বাকি দিনগুলিতেও আজ আমাদের তাঁকে প্রয়োজন। যুক্তিবাদী, বিজ্ঞান-নির্ভর মানসিকতার বলিষ্ঠ প্রতিভূ সমাজবিজ্ঞানী ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রয়োজন। ‘ঈশ্বর’-এর দূরত্বের ব্যবধান ঘুচিয়ে তাঁকে আজ সঙ্গে দরকার প্রতিটি দিন। তাঁর দেখানো পথে আমাদের আজকের হাজারো অন্ধকার দূর করতে হবে। সেটাই হবে তাঁর প্রতি প্রকৃত পুজোর ফুল আর মালা।
খুব ভাল লেখা। সত্যিই আজকের এই অবক্ষয়িত মূল্যবোধহীন অস্থির সময়ে… ” তাঁকে আজ সঙ্গে দরকার প্রতিটি দিন।”
আপনাকে ধন্যবাদ জানাই 🙏🏻