আজও সাধারণ মানুষ রং বলতে লাল, নীল, সবুজ, গেরুয়া কিংবা ফুল, উদ্ভিদ, প্রজাপতি বা ময়ূরের পেখমের রঙের কথাই বোঝেন। রং যে শুধু চিত্রশিল্পীদের রং-তুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, রঙেরও যে বিজ্ঞান আছে, অনেকেই তা জানি না।
প্রকৃতির অন্তর্গত উদ্ভিদ থেকে পাখি, পতঙ্গ— এসব কিছুর মধ্যে রয়েছে নানান রঙের সমাহার। রক্ত কিংবা এক এক জায়গার মানুষের গায়ের রং। রামধনু, সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত আর রাতের আকাশের তারাদের রং। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষকে মুগ্ধ করেছে প্রকৃতির এইসব অপরূপ বর্ণময়তা। সৌন্দর্যবোধের সঞ্চার করছে মানুষের মনে। মানুষের শিল্পকলার ইতিহাসও বেশ পুরনো। বহু আগে থেকেই মানুষ ছবি আঁকা কিংবা ছবিতে রঙের ব্যবহার শিখেছে। প্রকৃতির নানান উপাদান থকে তখন সেই সময়ের মানুষ রং যোগাড় করত। মাটি, পাথর, কাঠ-কয়লা, ফুল, পাতা কিংবা নানান খনিজ পদার্থ গুঁড়ো করে। পরবর্তী সময়ে মানুষ বুঝতে চেষ্টা করেছে কোথা থেকে আসে এই রং? পাশাপাশি শিখে নিয়েছে সঠিক রঙের ব্যবহারও। আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে বিজ্ঞানীরা রং, রঞ্জক পদার্থ নিয়ে গবেষণা করে সেই আরোহিত জ্ঞান দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন।
আজ এমন একজনের কথা বলব রঙের প্রতি ছিল যাঁর গভীর অনুরাগ ও আগ্রহ। শুধু রং নয়, রঙের থিয়োরি, ‘থিয়োরি অব কালার’ বিষয়ে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের অবতারণা করেছেন। এরকম রঙের কারবারি যে একজন ‘প্যাশনেট পেইন্টার’ হবেন, তা বলাই বাহুল্য। তাঁর আঁকা চিত্রশিল্পের একটি নমুনা এখানে দিলাম। আরও একটা কথা বলতে হয়, তা হল আঁকার জন্যে তিনি নিজেই রঙের রাসায়নিক (পিগমেন্ট) তৈরি করে নিতেন। তাঁর ‘কালার থিয়োরি’, কালার-টেবিল, স্কেল ও চার্ট বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফাইন-আর্ট এবং শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।
তবে যাঁর কথা বলছি, চিত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর সেরকম কোনও পরিচিতি নেই। বস্তুত একজন স্বনামধন্য রসায়নবিদ হিসেবেই তিনি পরিচিত। তাঁর নাম অসওয়াল্ড। পুরো নাম ফ্রিডরিখ উইলহেম অসওয়াল্ড (Friedrich Wilhelm Ostwald, ১৮৫৩–১৯৩২)। বাল্টিক-জার্মান ভৌত রসায়নবিদ এবং দার্শনিক। ‘রিয়াকসন ভেলোসিটিজ এবং ক্যাটালিসিস’-এর দিগদর্শী কাজের জন্যে তিনি ১৯০৯ সালে রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অসওয়াল্ডকে আধুনিক ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মানা হয়। অনুঘটক ও অনুঘটন প্রক্রিয়া, রাসায়নিক ভারসাম্য ও বিক্রিয়ার গতি সংক্রান্ত গবেষণায় তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। অসওয়াল্ড জনপ্রিয় হয়ে আছেন তাঁর ‘অসওয়াল্ড প্রসেস’ আবিষ্কারের জন্যে, যা অ্যামোনিয়া গ্যাস থেকে নাইট্রিক অ্যাসিড তৈরি করায় ব্যবহৃত হয়। রাসায়নিক শিল্পে যা অত্যন্ত জরুরি।
পঁয়তাল্লিশটি বই, পাঁচশোর বেশি গবেষণাপত্র এবং পাঁচ হাজার রিভিউ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। এছাড়াও ছ’টি স্কলারলি জার্নাল সম্পাদনা করেছেন তিনি। তিনি প্রসিদ্ধ পত্রিকা ‘জার্নাল অফ ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। দুখণ্ডে ‘টেক্সট বুক অফ জেনারেল কেমিস্ট্রি’ এবং তিন খণ্ডে লিখেছেন আত্মজীবনী।
স্বনামধন্য রসায়নবিদ অসওয়াল্ড ১৯০৬ সালে কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেওয়ার পরে দর্শন, শিল্পকলা এবং রাজনীতিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। শুধু জড়িয়ে পড়াই নয়, এর প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি প্রচুর সময় দিয়েছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গিয়েছেন শিল্পকলা ক্ষেত্রে। এছাড়া সাহিত্য ও মিউজিকেও ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। অবসর জীবনে তিনি ছবি আঁকা, কবিতা লেখা এবং ‘ভায়োলা’-য় সুর বাজাতেন আপনমনে। ‘ভায়োলা’ ছাড়াও ‘পিয়ানো’, ‘হারমোনিয়াম’ এবং ‘ব্যাসন’ বাজানোতেও দক্ষ ছিলেন। এছাড়াও তিনি মিউজিক কম্পোজও করতেন। এভাবেই তিনি উপভোগ করতেন। বস্তুত তাঁর শিল্পকলা এবং দর্শন-ভাবনা যেন কোনও সূত্রে তাঁর বৈজ্ঞানিক থিয়োরির সঙ্গে জড়িত ছিল। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রির কাজের পাশাপাশি ‘কালার থিয়োরি’, ‘দ্য হিস্ট্রি অ্যান্ড ফিলোজফি অফ সায়েন্স’ নিয়ে রয়েছে তাঁর অজস্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সারা জীবন ধরে বহুধাবিস্তৃত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন অসওয়াল্ড। তাঁর শিল্পকলা সংক্রান্ত কাজ এবং দর্শন বিষয়ক ধারণাগুলি প্রথমে সেভাবে আদৃত হয়নি। বলা ভাল, অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছিল। যদিও চিত্রশিল্পীরা মনে করেন, তিনিই প্রথম ‘কালার থিয়োরি’-র উদ্ভাবক। অসওয়াল্ড এক হাজারের বেশি পেইন্টিং এবং তিন হাজারের কাছাকাছি প্যাস্টেল ও রং নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা ও চর্চা করেছেন।
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে শৈল্পিক অভিজ্ঞতার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে— একাধিক চিন্তকদের এরকমই ধারণা। অসওয়াল্ড নিজেও বিশ্বাস করতেন তা। বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা এই দুইয়েরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কাঙ্ক্ষিত বস্তু বা ধারণাকে বোঝার চেষ্টা করা। মেধা ও বুদ্ধি আশ্রয় করে বিজ্ঞান সমাধানের লক্ষ্যে এগোয়। অন্যদিকে কল্পনা ও মানসচক্ষের ছবি আশ্রয় করে শিল্পকলা এগোয় সমাধানের উদ্দেশে। অসওয়াল্ডের কাছে শিল্পকলাচর্চা নিছকই অনুরাগের বিষয় ছিল না। বিজ্ঞানের জটিল ভাবনার মধ্যে কিছুক্ষণ শিল্পচর্চা তাঁর কাছে ছিল বিশুদ্ধ আলো-হাওয়ার মত।
আজ ২ সেপ্টেম্বর। অসওয়াল্ডের জন্মদিন। তাঁকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্যে এই সামান্য নিবেদন।
তথ্যসূত্র
Philip Ball and Mario Ruben, Color Theory in Science and Art: Ostwald and the Bauhaus, Angew. Chem. Int. Ed. 2004, 43, 4842 –4846।
Philip Ball, Painting by numbers Chemist Wilhelm Ostwald added colour to the art world., NATURE, VOL 425, 30 OCTOBER 2003
Pallavi Bhattacharyya, Wilhelm Ostwald – The Scientist, RESONANCE, May 2012, 428-433
Robert Root-Bernstein, Wilhelm Ostwald and the Science of Art, LEONARDO, Vol. 39, No. 5, pp. 418–419, 2006
রসায়ন এর বিভিন্ন অধ্যায়ে উইলিয়াম অসটওয়াল্ড’এর কত theories, laws & Equations পড়েছি। ভৌত রসায়ন’এর এক অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবেই তাঁকে জেনেছি। কিন্তু অনন্য চিত্র শিল্পী, সুরসাধক, কবি ও দার্শনিক অসটওয়াল্ড এর এই অনন্য পরিচয় কখনো কোন রসায়নের পাঠ্য পুস্তক এ হাইলাইটেড হতে দেখিনি। এ একান্তই আমাদের শিক্ষার অপূর্ণতা।
ভুবন রিখ্যাত একাধিক বিজ্ঞানীর বহুমুখী নানা অজানা প্রতিভার সন্ধান ও তার ওপর আলোকপাত করে লেখক সিদ্ধার্থ মজুমদার তাঁর পাঠকদের সমৃদ্ধ করে চলেছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। মুগ্ধ বিস্ময়ে আরও একবার সমৃদ্ধ হলাম আজ।
সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।🙏🏻