পঞ্চাশ বছর আগে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহিদ দিবসেই মাও জেদং ও রিচার্ড মিলহাউজ নিক্সনের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার হয়েছিল, যাকে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম ‘পিংপং ডিপ্লোম্যাসি’ আখ্যা দিয়ে আড়াল করতে চেয়েছিল মাও-নিক্সনের গোপন রাজনৈতিক অভিসার। তার দশ বছর বাদে সরকারি সাপ্তাহিক ‘বেজিং রিভ্যু’-তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে প্রকাশ পেয়েছিল যে চিন-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে মাও জেদং মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড মিলহাউস নিক্সনের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। দুনিয়া-কাঁপানো মহান প্রলেতারিয়ান সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপকার, গোড়ার দিকে যাঁর বর্শামুখ ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দিকে এবং যাঁর মতাদর্শগত ক্রোধ ছিল সোভিয়েত সংশোধনবাদের প্রতি। কিন্তু ১৯৭০ সালের নববর্ষে মাও ডাক দিলেন ‘সত্তর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করো’ (Usher in the Great 1970’s~ ১৯৭০) যেখানে তিনি বললেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতই সোভিয়েত সংশোধনবাদী সাম্রাজ্যবাদ দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণকে (অর্থাৎ তৃতীয় দুনিয়াকে) পদানত করতে চাইছে। তার পরে ‘সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’-কে বিশ্ব জনগণের প্রধানতর শত্রু ঘোষণা করা হয়। তার স্বাভাবিক পরিণতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপনে মিতালির প্রস্তাব। অথচ প্রচার হল জাপানে চিন ও আমেরিকার টেবিল টেনিস খেলোয়াড়রা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের বীজ বপন করে। পশ্চিমী সংবাদমাধ্যম (লন্ডনের গার্ডিয়ান দৈনিকও) ফলাও করে প্রচার করেছিল যে জাপানের নাগোয়া শহরে ১৯৭১-এর এপ্রিল মাসে বিশ্ব টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতার সময়ে চিনের ঝুয়াং জেদং ও মার্কিন টেবিল টেনিস খেলোয়াড় গ্লেন কাওয়ান-এর আলাপের মধ্যে দিয়ে দুদেশের শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসানের বাতায়ন উন্মোচন করে।
আপাতদৃষ্টিতে জাপানের নাগোয়া শহরে ১৯৭১-এর এপ্রিল মাসে বিশ্ব টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতার সময়ে ঝুয়াং-কাওয়ানের আলাপের মধ্যে দিয়ে দুদেশের শীতল কূটনৈতিক সম্পর্কের অবসান সূচিত হয় একথা প্রচার হলেও, আসলে তো অন্য খেলা চলছিল তলায় তলায়। নচেৎ দু’দশকের বেশি পারস্পরিক শত্রুতার কঠিন জাল ছিঁড়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের মাধ্যমে অবৈর অন্বয় সম্ভবই ছিল না, অন্তত পিংপং খেলার মাধ্যমে না। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ১৬ জুলাই ১৯৭১ ঘোষণা করেন পরের বছর মে মাসের আগেই তিনি চিন সফর করবেন। [History of the Chinese Communist Party— a Chronology of Events (1919-1980), Foreign Languages Press, Beijing, 1991, পৃ. ৩৫৩)। হোয়াইটহাউস এই ঘোষণাকে ‘আ মেজর ডিপ্লোম্যাটিক ব্রেক থ্রু’ আখ্যা দিয়েছিল।
প্রকৃত সত্য এই যে, নিক্সন নিজের উদ্যোগে বা নিজের প্রবল উৎসাহবশত মাও-এর সঙ্গে দেখা করেছিলেন, বা আগ বাড়িয়ে পেইচিং-এ প্রকাশ্যে বা গোপনে মাও-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন, তা মোটেই নয়। বরং উল্টোটাই ঘটেছিল। মাও-নিক্সন সাক্ষাৎকারের দশ বছর পরে একথা জানা যায় সরকারিভাবেই। মাও-এর জীবনীকার ও বন্ধু এডগার স্নো মারফত হাত ধরাধরির প্রস্তুতি গড়ে ওঠে। মাও-এর সনির্বন্ধ অনুরোধেই। স্নো মাও-এর অতিথি হয়ে শেষবার চিনে গিয়েছিলেন ১৯৭০ সালে গণচিনের জাতীয় দিবসে (১ অক্টোবর)। সাংস্কৃতিক বিপ্লব যখন মধ্যগগনে স্নো তখন চিনে ব্রাত্য ছিলেন। মাও তখন ‘চার চক্রী’-র হাতে স্বেচ্ছা-বন্দি। লংমার্চের সময় থেকে মাও এবং সি পি সি-র সুহৃদ এডগার স্নোর প্রতি এই আচরণে মাও ধৃতরাষ্ট্রের মত কিছু দেখেও দেখেননি, জেনেও জানেননি। মাও ১৯৭০ সালের জাতীয় দিবসে একথা প্রকাশ্যে স্বীকার করেন।
সাতষট্টি বছর বয়সে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি স্নো-র জীবনাবসানের ছ’দিন পরে পেইচিং-এ মাও-নিক্সন বাক্যালাপ হয়েছিল, যার পূর্ণ বয়ান এখনও অজানা। স্নো-র দশম মৃত্যুদিবসে পেইচিং-এ তাঁর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। মাও-এর জীবনাবসানের প্রায় সাত বছর পরে। স্নো-র স্মৃতিচারণ (লেখা/ভাষণ) সম্বলিত এক সংকলন প্রকাশ করে বেজিং রিভ্যু— ‘চায়না রিমেম্বার্স এদগার স্নো’। স্নো-র বন্ধু ও চায়না রিকনস্ট্রাক্টস-এর সম্পাদক ইস্রায়েল এপসটাইন তাঁর লেখায় জানান গণচিন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দোস্তির প্রেক্ষাপট। “In 1970 he (অর্থাৎ, এডগার স্নো) was back. In a talk with him, then, Chairman Mao Zedong explained that those officials who had opposed his return to China in 1967 and 1968 ‘had belonged to an ultra-Leftist group that had seized power in the Foreign Ministry for a time, but they were all cleared out long ago’, snow reported. On National Day that year Snow stood on the rostrum of Tien An Men with Chairman Mao. And on this visit, he was able to contribute, very substantially, to the advancement of his long-cherished hope, equal relations between his native USA and China that could facilitate ties and friendship between their two peoples. It was to him that Chairman Mao, afterwards, publicly expressed readiness to welcome the then President Richard Nixon, Richard Nixon, to China, for a visit and talks. Thus the long-standing rift between the two countries began to narrow.” (China Remembers Edgar Snow, Ed Wang Xing, Beijing Review, 1982, পৃ. ২৮)।
ভাষান্তর: স্নো ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে আলাপকালে, চেয়ারম্যান মাও জেদং কবুল করেছিলেন যে ১৯৬৭ ও ১৯৬৮ সালে ‘চিনে স্নো-র আবার আসার বিরোধিতাকারী কর্মকর্তারা একটি অতি-বামপন্থী চক্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যাঁরা কিছুকাল বিদেশ মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা কব্জা করেছিলেন, কিন্তু অচিরেই তাঁরা অপসারিত হন’, একথা স্নো নিজেই লিখেছিলেন। সে বছর জাতীয় দিবসে চেয়ারম্যান মাও-এর পাশে স্নো তিয়েন আন মেনের রোস্ট্রামে দাঁড়িয়েছিলেন। আর সেই সফরে, তিনি তাঁর জন্মস্থান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চিনের মধ্যে সম-সম্পর্ক তাঁর দীর্ঘকালের লালিত আশার অগ্রগতির কথা ব্যক্ত করেছিলেন যে সম্পর্ক দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বকে সহজতর করতে পারে। তাঁর কাছেই চেয়ারম্যান মাও জানান তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনকে চিন সফর ও আলোচনার জন্য স্বাগত জানাতে প্রস্তুত, বলেন এভাবেই দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ সংকুচিত হতে পারে।’ বইটির পাদটীকায় লেখা হয়েছিল মাও স্নো-কে বলেছিলেন নিক্সন রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে যদি না আসতে পারেন, ভ্রমণকারী হিসেবেও আসতে পারেন (ওই, পৃ. ৭৮)।
চিন সফরের কথা নিক্সন ১৯৭১-এর মধ্য-জুলাইয়ে প্রকাশ করেন। সেই সময়ই তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিংগার গোপনে পেইচিং-এ গিয়ে আলোচনা করে নিক্সন-সফরের ব্যবস্থা পাকাপাকি করেন। সেখানে তিনি চিনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেন, যা নিয়ে একটি ৪৬-পৃষ্ঠা নোট পরে প্রকাশিত হয়। সে আরেক কৌতূহলোদ্দীপক কূটনৈতিক দলিল।
প্রতি বছর ভাষাশহিদ দিবস একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদ আবদুস সালাম, রফিক উদ্দিন আহমেদ, সফিউর রহমান ও আবদুল জব্বারের শোণিতধারা অনিবাত ভাষাচেতনাকে বিবেকী প্রেরণায় শুধু ঢাকা বা বাংলাদেশের নয়, শুধু বাংলাভাষীদের নয়, দুনিয়ার মাতৃভাষাপ্রেমী সমস্ত মানুষদের আবহমান কাল ধরে প্রোজ্জ্বলিত করবে। কিন্তু ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ভাষাশহিদ দিবসে মানবেতিহাস কলঙ্কিত হল, ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বাসঘাতকতার দিন হিসেবেও চিহ্নিত হল। যখন ভিয়েতনামে (প্রধানত দক্ষিণ ভিয়েতনামে) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভিয়েতকং-দের যুদ্ধ চরম পর্যায়ে প্রবেশ করছে, সেই সময়ে পেইচিং-এ গণচিনের ও চিনের কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে স্বাগত জ্ঞাপন ও তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎ করেন। ইতিহাসের এ এক নির্মম পরিহাস আরেক কারণেও। এই দিনেই ১৮৪৮ সালে লন্ডনে মার্ক্স-এঙ্গেলসের লেখা কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছিল, আর তার ১২৪ বছর পরে মাও ও নিক্সনের সাক্ষাৎকার। তার ছ’দিন বাদে সাংহাই থেকে চিন-মার্কিন যৌথ ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত ও প্রকাশিত হয়। তখন চারু মজুমদার জীবিত এবং তিনি বা তাঁর দলের [সিপিআই (এম-এল)] নেতারা জানতেন না, একথাও সত্য নয়। নিক্সন-মাও মোলাকাতের সময় এঁরা মৌনব্রত অবলম্বন করেছিলেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাও জমানার চিনের তোতাপাখির মত চারুবাবু, অসীম চ্যাটার্জি, কানু সান্যাল, সুশীতল রায়চৌধুরীরা (নলশালবাড়ি কৃষক অভ্যুত্থানের আগে প্রমোদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, পুচালাপল্লী সুন্দরায়া এবং মাকিনেনি বাসভপুন্নাইয়ারাও) বলতেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সংশোধনবাদী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দোসর। অবশ্য তারপরে মাও আরেক তত্ত্ব হাজির করলেন— সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বের জনগণের (বিশেষত তৃতীয় দুনিয়ার) মানুষের পয়লা নম্বর দুশমন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নয়। সেজন্যেই মাও নিক্সনের সঙ্গে মোলাকাতের আকুলতা প্রকাশ করেছিলেন স্নো-র কাছে।
কভার: রিচার্ড নিক্সন এবং মাও জেদংয়ের সাক্ষাৎ, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২।