Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গৌড়বঙ্গের ম্যাড় পূজা: প্রাচীন মনসা সংস্কৃতির ধারা

লোকবিশ্বাস বলে, পুরাতন মালদার বেহুলা নদীতেই ছিল সেই নেতা ধোপানির ঘাট, যেখানে বেহুলাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বেঁধেছিল লখিন্দরের কলার ভেলা। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলে, মনসামঙ্গল কাব্যের উত্তরবঙ্গ ধারার প্রধানতম কবি জগজ্জীবন ঘোষালের মন্দির ও সাধনপীঠ আজকের পুরাতন মালদার কোনও একটি অঞ্চলে। এই লোকবিশ্বাস এবং ভক্তিকে অবলম্বন করে আজও পুরাতন মালদার বাচামারি পালপাড়া সংলগ্ন অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী মনসা পূজার রীতি ম্যাড় পূজাকে তিন পুরুষব্যাপী ধরে রেখেছেন বাচামারির অরূপ দাস। অবলুপ্তপ্রায় লোকশিল্পের এই ধারা টিকে আছে তাঁর হাত ধরেই।

‘বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস’ শীর্ষক আকরগ্রন্থে অধ্যাপক বরুণকুমার চক্রবর্তী পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আগত বাসিন্দাদের মাধ্যমে এই বিশেষ ধরনের মনসা পূজার বিস্তার লাভের কথা লিখেছেন। মনসা পূজার যে বিশেষ রূপটিকে ম্যাড় পূজা বলা হয়, তা বছরের যে কোনও সময়ে করা যায়। এমন নয় শ্রাবণ সংক্রান্তি বা নির্দিষ্ট কোনও তিথির দরকার রয়েছে। এই পূজায় আলাদাভাবে মূর্তি তৈরি করা হয় না। স্থাপিত হয় মনসার ঘট এবং তাকে কেন্দ্র করে তিনদিক থেকে মন্দিরের মত শোলা বা হালের থার্মোকলে নির্মিত একটি ঘর তোলা হয়। তার ওপরে রং-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হয় মনসামঙ্গল কাব্যের খণ্ডদৃশ্য। কোথাও সপ্তডিঙ্গা মধুকর নিয়ে বাণিজ্যযাত্রায় চাঁদের ছয় ছেলে, কোথাও চাঁদ সদাগর স্বয়ং, কোথাও সনকা বা নেতা ধোপানি। অবশ্যই সবকিছুর কেন্দ্রস্থলে সতী বেহুলার কোলে শায়িত বিষে জর্জর দেহে লখিন্দর। সকলের মাথার উপরে নীলকণ্ঠ শিব এবং তাঁর মানসজাত কন্যা মনসা।

পূর্ববঙ্গ নিবাসী অনন্ত দাস, চন্দ্রনাথ দাসের উত্তরাধিকার পেরিয়ে আজকে পঞ্চাশোর্ধ্ব অরূপ দাস সম্পূর্ণ একার দক্ষতায় শোলা ও থার্মোকল কেটে ম্যাড় বানানোর কাজটি করেন। রং-তুলির সাহায্য নিয়ে এই হারিয়ে যাওয়া শিল্প একদিনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর হাতে। দ্রুত হাতে শেষ পর্যায়ের তুলির টান দিতে দিতে লোকশিল্পী অরূপ দাস বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের রাজশাহী জেলার আড়ানি গ্রাম থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন এখানে। তাঁরা প্রত্যেকে এই ম্যাড় পূজা ও ম্যাড় বানানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঘট স্থাপন করে মনসা পূজার পাশাপাশি রয়ানি গান হয় নয় দিন ধরে। নবরাত্রির মাধ্যমে নিষ্ঠা সহকারে এই মনসা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের বাড়ির প্রায় ১০০ বছরের ঐতিহ্য মেনে আমার বাবা বা ঠাকুরদা যেভাবে ম্যাড় বানাতেন, আমি চেষ্টা করেছি তাতে সামান্য পরিবর্তন আনতে। যেমন তারা মনসামঙ্গলের চরিত্রগুলিকে আঁকতেন পাশের দিকে মুখ করে, আমি সরাসরি পূর্ণাবয়ব আঁকার দিকে জোর দিয়ে থাকি। তবে মনসামঙ্গলের গল্পটি ধরে রাখার কৌশল একেবারে ঐতিহ্য মেনেই হয়। আগে রায়গঞ্জ-সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে ম্যাড় বানানোর বরাত পেতাম। শোলার দাম এবং অন্যান্য কারণে এখন সেই চাহিদা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’

অরূপবাবুর কথার সূত্রেই জানা যায়, এক সময় পুরাতন মালদার প্রচুর বাড়িতে তিথি মেনে ম্যাড় পূজা মনসা পূজা হিসাবে পালিত হত। এখন সংখ্যাটা ক্রমশ কমে আসছে।

গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার হালদার তাঁর শৈশব থেকে পুরাতন মালদার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিথি মেনে নবাবগঞ্জ থেকে আরম্ভ করে চৌরঙ্গী মোড় মঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জায়গার নানা বাড়িতে ম্যাড় পূজা পালিত হত। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও এই পূজা হতে দেখেছি। লোকসংস্কৃতির ধারা মেনে পুরাতন মালদার ম্যাড় পূজার ঐতিহ্য অবশ্যই সংরক্ষিত হওয়া দরকার।’

গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাস বলেন, ‘‘জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গলের যে অংশটিতে জালু মালুর আখ্যান আছে, লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞান ও নৃতাত্ত্বিক সূত্র ধরে প্রমাণ করে দেওয়া যায়, পুরাতন মালদার হালদার পদবিধারী মৎস্যজীবীদের একটা বড় অংশ তাদের উত্তরাধিকার বহন করছেন। জগজ্জীবনের সাধনপীঠ হিসাবেও বেহুলা নদীর তীরবর্তী একটি অংশকে আবছাভাবে চিহ্নিত করেছিলেন আচার্য সুকুমার সেন। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছিলেন সংস্কৃত ‘মঠ’ থেকে প্রাকৃত ‘মটঠ’, তা থেকে অপভ্রংশ হয়ে ‘ম্যাড়’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। শুধু পুরাতন মালদায় নয়, সমগ্র গৌড়বঙ্গের ম্যাড় পূজা প্রাচীন মনসা সংস্কৃতির একটি আবহমান ধারাকেই ধরে রেখেছে।’’

২০০৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত অভিজিৎ সেনের উপন্যাস ‘বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর’-এ গৌড়বঙ্গের ম্যাড় পূজার উল্লেখ আছে। এখানে আছে শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসাপূজা উপলক্ষে নারী পুরুষ দুই ভক্ত্যা বিচিত্র সুরে ‘আরে বালী তোর বদন দেখিয়া প্রাণ যায়রে’ ধুয়া অবলম্বন করে এক গভীর বিষাদ আশ্রয়ী গান গাইতে গাইতে আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা, রোগ-শোক থেকে মুক্তি, পরমায়ু বৃদ্ধি ও মঙ্গলের অঙ্গীকার প্রার্থনা করছে। সময় এগোয়— সবকিছু হারিয়ে যাওয়ার ফাঁকে অরূপ দাসের মত লোকশিল্পীদের হাত ধরে লোক ঐতিহ্য ও আধুনিকতা এক সুরে বাঁধা পড়তে থাকে।

চিত্র: লেখক
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সোমেন চন্দ: এক বহ্নিময় কথাকার

মাত্র সতের বছর বয়সে তিনি একটি উপন্যাস রচনায় হাত দিয়েছিলেন, যদিও তা অসমাপ্ত থাকে। উপন্যাসটির নাম ছিল ‘বন্যা’। পরবর্তীকালে উপন্যাসটি অসমাপ্ত-ই থেকে যায়। আরও দুঃখের বিষয়, এর বৃহদংশ হারিয়েও গেছে। আজ যে সোমেন চন্দের লেখককৃতির জন্য আমরা তাঁকে স্মরণ করি, তা হল তাঁর বেশ কিছু অসামান্য ছোটগল্প। সংখ্যায় খুব বেশি নয়, মাত্র চব্বিশটি। আরও কিছু গল্প লিখলেও তা কালের ধুলোয় হারিয়ে গেছে। গল্পের সংখ্যা সামান্য, তবে অসামান্যতা রয়েছে সেগুলির রচনার পারিপাট্যে, বিষয়বস্তু চয়নে, শিল্পিত প্রকাশে ও লেখনীর মুনশিয়ানায়। এছাড়া তিনি দুটি নাটিকাও লেখেন, ‘বিপ্লব’ ও ‘প্রস্তাবনা’। লেখেন কিছু প্রবন্ধ। তাঁর ছোটগল্পগুলি এতটাই শিল্পোত্তীর্ণ ছিল যে, তাঁর জীবিতকালেই একাধিক ভাষায় তা অনূদিত হয়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »