লোকবিশ্বাস বলে, পুরাতন মালদার বেহুলা নদীতেই ছিল সেই নেতা ধোপানির ঘাট, যেখানে বেহুলাকে সঙ্গে নিয়ে এসে বেঁধেছিল লখিন্দরের কলার ভেলা। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলে, মনসামঙ্গল কাব্যের উত্তরবঙ্গ ধারার প্রধানতম কবি জগজ্জীবন ঘোষালের মন্দির ও সাধনপীঠ আজকের পুরাতন মালদার কোনও একটি অঞ্চলে। এই লোকবিশ্বাস এবং ভক্তিকে অবলম্বন করে আজও পুরাতন মালদার বাচামারি পালপাড়া সংলগ্ন অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী মনসা পূজার রীতি ম্যাড় পূজাকে তিন পুরুষব্যাপী ধরে রেখেছেন বাচামারির অরূপ দাস। অবলুপ্তপ্রায় লোকশিল্পের এই ধারা টিকে আছে তাঁর হাত ধরেই।
‘বাংলা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস’ শীর্ষক আকরগ্রন্থে অধ্যাপক বরুণকুমার চক্রবর্তী পূর্ববঙ্গ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আগত বাসিন্দাদের মাধ্যমে এই বিশেষ ধরনের মনসা পূজার বিস্তার লাভের কথা লিখেছেন। মনসা পূজার যে বিশেষ রূপটিকে ম্যাড় পূজা বলা হয়, তা বছরের যে কোনও সময়ে করা যায়। এমন নয় শ্রাবণ সংক্রান্তি বা নির্দিষ্ট কোনও তিথির দরকার রয়েছে। এই পূজায় আলাদাভাবে মূর্তি তৈরি করা হয় না। স্থাপিত হয় মনসার ঘট এবং তাকে কেন্দ্র করে তিনদিক থেকে মন্দিরের মত শোলা বা হালের থার্মোকলে নির্মিত একটি ঘর তোলা হয়। তার ওপরে রং-তুলিতে ফুটিয়ে তোলা হয় মনসামঙ্গল কাব্যের খণ্ডদৃশ্য। কোথাও সপ্তডিঙ্গা মধুকর নিয়ে বাণিজ্যযাত্রায় চাঁদের ছয় ছেলে, কোথাও চাঁদ সদাগর স্বয়ং, কোথাও সনকা বা নেতা ধোপানি। অবশ্যই সবকিছুর কেন্দ্রস্থলে সতী বেহুলার কোলে শায়িত বিষে জর্জর দেহে লখিন্দর। সকলের মাথার উপরে নীলকণ্ঠ শিব এবং তাঁর মানসজাত কন্যা মনসা।
পূর্ববঙ্গ নিবাসী অনন্ত দাস, চন্দ্রনাথ দাসের উত্তরাধিকার পেরিয়ে আজকে পঞ্চাশোর্ধ্ব অরূপ দাস সম্পূর্ণ একার দক্ষতায় শোলা ও থার্মোকল কেটে ম্যাড় বানানোর কাজটি করেন। রং-তুলির সাহায্য নিয়ে এই হারিয়ে যাওয়া শিল্প একদিনের মধ্যে জীবন্ত হয়ে ওঠে তাঁর হাতে। দ্রুত হাতে শেষ পর্যায়ের তুলির টান দিতে দিতে লোকশিল্পী অরূপ দাস বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের রাজশাহী জেলার আড়ানি গ্রাম থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন এখানে। তাঁরা প্রত্যেকে এই ম্যাড় পূজা ও ম্যাড় বানানোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ঘট স্থাপন করে মনসা পূজার পাশাপাশি রয়ানি গান হয় নয় দিন ধরে। নবরাত্রির মাধ্যমে নিষ্ঠা সহকারে এই মনসা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের বাড়ির প্রায় ১০০ বছরের ঐতিহ্য মেনে আমার বাবা বা ঠাকুরদা যেভাবে ম্যাড় বানাতেন, আমি চেষ্টা করেছি তাতে সামান্য পরিবর্তন আনতে। যেমন তারা মনসামঙ্গলের চরিত্রগুলিকে আঁকতেন পাশের দিকে মুখ করে, আমি সরাসরি পূর্ণাবয়ব আঁকার দিকে জোর দিয়ে থাকি। তবে মনসামঙ্গলের গল্পটি ধরে রাখার কৌশল একেবারে ঐতিহ্য মেনেই হয়। আগে রায়গঞ্জ-সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা থেকে ম্যাড় বানানোর বরাত পেতাম। শোলার দাম এবং অন্যান্য কারণে এখন সেই চাহিদা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’
অরূপবাবুর কথার সূত্রেই জানা যায়, এক সময় পুরাতন মালদার প্রচুর বাড়িতে তিথি মেনে ম্যাড় পূজা মনসা পূজা হিসাবে পালিত হত। এখন সংখ্যাটা ক্রমশ কমে আসছে।
গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার হালদার তাঁর শৈশব থেকে পুরাতন মালদার বাসিন্দা ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে দেখেছি বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিথি মেনে নবাবগঞ্জ থেকে আরম্ভ করে চৌরঙ্গী মোড় মঙ্গলবাড়ি পর্যন্ত বিস্তীর্ণ জায়গার নানা বাড়িতে ম্যাড় পূজা পালিত হত। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও এই পূজা হতে দেখেছি। লোকসংস্কৃতির ধারা মেনে পুরাতন মালদার ম্যাড় পূজার ঐতিহ্য অবশ্যই সংরক্ষিত হওয়া দরকার।’
গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতিবিদ অধ্যাপক অচিন্ত্য বিশ্বাস বলেন, ‘‘জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গলের যে অংশটিতে জালু মালুর আখ্যান আছে, লোকসংস্কৃতি বিজ্ঞান ও নৃতাত্ত্বিক সূত্র ধরে প্রমাণ করে দেওয়া যায়, পুরাতন মালদার হালদার পদবিধারী মৎস্যজীবীদের একটা বড় অংশ তাদের উত্তরাধিকার বহন করছেন। জগজ্জীবনের সাধনপীঠ হিসাবেও বেহুলা নদীর তীরবর্তী একটি অংশকে আবছাভাবে চিহ্নিত করেছিলেন আচার্য সুকুমার সেন। ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছিলেন সংস্কৃত ‘মঠ’ থেকে প্রাকৃত ‘মটঠ’, তা থেকে অপভ্রংশ হয়ে ‘ম্যাড়’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে। শুধু পুরাতন মালদায় নয়, সমগ্র গৌড়বঙ্গের ম্যাড় পূজা প্রাচীন মনসা সংস্কৃতির একটি আবহমান ধারাকেই ধরে রেখেছে।’’
২০০৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত অভিজিৎ সেনের উপন্যাস ‘বিদ্যাধরী ও বিবাগী লখিন্দর’-এ গৌড়বঙ্গের ম্যাড় পূজার উল্লেখ আছে। এখানে আছে শ্রাবণ সংক্রান্তির মনসাপূজা উপলক্ষে নারী পুরুষ দুই ভক্ত্যা বিচিত্র সুরে ‘আরে বালী তোর বদন দেখিয়া প্রাণ যায়রে’ ধুয়া অবলম্বন করে এক গভীর বিষাদ আশ্রয়ী গান গাইতে গাইতে আশা-আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা, রোগ-শোক থেকে মুক্তি, পরমায়ু বৃদ্ধি ও মঙ্গলের অঙ্গীকার প্রার্থনা করছে। সময় এগোয়— সবকিছু হারিয়ে যাওয়ার ফাঁকে অরূপ দাসের মত লোকশিল্পীদের হাত ধরে লোক ঐতিহ্য ও আধুনিকতা এক সুরে বাঁধা পড়তে থাকে।