সময়টা রূপকথার। সেখানে তখনও বারুদের গন্ধ মেশেনি। গাঢ় নীল শিবালিকের কোলের পাশে অনামী এক গ্রাম, পিঠে কুয়াশা মেখে ঘুমিয়ে থাকে। উদার সমৃদ্ধ আকাশ তাকে পাহারা দেয়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পথ বেয়ে নেমে আসে নানা বুনো ফল আর ফুল। কোথাও বেরিয়াঁ, কোথাও ন্যাশপাতি, আবার সুমিষ্ট গ্রুন্নের লাল রসালো স্বাদের ঝোপ। এ সবের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে আপাত ধীরস্রোতা শতদ্রু নদী। তার সবজে জল রোদে চিকচিক করে।
সেই গ্রামটি, এতদিনকার অনামী গ্রাম নাঙ্গল, একটু একটু করে রূপ পাল্টাতে শুরু করল। স্বাধীনতোত্তর উচ্চতম নদী প্রকল্পের ধারা অনুযায়ী ভাখড়া গ্রামে (হিমাচল প্রদেশ ও পাঞ্জাবের সীমান্তে) শতদ্রু নদীকে বাঁধ প্রকল্পের আওতায় আনা হল। শুরু হল ভাখড়া-নাঙ্গল বাঁধ, যা এশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় দীর্ঘতম বাঁধ। আবার এটিই হল ভারতের ‘দি হাইয়েস্ট স্ট্রেইট গ্রাভিটি ড্যাম’। লক্ষ লক্ষ মানুষের দ্বারা তৈরি এ বাঁধ, যা বহুমুখী উদ্দেশ্য নিয়ে গড়া। প্রায় ২০৭.২৬ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট এ বাঁধের ফলে যেমন বিশাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বারা পাঞ্জাব থেকে রাজস্থান অবধি উপকৃত হবে, তেমনই সেচব্যবস্থার আওতায় কয়েকটি রাজ্যও আসবে। তাই তৈরি হল নাঙ্গল টাউনশিপ। জমজমাট একটি শহর।
পাল্টে যেতে থাকল পথঘাট। নানা স্থান থেকে বাঁধ প্রকল্পে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পেশা ও কাজের লোকজনের সমাগম শুরু হল। এ মহাযজ্ঞে জড়িত ছিলেন প্রযুক্তিবিদ, ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি, তেমনই ছিলেন অতি সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষও। তৈরি হল দীর্ঘ বাঁধানো ক্যানাল রাজস্থান অবধি, ফলে গ্রিন রেভুলেশন। তৈরি হল অফিস, আদালত, প্রথম শ্রেণির মত হাসপাতাল (ফ্রি সার্ভিস), সৎলুজ সদনে কাচের ঘর, সারা শহরের জন্য জলের সুব্যবস্থার ট্যাঙ্কি, শিশুদের অতি মনোরম পার্ক। তৈরি হল মেইন মার্কিট, গোল মার্কিট, শর্মা স্টোর, টিপ স্টোর, পোলোরাম কি সরায়। ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ইস্কুল। আরও কত কী! সুপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, অফিসকর্মীদের জন্য গ্রেড অনুযায়ী কোয়ার্টার্স, বাংলো ইত্যাদি হল। আর, আর এই বিশাল প্রকল্পের উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে ‘তালিয়াঁওয়ালি বুঢ্যি’ ওরফে স্বর্ণামাই। যার দু’হাতে দুটো ব্যাগে টিফিন ক্যারিয়ার ভরা।
শহরের গায় যে হালকা কুয়াশার আবরণ ছিল, সেটা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। রুক্ষ অগোছালো পথঘাট চোখ মেলছে। স্বর্ণামাই তার হাঁটার গতি বাড়ানোর চেষ্টা করল। কয়েক পা এগিয়েও গেল, পরক্ষণেই গতি স্লথ হয়ে এল। ফ্যাকাশে ওড়নাটা মাথার পিছন দিকে ফুলে ফুলে উঠছিল। একটু থেমে ব্যাগগুলো হাতবদল করে নিল। বড় রাস্তায় যখন পৌঁছল তখন প্রায় সকাল সাতটা বাজে। একটু পরেই বাঁধের কাজের শ্রমিক, কর্মীদের নিয়ে বাসটা এসে দাঁড়াবে। কিছু মানুষ নামবে, কিছু বাসে উঠে পড়বে। স্বর্ণামাই হাঁপাতে থাকে।
সাদা রঙের বাসটি এসে দাঁড়াল। কে যেন বলে উঠল, ‘ও কিথ্যে র্যহ গয়ী মাই?’
‘হ্যাঁ, সে কোথায়ই বা দাঁড়াবে? বাস ড্রাইভার হরবক্স সিং স্বর্ণামাইয়ের হয়ে বলল। স্বর্ণামাই হাতের টিফিনবাক্সগুলো বাড়িয়ে দিতেই কর্মীরা হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল। আর রাতের ডিউটিতে যারা ছিল, তাদের ফাঁকা টিফিন বাক্সগুলো নিয়ে নিল। হর্ন দিয়ে বাস এগিয়ে গেল। দু’পাশের কচনার ফুলের সাদা গোলাপি পাপড়িগুলো হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল।
স্বর্ণামাইয়ের বয়স ষাটের উপর। রাজপুত রমণী। গ্রাম ছেড়ে এসেছে পেটের দায়ে। শিবালিক পাহাড়ের আড়ালে যে বাঁধ তৈরি হচ্ছে, সেখানে হাজার হাজার মানুষ কাজ করছে। কারও রাতের ডিউটি, কারও বা দিনের। রাতদিন কাজ চলছে, তাই সবাই ঠিকমতো বাড়িও যেতে পারে না। এই বাঁধ তৈরি করতে যতটা অর্থ ও সময় ব্যয় হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানুষের প্রাণ খোওয়া গেছে। তিন-তিনবার এ বাঁধ ভেঙে গেছে, ফলে কর্মরত কত যে প্রাণ ভেসে গিয়েছে শতদ্রুর তীব্র স্রোতে! শ্রমিকরা যেন সব এক একজন সৈনিক! কেউ বলতে পারবে না যে কে কখন হাজার ফুট উপর থেকে নিচের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে, বা কার হাত ভাঙবে, কার বা পা ভাঙবে।
এ সব কবেকার কথা! সময়টা ছয়ের দশকের। বাঁধের কাজও প্রায় শেষের দিকে। তখনও দিনরাত কাজ চলছে। সবাই ব্যস্ত। সকাল সাড়ে সাতটা, দুপুর সাড়ে বারোটা, বিকেল সাড়ে চারটে ভোও বাজলেই স্বর্ণামাইয়ের মত কয়েকজন ছুটতে থাকে। হাতে খাবারের টিফিন বাক্স নিয়ে স্বর্ণামাইও তাই ছোটে, খাবার পৌঁছে দিতে!
‘সি’ ব্লকের গলির মোড়ে ঢুকেই স্বর্ণামাই থমকে গেল। আবার সেই হাততালি। কারা যেন ‘তালিয়াঁওয়ালি বুঢ্যি’ বলে চিৎকার করছে আর হাততালি দিচ্ছে। স্বর্ণা ঘুরে দাঁড়াতেই কিছু কচিকাঁচা হি হি করতে করতে ছুটে পালাল। পাড়ার কিছু লোক স্বর্ণার হয়ে বাচ্চাদের বকুনি দিল, আবার কেউ কেউ মুখটিপে হাসলও। এ নিত্যদিনের ব্যাপার! আসলে, স্বর্ণামাই একদিন বাড়ি ফিরবার পথে শুকনো ডালপালা কুড়াতে কুড়াতে যাচ্ছিল। মনটা বড় বিষন্ন। হঠাৎ কানে এল কারা যেন জোরে জোরে হাতে তালি দিতে দিতে চলেছে। শব্দটা কানে বড় বিরক্তিকর ঠেকেছিল। অসহ্য লাগছিল। তাই হাত তুলে ছেলেগুলোকে বারণ করল। বাচ্চাগুলো প্রথমে থমকে গেল, পরে দৌড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আবার হাততালি দিতে আরম্ভ করল। যেন তারা মজা পেয়ে গেছে। স্বর্ণামাই আবার তাড়া করল হাতে লাঠি নিয়ে। লাঠি দেখেই সব পালিয়ে গেল। পরদিন আবার ওই পথে চলতে গিয়ে টের পেল যে বাচ্চারা ইচ্ছে করে জোরে জোরে হাতে তালি দিচ্ছে। তাদের দলে কিছু নতুন মুখও জুটেছে! সম্ভবত কালকের ছেলেরাই তাদের অন্য সঙ্গীদের এই ‘মজার খেলাটা’ শিখিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে স্বর্ণামাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর তাড়া করল। সেই দিন থেকে গলির বাচ্চারা ওকে দেখলেই ‘তালিয়াঁওয়ালি বুঢ্যি’ বলে হাততালি দেয়।
স্বর্ণামাই কবে থেকেই ছুটছে। রাজপুত স্বর্ণার কখনও কথার খেলাপ হয় না। ঠিক সময়মতই সে কর্মীদের খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। সে আর তার স্বামী অজিত সিং পাশের একটি গ্রাম দুভেট্টায় থাকত। আশপাশের নানা গ্রাম থেকে বাঁধের কাজে বহু লোকজন এসে জুটেছিল। অজিত সিং তাদেরই একজন ছিল। স্বর্ণামাই সারা দিনই খাটত। নিজের জমিতে কাজ করত, গম ও ভুট্টা পেসাই করত আর স্বামী ও ছেলেমেয়েদের যত্নআত্তি করত। তখন সবে বড়মেয়ে পারোর বিয়ে হয়েছে। হঠাৎ একদিন ভরসন্ধ্যায় অজিত কাঁপতে কাঁপতে এসে হাজির। সে রাতেই তার জ্বর এল। ছেলে কিশন তখন সবে আট বছরের। জ্বর ক্রমশ বেড়েই গেল। হাকিম বলল : ভাভিজি, এর উপর ভুতের ভর হয়েছে। শুনে অতিসাহসিনী স্বর্ণার মাথা ঘুরে গিয়েছিল। সে শুনেছিল, যারা বাঁধের কাজে অপমৃত্যু লাভ করেছে, তাদের আত্মারা অন্যদের ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলে। স্বর্ণা তার ইষ্টদেবতার কাছে বারবার মিনতি করা সত্ত্বেও অজিতকে বাঁচাতে পারেনি।
ফিরতিপথে কালো পাথরের এক দেওয়ালের পাশে শ্রান্ত-ক্লান্ত স্বর্ণা বসে পড়ে। সুদূর অতীতের কথা সে মনে করতে চায় না, তবু যখন ক্লান্তিতে অবসন্ন বোধ করে, তখন তার রাজস্থানের পুরনো গ্রামের কথা মনে পড়ে। শৈশবে মাইল দূর থেকে জল আনতে হত। উটের পিঠে চড়ে বাবাকে ভুট্টার রুটি সহ শাক দিতে যেত, সঙ্গে নিয়ে যেত লস্যি। অল্পবয়সেই জগৎ সিংয়ের ছেলে অজিত সিংয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অজিত কিছুটা লেখাপড়া শিখেছিল। তাই সে শহরেই যেতে চাইত। শ্বশুর মারা যাওয়ার পর স্বর্ণার আর গ্রামে থাকা হল না। স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে অজিত গ্রাম ছাড়ল। নানা ধরনের উপার্জন পন্থা ধরে, শেষমেশ তারা দুভেট্টা গ্রামে এসে বাসা বাঁধল। এখানে আসামাত্রই অজিত কাজ পেয়ে গেল। বাঁধেরই কাজ। তবে স্বর্ণার জীবনসংগ্রাম আরও কঠিন হয়ে উঠল, যখন তার স্বামী মারা গেল। পাশে কেউ নেই। বাড়ি বাড়ি কাজ করে এবং আরও এটা-সেটা করে দিনযাপন করতে লাগল। একটু জমি ছিল, সেটাই তখন ভরসা। এরপর অফিসওয়ালাদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার কাজটি পেয়ে গেল। ছেলেকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দিল। ছোটমেয়েকে দু-চার ক্লাস পড়িয়ে সেলাইয়ের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। সেই দুঃসময়েও স্বর্ণা কারও কাছে হাত পাতেনি। যারা ওকে চেনে, তারা জানে যে স্বর্ণার আত্মসম্মানবোধ প্রখর। কারও কাছে তাই মাথা নত করেনি।
ফাঁকা টিফিনবাক্স হাতে ধীরেসুস্থে ‘আর’ ব্লকের পাশ দিয়ে আসতে গিয়ে স্বর্ণা থমকে গেল। মোড়ের ওপাশে ছেলে কিশন বীরাকে নিয়ে যাচ্ছে। স্বর্ণার নাতি বীরা, মানে বীরেন্দর। স্বর্ণা ভাবল— ওরা কোথায় যাচ্ছে! মনটা তার ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। সে তার লাজুক ধরনের ছেলেটিকে দিয়ে কখনও কোনও কাজ করায়নি। দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে ছেলে কিশন কাজ পেয়ে গিয়েছিল, তাই স্বর্ণা আনন্দে তার বিয়েও দিয়েছিল। ভেবেছিল— এবার বুঝি বিশ্রাম পাবে! বাইরে আর কাজ করতে হবে না। কিন্তু সে যা ভেবেছিল তা হয়নি। ছেলের বউ তাকে প্রায় একঘরে করে দিয়েছিল। সে স্বর্ণাকে রান্নাঘরেও ঢুকতে দিত না, পাছে সে খাবারে কিছু মিশিয়ে দেয়। নাতির জন্মের পর স্বর্ণা একেবারে ঘরছাড়া হয়ে গেল। সেদিন স্বর্ণা কেঁদেছিল। এটাই ভাগ্যলিখন বলে মেনেও নিয়েছিল। কোনও আক্ষেপই করেনি। এখন কেউ যদি তাকে দু-দণ্ড কাছে বসিয়ে ভাল-মন্দ জিজ্ঞেস করে, সে রূঢ়ভাবে প্রসঙ্গ শেষ করে দেয় অথবা কোনও উত্তর না দিয়ে সরাসরি উঠে চলে যায়। কেউ তাই তার মনের নাগাল পায় না। ছোটমেয়ে জানকী মাঝে মাঝে বলে বসে— মাইজি, তুঁ থারে সংগ্ কিঁউ না আবে?
মাথায় হাত বুলিয়ে স্বর্ণা বলে— ত্যঁ তাঁ তু জানে এ্যঁ।
হ্যাঁ, তারা জানে যে মা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির জলও বিনা পয়সায় গ্রহণ করবে না। স্বর্ণা সেটাকে পাপ বলে মনে করে। সে না খেয়ে মরে যেতে রাজি কিন্তু মেয়ের বাড়ির অন্নজল খেয়ে নিজের ধর্ম খোয়াতে রাজি নয়।
খালি টিফিনবাক্সটি মালকিনের হাতে দিয়ে দরজার পাশে একটু বসে পড়ল। গৃহকর্ত্রী বলল— মাই, তুই বেশি কাহিল হয়ে পড়েছিস। এই এতটা পথ আসতে-যেতে তোর তো কষ্ট হয়ই, অন্যেরও কষ্ট হয়।
স্বর্ণা কিছু বললে না।
তোর আসলে বিশ্রাম দরকার! ছেলের বউ তো সবারই একটু-আধটু খারাপ হয়ই। দু’দিন পরে ঠিকও হয়ে যায়।
গৃহকর্ত্রীর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু এটুকু বলল— রে ভালমানুষ, তোমার খাবার ভরে রেখো, আমি আসছি—। বলেই স্বর্ণা বাইরে বেরিয়ে এল। ওড়নাটাকে মাথার পরে একটু বেশি টেনে নিল— ‘ঠিক? ও আর ঠিক হবে না। এ তো আমার কিসমত! সে তোমরা কী বুঝবে! বুড়ি হও, ছেলের বউ আসুক, তারপর বুঝবে!’ স্বর্ণা মনে মনে আউড়ে গেল।
ফেরার পথে স্বর্ণামাই গুড্ডির মায়ের কাছে এল। গুড্ডির মা একজন উদার দয়ালু মানুষ। ওকে দেখামাত্রই বলে উঠল— কোথায় ছিলি মাই? আসিসনি যে!
এখানে এলে স্বর্ণার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় ওদের মত হয়ে যায়। ধোওয়ামোছা মেঝের পরে গড়িয়ে পড়ে বলল— কোথায় আর যাব? আসলে সময়ই পাই না।
গুড্ডির মা একগ্লাস জল এগিয়ে দিল। জলের লম্বা গ্লাসটা ধরে স্বর্ণা বলল— একটা কথা শুনতে এলাম, ভালমানুষ। তোর এখানে আমার জন্য একটু জায়গা হবে কি? শুধু মাথা ঠেকাবার একটু জায়গা, আর কিছু নয়—। বলে উৎসুক চোখে তাকিয়ে রইল। গুড্ডির মা আর ‘না’ বলতে পারল না। জিজ্ঞেস করল— কেন রে?
ছেলের কাছে কীসের টানে থাকব? বলতে বলতে স্বর্ণামাই চোখদু’টি জোরে চেপে রাখল।
এতদূর বাড়ি গিয়ে খাবি? গুড্ডির মা বলল। এখানেই খেয়ে নে না!
ক্ষণেকের জন্য স্বর্ণার মন বলল— তৈরি করা খাবার…। কিন্তু পরক্ষণেই উঠে পড়ল। চলে তো আসবই। তা এখন খাওয়া আর তখন খাওয়া একই ব্যাপার। বলেই স্বর্ণা সদর দরজা ঠেলে রাস্তায় বেরিয়ে এল। খানিকটা হাওয়া চোখেমুখে লাগতেই স্বর্ণামাই যেন সোজা হয়ে দাঁড়াল। নাঃ, হাঁটাহাঁটি কমে যাবে! শুধু গিয়ে আমার ক’টা জিনিস নিয়ে আসতে হবে। স্বর্ণা মনে মনে ভাবে— হ্যাঁ চলে আসবে বৈকী! কী দরকার ওদের কাছে থাকবার। ছেলের বউ ভাত দেবে না, ছেলে কথা বলবে না। তাহলে— কী জন্য? কীসের জন্য? কিশন তো কোয়ার্টারে থাকে, গ্রামের বাড়ি শূন্য। যা জমি ছিল, কিশন মানা সত্ত্বেও বিক্রি করে দিয়েছে। তাহলে? স্বর্ণার মাথাটা যেন আরও ঝুঁকে গেল। হাতের বাক্সগুলি ফাঁকা হওয়া সত্ত্বেও কেমন ভারি ঠেকছে! রাস্তা পেরিয়েছে সবে, হঠাৎ শুনতে পেল— ‘তালিয়াঁওয়ালি বুঢ্যি’! ‘তালিয়াঁওয়ালি বুঢ্যি’!
স্বর্ণা দু’চোখ কুঁচকে বলল— ওরে, তোরা কি পাষাণ নাকি! আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই ছেলেগুলো দূরে পালিয়ে গেল। একজন সহৃদয়বান ওদের তাড়া করেছিল। ক্লান্ত পায়ে স্বর্ণা এগিয়ে গেল। লোকটিকে কিছুই বলল না।
বাতাসে গরম হলকাটা আর নেই। কিছুটা ঠান্ডাভাব এসে গেছে। খাবার ভর্তি বাক্সগুলো যার যার হাতে দিতে গিয়ে কানে এল— সৎশ্রী আকাল মাইজি। ড্রাইভার হরবক্সের গলা।
—যুগ যুগ জিয়ো বেটা। স্বর্ণা এটুকুই বলল। আজকাল আর স্বর্ণাকে বেশি বোঝা বইতে হয় না। কয়েকজন ছাড়া এখন আর বাঁধের কাজে ২৪ ঘণ্টার ডিউটি দিতে হয় না যে!
সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে আলো থাকতে থাকতে স্বর্ণা তার ঘুপচি ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে ছেলের ঘরের দিকে একবার তাকাল। কাউকেই দেখতে পেল না। কেউ দেখছে না দেখে যেমন ওর একটা কষ্ট হল, তেমনই একটু নিশ্চিন্ত হল যে কারও মুখোমুখি হতে হল না। চারিদিকে একবার চোখ বোলাল— কোণের পেয়ারা গাছে অনেক পেয়ারা হয়েছে। বাগানে একটা লেবু গাছ আছে। আঙুর গাছটা ঝুলে পড়েছে। আরও কী সব লাগানো আছে। কিশন মাঝে মাঝে জলটল দেয়। আলো ক্রমশ কমে আসতেই লাইটপোস্টে আলো জ্বলে উঠল। স্বর্ণার গমনপথটুকু কিছুটা যেন আলোকিত করে দিতে চাইছে। সবে সে সেই পথ ছেড়ে পথে পা বাড়িয়েছে, একটা ছায়া তার সামনে এসে দাঁড়াল। স্বর্ণামাই তাতে চমকালো না কিন্তু যখন ছায়াটা ধীরে ডাকল— মা, মাই! স্বর্ণা ভুত দেখার মত চমকে পিছনে সরে গেল— কি—কিশন— তুঁ—তুই! স্বর্ণার স্বর যেন আটকে গেল। মনে হল তার শ্বাস বন্ধ হয়ে গেছে। ছায়াটা বলল— মা, তুমি চলে যাচ্ছ? তোমার অধম, অকৃতজ্ঞ ছেলের কাছ থেকে, যে তোমাকে শুধু কষ্টই দিল! কিন্তু…।
কিশনের গলা কেঁপে গেল। স্বর্ণামাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল— না রে! আমার কোনও কষ্ট হবে না। আমি তোর উপর রাগ করিনি। তুই ভাল থাকলে, আমিও ভাল থাকব।
কিশন যেন আশ্বস্ত হল। পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে স্বর্ণার হাতে ধরে রাখা বোঁচকাটির পরে রেখে বলল— মা, এটা তুমি রাখো। তোমার কাজে লাগবে। আমি— আমি এখন যাই।
বলেই কিশন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। স্বর্ণা যেন কিছু বুঝতে পারল না। সামনের দিকে চেয়েই রইল। এটা স্বপ্ন, না সত্যি! ভাবতে চেষ্টা করল। নোটটা মনে হল একখণ্ড আগুনের দলা। অভিমানে গলা বুজে এল। তারপর ধীরে ধীরে পা বাড়াল। অভিমানে, কষ্টে চোখের জল বাঁধ মানছিল না। ওর ডাক, ওর কথা সারা রাত কানের কাছে বেজেই চলেছিল।
দিন বয়ে চলেছে। স্বর্ণামাই এখন সত্তর পেরিয়ে গেছে। শরীরে জোর না থাকলেও মনের জোরেই চলে। স্বর্ণামাই কাজের অযোগ্য হয়ে পড়ায় এ কাজ থেকে বাতিল হয়ে গেল। আরও অসহায় হয়ে পড়ল। তবু তার চরিত্রের মধ্যে একটা দৃঢ়তা, একটা জেদ ছিল। কেউ তাকে দুটো খেতে দিলে বা একটু সাহায্য করতে চাইলে, সে রূঢ়ভাবে উপেক্ষা করে। কিন্তু এত শূন্যতার মধ্যেও যখন পথ চলতে চলতে কোনও নাতির সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। তাদের আদর করে, খেতে দেয়, সবার খোঁজখবর নেয়। এখন খাবার সাপ্লাইয়ের কাজটা নেই। তাই কোনওরকমে দিন গুজরান করে। এখন ক্লান্তি আর অবসাদ চেপে ধরে। নিজের কোঁচকানো আলগা চামড়াকে লক্ষ করতে করতে হঠাৎ ওর মনে পড়ল— একবার বাজারে এক স্বাস্থ্যবতী মহিলাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল, আর ভাবছিল— আহা, আমিও যদি ধনী হতাম, তাহলে এইরকম মোটা হতাম। সেদিন সে এক স্বভাববিরুদ্ধ কাজ করেছিল। ওই মহিলাকে দেখতে গিয়ে সময় নষ্ট করেছিল। হঠাৎ স্বর্ণার কানে কিছু কথা ভেসে আসে— চিরকালের জন্য?
—এতদিন তো কাটাল!
—ওসব বলতে নেই!
—তুমি ওসব রাখো তো! ও মরেটরে গেলে, তারপর?
বুড়ি স্বর্ণা হঠাৎ সচকিত হয়ে উঠল; যেন প্রতিটি শব্দের অর্থ ধরার চেষ্টা করতে লাগল। স্বর্ণামাই বুঝি বা সব বুঝতে পারল।
গুড্ডির মায়ের বয়স হয়েছে। তারও নানা ঝামেলা। ছেলেরা যার যার মত কাজকম্ম করে। স্বামী রিটায়ার করেছে, অথচ মেয়েটির এখনও বিয়ে দিতে পারেনি। তাই তার পক্ষে সব দিক বজায় না রাখলেই নয়। তবু সেদিন ঘুম থেকে উঠে স্বর্ণামাইকে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে দরজার পাশে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেল। স্বর্ণামাই মৃদুস্বরে গুড্ডির মাকে বলল— ভালমানুষ, কোনও অপরাধ নিয়ো না। একদিন নিজের ইচ্ছেয় এসেছিলাম। আজ আবার নিজের ইচ্ছেতেই ফিরে যাচ্ছি। বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। গুড্ডির মা কোনও কথাই বলতে পারল না। শুধু বলল— মাই, আবার আসিস!
রিকশায় বসে স্বর্ণা চোখ বন্ধ করে ভাবছিল— তোর কোনও দোষ নেই! এখন বুড়ি হয়েছিস, তাই ছেলেদের কথা শুনতে তো হবেই। রাম তোর মঙ্গল করুন। রিকশাচালক স্বর্ণাকে তার বাড়ির দোরগোড়ায় নামিয়ে চলে গেল। সকালের সরগরম আরম্ভ হয়ে গেছে। তবুও স্বর্ণার মনে হল— বড় নির্জন, বড় স্তব্ধতা! মনে মনে ভাবে— আজ অনেকদিন পর কিশন আমায় দেখে আর থাকতে পারবে না, ঠিক ছুটে আসবে। এখনও হয়তো ও ঘুমিয়ে আছে। তাই বা কেন, ও তো কাজে চলে গেছে। স্বর্ণামাই নিজের পরিত্যক্ত ঘরটির সামনে এসে থমকে দাঁড়ায়। একটা ঘুপচি ঘর। আজ সেখানে বসে থাকতে থাকতে স্বর্ণার মনে হল— সে অযথাই কিশনের অপেক্ষা করছে। অথচ প্রতিক্ষণেই মনে হচ্ছে— এই বুঝি কেউ ‘মা’ বলে ডেকে উঠবে! স্বর্ণা সামনের দিকে চেয়েই রইল। তবু কেন কেউ দেখছে না! একটু পরেই এক অপরিচিত লোককে আসতে দেখল। চমকে উঠল। আরও চমকে উঠল, যখন শুনল, কিশন সিং বছরখানেক আগে অন্যত্র চলে গেছে। কোথা? তারা জানে না। হঠাৎই স্বর্ণার মনে হল— কিশন নামের কেউ নেই! ও একটা কল্পিত নাম— একটা স্বপ্ন। স্বপ্ন কি কখনও সত্যি হয়?
স্বর্ণামাইকে যারা চিনত বা প্রতিদিন দেখত, তারা তার সততা আর নিরলস পরিশ্রমের কথা বলত। তার পরবর্তী জীবনের কথাও বলত। তারপর আস্তে আস্তে সবাই ভুলেও গেল। বাঁধের কাজ সম্পূর্ণ প্রায়। শহরে নতুন নতুন আবাসন, রাস্তাঘাট সব আধুনিক ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে। পুরনো কর্মীরা হয় অবসর নিয়েছে, নয়তো বদলি হয়েছে। নতুন নতুন সব ওয়ার্কাররা এ শহরের আদিকথা জানে না। শহরের ইটমাটিকে চেনে না। ওরা সাজানো শহরকেই দেখছে। কারা সাজিয়েছে, কীভাবে সাজিয়েছে, জানে না। বাঁধের কারণে শত শত মানুষ বেঁচে আছে। তাতে স্বর্ণামাইয়ের মত কিছু প্রাণ উৎসর্গ হয়েছে মাত্র।
এর দিনকয়েক পরে শোনা গেল স্বর্ণামাই তার পুরনো আস্তানায় ফিরে কাউকে না দেখতে পেয়ে তার গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছে। একাকী, অনাহারে, অনাদরে একেবারে কাহিল হয়ে পড়েছিল। প্রতিবেশী এক মহিলা মাঝে মাঝে খোঁজ নিত। সেদিন তার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে বৃদ্ধা ছেলেদের এক রংচটা জামা মাথায় গলায় জড়িয়ে, হাত মুঠো করে কাত হয়ে শুয়ে আছে। যেন শীত করছে। তারপর গ্রামের মোড়লকে নিয়ে প্রতিবেশীরাই এলেন। স্বর্ণামাইয়ের মুঠোয় একটা চেপ্টে যাওয়া দশ টাকার নোট ছিল। জামাটা সম্ভবত ছিল কিশনের।
অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব
আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।
অসাধারণ। মন ছুঁয়ে গেল।?