আসলে কোনও গল্পই তো শেষ হয় না, তাই শুরু করে কী লাভ? অবশ্য এসব চিন্তাভাবনারও কোনও মানে হয় না। কারণ চেয়ে বা না-চেয়েও আমরা সবাই একটা-না-একটা গল্পের মধ্যে ঢুকে পড়ি।
ওই যে আনন্দ, আপনারা ওকে চেনেন। শিক্ষিত এবং কালচার ফ্যামিলি। ও বিয়ে করেছে আনন্দীকে। ভালবাসার বিয়ে। আনন্দীও যথেষ্ট পরিশীলিত পরিবারের মেয়ে। শিক্ষিতা এবং চমৎকার চমৎকার রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়।
আনন্দ একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। ইংরেজি সাহিত্য। আনন্দী একটা কলেজের ফিজিক্সের অধ্যাপিকা। সাদাকালো আমলের তনুজার মত মুখশ্রী।
নিরিবিলি যোধপুর পার্কের একটা ধুমধাড়াক্কা ফ্ল্যাট। যেমন হওয়ার কথা। দুপাশে জীবনের রঙিন মেলা। তার মাঝখান দিয়ে যেন এক দুরন্ত অশ্বমেধের বৈবাহিক ঘোড়া।
কিন্তু সব উৎসবেরই দু-একটা আলগা মুহূর্ত থাকে। দু-একটা আলগা ছিটকিনি। তার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে এক পণ্ড হাওয়া। কখনও অফ পিরিয়ডে, কখনও মাঝরাতে আদর শেষ হয়ে যাওয়ার পর ক্লান্তি নামে যখন, কখনও ডাইনিং টেবিলে বিরিয়ানি আর চিলি চিকেনের ফাঁক দিয়ে। একটা আপুদে হাওয়া। তরবারির মত মাথার ভিতরে ঢুকে চুরি করে নিয়ে যায় সব গঠনমূলক পরিকল্পনা, উন্নততর আগামীদিনের ছক, এই সোনার খাঁচার আঠা। সেইসব শূন্যস্থানে রেখে যায় একটা কথা— ‘দিনের-পর-দিন দুর্ভিক্ষে পিকনিক করতে লজ্জা করে না?’
খানিকটা আলগা হয়ে আসে বাঁধন, দুজনেই কখনও কখনও তাকিয়ে থাকে পরস্পরের দিকে, কিন্তু দেখে না। বাইরে মেঘ ডাকে, বৃষ্টি নামার আগে ছাদ থেকে জামা-কাপড় নামিয়ে নিয়ে আসতে ভুল হয়ে যায়— ‘ধ্যাত্তেরি…’।
আচ্ছা দাঁড়ান, গল্পটা যদি এইভাবে শুরু করি— একটা ছেলের কৈশোর থেকেই সেই দুর্ভিক্ষ ইশারা-ইঙ্গিত করত। ডাকত। ছেলেটা তখন থেকেই মনে মনে সাড়া দিত— যাই—
তাদের নিভন্ত বাড়িতে অসুস্থ বাবা-মায়ের ঘোলাটে চোখ আর অনেকগুলো ভাইবোনের পেটভরা খিদে একটা ছোট্ট সম্বল নিয়ে টিকে ছিল। সে। হ্যাঁ, সে।
কিন্তু জানালা দিয়ে বারবার বাইরেটা ঢুকে পড়ত। ঢাকা পড়ে যেত বিএসসি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, সামনে মাস্টার ডিগ্রির আলোকিত হাতছানি, দুরন্ত কেরিয়ারের নিভৃত ইশারা-ইঙ্গিত— ‘আমাকে নাও! তৃপ্ত হও!’
ঢাকা পড়ে যেত দু’জোড়া ঘোলাটে চোখ, দুপুরবেলায় আলো-মরে-আসা কয়েকটা পাকস্থলী।
অনেক বড় আলপনা এঁকে দেবে বলে নিজের ছোট্ট আলপনাটা মুছে ফেলল। কষ্ট হয়েছিল। কষ্ট সয়েছিল। জানালা দিয়ে অন্ধকার ঢুকে তাকে নিয়ে গেল বৃহত্তর বাড়িতে। যেখানে উপোসী লাশের ওপর অশালীন নৃত্য। অত্যাচারে আটখানা দেহের অংশ নিয়ে হায়না-শকুনের কাড়াকাড়ি। যেখানে রক্তমাখা ভাত। মানে ভাতের স্বপ্ন আর জাগরণের রক্ত। মৃত্যু-উপত্যকার হিম। মরুণে হাওয়া। লোভী অন্ধকার। ফুল নেই আলপনা নেই। দু’রকম দুর্ভিক্ষ। ভাতের। মনুষ্যত্বের।
সে নিজেকে ছুড়ে দিয়েছিল সেই মৃত্যুময় হিমে। নিজের শিকল ছিঁড়ে। ফুলের ইশারায়। অন্ধকার ফাটানো আলো-আলপনার ডাকে। দুর্ভিক্ষের দু’রকম মোচনে।
পচন ধরে গিয়েছিল লাশে। মানে শরীর থেকে দেহ হয়ে যাওয়ার পাঁচ দিন পরে, যখন খুঁজে পাওয়া গেল মায়ের মত ছায়ায় ঢাকা এক অরণ্যের গভীর কোলে। ওর নাম আপনারা ঝড়, বৃষ্টি, ত্যাগ যা খুশি রাখতে পারেন।
না না এসব অসমাপ্ত গল্পের আর কোনও রোমাঞ্চ নেই। মুখে মুখে ফেরে। শেষ না-হওয়া সব আধখানা, পৌনে একখানা করে গল্প। কী লাভ?
আচ্ছা এটাই লাস্ট, আর একবার দেখব। তবে এটাই লাস্ট। যদি কোথাও পৌঁছাতে না পারি, গল্প একটা ফালতু জিনিস বলে ছাতার ব্যবসা করব।
ছেলেটা অলৌকিক দুটো দশকের গল্প শুনেছে বড়দের কাছে। পঞ্চাশের দশক আর ষাটের দশক। অভাব ছিল, অভাব ছিল, কিন্তু ছেঁড়া পায়জামা আর কোঁচকানো শার্ট উপচে-পড়া এক শুক্লপক্ষের হাসি ছিল। এক আশ্চর্য সম্পদের সন্ধান পেয়ে যাওয়া হাসি। সে হাসি আসত দুটো সোনায় মোড়া সাংস্কৃতিক দশক নিঙড়ে। গান কবিতা নাটকের কখনও ঝোড়ো কখনও মিঠে হাওয়া এসে পাকস্থলীর যে জায়গাটা শূন্য থাকত তাকে ভরিয়ে দিত।
আমাদের গল্পের এই ছেলেটা সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে জন্মেছে। দশ-বারো বছর বয়সে সে শুনেছে কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের কথাও। আমাদের গল্পের এই ছেলেটার শৈশবের একান্নবর্তী পরিবারের একটা বন্ধ না-হওয়া হাঁ-মুখো অভাব ছিল। কিন্তু বিপ্লবের ক্ষমতা ছিল না।
সে তার কুড়ি-বাইশ বছর বয়সে এসে দেখল— পৃথিবীটা আস্তে আস্তে কারখানা হয়ে যাচ্ছে। ধাতব শব্দ ক্রমশ বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠছে রুক্ষতা হিংস্রতা কর্কশ সব শব্দের আমদানি, প্রফিট আর লস-সর্বস্ব হিসেব। বোধহীন গতি ও আত্মসর্বস্ব ওভারটেক। ভরা পাকস্থলীর মানুষগুলো কেমন অতৃপ্ত খিটখিটে মারমুখো নিরানন্দ।
আর এই আনন্দহীন সময় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য কিছু নিকৃষ্ট ফুর্তি। তার মধ্যে সবচেয়ে মুখরোচক ধর্ষণ। আবার পরিচয় হবার দিন সাতেকের মধ্যেই মেয়েটা, ছেলেটার সঙ্গে বিছানায় যাবার জন্য চনমন করছে। পোশাকে আমন্ত্রণের ভাষা স্পষ্ট।
আমাদের গল্পের ছেলেটা টের পায় অভুক্ত হৃদয়ের বিষে-ভরা পাকস্থলী। সে মনে মনে স্মরণ করে দুটো অলৌকিক দশককে। কিন্তু পুনরাবৃত্তি চলবে না। নতুন কিছু দিতে হবে। যা সস্তা নয়, কিন্তু সহজ। অথচ গভীর। কিন্তু সময় সিংহের মত কেশর ফোলাচ্ছে। রাগে। আড়ালে।
তার গতিপথকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে নাকি কেউ? চেয়েছিল। সময়ের নিরাপদ এবং স্রোতের অনুকূলে আবর্জনার মত ভেসে না গিয়ে, স্রোতের বিপরীতে মাছ যেভাবে ডিম পাড়ে, প্রাণের সঞ্চার ঘটে, অনুভবের জন্ম হয়, এক মরা গ্রহ জীবন্ত হয়ে ওঠে— ঠিক সেইভাবে সে চেয়েছিল।
যখন মানুষ তালবেতাল দৌড়চ্ছে, কাউকে ফেলে দিয়ে অথবা নিজে পড়ে গিয়ে, তারপর আবার উঠে, কী পেতে চায়, কী পেলে শান্তি আসবে, সে খানিকটা জুড়োবে, তার সঠিক ধারণায় না পৌঁছে না-জানা জিনিসটার কাছে পৌঁছতে চাইছে পাগলের মত— ঠিক তখনই সে শুরু করল। অলক্ষ্যে এক হতচকিত সিংহ মুহুর্মুহু লেজের ঝাপটা মারছে মাটিতে। আর সে মঞ্চে উঠে পড়েছে। কোনও মেকআপ নেই। মিউজিক নেই। একটা অতি সাধারণ জামা প্যান্ট। ইস্ত্রিহীন। কোনও আলোর খেলা নেই। শুধু একটা মেড়া মাইক্রোফোন আর সে। বলে যাচ্ছে— সেইসব অঙ্গীকার। বহু বছরের নিদ্রাহীন অপেক্ষায় যারা আজও বসে আছে, ভুলে গেছে, ফিরে গেছে। শুধু গলার কাছে আটকে আছে ঝুপসি দুপুর ছাদ। জ্ঞানী হিজল গাছ। ঠ্যাংখোঁড়া সেই শালিক। টিভি এরিয়াল।
অলক্ষ্য থেকে লাফ দেওয়ার আগের মুহূর্তে গুঁড়ি মারছে সিংহ।
হারিয়ে গেছে কথা। আকাশ ভাসে মেঘে। ছায়ায় মেঠোপথ। অনেক দিনের আগে একটা হিংস্র আবেগহীন লাফ। বাতাস চিরে সিংহটা উড়ে আসছে।
হারিয়ে গেছে ভাষা। একটি সবুজ মাঠ। দুইটি হৃদয় জুড়ে। গান বেঁধেছে কারা? শব্দহীন সুরে। মাঠের মতো হৃদয়। তোমার চোখের অঙ্গীকারে।
দর্শকেরা ফিরে যাচ্ছে উজানে। স্তিমিত হচ্ছে কামের উন্মত্ততা। লাভ-ক্ষতির এক অন্যরকমের অংক কষা হচ্ছে। মরে আসছে নির্বোধ গতি। হিংস্রতায় জং ধরছে। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান কারখানা একটু থমকে গেল কি?
সিংহটা লাফ দিয়ে পড়ল ছেলেটার ওপর। ছেলেটা লড়েছিল। দুজনে অনেকক্ষণ ওলট-পালট খেলো পৃথিবীর মাটিতে। ছেলেটা টিপে ধরেছে সিংহের গলা। সিংহ উপর্যূপরি থাবা মারছে ছেলেটার বুকে গলায় মুখে মাথায় চোখে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জারুল গাছ, হৃদয় জোড়া মাঠ, সহজ সরল সাদাকালো সব দিনের এরিয়াল। শব্দহীন অঙ্গীকার— সব।
সিংহটার তেমন দোষ ছিল না। একটা জবরদস্ত কারখানা। সেখানে প্রজাপতি উড়বে, পাখি ডাকবে, রোলার-এর গা দিয়ে মাধবীলতা উঠবে, চ্যাংড়ামি?
ছেলেটা এখন পঞ্চাশের আশপাশে। সিংহের থাবায় চোখদুটো নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তার চেয়েও কি একটা বড় জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে— এক তুঙ্গতম আকাঙ্ক্ষা। ভাল কথা! ছেলেটার নাম তো আকাঙ্ক্ষা দেওয়া যেতে পারে? খারাপ হবে? থাক ওটাই থাক।
কিন্তু গেরো দেখেছেন? এ গল্পটাও প্রতিবন্ধী। বলেছিলাম না? গল্প শেষ হয় না। সব অসমাপ্ত।
আমি পেন-ফেন বন্ধ করে কাগজ-টাগজ সরিয়ে রেখে রোজকার মতই গভীর রাতে শুয়ে পড়েছি। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম পৃথিবীর অস্বস্তি। তার অহংকারী মুকুটে এক করুণ ফাটল। মাথাটা অল্প নোয়ানো। বুকপকেটে রাখা দৃপ্ত হাসিটা তাকে তার মেকআপ থেকে আলাদা করে দিয়ে চলে গেছে। ওই রাজপোশাক যেন তার নয়। শরীরে আছে, আত্মায় নেই। ত্রয়োদশীর চাঁদ, এ মধ্যযাম, কুণ্ঠিত হাওয়া, পাখিদের ঘর ভেজানো শিশির, আকাশ থেকে গড়িয়ে আসা নৈঃশব্দ্য— এইসব, মঞ্চের এই সব কিছু— ধার করা। দেনা।
যখন অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ থেকে একে একে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল আনন্দ ভালবাসা উদাসীনতা শহর ত্যাগ আকাঙ্ক্ষা বৃষ্টি— সব অসমাপ্ত মানুষ, মানুষেরা যেমন হয়— একসঙ্গে যখন প্রশ্ন করল পৃথিবীকে— ‘আমাদের বাদ দিলে তোমার ওসব অলংকার কি আবর্জনা নয়? আমাদের প্রত্যেকের অসম্পূর্ণতাই কি তোমাকে সম্পূর্ণ করেনি? চুপ করে আছ কেন? বলো?’
দেনাদার ধরিত্রী তীব্র অস্থিরতার মধ্যেও হঠাৎ চুপ করে কেমন একধারা হাসল। সে হাসি ছড়িয়ে গেল প্রতিটা অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহের কোণে কোণে। প্রতিটা চেয়ারের চেয়ারে।
বহুদিন পর আজ আমার গভীর ঘুম হল।
এই নির্মাণের শব্দ -স্থপতিকে প্রণাম। অন্যত্র বিশদ আলোচনার ইচ্ছা রইল।