আজ এমন এক মানবীর কাহিনি বর্ণনা করব, যাঁর প্রাজ্ঞ কথাভাষ্য জনমানসে আলোড়ন ফেলায় চিরদিনের মত তাঁর কণ্ঠরোধ করে দেওয়ার শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু সত্যিই কি প্রতিভাকে এভাবে দমিয়ে রাখা যায়? উত্তরটা দিয়েছে সময়। না দমিয়ে রাখা যায় না, সেই কারণেই জিভ কেটে নেওয়ার পরেও খনার বচনকে ছড়িয়ে পড়া থেকে আটকানো যায়নি। আসলে খনা এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতেন, যা হুবহু ফলে যেত। বাঙালি লোকসংস্কৃতিতে এখনও তাই অমৃতবাণীর মত খনার বচনের প্রচলন রয়েছে।
এবার আসি কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া খনার ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে। খনার ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কারও কাছে খনা সিংহলীয় বা কারও কাছে বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপাবাসী, আবার কারও কাছে তিনি ওড়িশার লীলাবতী। খনাকে নিয়ে একাধিক ভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে। এর কোনটা সঠিক, সেটা বলা প্রায় অসাধ্য। আসলে খনাকে নিয়ে তেমন ঐতিহাসিক কোনও প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। লোকমুখে প্রচারিত বিশেষ করে সেই সময়ের বহুল সমাদৃত কথকরাই মূলত খনার বচনকে লোকমুখে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
তবে খনাকে আমরা প্রাচীন বিদূষী, বাঙালি নারীরূপেই বুঝি। যিনি ছিলেন একাধারে জ্যোর্তির্বিদ, গণিতজ্ঞ এবং কবি। বাংলা অঞ্চলে কথিত আছে, শুভক্ষণে জন্মগ্রহণ করার কারণে তাঁর নাম ‘ক্ষণা’ বা ‘খনা’। আবার ওড়িয়া ভাষায় ‘খন’ বা ‘খোনা’ শব্দের অর্থ বোবা। ওড়িশায় প্রচলিত আছে, মিহির তাঁর স্ত্রী লীলাবতীর জিভ কেটে দেন বলে তাঁর (লীলাবতীর) নাম হয় ‘খোনা’। আবার অনেক পণ্ডিত মনে করেন ‘খনার বচন’ যেহেতু আবহাওয়া, দিনক্ষণ, তিথিনক্ষত্রের সঙ্গে জড়িত, তাই ‘ক্ষণ’ থেকে ‘খন’ হয়ে ‘খনা’ নামটির উৎপত্তি।
খনার সম্বন্ধে কোনও লিখিত ইতিহাস না থাকায় জোরালোভাবে বলা যায় না যে, ‘খনার বচন’ খনা নামের কোনও বিদূষী নারীর রচিত লোকশাস্ত্র। তবু খনার সম্বন্ধে আমাদের অনুসন্ধান যেহেতু ‘খনার বচন’-কে কেন্দ্র করে, তাই খনার ইতিহাস খোঁজার প্রধান সূত্র হওয়া উচিত ‘খনার বচন’। কিন্তু খনা সম্পর্কে জনশ্রুতির এত ব্যাপক প্রসার, যা খনা সম্পর্কে সঠিক তথ্য অনুসন্ধানে যতটা সহায়তা করে আবার ঠিক ততটাই অসহযোগী হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। তাই বিভিন্ন কিংবদন্তিকে পাশে নিয়ে ‘খনার বচন’-কে কেন্দ্র করে, সঙ্গে বাংলার ইতিহাসকে পথপ্রদর্শক করে খনার প্রকৃত ইতিহাস অনুসন্ধান করাই বোধহয় সমীচীন।
প্রথমে খনার সময়কাল নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। অনুমান করা হয়, খনার সময়কাল ৮০০ থেকে ১১০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। যদিও বরাহ (৫০৫-৫৮৭) যদি খনার শ্বশুর হন, তবে খনার আরও কয়েক শতক আগে জন্ম হওয়া উচিত। কিন্তু এদিকে ‘খনার বচন’-গুলির ভাষা, আঙ্গিক ও বাক্যগঠনের রীতি দেখে ভাষা বিশেষজ্ঞদের মত, ‘বচন’-গুলির প্রাচীনত্ব চার থেকে সাড়ে চারশো বছরের বেশি হবে না। এটা ধরে নিলে, খনার জীবনকাল ৮০০-১১০০-র থেকে আরও কয়েক শতক পরে হওয়ার কথা। তবে এটাও সম্ভব যে, ‘বচন’-গুলির ভাষা কালের নিয়মে পরিবর্তিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে। কারণ সেগুলি শ্রুতিরূপেই প্রচলিত ছিল।
খনার বচনগুলিকে ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, ‘বচন’-গুলি যে সময় রচিত, সে সময় এদেশে কৃষি এবং গো-পালনের সমান গুরুত্ব ছিল। এছাড়াও ‘বচন’-গুলিতে মহিষ এবং মোরগের কথা উল্লেখ নেই। এর দ্বারা মনে করা যেতে পারে, ‘বচন’-গুলি এমন সময় রচিত হয়, যখন মহিষ-মোরগ গৃহপালিত পশু বা প্রাণীরূপে প্রাধান্য লাভ করেনি। তাই অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করেন, ‘খনার বচন’-এর রচনাকাল হয়তো গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে। অর্থাৎ খনার জীবনকাল গুপ্তযুগের, কিংবদন্তি সম্রাট বিক্রমাদিত্যের সমসাময়িক।
খনাকে নিয়ে প্রচলিত সব কিংবদন্তিগুলোকে একটি সাধারণ সুতোয় বাঁধলে বেশ কয়েকটি কাহিনি পাওয়া যায়। প্রথম কাহিনি বা কিংবদন্তিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন রাজ্য অবন্তী নগরের (বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী) রাজার রাজপ্রাসাদের প্রধান জ্যোতির্বিদ বিখ্যাত পণ্ডিত বরাহমিহিরের পুত্র জন্মগ্রহণ করলে, তিনি পুত্রের কোষ্ঠীবিচার করে দেখেন, তাঁর শিশুপুত্রের আয়ু মাত্র এক বছর। বরাহ হতাশ হয়ে পড়েন, পুত্রের চিন্তা সহ্য করতে না পেরে তিনি একটি পাত্রে করে পুত্রকে নদীর স্রোতে ভাসিয়ে দেন।
এর পর শুরু হচ্ছে অপর এক কিংবদন্তি লীলাবতীর কথা। ইতিহাস বলে, বরাহ এবং মিহির একই ব্যক্তি ছিলেন। মিহির দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের কাছ থেকে বরাহ উপাধি পেয়েছিলেন। খনা তাঁর বচনে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর শ্বশুর বরাহ। তবে তিনি নিশ্চয়ই বরাহের পুত্রবধূ। কিন্তু বরাহ বা মিহির বা বরাহমিহির যদি একই ব্যক্তি হন, তবে খনার স্বামী কে? অনেক পণ্ডিতদের মতে, বরাহমিহিরের পুত্রের নাম ‘পরাশর’। ‘পরাশর’-ও ছিলেন একজন জ্যোর্তির্বিদ। তবে কি ‘পরাশর’ ছিলেন খনার স্বামী? এই মত জোরালো হয় এই বিচারে যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার নবরত্নদের মধ্যে বরাহমিহিরকে একজন ব্যক্তিরূপেই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে মিহিরের ‘বরাহ’ হয়ে ওঠার পিছনে একটা গল্প জানা যায়।
সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত-র পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করলে মিহির রাজকুমারের কোষ্ঠীবিচার করে বললেন, তাঁর পুত্র ১৮ বছর বয়সে মারা যাবে। ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হল। আঠেরো বছর বয়স হতেই এক শূকরের মতান্তরে বরাহমূর্তি ভাঙার আঘাতে মৃত্যু হল রাজকুমারের। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মিহিরের এই জ্যোতিষগুণ দেখে তাঁকে মগধের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘বারাহ’ উপাধিতে ভূষিত করলেন।
পণ্ডিত রামপদ ভট্টাচার্য তাঁর খনার বচন বা সরল জ্যোতিষ বচন বইতে ‘খনার জীবনী’ বর্ণনা করেছেন এভাবে: খনার জীবন-কাহিনি সম্বন্ধে অনেক প্রবাদ কাহিনী রহিয়াছে। কেহ কেহ বলেন খনার পিতা ময়দানব, আবার অনেকে বলেন খনা ছিলেন রাজকন্যা। রাক্ষসগণ সেই রাজবংশের প্রায় সকলকেই নিধন করিয়া, রাজকন্যা খনাকেই বাঁচাইয়া রাখিয়াছিল। রাক্ষসগণই মায়াবশে খনাকে লালন-পালন করে এবং তাঁহাকে জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দেয়। তদানীন্তনকালে মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার বরাহ পণ্ডিতেরও একটি পুত্র হয়। বরাহ পণ্ডিত জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী হইয়াও ভ্রমবশত পুত্রের আয়ু শতবর্ষস্থলে দশবর্ষ গণনা করেন। পুত্রের প্রতি বিশেষ মায়া সঞ্জাত হইবার পূর্বে বরাহ পণ্ডিত তত্পুত্র মিহিরকে একটি তাম্রনির্মিত পাত্রে করিয়া সমুদ্রে ভাসাইয়া দিলেন। ঈশ্বরের অপার লীলা। সেই তাম্রপাত্রখানি ভাসিতে ভাসিতে সুদূর সমুদ্রতীরে উপস্থিত হইল। রাক্ষসগণ তাম্রপাত্রস্থিত সন্তানকে নিজেদের আবাসে লইয়া গিয়া খনার সহিত লালন-পালন করিতে লাগিল এবং জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা দিল ও খনার সহিত বিবাহ দিল। রাক্ষসদের আশ্রয় হইতে মিহির ও খনা অনেক পথ ঘুরিয়া উজ্জয়িনী নগরে উপস্থিত হইলেন। বরাহ পণ্ডিত পুত্র ও পুত্রবধূকে পাইয়া আনন্দিত হইলেন। ধীরে ধীরে খনার খ্যাতি চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল। খনা মুখে মুখে যাহা বলিত, তাহাই ধ্রুব সত্য হইতে লাগিল। শেষ পর্যন্ত খনার খ্যাতিতে স্বামী ও শ্বশুরের যশ ম্লান হইল। খনা নিজের স্বামী ও শ্বশুরের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখিবার মানসে নিজের জিহ্বা নিজেই কর্তন করিলেন। এই প্রতিভাসম্পন্না মহিলার আত্মত্যাগ তাঁহাকে আরও মহীয়সী করিল। স্বামী ও শ্বশুরের সম্মান বাঁচিল, কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনেক তথ্য অজ্ঞাত রহিয়া গেল। তবু খনা মুখে মুখে জ্যোতিষশাস্ত্রের সারমর্ম যতটুকু উদ্ঘাটন করিয়াছিলেন, তাহাই মুখে মুখে প্রচারিত হইয়া আজিও খনার বচন নামে প্রসিদ্ধ।
অপর একটি কিংবদন্তি অনুসারে, মহারাজ বিক্রমাদিত্য যখন উজ্জয়িনীর রাজা ছিলেন, তখন মালাবার প্রদেশের চুঙ্গীনামে খণ্ড গ্রামে বিখ্যাত জ্যোতিষাচার্য্য বরাহের ঔরসে শ্রীমতী ধরাদেবীর গর্ভে মিহির জন্মগ্রহণ করেন। পুত্র ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বরাহ গণনা করে দেখেন, তাঁর পুত্রের আয়ু মাত্র এক বৎসর। জ্যোতিষশাস্ত্রে বিচক্ষণ ব্যক্তি বরাহ ভুলবশত পুত্রের আয়ু মাত্র এক বৎসর জানতে পেরে প্রচণ্ডভাবে চিন্তাসাগরে নিমগ্ন হলেন। আবার গণনা করে দেখলেন অবিকল পূর্বের মতো অবস্থা। এবার বরাহ ভাবলেন, এরূপ অল্পায়ুযুক্ত পুত্রকে বৃথাই লালন-পালন করে মায়ামোহে বিজড়িত হয়ে কোনো লাভ নেই। তাই অনেক চিন্তার পর পুত্রের অকালমৃত্যু প্রতিহার করার জন্য সদ্যোজাত শিশুকে একটি তাম্রপাত্রে করে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দিলেন। সেই পাত্রটি জলে ভাসতে ভাসতে এস হাজির হলো একেবারে সিংহলদ্বীপে। পূর্বে এই দেশের নাম ছিল লঙ্কা। পরে আমাদের দেশের সাহসী ও শক্তিমান পুরুষ বিজয়সিংহ লঙ্কা জয় করে তাঁর নামানুসারে এই স্থানের নামকরণ করেন সিংহল। তখন সিংহলের অধিপতি ছিলেন ময়দানব। দুরন্ত রাক্ষসগণ তাঁকে নিধন করে তাঁর একমাত্র গুণবতী ও রূপবতী কন্যাকে জীবিত রেখেছিলেন। তাঁরা জানতেন, অজস্র মায়াজাল এবং জ্যোর্তিবিদ্যা। খনাকে কন্যা হিসেবে লালন-পালন করে তাঁকে জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। খনা ক্রমে রক্ষকুলের অনুকম্পায় জ্যোর্তিবিদ্যায় অশেষ পারদর্শিতা লাভ করে তাঁদের আশ্রয়ে পালিতা হয়ে বড় হতে থাকেন। তাম্রপাত্রটি যখন ভেসে ভেসে সিংহলের সমুদ্র তীরে গিয়ে হাজির হলো তখন খনা কয়েকজন রাক্ষসী রমণীর সঙ্গে সাগরজলে স্নান করতে গিয়েছিলেন। খনা ভাসমান পাত্রে একটি সুন্দর বালককে দেখে তার পরমায়ু গণনা করে দেখেন, এই বালকের আয়ু একশ বছর। ভ্রমবশত তার পিতা বরাহ তাকে পরিত্যাগ করেছেন মাত্র। এবার ভবিষ্যৎ জ্ঞাতা জ্যোতিষী খনাদেবী সেই বালককে নিজ আবাসে নিয়ে গিয়ে পালন করতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে রাক্ষসদের ও খনার আশ্রয়ে থেকে তাঁদের লালন-পালনে মিহির বড় হলো। বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিহিরও রাক্ষসীদের কাছে জ্যোতিষশাস্ত্র শিক্ষা করে ব্যুৎপত্তি লাভ করলেন। তারপর রাক্ষসীগণ মিহিরকে যোগ্য পাত্র স্থির করে তাঁদের সকলের একমাত্র আদরের কন্যা খনাকে বিয়ে দিলেন। এভাবে মিহির ও খনার বাল্যকাল থেকে যৌবনকাল পর্যন্ত রাক্ষসদের আশ্রয়ে অতিবাহিত হলো। কয়েক দিন পরে জ্যোতিষতত্ত্ব মাধ্যমে মিহিরের নিজের পূর্ব বৃত্তান্ত অবগত হয়ে স্বদেশে জন্মভূমিতে ফিরে যাওয়ার জন্য মনে উদ্বেগ দেখা দিতে থাকে। কিন্তু এই বিশাল জলধিবেষ্টিত রাক্ষসদ্বীপ থেকে কেমন করে ফিরবেন তাই নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। স্বামীর বিষণ্নতাভাব দর্শন করে খনা বিচার করে বুঝতে পারলেন, তাঁর স্বামীর মন চেয়েছে স্বীয় মাতৃভূমিতে ফিরে যাবে। তাই সব বিষয় অবগত হয়ে খনা একদিন মিহিরকে ডেকে বললেন— এখন মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত, আমাদের যাত্রা করার শুভ সময়। এ সময় যাত্রা করলে কোনো প্রকার বাধা বিঘ্ন দেখা দেবে না। অতএব আর বিলম্ব না করে বিশেষভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সত্বর গৃহ হতে বহির্গত হওয়া একান্ত কর্তব্য। তারপর সুযোগমতো উভয়ে কয়েকটি জ্যোতিষশাস্ত্র গ্রহণ করে দুজনে গৃহ হতে বহির্গত হলেন। দ্বারে এক রাক্ষস প্রহরী ছিল। সে গিয়ে সিংহলের রাক্ষসপ্রধানকে তাদের বহির্গত বিষয়ে অবগত করাল। রাক্ষসপ্রধান সব কথা শুনে বললেন, তারা মাহেন্দ্রক্ষণে যাত্রা করেছে। সুতরাং, তাদের আর কোনো বিঘ্ন ঘটতে পারে না। তিনিই ভৃত্যকে আদেশ করলেন, উভয়কে সমুদ্রের পরপারে রেখে এসো। তখন মায়াবী রাক্ষস মায়াবলে কাষ্ঠের জলযানে পরপারে অর্থাৎ ভারতের উপকূলে তাঁদের পৌঁছে দিল। এভাবে সুদূর সিংহল থেকে রাক্ষসের কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে ফিরে এসে তাঁরা সোজা চলে গেলেন তাঁদের পিতা বরাহের কাছে। প্রথমে বরাহ তাঁদের কথা বিশ্বাস করতে পারলেন না। কারণ, আবার তিনি গণনা করে দেখলেন, মিহিরের আয়ুষ্কাল মাত্র এক বছর। বরাহের গণনার বিষয় লক্ষ্য করে খনা বললেন:
কিসের তিথি কিসের বার
জন্ম নক্ষত্র কর সার।
কি কর শ্বশুর মতিহীন
পলকে আয়ু বারো দিন
বরাহ খনার জ্যোর্তিবিদ্যার অদ্ভুত ক্ষমতা দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আর কালবিলম্ব না করে বরাহ পুত্র ও গুণবতী বধূমাতাকে সাদরে গৃহে স্থান দিলেন। সেই থেকে খনাদেবী শ্বশুরালয়ে স্বামীসহ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন। এদিকে ক্রমে ক্রমে মিহিরও স্বীয় পিতার ন্যায় মহারাজ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করে জ্যোতির্বিদ্যায় ভাল যশস্বী হয়ে উঠলেন। সভায় তিনি নবরত্নের মধ্যে অন্যতম রত্নরূপে পরিগণিত হলেন। একদা রাজা বিক্রমাদিত্য পণ্ডিতরত্নদের মধ্যে এক প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, আকাশে নক্ষত্র সংখ্যা কত? কোনও পণ্ডিত হিসাব করে কোনও কিছু বলতে সাহস পেলেন না। তখন বরাহ ও মিহির পিতাপুত্র নানা প্রকার গণনা করে যথাযথ উত্তর না দিতে পেরে মহারাজের কাছে মাত্র এক দিনের সময় নিয়ে গৃহে প্রত্যাগত হলেন। তারপর মহাগুণবতী খনা শ্বশুর ও স্বামীর মুখে সমুদয় বৃত্তান্ত অবগত হয়ে অনায়াসে তা গণনা করে বলে দিলেন। মিহির গিয়ে রাজার কাছে সঠিক উত্তর দিতেই রাজা খুশি ও আনন্দিত হলেন। রাজা ক্রমে ক্রমে সন্ধান নিয়ে গুণবতী খনার কাহিনি জানতে পেরে আরও কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে থাকেন বরাহ-মিহিরকে। খনা গৃহে থেকে সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর বলে দিতেন। ক্রমে অল্পকালের মধ্যে খনার যশ ও সৌরভ চারদিকে পরিব্যাপ্ত হল। রাজা বিক্রমাদিত্য সমুদয় বিষয় অবগত হয়ে খনাকে তাঁর সভার জনৈক রত্ন করে রাখবেন বলেই বরাহকে আদেশ করলেন তাঁর পুত্রবধূকে রাজসভায় আনার জন্য। বরাহ ভাবলেন, বাড়ির বউমাকে রাজসভায় থাকতে দেখলে সমাজ মন্দ বলবে ও কলঙ্কে দেশ ভরে যাবে। সুতরাং, খনা সেখানে থাকলেও যাতে কথা না বলতে পারেন, সে জন্য তাঁর জিভ কর্ত্তন করলে ভাল হবে। বরাহ কলঙ্কের ভয়ে ছেলেকে খনার বাকশক্তি লোপ করার জন্য তাঁর জিভ ছেদন করতে আদেশ দিলেন। পিতার নিদারুণ আদেশ শ্রবণ করে মিহির আর স্থির থাকতে পারলেন না। তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। মিহির পিতার আদেশ পালন করতে ইতস্তত করতে লাগলেন। তখন খনা স্বামী ও শ্বশুরের মনের অবস্থা উপলব্ধি করে বললেন, আমার মৃত্যুকাল আসন্ন স্বামী। আপনি আপনার পিতার আদেশ পালন করুন। মিহির ভাবলেন, একদিকে পিতার আদেশ, অপরদিকে পত্নীর অন্তিম অনুরোধ। বেশ তা-ই হোক। ধারালো ছুরি হাতে ধরলেও মিহিরের হাত কাঁপতে থাকে কিন্তু শ্রীহরির নাম নিয়ে উভয়ের আদেশ ও আবেদন রাখতে অনায়াসে খনার জিভ টেনে ছেদন করলেন। কিছুক্ষণ পর প্রকৃতির নিয়মানুসারে খনার পঞ্চভূতের দেহ পঞ্চভূতে মিশে গেল। এখানে খনার জীবন নাটকের যবনিকা পতন ঘটল।
এবার প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক যে, খনা যদি সিংহলের রাজকুমারী হয়ে থাকেন এবং উজ্জয়িনীতে এসে বসতিস্থাপন করেন, তবে বাংলা এবং ওড়িশায় খনার বচনের এত প্রাদুর্ভাব কেন?
মহাবংশ নামক সিংহলি প্রাচীন ঐতিহাসিক গ্রন্থে প্রকাশ, খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে জনৈক বাঙালি রাজপুত্র সিংহলে গিয়ে উপনিবেশ স্থাপন করেন। একটি প্রাচীন সিংহলি পালি গ্রন্থে পাওয়া যায়, লীলাধিপতি অর্থাৎ রাঢ়াধিপতি সিংহবাহুর পুত্র বিজয়সিংহ পিতৃপরিত্যক্ত হয়ে তৎকালীন বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র সিংহলে বাণিজ্য করতে গিয়ে ক্রমে দারুণ প্রতিপত্তিশালী হয়ে সিংহলের অধিপতি হয়ে বসেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ সিংহলে বহু শতাব্দী রাজত্ব করে। অতঃপর গণ-অভ্যুত্থানে এ রাজবংশের অবসান ঘটে। হতে পারে খনা সে বংশেরই দুর্ভাগা রাজকুমারী ছিলেন। এবং সে কারণেই তত্কালীন বাংলাদেশের ভাষা ছিল তার মাতৃভাষা। বাংলা ভাষার সঙ্গে সিংহলি ভাষার মিলও দেখা যায়। সিংহলে বাঙালি রাজবংশটি কতকাল রাজত্ব করেছিল, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না।
তবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের চেয়ে পূর্ব ভারতের সঙ্গেই মগধের ভাষাগত রাজনৈতিক ও কৃষ্টিগত সম্পর্ক বেশি। ফলে খনা তাঁর বচন পাটলিপুত্রে অথবা বাংলাদেশেই লিখুন, ভাষা অভিন্নই হবে। মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় বিবর্তিত রূপই প্রাচীন বাংলা। মাগধী অপভ্রংশের স্থানীয় রূপই ছিল রাঢ়-বরেন্দ্র-সমতট-চট্টলের লোকায়ত ভাষা। আর উজ্জয়িনীতেও খনার পক্ষে তৎকালীন বাংলায় বচন রচনা সম্ভবপর। কারণ কালিদাসের তালিকানুসারে বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার সদস্যসংখ্যা প্রায় অর্ধশত ছিল। যাঁরা বাংলাভাষায় বুৎপত্তি লাভ করেছিলেন। আর গুপ্তবংশ ও কালিদাস বাঙালি হলে উজ্জয়িনীর জ্ঞানচর্চায় বাঙালি প্রভাব থাকা স্বাভাবিক।
অপর এক কিংবদন্তিতে খনার বাসস্থান নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। এই কিংবদন্তিতে খনার জন্মস্থান বারাসতের দেগঙ্গা থানার অন্তর্গত দেউলী গ্রামে। দেউলী আসলে রাজা চন্দ্রকেতুর শাসনকালের একটি গড়। রাজা চন্দ্রকেতুর শাসনকালে এই অঞ্চলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায় তাই ‘দেউলী’ নাম হয়। চন্দ্রকেতুগড়ে এখনও রাজবাড়ির অদূরে একখণ্ড জমিকে ‘বরাহমিহিরের বাস্তু’ নামে লোকে অভিহিত করে থাকেন। এখানেই আছে ‘খনা মিহিরের ঢিবি’। ১৯০৬ সালে প্রকাশিত আর্কেওলজি অব ইন্ডিয়ার রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে, ২৪ পরগনার লোকদের খনার বচন অনুসারে কৃষি পদ্ধতি, গাছ রোপণের ব্যাপকতা এবং বাসস্থান নির্মাণের কৌশল দেখে মনে হয়, খনার বাসস্থান ২৪ পরগনাতেই ছিল। খনার ঢিপি থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা গেছে, এগুলো গুপ্তযুগের। অর্থাৎ খনার জন্মস্থান বারাসতের দেউলী গ্রামেও হতে পারে অথবা সিংহল থেকে খনা-মিহির বাংলাতে প্রথমে এসে এখানে থাকা শুরু করেন, সেটাও হতে পারে।
জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে খনার বিশেষ বিবরণ না পাওয়া গেলেও অনুমিত চতুর্দশ শতকের বাঙালি জ্যোতিষী প্রজাপতি দাসের পঞ্চস্বরা ও ষষ্ঠীদাসের গ্রন্থে খনার বচনের উদ্ধৃতি রয়েছে। সংকলন খণ্ডের ‘জ্যোতিষ ও হোরা শাস্ত্র’ উপাধ্যায় দ্রষ্টব্য। খনার অনুসারী জ্যোতিষী প্রজাপতি দাসের পঞ্চস্বরা বা ‘গ্রন্থ সংগ্রহ’ গ্রন্থটি আনুমানিক চোদ্দো শতকে রচিত হয়েছিল। বইটি রসিক মোহন চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক কলকাতা থেকে ইংরেজ আমলে প্রকাশিত হয়েছিল। এতে প্রচুর খনার বচন, বিশেষত হোরা শাস্ত্রীয় বচনাদি উদ্ধৃত হয়েছিল। এই রচনাগুলো চার ভাগে বিভক্ত। কৃষিকাজের প্রথা, কৃষিকাজ ফলিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান, আবহাওয়া জ্ঞান এবং শস্যের যত্ন সম্পর্কিত উপদেশ।
খনার বচনের প্রকাশিত সংকলনের ভেতর পিএম ভট্টাচার্যের ‘বৃহৎ খনার বচন’ সম্ভবত সর্বপ্রথম এবং ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত মধুসূদন ভট্টাচার্যের ‘খনার বচন’ দ্বিতীয় সংকলন। এর পরেই শ্রী মহেন্দ্রনাথ করের সংগৃহীত ‘সানুবাদ খনার বচন’ প্রকাশিত হয়।
প্রাচীন পুথি বিশেষজ্ঞ নওয়াজ (১৯৮৯) তাঁর ‘খনার বচন, কৃষি ও বাঙালী সংস্কৃতি’ বইতে লিখেছেন, খনা তাঁর কালজয়ী বচনে কৃষিতত্ত্বজ্ঞান সমাজের সম্মুখে বেদবাণীর মতোই উপস্থাপিত করেছেন। এককালে তা অশোকের অনুশাসনের মতো কিংবা চাণক্য-শ্লোকের মতো ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল কি না কে জানে। নচেৎ ভারতবর্ষের সমগ্র পূর্বার্ধে একটি মহিলার কথা জনসাধারণের নিকট এত ব্যাপক ও সুশৃঙ্খলভাবে জানা গেলো কীভাবে? উল্লেখ্য, ডাক ও খনার বচন এককালে গীত হতো এবং জনসমাগমস্থলে খোদাই করে রাখা হতো।
কিন্তু খনার জিভ কেটে নিলেও তার প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার আলোকে সমৃদ্ধ ‘বচন’-গুলিকে রোধ বা ধ্বংস করা যায়নি কারণ জনমানসে তা স্থান পেয়েছে পরম্পরায় উপযুক্ত পথের দিশারীরূপে। খনার বচনের সঙ্গে ভারতের রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং বিহারে প্রচলিত ঘাঘ ও ভাদ্রির মিল রয়েছে। পাশাপাশি ভারতের বিহার, পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত ডাকের বচনের সঙ্গেও এর মিল রয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বিষয়টিকে গুরুত্বের চোখে না দেখলেও খনার বচন তার অবশ্যম্ভাব্যতা থেকে কক্ষচ্যুত হয়নি।
আশুতোষ দেবের বাংলা অভিধানের পরিশিষ্টে প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহে কিছু খনার বচনও স্থান পেয়েছে। কিন্তু এসব বচনের কৃষিমূলক অর্থ বদলে সেখানে একটি প্রবাদমূলক অর্থ দাঁড় করানো হয়েছে। যেমন কুয়ো হয় আমের ভয়, তাল-তেঁতুলের কিবা হয়। এই খনার বচনের মানে কুয়াশায় আমের বোল ঝরে পড়ে ও আমের ক্ষতি হয় কিন্তু তাল ও তেঁতুলের ক্ষতি হয় না। এ বচনটির অর্থ করা হয়েছে ‘মহতের বিপদের ভয় বেশি’।
ষোল চাষে মূলা,
তার অর্ধেক তুলা;
তার অর্ধেক ধান,
বিনা চাষে পান।
(১৬ দিন চাষ করার পর সেই জমিতে মূলা চাষ করলে ভাল জাতের ফলন পাওয়া যায়। তুলা লাগানোর জমিতে ৮ দিন চাষ করতে হবে, ধানের জমিতে ৪ দিন চাষ করে ধান লাগালে ভাল ফলন পাওয়া যায়। পানের জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না।)
চাল ভরা কুমড়াপাতা, লক্ষ্মী বলেন আমি তথা।
(গ্রাম-বাংলার বাড়ির চাল বা ছাদভরা কুমড়োগাছের পাতার ফলনও যদি ভাল হয়, তাহলে মানুষ সেটার দ্বারাই অন্ন যোগাতে পারবে।)
নারিকেল গাছে লুন-মাটি, শীঘ্র শীঘ্র বাঁধে গুঁটি।
মাছের জলে লাউ বাড়ে, ধেনো জমিতে ঝাল বাড়ে।
(যে পুকুরে মাছ চাষ করা হয়, তার পাশে লাউগাছ লাগানো উপকারী। আবার যে জমিতে ধান চাষ হয়, সেখানে লঙ্কার ফলন ভাল হয়।)
কোল পাতলা ডাগর গুছি
লক্ষ্মী বলেন ঐখানে আছি।
(ফাঁক ফাঁক করে ধান বুনলে ধানের গুছি মোটা হয় এবং অনেক বেশি ফলন হয়।)
দিনে রোদ রাতে জল দিন দিন বাড়ে ধানের বল।
(দিনের বেলা প্রখর রোদ আর রাত্রে বৃষ্টি হলে ধানের জমি উর্বর হয় ও ধানের ফলন ভাল হয়।)
আউশের ভুঁই বেলে, পাটের ভুঁই আঁটালে।
(বেলে মাটিতে আউশ ধান এবং এঁটেল মাটিযুক্ত জমিতে পাট ভাল হয়।)
নদীর ধারে পুতলে কচু, কচু হয় তিন হাত উঁচু।
(এখানে বলা হয়েছে, নদীর পাড়ে কচু গাছ বুনলে কচুর ফলন ভাল হয়।)
ওরে ও চাষার পো শরতের শেষে সরিষা রো।
(শরৎকালের শেষ দিকে সরিষার আবাদ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে, এতে লাভ পাওয়া যায়।)
না হয় অঘ্রাণে বৃষ্টি, হয় না কাঁঠালের সৃষ্টি।
(অঘ্রাণে বৃষ্টি না হলে কাঁঠালের ফলন ভাল হয় না।)
ভাদরে আশ্বিনে না রুয়ে ঝাল
যে চাষা ঘুমিয়ে কাটায় কাল
পরেতে কার্তিক অঘ্রান মাসে
যদি বুড়ো গাছ খেতে পুঁতে আসে
সে গাছ মরিবে ধরিবে ওলা
পাবে না মাল চাষার পোলা।
(ওপরের খনার বচনের অর্থটি এমন যে, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে লঙ্কার চাষ করলে ফল ভাল হয়। তা না করে যদি আলস্যে সময় কাটিয়ে কার্তিক-অঘ্রান মাসে চাষ করা হয়, তাহলে ধসা রোগে গাছ নষ্ট হয়ে যায়। লঙ্কা পাওয়ার কোনও আশাই থাকে না।)
ব্যাঙ ডাকে ঘন ঘন
শীঘ্র হবে বৃষ্টি যেন
(খনার বচনে বলে যে, ব্যাঙের ডাক বৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ।)
আমাদের প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ব্যাঙের উপস্থিতি এবং ব্যাঙের ডাক প্রকৃতির এক প্রতিবেশীয় সূচক এবং আবহাওয়ার এক অনন্য নির্দেশক।
খেত আর পুত
যত্ন বিনে যমদূত।
চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে খনার উক্তি,
যে যে মাসের যে যে রাশি।
তার সপ্তমে থাকে শশী॥
সেই দিন যদি হয় পৌর্ণ-মাসী।
অবশ্য রাহু গ্রাসে শশী॥
এইসব ভাষ্যের যৌক্তিকতা আজও অম্লান। খনার বচনের অসারত্ব প্রমাণের চেষ্টা কেবল অধিপতি ঔপনিবেশিক আসুরিক চরিত্রকেই হাজির করে। খনার বচনের আখ্যানের বরাহমিহির থেকে শুরু করে আজকের প্রযুক্তি-নির্ভর গরিমাসর্বস্ব বাহাদুরি সবখানেই এই একই রকম বৈষম্যের ধারাবাহিকতা। কিন্তু তাতে কোনওভাবেই খনার বচনের বিজ্ঞান-দর্শন বদলে যায় না বা এর উপযোগিতা হারিয়ে যায় না। খনার জিভ কেটে ফেললেও তাঁর বিচক্ষণ কথননির্দেশিকা আজও জাগ্রত। হয়তো আবহাওয়ার পরিবর্তনে তা কিছুটা বিবর্তিত, যার দায় খনার নয়।
যুগে যুগে খনাদের আসলে এভাবে বাহ্যিকভাবে মেরে ফেলা যায় কিন্তু এর ফলে তাঁরা আত্মিকভাবে শতগুণ শক্তিতে বেঁচে থাকে। যদি জিভ কাটার মাধ্যমে খনাকে না মারা হত তাহলে হয়তো লীলাবতী হারিয়ে যেত শত শত শ্লোক ও বচন রচয়িতার মাঝে। অন্য অনেক জ্ঞানীদের যেমন কেউ মনে রাখেনি, তাঁকেও কেউ মনে রাখত না। কিন্ত তাঁর এই মৃত্যুই যেন যুগের পর যুগ বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁকে।
রক্তক্ষরণে শারীরিকভাবে মৃত খনার বচন আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, এটাই প্রমাণ করেছে নারীর আশ্চর্য সৃজনক্ষমতার লয় নেই, তা অপ্রতিরোধ্য। খনারা আসলে মরে না, বেঁচে থাকে মানুষের মননে ও চেতনায়। এই মহীয়সী নারীরা না থাকলে শশী জোৎস্না বিনা নিদ্রাবিহীন হতো। সভ্যতার কাননে ফুল ফুটত না।
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
