অপার শূন্যতা। ব্যালকনিতে বসে যতদূর চোখ যায় আবছা ধূসরতা। একটু আগে সকাল হয়েছে। আলো ফুটছে ধীরে ধীরে। দিন এবার তার ব্যস্ত দৌড় শুরু করবে। ডানায় লাগবে রঙের ছোপ। তার আগে একটু ওয়ার্ম আপ সেরে নিচ্ছে। খুব সকালে ঘুম ভাঙে আদিত্যর। প্রথমে পুব দিকের জানালায় দাঁড়িয়ে সূর্যপ্রণাম করে। ছোটবেলায় বাবা সবার আগে ঘুম থেকে উঠতেন। তারপর তাদের চার ভাইকে ডেকে তুলতেন। উঠোনে সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে সূর্যমন্ত্র বলতে হত। সে অভ্যেস এখনও আছে। তারপর কিচেনে গিয়ে নিজের হাতে এক কাপ চা করে ব্যালকনিতে এসে বসেন। দু’চোখ ভরে সকাল দেখেন। কত মানুষ মর্নিং ওয়াকে বের হয়। কিছু মানুষ সাইকেলে বাইকে হেঁটে তাদের রুজি-রোজগারের খোঁজে ছোটে। আদিত্য দার্শনিক নন, সামান্য ব্যাঙ্ককর্মী ছিলেন। যৌবনে কিছু কবিতা লিখেছেন মনের খেয়ালে। কিন্তু ইদানীং সকালে ব্যালকনিতে বসে দূরের দৃশ্যমান প্রকৃতি আর মানুষজনের যাতায়াত দেখে তাঁর মধ্যে কেমন একটা বোধ কাজ করে। বহমান জীবন, তার এই অন্বেষণ কোথায় যেন অনির্দেশ।
নিউটাউন এমনিতেই ফাঁকা ফাঁকা। তবে প্রচুর সবুজ আছে। নতুন গড়ে ওঠা উপনগরী। আদিত্য রায় যে ব্লকে থাকেন, সেটা অনেকটা ভিতরে।
এদিকটায় এখনও তেমনভাবে নির্মাণ শুরু হয়নি। গাছপালা জলাভূমি বেশি। তাই পাখি আসে নানা প্রজাতির। সকালে জেলেরা জাল কাঁধে মাছ ধরতে আসে জলাভূমিতে। আদিত্য রায় অনেক দিন নিচে গিয়ে ওদের কাছ থেকে ছোট মাছ কিনেছেন। দাম কম অথচ একেবারে লাফাচ্ছে। এসব মাছ মার্কেটে খোঁজ করে পাওয়া যায় না। পেলেও দাম বেশি, এত টাটকাও না। কলকাতায় চলে আসার আগে ছোটবেলা কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মজিলপুর। বড় চকবন্দি দোতলা বাড়ি। মাঝখানে অনেকটা উঠোন। এক পাশে ঠাকুরদালান। দুর্গাপূজা হত প্রতি বছর ধুমধাম করে। গ্রামের সব লোক ভোগ খেতে আসত। একান্নবর্তী পরিবার। তিন চারটে পুকুর ছিল। ফলের বাগান। বাবা সনাতন কাকাকে ডেকে জাল ফেলে মাছ ধরাতেন। ছোটবড় অনেক মাছ। কী অপূর্ব স্বাদ সে মাছের। কী স্বপ্নময় স্মৃতিঘন ছিল শৈশব। বাবার ওকালতিতে পসার বাড়ল। গ্রাম থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে কোর্টের কাজে অসুবিধা হচ্ছিল। তার ওপর তিনি চাইছিলেন ছেলেমেয়েরা কলকাতার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ুক। তাই শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামের পাট চুকিয়ে শহরে চলে আসবেন। কোনও এক মক্কেলের দৌলতে একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি পেলেন সস্তায়। গড়িয়াহাটের কাছে ফার্ন রোডে। এখান থেকে বাবার কোর্ট আলিপুর খুব কাছে। সঞ্চিত টাকা আর পৈতৃক সম্পত্তির ভাগের কিছু জমি বিক্রি করে বাবা বিমলভূষণ ফার্ন রোডের বাড়িটা কিনে নিলেন। তারপর কিছু মেরামতি ও রং করার পর গ্রামের বাড়ি ছেড়ে তারা চলে এসেছিলেন নতুন বাড়িতে। দুই কাকা আর খুড়তুতো ভাইবোনেরা থেকে গেল। দেশে যাওয়া মানে বছরে ওই একবার, পারিবারিক দুর্গাপুজোতে। বাবার মৃত্যুর পর এখন অবশ্য সে পুজো বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের বাড়িতে অনেক দিন আর যান না আদিত্য।
***
নিউটাউনের ফ্ল্যাটে চলে আসার পর আদিত্য আবার সেই পুকুরের মাছের স্বাদ ফিরে পেলেন। ফিরে পেয়েছেন তাঁর হারানো শৈশব। সবুজ সকাল আর পাখির ডাক। মাঝে মাঝে খুব মনখারাপ হয়ে যায়। যখন ভাবেন কয়েক বছরের মধ্যে এই সবুজ লোপাট হবে। পাখিরা এসে বসবে না, তাদের ডাকও শোনা যাবে না। ব্যালকনিতে বসে আদিত্যর চোখ আর সুদূর খুঁজবে না। বড় বড় হাইরাইজ উঠে তাঁর দৃষ্টিসীমাকে আড়াল করবে। তখন কী নিয়ে বাঁচবেন? জীবনের যিনি সঙ্গী ছিলেন অনেক আগেই আচমকা বিদায় নিয়েছেন। যাবার আগে জোর করে এই ফ্ল্যাট বুক করিয়েছিলেন। সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে বলে না, একমাত্র মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে। ফ্ল্যাটের কনট্র্যাক্ট সই হবার পর একদিন অফিস থেকে ফিরতেই সেই মারাত্মক কথাটা শুনলেন। চায়ের কাপ হাতে ধরিয়ে সুধা বলেছিলেন, ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।’
বিয়ের আগের নাম ছিল সুবর্ণা। খুব সুন্দর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। বিয়ের পর আদিত্য বলেছিলেন, ‘এত ভাল গান গাও। তোমাকে সুধা নামে ডাকব।’ সুবর্ণা হেসে ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছিলেন। আজ সুধার গলা শুনে চমকে ওঠেন আদিত্য। বড় বিষণ্ণ আর আর্ত শোনাল।
‘কী কথা, বলো।’
‘আমাকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? বুকটা ভার ভার ঠেকে। ঘুমের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যথা। বাঁ বুকটায় শক্ত ঢিলের মত কী একটা যেন। এতদিন বলিনি। আজ আবার নিপল থেকে রস বের হচ্ছে। তাই বলছিলাম…’
সুধা কাঁদছেন। আদিত্য স্ত্রীর হাত ধরে সোফায় বসান। সান্ত্বনা দেন।
‘ঠিক আছে নিয়ে যাব। কিন্তু অমন করে বলছ কেন? কিচ্ছু ভেব না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এরপর প্রথমে গাইনি, তারপর অনকোলজিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। তিন চার ধাপ পরীক্ষার শেষে ব্রেস্ট ক্যানসার পজিটিভ। লেডি ডাক্তার আটটা কেমোর পর অপারেশন করবেন বলে দিলেন। সুধা শুধু মেয়ে অহনার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন আর কাঁদেন। বাড়ির পরিবেশ তখন বিষণ্ণ শূন্যতায় ভরা। চারটে কেমোর পর সুধাকে আর চেনাই যাচ্ছিল না। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। মাথায় চুল নেই। সারারাত তীক্ষ্ণ ব্যথায় ঘুম হয় না। পাঁচ নম্বর কেমো নিতে গিয়েই হার্ট অ্যাটাক। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাডমিট। প্রথমে আইসিইউ। তারপর ভেন্টিলেশনে। দু’দিনের মধ্যেই সব শেষ। চোখে অন্ধকার আর অন্ধকার। আদিত্য মেয়েকে নিয়ে অথৈ বিষাদ সাগরে। এমন আচম্বিতে অকস্মাৎ ঘটে গেল সব ঘটনা, যেন ভোজবাজি। মেয়ে অহনা তখন সবে তেরোয়।
***
‘সখি, বহে গেল বেলা, শুধু হাসি খেলা/ একি আর ভাল লাগে…’
মৃতা স্ত্রীর সিডি চালিয়ে শুনছিলেন আদিত্য। মনে হচ্ছিল সুধা পাশে ডিভানে বসে গাইছেন। তাঁর গায়ের গন্ধ, চুলের গন্ধ তিনি যেন পাচ্ছেন। চোখ বন্ধ করে একটা ঘোরের মধ্যে আছেন। স্ত্রী চলে যাবার পর অনেক দিন কেটে গেছে। মেয়ে অহনা এখন কলেজে পড়ে। আদিত্য চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। মেয়ে কলেজ চলে গেলে শূন্য বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করে। সুধার ছবিটার দিকে তাকাতে পারেন না। ওর গানের ঘর তালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। কোনও কাজে স্পৃহা পান না। একটা অবসাদ মোটা চাদরের মত গায়ে সব সময় লেপটে থাকে। আদিত্য দম নিতে চান, পারেন না। বন্ধু সত্যসুন্দর একদিন বাড়িতে এসেছিল। তার অবস্থা দেখে বলল, ‘আদিত্য, অবসাদ বড় খারাপ জিনিস। একবার চেপে ধরলে অন্ধকার গহ্বরে টেনে নিয়ে যাবে। ওকে পাত্তা দিলে চলবে না। বি প্র্যাকটিক্যাল। তুই বরং আমাদের পার্কের ক্লাবে আয়। দেখবি, হাসিতে মজাতে গল্পগুজবে সব মনখারাপ উধাও হয়ে গেছে। বিপর্যয়ের পর পৃথিবী আবার নতুন করে সাজে।’
অহনা কলেজের পর নাচের ক্লাসে যায়। তারপর এক প্রফেসরের কাছে কোচিং সেরে বাড়ি ফিরতে রাত হয়। আদিত্যর সময় কাটে না। ভাবেন আজ তিনি পার্কের ক্লাবে যাবেন। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে যতীন দাস পার্ক। হাঁটতে হাঁটতে বিকেলে গিয়ে হাজির হলেন। ওদের দলটা বেশ ভারি। আদিত্যর চেনা বন্ধুরা আছে আবার অচেনা অনেক। সবাই অবসর নিয়েছে। গল্প, গান, কবিতাপাঠ চলছে। ক্লাবের নামটা সুন্দর। ‘বিকেলের জলসা’। তাকে দেখে বন্ধু সত্যসুন্দর এগিয়ে এল। ও ক্লাবের সেক্রেটারি। সবাই গোল হয়ে পার্কের সবুজ ঘাসে বসেছে। আদিত্যও বসলেন। খোলা আকাশের নিচে বিকেলের শান্ত বাতাস। চারপাশে সবুজ। দূরে দূরে বাচ্চারা খেলছে। অনেকদিন পর আজ খুব ভাল লাগছে আদিত্যর। যেন বদ্ধ গুহার অন্ধকার থেকে আলোময় প্রকৃতির মাঝে এসে পড়েছেন। নিজেকে সুস্থ সতেজ লাগছে। তিনিও বন্ধু সত্যসুন্দরের অনুরোধে মোবাইলে সেভ করা একটা কবিতা পড়লেন। সুধা মারা যাবার পর লিখেছিলেন। ক্রমে সন্ধ্যার বাতাস ভারি হল। এক কাপ কফি খেয়ে অনুষ্ঠান শেষ হতে বাড়ির পথ ধরলেন আদিত্য।
***
সুধা নেই। অথচ মেয়ে বড় হয়ে উঠছে। মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর ভাবলেন, এবার ওর বিয়ে দেওয়া দরকার। নেট সার্চ করে নানা ম্যাট্রিমনিয়াল সাইট ঘেঁটে যোগাযোগ করলেন কিছু পাত্রপক্ষের সঙ্গে। কিন্তু মন সায় দেয় না। আজকাল খবরের কাগজে, নিউজ চ্যানেলে যা সব ঘটনা পড়ছেন বা দেখছেন, তাতে ভয় হয় মনে। কত ফন্দি নিয়ে লোক ঘোরে আজকাল। কত বিয়ের পরিণতি শেষ পর্যন্ত হয় মর্মান্তিক করুণ! শেষে এক বন্ধুর মাধ্যমে তারই পুরনো অফিস কলিগের ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ ঠিক করলেন।
অহনা আপত্তি তুলেছিল। বলেছিল, ‘বাবা, ভাবছি নেট দেব। পিএইচডি-টা করি।’
আদিত্য বলেছিলেন, ‘তা সে তো বিয়ের পরেও করা যাবে। আসলে কী জানিস মা, আমার তো বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। কখন কী হয়ে যায়। তোর বিয়েটা দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছি।’
মেয়ে কী বুঝল, শেষে রাজি হল ছেলে দেখতে। বাবা-মেয়ে দু’জনেরই ছেলে পছন্দ হল। ওরা থাকে দুর্গাপুর। ছেলের অফিস কলকাতায়। অহনা ওর এক মাসির সাহায্য নিয়ে বিয়ের কেনাকাটা নিজেই সারল। বাকি বন্দোবস্ত আদিত্য তার বন্ধু সত্যসুন্দরের সাহায্যে করলেন। বিয়েটা ভালয় ভালয় হয়ে গেল। কনে বিদায়ের সময় বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। ঠিক সুধা চলে যাবার সময় যেমন হয়েছিল। অহনা তাকে জড়িয়ে খুব কাঁদছিল। ‘বাবা, তুমি তো একা হয়ে যাবে। কে দেখবে তোমাকে! বিয়েতে রাজি না হলে ভাল হত।’
আদিত্য মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলছিলেন, ‘একা কেন রে। সুখেন তো রোজ অফিস আসবে। কোনও অসুবিধা হলে ওকে ফোন করব। কিছু দেবার থাকলে ওর হাতে গিয়ে দিয়ে আসব।’
সেই মেয়ে বিয়ের পর বছর ঘুরতে এসে বলল, ‘বাবা, তোমার জামাইয়ের পক্ষে দুর্গাপুর থেকে প্রতিদিন অফিস করা খুব টাফ হচ্ছে। আমি বলছিলাম কী, আমরা যদি কলকাতা এসে থাকি।’
‘বেশ তো। কিন্তু তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির মত নিয়েছ?’
‘হ্যাঁ বাবা, সুখেন কথা বলেছে। তবে শনিবার করে ও বাড়ি যাবে।’
‘বেশ। তবে তোমরা নিউটাউনের ফ্ল্যাটে যাও। তোমার মা তো তোমাদের কথা ভেবেই ওই ফ্ল্যাট নিয়েছিল।’
‘না বাবা, ওখানে গেলে ওর অফিসে যাতায়াতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া আমার সব বন্ধুরা এদিকে থাকে। আমার নাচের স্কুল। ভাবছি এমফিলে ভর্তি হব। আমরা এই বাড়িতে থাকি?’
মেয়ের কথায় মান্যতা দিয়ে আদিত্য রায় রাজি হলেন।
এর দু’বছর পর অহনার কোলে এল ফুটফুটে টুবলু। ভাল নাম রৌনক। সপ্তাহখানেক পার্কের ক্লাবে যাওয়া হল না। নার্সিংহোম আর বাড়ি করতে হল। নবজাতকের সব জিনিস তাকেই কিনে আনতে হল। রাতে স্বপ্নে সুধা এল। মিটিমিটি হাসছে। মুখে কোথাও রোগশোকের চিহ্ন নেই। ‘কীগো, কেমন মজা। দাদু হয়েছ, এটুকু করবে না।’ মজা করতে করতে সুধা মিলিয়ে গেল। টুবলু বছরখানেক হতেই অহনা আবার বায়না ধরল। জন্মদিনে পায়েসের বাটি সামনে রেখে বলল, ‘বাবা, আমাকে কিছু উপহার দেবে না?’
‘বল, কী চাই?’
‘টুবলু বড় হচ্ছে। ওকে ভাল স্কুলে দিতে হবে। টাকার খুব দরকার।’
‘হ্যাঁ, টাকা তো লাগবেই। যখন সময় হবে আমিই দেব।’
‘তুমি আর কত দেবে। এই তো বিয়ের এতবড় খরচ গেল। তার ওপর নার্সিংহোমের বিল দিলে। সুখেন বলছিল, আমার কিছু করা উচিত।’
‘ভাল তো, চাকরির চেষ্টা কর।’
‘না বাবা, চাকরি করলে টুবলুকে কে দেখবে। আমাকে বাড়িতে থেকে কিছু একটা করতে হবে। যাতে আর্ন হয়। আবার নিজের আইডেন্টিটি তৈরি হয়।’
‘পরিষ্কার করে বল, কী চাইছিস।’
অহনা একটু থামল। তারপর সময় নিয়ে বলল, ‘আমাদের নিচের দুটো ঘর নিয়ে আমি একটা নাচের স্কুল করতে চাইছি, বাবা। তাতে আমার বাড়িতেও থাকা হবে আর উপার্জন।’
‘কিন্তু নিচে তো আমি থাকি। উপরের ঘরদুটো তোদের ছেড়ে দিয়েছি।’
‘সেটাই তো বলছি। যদি রাগ না করো, একটা কথা বলি। তুমি নিউটাউনের ফ্ল্যাটে চলে যাও। তাহলে আমি স্কুলটা করতে পারি। দেবে না, আমাকে এ উপহার!’
একটা প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দিল মেয়ে। মা চলে যাবার পর কত মায়া আর যত্নে তাকে বড় করেছেন। আজ নিজেদের স্বার্থে বাবাকে দূরে সরাতে এরা একটুও ভাবে না। উপহার তো দিতেই হবে। কিন্তু মন ভরে গেল অভিমানে। চোখ ঝাপসা। বুকের গভীরে কোথাও শিকড় ছিঁড়ছে। ছোঁয়ানো জলের শব্দ। হয়তো বেদনার। সঙ্গীহীন নিঃসঙ্গ আদিত্য আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন। আস্তে উচ্চারণ করল, ‘বেশ, তাই-ই হবে।’
***
সুধার গাওয়া একটা গান মেয়েকে দিয়ে সিডি থেকে ল্যাপটপ থ্রু ইউএসবি করে মোবাইলে রিংটোন করে নিয়েছেন আদিত্য। কেউ ফোন করলে বাজে। তখন সুধার কথা মনে পড়ে। বিষণ্ণতা কিছুটা কমে। তবু যখন ফার্ন রোডের বাড়িতে ছিলেন, মনে হত কলকাতা। বন্ধুদের মধ্যে আছেন। নিজেদের বাড়ি আর সুধার স্মৃতি মেখে আছেন। কিন্তু এখন মনে হয় যেন কলকাতার বাইরের আর এক কলকাতা। একে ঠিক চেনেন না। ঝাপসা। জীবনানন্দের সেই দূরতর দ্বীপের মত।
বেলা বেড়ে গেছে। রোদে তেজ। আদিত্য ব্যালকনি থেকে ঘরে এলেন। মেয়ের চোখে ছোট হবেন না বলে একরকম অভিমান নিয়েই সরে এসেছিলেন। সুধার স্মৃতিকে পিছনে ফেলে। একাই থাকেন। শুধু লক্ষ্মী নামে এক বিধবা মাঝবয়সী একটু বেলার দিকে এসে কাজ ও রান্না করে দিয়ে যায়। সকালে নিচে নেমে একটু হাঁটেন। মাঝেমধ্যে মার্কেটে যান। কিন্তু করোনা আর লকডাউন এসে সব ওলোট-পালট করে দিল। মানুষ সব কেমন গৃহবন্দি হয়ে পড়ল। নিজের মধ্যে বড় অসহায়। কত মানুষের চাকরি গেছে। কত ছোট ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। চ্যানেল আর সংবাদপত্র খুললে, বন্ধুদের ফোনে প্রতিনিয়ত আত্মহননের খবর আসছে। মাঝরাতে কখনও হঠাৎ ঘুম ভেঙে আদিত্য চেয়ে থাকেন সিলিং ফ্যানের দিকে। অর্থহীন মনে হয় এ জীবন। এই বেঁচে থাকা।
মাথাটা অল্প ঘুরছে। টাল সামলে সোফাতে বসলেন আদিত্য। সুগার না প্রেসার কোনটা যে বাড়ল বুঝতে পারছেন না। হাত বাড়িয়ে টি-টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে জল খেলেন। একটু ধাতস্থ হলেন। এমন সময় ‘সখি, বহে গেল বেলা, শুধু মিছে খেলা…’
সামনে রাখা ফোনটার রিংটোন বাজছে সুধার গলায়। তাড়াতাড়ি ধরলেন।
‘হ্যালো, দাদুন, আমি টুবলু বলছি।’
‘হ্যাঁ, বলো দাদু। তোমার গলা তো আমি চিনি।’
‘তুমি কেমন আছ?’
‘আমি ভাল। তোমরা কেমন?’
‘আমি ফাইন। মম, বাপি সব্বাই ভাল। সব্বাই ফাইন। তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।’
‘তাই নাকি! তা শুনি সুসংবাদটি কী।’
‘আমি তোমার নিউটাউনের ডিপিএস স্কুলে চান্স পেয়েছি। ওখানেই ভর্তি হব। লকডাউন পুরো উঠে গেলে যখন স্কুল শুরু হবে নতুন করে, আমি আর মা তোমার ওখানে তোমার সঙ্গে থাকব। ওখান থেকে স্কুল কাছে। বাপি এখানে থাকবে। আমরা শুক্রবার করে চলে আসব। কী মজা।’
আদিত্যর চোখ জলে ভিজে গেল। তিনি যেন অন্ধকারে একটা লম্বা সাঁকো দেখতে পেলেন। যে সাঁকো এতদিন ভাঙা ছিল। মনখারাপের সেই বিমর্ষ সাঁকো এবার যেন খুশিতে জুড়ে গেল। টুবলুর ফোনটা ম্যাজিক উদ্ভাস হয়ে তাঁর সমস্ত অবসাদ শুষে নিল। শূন্য ফেরিঘাট যেন পারাপারে মুখরিত হল।