১৯৪৭-এর দ্বিজাতিতত্ত্ব ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাঙালি সংস্কৃতির মহৎ ভাবনাগুলি উপড়ে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মাটিলগ্ন, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক রাজনীতির স্পর্শে জেগে ওঠে বাঙালির মানসলোক, জনচিত্তে নতুন করে ফিরে আসতে থাকে বাঙালির চিরায়ত গৌরবগাথা ও ঐতিহ্য। ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-লালন এবং মরমী সাধকদের মানবিক আধ্যাত্মবাদ। জনচিত্তে ফুটে উঠতে থাকে বাঙালি সংস্কৃতির সুকৃতিসমূহ বৃহত্তর তাৎপর্যে। আয়ুব খানের ফৌজি শাসন ও নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মধ্যেও রবীন্দ্র-নজরুলের গানে, কবিতার পঙ্ক্তিমালায়, যাত্রাপালা-কবির লড়াইয়ের ঝংকারে, মননচর্চা ও সম্প্রীতি সাধনায় পূর্ববঙ্গের শহর ও গ্রাম মুখর হয়ে উঠতে থাকে। বাঙালি সংস্কৃতির অবিনাশী শক্তি আত্মায় ধারণ করে ষাটের দশকে যাঁরা বাংলাদেশের সংস্কৃতি-ভুবন আলোকিত করেছেন তাঁরা অধিকাংশই লোকান্তরিত হয়েছেন। যাঁরা আজও বেঁচে আছেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য সনজীদা খাতুন। তিনি সারাজীবন শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা করে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যা নিয়ে পুরো জাতি গর্ব করতে পারে। ৯০ বছরের জীবন-পরিক্রমায় বহুমাত্রিক মননচর্চা দিয়ে এমন এক সারস্বত পরিমণ্ডল তিনি নির্মাণ করেছেন, যা থেকে ভাবীকালে বাঙালি সমাজ অনুপ্রেরণা ও উদ্দীপনা পেতে পারে। বাংলাদেশের সংস্কৃতি-পরিবারে তাঁকেই অভিভাবক মনে করা হয়। সাত দশকের বেশি সময় ধরে সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে যে-নিরন্তর পথচলা যায় তার উজ্জ্বল উদাহরণ কেবল সনজীদা খাতুন নিজে।
সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবদান অতুলনীয়। বাঙালি সংস্কৃতি ও বাঙালিত্ব বোধ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেও তিনি অক্লান্ত ও অনলস। ষাটের দশকে বাঙালি সংস্কৃতির যে-অভূতপূর্ব উজ্জীবন, তাতে তিনি ছিলেন একাধারে কর্মী, শিল্পী, সংগঠক ও সাধক। রবীন্দ্র-ভাবসমুদ্রে স্নাত এই সাংস্কৃতিক নেত্রী কেবল শিল্পসাধক নন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বলিষ্ঠতম সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার। বাঙালির সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির উজ্জীবন ও বিকাশে বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন তাঁকে অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু, রাজনৈতিক উত্থান-পতন কিংবা স্বাধীনতা-উত্তরকালে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হামলা— কোনও কিছুই তাঁকে সত্যধর্ম থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বে রমনার বটমূলে পয়লা বৈশাখ বাংলা বর্ষবরণ উদযাপিত হচ্ছে ষাটের দশক থেকে।
সনজীদা খাতুনের জন্ম ৪ এপ্রিল, ১৯৩৩ ঢাকায় এক সাংস্কৃতিক পরিবারে। মা সাজেদা খাতুন গৃহিণী। বড় হয়েছেন ১১ ভাইবোন ও আত্মীয়দের যৌথ পরিবারে। বহুমাত্রিক সৃজনকুশলতার অধিকারী সনজীদা খাতুন একাধারে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সঙ্গীতজ্ঞ ও শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশের স্বপ্রতিষ্ঠিত ও শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও বর্তমান সভাপতি। তাঁর পিতা বাংলাদেশের কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের নেতা জাতীয় অধ্যাপক ড. কাজী মোতাহার হোসেন। বড় হয়েছেন জননী-সাহসিকা সুফিয়া কামাল, সংগীতজন পঙ্কজকুমার মল্লিক, দেবব্রত বিশ্বাস, আবদুল আহাদ, রামকানাই দাশ, চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান, সত্যেন সেন, ঋষিপ্রতিম লেখক রণেশ দাশগুপ্ত প্রমুখ গুণীজনের স্নেহছায়ায়।

রবীন্দ্রনাথ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, সম্প্রদায়গত-ধর্মভিত্তিক কোনও দিনই ‘সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র’ হওয়ার কিংবা ‘সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব’ করার মতো মহৎ দিন হিসেবে গণ্য হতে পারে না। তিনি বাঙালির উৎসবের দিন সন্ধান করেছেন অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের মর্মস্থলে। বাঙালি সমাজ নানা রাজনীতি, মত পথ ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত, বাংলাদেশি বাঙালি, ভারতীয় বাঙালি কত নামে-উপনামে পরিচিত। বিশ্বায়নের ছাপ পড়েছে তার যাপিত জীবনে, তারপরও বাঙালিত্বকে তারা বুকের গভীরে আগলে রেখেছে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে, বাঙালির ভাবনা-ভাবুকতার বিরাট অংশ অধিকার করে আছে প্রকৃতি-চেতনা ও ঋতুপরিবর্তনের বৈচিত্র্য। প্রকৃতি-চেতনা থেকে উৎসারিত বর্ষবরণের উৎসবে কোনও বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের ছোঁয়া নেই, বরং এই উৎসবের গভীরে নিহিত আছে সকলকে নিয়ে বেঁচে থাকার মানবিক আকুতি। স্মরণাতীত কাল থেকে উদযাপিত বর্ষবরণ উৎসবের নবায়ন ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো সনজীদা খাতুন এই দিন উদযাপনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অর্ধশতাব্দী ধরে রমনার বটমূল থেকে এবং তাঁর সঙ্গে আছেন ছায়ানটের একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ সংস্কৃতি-কর্মী। এক্ষেত্রে ওয়াহিদুল হক, জাহিদুর রহিম, ফাহমিদা খাতুন, ইফফাত আরা দেওয়ান, বিলকিস নাসিরুদ্দিন, মালেকা আজিম খান, মাহমুদুর রহমান বেনু, সাদিয়া আফরিন, ডালিয়া মোরশেদের নামও অবশ্য-উচ্চার্য। সনজীদা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রবর্তিত এই নবায়িত বর্ষবরণ উৎসব এখন একালের বাঙালির সবচেয়ে বৃহৎ সর্বজনীন উৎসব— প্রাণের উৎসব। বাঙালি প্রতিবছর পয়লা বৈশাখের উৎসবে মিলিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের বোধে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এই উৎসব কোনও বিশেষ ধর্মকে প্রাধান্য দেয় না, শাস্ত্রীয় রক্ষণশীলতার রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা করে না, ধর্মের বেশে মোহ এসে কাউকে চেপেও ধরে না। বাঙালির এই অসাম্প্রদায়িক জাগরণ যাত্রায় সনজীদার দৃঢ় ভূমিকা বাঙালি মনে রাখবে। ভেবে বিস্মিত হই যে, ১৯৭১ সালেও তিনি সাভারের একটি মাটির ঘরে বটমূল কল্পনা করে নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গান গেয়ে পারিবারিকভাবে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করেছেন। পয়লা বৈশাখ হবে না, এটা তিনি ভাবতেই পারতেন না।
স্বদেশ, সংস্কৃতি, স্ব-সমাজ এবং শিল্পের প্রতি বিশ্বস্ত, আমাদের শিল্প সংস্কৃতি ভুবনের এই অগ্রগণ্য-নেত্রী প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব-নিকেশ করেন না কখনও, তিনি মনে করেন জীবনে যা পেয়েছেন তা তুচ্ছ নয়, বরং অতুলনীয়। তাঁর দুঃখ, এত রক্তক্ষরণ, এত লড়াই-সংগ্রামের পরও দেশের অধিকাংশ জনগণ বাঙালিত্ব কাকে বলে জানে না, এমনকী রাষ্ট্রও তা বোঝে না। সে কারণেই গালে পতাকা আর একতারা এঁকে, মাথায় গামছা বেঁধে বাঙালি হওয়ার চেষ্টা করে এ প্রজন্মের অনেকে। এখন সংস্কৃতির মূল বিষয় অনুধাবনের চেয়ে হৈচৈ-ই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষবরণ উদযাপনে তাঁর ও উদ্যোক্তাদের ভাবনায় ছিল, মানুষের মনের উৎকর্ষ সাধন। মনের সঙ্গে সংস্কৃতির সংযোগ স্থাপিত হলেই কেবল একজন মানুষ পূর্ণতর মানুষ হয়ে উঠতে পারে। আর সে সাধনাই তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা হামলার পর তার মনে হয়েছে যে, শুধু গান গেয়ে কিছু হবে না, এ জন্য প্রকৃত শিক্ষার বিস্তার প্রয়োজন। রাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকলে সবকিছু হয় না, নিজেদেরও উদ্যোগ নিতে হয়। একারণে তিনি নিজে স্কুল গড়ার কথা ভেবেছেন।
বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে আত্মনিবেদিতা সনজীদা খাতুন বাঙালিত্বের ভিত্তি দৃঢ় করার জন্য ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তনের অধ্যক্ষ ও ভিন্নধর্মী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দার সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের মতো সংগঠন। তিনি মনে করেন, কেবল শহুরে পরিমণ্ডলে সংস্কৃতিচর্চা করলে চলবে না, সংস্কৃতিচর্চাকে গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গৌরবগাথা, মানবিক দিক, ধর্মের নামে যে অন্যায় হচ্ছে— সবকিছু সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির প্রগতিশীলতা থেকে ডানপন্থার দিকে উলটো যাত্রা তাঁকে ব্যথিত করে। সুস্থ ধারার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তাঁর চিত্তে আনন্দ জাগিয়ে তোলে, আবার সংস্কৃতি-বিরোধী অপতৎপরতায়, জঙ্গিবাদের আস্ফালনে তিনি বিষাদে ম্রিয়মান হয়ে পড়েন। তারপরও সব প্রতিকূলতা জয়ের সাহস রাখতে চান, ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ দিয়ে নিজেকে অপমানিত করতে চান না কোনওভাবেই। ‘আপনা মাঝে’ যে-শক্তি, সে শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ব্যক্তিক ও সাংস্কৃতিক সংকট মোকাবেলা করতে চান।
সনজীদা খাতুন মূলত সঙ্গীতজ্ঞ, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি মোট ১৬টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ’, ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’, ‘রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান’, ‘অতীত দিনের স্মৃতি’, ‘তোমারি ঝর্ণাতলার নির্জনে’, ‘কাজী মোতাহার হোসেন’, ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’, ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতির চড়াই-উৎরাই’, ‘সংস্কৃতির বৃক্ষছায়ায়’, ‘সংস্কৃতির কথা সাহিত্যের কথা’, ‘স্মৃতিপটে গুণীজন’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর গাওয়া গান নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য অডিও অ্যালবাম। এত কিছুর পরও এই প্রবাদতুল্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নিজেকে সংগঠক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বেশি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আসলে এটাই আমার বড় পরিচয়। আমি নিজে মঞ্চে বসিনি, সবাইকে বসিয়েছি। আমি সংস্কৃতি ছেড়ে চলতে পারব না।’ রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ৪ বছর বেশি পার করলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ভুবনের এই নেত্রী, অর্থাৎ নব্বইতে পা রাখলেন সনজীদা খাতুন। এ বয়সেও তিনি প্রাণৈশ্বর্যে ভরপুর এক তরুণী, সত্যভাষণে অকপট ও ঋজু। জীবনের প্রভাতবেলায় বাঙালি সংস্কৃতির বৃক্ষছায়ায় দাঁড়িয়ে ‘রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে’ যে প্রতিজ্ঞামন্ত্র তিনি উচ্চারণ করেছিলেন, সেই প্রতিজ্ঞামন্ত্র জীবনের অপরাহ্ন বেলাতেও ভুলে যাননি তিনি। সংস্কৃতিকে বেছে নিয়েছেন জীবনের পাথেয় হিসেবে, সত্য-সুন্দর-প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শাণিত হাতিয়ার হিসেবে। নবতিপর জন্মদিবসে বাঙালি সংস্কৃতির অভিভাবক সনজীদা খাতুনের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।