গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে জন্ম নিয়ে, বেড়ে উঠেও মনস্তাত্ত্বিক কারণে বাঙালি চিরকাল শীতবিলাসী। দীপাবলির আলোকসজ্জাকে হেমন্তিকা আঁচল দিয়ে গোপন করল কী করল না বাঙালি-মন অতি আগ্রহী হয়ে পড়ে তাপমাত্রার পারদের অবনমনের খোঁজে। উৎসবপ্রিয় বাঙালি আসলে এক উৎসব শেষ হতে না হতেই আর-এক উৎসবের পরিকল্পনা শুরু করে দেয়। ভাইফোঁটার মহাভোজ পরিপাক হবার আগেই ভোজনপ্রিয় বাঙালি নলেন গুড়, পিঠেপুলি ও কেক-পেস্ট্রির রসনায় স্বপ্নিল হয়ে পড়ে। আর যিশুপুজো শুরু হবার কিছুদিন আগে থেকে শুরু করে নতুন বছরের প্রথম এক-দু’মাস বাঙালির হেঁশেলে বিভিন্ন রকম পিঠে আর হালফিলের অনেক কিচেনে তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে বিভিন্ন ধরনের কেক-পেস্ট্রি। বর্তমানে তা অনেকের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও পথ দেখাচ্ছে। কিন্তু জানেন কি, বাঙালিকে বাংলা ভাষায় প্রথম ‘কেক, বিস্কুট ও পেস্ট্রি’ বানাতে শিখিয়েছেন একজন আদ্যন্ত কবি?
হ্যাঁ, বাঙালিকে বাংলা ভাষায় কেক, পেস্ট্রি ও চায়ের সঙ্গে জীবনসাথির মত জড়িয়ে থাকা বিস্কুট ঘরোয়া উপায়ে বানাতে শিখিয়েছেন যিনি, তিনি আদতে একজন কবি। নাম সাধনা মুখোপাধ্যায়। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কবিতা রচনার পাশাপাশি রন্ধনপ্রণালী, জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিশুতোষ সাহিত্য বিষয়ে লেখালিখি করেছেন বিস্তর। তিনি একাধারে কবি, সুলেখিকা, রন্ধন-পটিয়সী, শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবিকাও। ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’-র এক যথার্থ উদাহরণস্বরূপ ছিলেন তিনি।
সাধনা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৬ ডিসেম্বর এলাহাবাদে। তিনি ভূগোলে মাস্টার ডিগ্রি লাভ করেছিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিটি করেন। এরপর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন শিক্ষকতা দিয়ে। পরে একটি শিশু–কিশোর পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে দীর্ঘদিন কাজও করেছেন। অবসর নেওয়ার পর অবৈতনিক শিক্ষাদান ও সমাজসেবামূলক কাজেও নিযুক্ত ছিলেন। দীর্ঘ সাড়ে চার দশক ধরে তাঁর কবিতা ‘দেশ’ ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতার বইয়ের নাম ‘আকাশ কন্যা’। প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে। তার পর ‘দোপাটির ইচ্ছে’ (১৯৭০), ‘ছন্দকদলী কৃষ্ণচূড়া’ (১৯৭১), ‘একদা রাজধানী’ (১৯৭২), ‘কবিতার আদালত’ (১৯৭৩), ‘প্রত্যুষের ফুল’ (১৯৭৪), ‘রমণী গোলাপ’ (১৯৭৫), ‘ছুঁই মুই লজ্জাবতী’ (১৯৮৪), ‘ক্যাপটেনের স্ত্রীর রবীন্দ্র সংগীত’ (১৯৮৬), ‘চাঁপার সিন্দুক’ (১৯৯০) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ পরপর প্রকাশ পায়। এর সঙ্গে ভূগোল বিষয়ক ও শিশুদের উপযোগী ‘জানা-অজানা’ (দুখণ্ডে), ‘দুঃসাহসিক অভিযান’, ‘বারো মাসের কথা’, ‘বিচিত্র জীবজগৎ’ ইত্যাদি বইও লিখেছেন। এছাড়া তাঁর ছোটদের বেশ কিছু গল্পের বইও প্রকাশিত হয়েছে।
সাধনা মুখোপাধ্যায় যে শিশু–কিশোর পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতেন, ওই পত্রিকাতে ‘দিদিমণি’ ছদ্মনামে লেখা তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলিই পরে ‘জানা-অজানা’ নামে কিশোর-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। কবিতা লেখার জন্য তিনি ‘প্রতিশ্রুতি’ পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি আরও একাধিক সম্মানে ভূষিত হন। তাঁর স্বামী পবিত্র মুখোপাধ্যায় পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সেই সূত্রে তাঁরা বেশ কিছুদিন দিল্লিতে বসবাস করতেন। পরে তাঁরা দুজনেই কলকাতায় চলে আসেন।
রান্নাবান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ছিল তাঁর বিশেষ উৎসাহ। তিনি রান্না সংক্রান্ত বই লেখা শুরু করেছিলেন ‘রান্না করে দেখুন’ বইটি দিয়ে। তারপর ‘চায়ের সঙ্গে টা’, ‘জ্যাম জেলি আচার চাটনি’, ‘সুস্থ থাকতে খাওয়াদাওয়ায় শাকসবজি মশলাপাতি’, ‘শরীর ভাল রাখতে কী ফল খাবেন’ ইত্যাদি এই জাতীয় অনেক গ্রন্থ। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ‘কেক, বিস্কুট ও পেস্ট্রি’ বইটি।
তাঁর লেখা অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘ফেলা ছড়ার রান্না’, ‘সুস্থ থাকতে ফলখাবার’, ‘উত্তরবঙ্গের চলতি রান্নাবান্না’, ‘ঘরোয়া রান্না’, ‘বাচ্চাদের টিফিন’, ‘মাছ রান্না’, ‘চাইনিজ রান্না’, ‘নিরামিষ রান্না’, ‘পুরোনো কলকাতার রান্নাবান্না’, ‘৭৫১ রকম সহজ রান্না ও জলখাবার’, ‘এক মলাটে তিন দেশের রান্না’, ‘কালিয়া পোলাও’, ‘মুরগী মটন’, ‘৫০১ সহজ সহজ রান্না’, ‘বিনা তেলে রান্না’, ‘পাঁচ গিন্নির পাঁচমিশেলী রান্না’, ‘ঘরোয়া পুডিং মিষ্টি পুডিং’, ‘আইসক্রিম কুলফি-মালাই’, ‘সাত রাজ্যের রান্না’, ‘পূর্ব পশ্চিম পঞ্চাশ দেশের রান্না’, ‘টি পার্টির টুকিটাকি’ ইত্যাদি।
ভোজনপ্রিয় বাঙালির জন্য খাবার তৈরির রহস্য এইসব বইতে তুলে ধরেছেন সাধনা মুখোপাধ্যায়। শুধু নিত্যদিনের উপযোগী কাজ-চালানো কিছু রন্ধনপ্রণালীই নয়, উৎসবে আর অতিথি আপ্যায়নে রকমারি চোখ-ভোলানো ও রসনা-তৃপ্তিকর খাবার তৈরি করার যাবতীয় পদ্ধতিও তাঁর বইয়ের দু’মলাটের মধ্যে রয়েছে। এইসব প্রত্যেকটি বইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, তা সহজ সরল, অনাড়ম্বর সুপাঠ্য ভাষা অথচ প্রত্যক্ষ পরখ করা অভিজ্ঞতার গুণে তা অনন্য হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন শব্দ ও ঘটনার অনুষঙ্গ বুননে, জীবনযাপনে, সৃজনশীলতায়, লেখালিখির ছড়ানো সম্ভারে সাধনা মুখোপাধ্যায়ের এক বিবিধবর্ণময়ী চরিত্রসত্তার পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠেছে।
এবার কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কাব্যপ্রতিভা ছুঁয়ে দেখা যাক। ১৯৬৬-তে দেশ-এ প্রকাশিত তাঁর ‘দোপাটির ইচ্ছে’ কবিতায় লেখেন: ‘রক্ত বড় ঠাণ্ডা লাগে বহুদিন উষ্ণতা পাইনি,/ আয়ুর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তোর কাছে তো যাইনি,’ এই উচ্চারণ যেন আমাদের ঠান্ডা ধমনীর রক্ত সঞ্চালনে শীতল এক অভিমানের দেওয়াল গড়ে ওঠার ইঙ্গিত বহন করে। আবার শব্দ গাঁথতে গাঁথতে এগিয়ে চলে, ‘চিরায়ত গোলাপের অমরতা আমি তো চাইনি’ বলেও তিনি লিখতে ভালবাসেন, ‘বেজে ওঠে বারবার মুগ্ধ তার গুনগুনানি শুনে/ আবার ইচ্ছে হয় লাল হয়ে পুড়তে আগুনে’। শেষে এসে লেখেন, ‘রোদ্দুর পোহাতে শুধু বেঁচে থাকি বার্ধক্যের শীতে’। ‘রোদ্দুর’ ও ‘বার্ধক্য’ এই দুই ভিন্নতার মধ্য দিয়ে শূন্যতা অতিক্রমের এক আত্মঅন্বেষণ কবিকে আশাবাদের এক মুক্ত অঙ্গনে পৌঁছে দেয়:
রক্ত বড় ঠাণ্ডা লাগে বহুদিন উষ্ণতা পাইনি,
লাবণ্য-লোলুপ তুই সময়-ডাইনি,
পুরনো ফসলগুলো ধুয়ে ধুয়ে বিবর্ণ করিস
নতুন মুকুল এনে উজ্জ্বলতা দু-হাতে ভরিস।রক্ত বড় ঠাণ্ডা লাগে বহুদিন উষ্ণতা পাইনি,
চিরায়ত গোলাপের অমরতা আমি তো চাইনি,
একটি জিজ্ঞাসা রাখছি যে তোর কাছে শোন,
যখন শ্রাবণ শেষে দোপাটির সব মূলধন
কেড়ে নিস, তখনো বাঁচিয়ে রেখে গাছের করুণ কঙ্কাল,
একটি কি দুটি ফুলে ম্রিয়মাণ অপ্রতিভ লাল,
কী লাভ হয় যে তোর! কী যে হয় সুখ!
আমার দীনতা দেখে, বল তুই হে লাবণ্যভুক!অনেক মৌমাছি আসে, শেফালিকা রজতহাসিনী,
মুমূর্ষু রুধিরস্রোতে আসঙ্গের ইচ্ছে রিনিরিনি,
বেজে ওঠে বারবার মুগ্ধ তার গুনগুনানি শুনে,
আবার ইচ্ছে যায় লাল হয়ে পুড়তে আগুনে।রক্ত বড় ঠাণ্ডা লাগে বহুদিন উষ্ণতা পাইনি,
আয়ুর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তোর কাছে তো যাইনি,
ফুল যবে কেড়ে নিস তখনই রিক্ত অবয়ব,
ধুলোয় গুঁড়িয়ে দিস, তা না হলে ইচ্ছেদের সব,
কণ্ঠরোধ করে দিস মুকুলের মৃত্যুর নিশিথে,
রোদ্দুর পোহাতে শুধু বেঁচে থাকি বার্ধক্যের শীতে।
(দোপাটির ইচ্ছে)
আবার ‘নির্মম আঙুল’ কবিতায় তিনি জীবনের এক প্রখর বাস্তবের কথা মনে করিয়ে দেন:
লোকটার দ্বারা কিছুই হবে না
এমন মায়াবী ও যে
বাগানের আগাছাও তুলতে পারে না
সাধের বাগানটার
বসরা গোলাপ দামি
পাশে তার
বেড়ে ওঠে ঝাঁপিয়ে দাপিয়ে
আসশেওড়া বাসকলতার ঘন ঝাড়আসলে মসৃণ হতে হলে
নির্মম আঙুল চাই
পরগাছা তোলবার
এমন কি স্বশরীরজাত শ্মশ্রু
মমতায় ক্ষৌরী না করে দিলে
ঢেকে দেয় চিবুকের
ইঙ্গিতবহনকারী গঠন বাহারমুখের বাগানজাত
ঠোঁটের ফোয়ারা ফুলে
মধু উদ্রেককারী সম্ভাবনা
উপদ্রবকারী রোম
সবকিছু গ্রাস করে নেয়
মৌমাছিরা দংশন করে না আর হুলে
আসলে সফল হতে হলে
পরগাছা তোলবার
ক্ষমতাটা চাই
নির্মম আঙুলে।
(নির্মম আঙুল)
‘কেঁদো না বালিকা তুমি’ কবিতায় তিনি কোমল আরোগ্যময় মরমিয়া ভাষায় সমাজের পাপ বহনকারী এক নিষ্পাপ বালিকাকে তার তিক্ত যন্ত্রণার ভার লাঘব করেছেন এভাবে:
তোমার নিষ্পাপ গালে
জলের বিন্দু লেগে আছে
বলো না বালিকা তুমি অশ্রুর কারণ
তোমাকে কি কোনো স্থানে পেয়ে নির্জন
তাড়না করেছে কোনো নিষ্ঠুর বালক
কেড়ে নিয়ে গেছে হাত থেকে
তোমার ও শ্রমলব্ধ নীলকণ্ঠ পাখির পালক
কেঁদো না বালিকা তুমি
তুমি কাঁদলে কষ্ট হয় পৃথিবীর
বৈশাখে প্রাবৃট্ ঋতু শুরু হয়ে যায়
অলক্ষ্যে বারি ঝরে
অশ্রু সুনিবিড়
অপাপবিদ্ধা তুমি
অহংকারহীন এক
পবিত্রতার ছবি আঁকা
তুমি কাঁদলে পৃথিবীর
অন্তর ব্যথিত হয়
তার বহু যুগ আঁকা বাঁকা
অর্ধচাঁদ পূর্ণচাঁদ প্রতিপদ
অমাবস্যা স্তরায়ণ
সমস্ত পেরিয়ে
তোমার মূর্তিটিকে সম্পূর্ণ করেছে
যে বালক কেড়ে নিল তোমার পালক
তার যেন পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছে
নিশ্চিন্ত থাকো তুমি মনে মনে
প্রায়শ্চিত্ত করবে সে ঘোরতর
ভীষণ গভীর এক
পৌঁছিয়ে যৌবনের বনে
(কেঁদো না বালিকা তুমি)
‘আমার আলোকতীর্থের বন্ধুরা’ কবিতায় কবি অকপট স্বীকারোক্তিতে তীব্র আত্মসর্বস্ব সৃষ্টির দম্ভে মশগুল স্বপ্নভঙ্গের অনুভূতিকে নিজেই নির্মোহভাবে বর্ণনা করেছেন:
আমি ও আমার আলোকতীর্থের বন্ধুরা
শক্তীশ হিমাদ্রী আর রমল সৌরেন,
কৃষ্টির সমস্যা নিয়ে বড় বেশী চিন্তিত ছিলাম;
এবং নিত্যদিন আমরা ক’জন,
বিবিধ বিষয় নিয়ে ডজন ডজন,
লিখতাম যত না,
তার চেয়েও বেশী,
—বকতাম কথা কইতাম।আমি ও আমার আলোকতীর্থের বন্ধুরা
শক্তীশ হিমাদ্রী আর রমল সৌরেন,
আমাদের মুখে ছিল এঞ্জেলো, দ্য ভিনচি, অ্যালিয়েট,
লরেন্সের নাম;
এবং নিত্যদিন আমরা ক’জন,
শূন্য চায়ের কাপে ডজন-ডজন,
জানতাম যত না,
তার চেয়েও বেশী,
—বিদ্যে জাহির করে তর্কের ঝড় তুলতাম।আমি ও আমার আলোকতীর্থের বন্ধুরা
শক্তীশ হিমাদ্রী আর রমল সৌরেন,
স্নাতক-উত্তর শ্রেণী অহংকারে ঝলমল মুখ,
স্থির বিশ্বাস ছিল,
যা-কিছু হয়েছে লেখা,
পুরনো যা-কিছু শেখা,
হাস্যকর; আমরাই একদিন ভরে দেব সৃষ্টির বন্ধ্যতার বুক।আমি ও আমার আলোকতীর্থের বন্ধুরা
শক্তীশ হিমাদ্রী আর রমল সৌরেন,
অনেক বছর বাদে এর ওর টুকরো-টুকরো খবর পেলাম
শক্তীশ কেরনি আর হিমাদ্রী স্টেনো,
রমল ওষুধ বিক্রি করে,
বাস-স্টপে সৌরেন
এক গাল হেসে বলে, বিয়ে করে ফেললাম,
পুটিয়ারী ইস্কুলের মাস্টারী জুটে গেছে।
আমি ও আমার আলোকতীর্থে এক বন্ধু
সেই উপলক্ষেই বহুদিন পরে,
আনন্দে যত না,
তার চেয়েও বেশী,
—বুভুক্ষায় রেস্তোরাঁয় বাসী মাংস
আহারে এলাম।
(আমার আলোকতীর্থের বন্ধুরা)
‘গোসলখানায়’ কবিতায় তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন হয়তো প্রাপ্তির চেয়ে স্বপ্নই অধিক মধুর:
গোসলখানায় ঢুকে বসেছিলে একদিন আমাকে করাবে স্নান
সেই থেকে বুক আনচান করে
কেঁপে আছি ভেতরে ভেতরে
ব্যগ্র ব্যাকুল হাতে সাবান জোগাড় করি
গন্ধতেল নির্যাস
মাথাঘষা রিঠে তাও যত্ন করে রেখেছি কৌটোয়
আর আছে প্রলেপন কমলা সরের
কখন মাখবে তেল কখন সাবান কখন বা অঙ্গরাগ
তা তো জানা নেই
তোয়ালে গামছা দুই রেখেছি একান্তে কেচে
যে কোনওটা নিও অভিরুচি
জল মুছি জল মুছি বলবে যখন তুমি
তখন দু’হাত ধরে আবদারে জড়ানো গলায়
বলব আরেকটু থাকে আরেকটু রাখো
নরম সাবান এই বুকে
তেলের সঙ্গে দাও মাখিয়ে তোমার পৌরুষ
সেই ছবি কল্পনায় সারা দেহ টানটান
প্রতীক্ষায় দিন কাটে প্রতীক্ষায় রাত
হয়তো প্রাপ্তির চেয়ে স্বপ্নই অধিক মধুর
জানি না অঙ্গের কি যে আচরণ গোসলখানায়
দরোজা যদি বন্ধ করে দাও অকস্মাৎ!
(গোসলখানায়)
আবার তিনি যখন ছোটদের জন্য ছড়া লিখছেন; ‘মাঠ চাই’, তখন শিশুমনের নিখাদ চাওয়াপাওয়া ধ্বনিত হচ্ছে তাঁর কবিতায়:
পাড়ায় একটা মাঠ আছে ভাই তাই তো মরি ত্রাসে
হঠাৎ সেটা না পড়ে যায় ফ্ল্যাট-বাড়ির গ্রাসে
এইখানেতে খেলতে আমি
পা দিয়ে বল ঠেলতে আমি
মনের পাখা মেলতে আমি
ক্রিকেট খেলি ঘাসেধুলোর মধ্যে লুটিয়ে পড়ি
সবুজে দিই গড়াগড়ি
পাখি দেখি নানান রঙের উড়ছে নীল আকাশেএ ওর ঘাড়ে লাফাই ঝাঁপাই
চিৎ হয়ে শুই ডিগবাজি খাই
প্রাণ খুলে গান আনন্দে গাই
কত রকম দুষ্টুমি যে মাথার মধ্যে আসেআরও আছে গাছগাছালি
শিউলি ফুলের খরা ডালি
ঝাঁপিয়ে চুমু কুড়িয়ে নিই
পুজোর অবকাশে
(মাঠ চাই)
তাঁর ‘ছুটির গল্প’ কবিতাটি যেন সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকের গ্রীষ্মাবকাশে মামাবাড়ি, দাদু-দিদার বাড়ি বেড়ানোর স্মৃতিময়তার সঙ্গে সঙ্গে সেইসব মুখরোচক ঘরে বানানো খাদ্যসম্ভারের উল্লেখ করে পাঠকদের নস্টালজিক করে তোলে। আর এভাবেই কবিতা এবং রসনা বিষয়ক লেখার মিলিত এক বৃত্ত গড়ে ওঠে তাঁর কৃতিত্বের অনায়াস দক্ষতায়। সাধনা মুখোপাধ্যায় তাই বাঙালি জীবনে অন্য এক ‘ভোরের অ্যালার্ম’।
করোনা ও তজ্জনিত লকডাউনের সময় ০৬.০৯.২০২০-তে তাঁর চলে যাওয়া বড়ই নীরবে সম্পন্ন হয়। কিছুটা চেনা আর অনেকটা অচেনার পর্দা সরিয়ে যদি উৎসাহী পাঠক তাঁর সৃষ্টি আহরণে উদ্যোগী হন, তবে হাঁটতে শুরু করলেই নিজেকে নিজে ভাল রাখার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের ও অন্যান্যদের ভাল রাখার রসদ খুঁজে পাবেন নিশ্চিতরূপে একথা বলাই যায়। আসলে, এক নিদাঘ সময়ের কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় নিজের সৃষ্টির সঙ্গে কখনওই দ্বিচারিতা করেননি। তাই তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে উজ্জ্বল মত ও পরিকল্পনাগুলো উপযুক্ত অনুধাবন করলে সমৃদ্ধ হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়কে জানতে পেরে ভাল লাগল। লেখককে অভিনন্দন।