Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রুপোর কাঠি

কয়েক বছর আগে একটা ভারী ঝড় টেনে নিয়ে গেছে নারকেল গাছের মাথাটা নাকি সেই কয়েকদিনের বাজে পুড়ে গেছে সেটা, কেউ নিঃসন্দেহে কিছু বলতে পারে না। গৃহস্থের অমঙ্গলের কথা ভেবে গাছটাকে তাড়াতাড়ি কেটে ফেলার পরামর্শ দেয় কেউ কেউ। গাছটা উপকূল অঞ্চল থেকে কাছে বলে তার উপর ঝড়ের অধিকার ছিল অনেক বেশি। একটা দানবীয় চেহারা কিংবা একটা স্মৃতির দুঃখ, দুঃখের ক্ষত হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে।
সুদর্শন আজ একটু অন্ধকার থাকতেই ঘুম থেকে উঠেছে। ঘুম বলা ভুল। সারা রাতের দুঃস্বপ্ন যদি ঘুমকে গাঢ় হতে না দেয় তবে সেই ঘুমের আর রাতের ছাপ গোটা মানুষকে মরা মাছের চোখের মত করে তোলে। সুদর্শন তেমন রূপ নিয়েই দাঁড়িয়েছিল। দক্ষিণদুয়ারী ঘরের বারান্দায় বেরিয়ে ঠায় তাকিয়ে আছে ওই বাজ পড়া নারকেল গাছটার দিকে (অন্তত এই মুহূর্তে, সুদর্শন গাছটার মৃত্যুর জন্য ঝড়কে দায়ী করে না)। ঘাসে ঢাকা খামার। নানা রকমের গাছপালার সঙ্গে আগাছা মিলেমিশে একটা ধাঁধা তৈরি করেছে যেন। গাছটাকে সে আজ আবিষ্কার করেছে একসময়ের জীবন প্রাচুর্যে ভরপুর একটা ভালবাসা আর বিশ্বাসের স্তম্ভ হিসেবে। দিনের বেলায় যা ন্যাড়া দাঁড়িয়ে থাকে। শূন্য। এখন অন্ধকার তাকে সাজিয়েছে। একটু পরে আলো তাকে হত্যা করবে। কেড়ে নিয়ে যাবে তার সৌন্দর্য। কিছুই করার থাকবে না এমন অসহায় দাঁড়িয়ে থাকবে সে।
বছর বাইশের সুদর্শন সত্যিই সুদর্শন। লম্বা চেহারা। মাথা ভর্তি চুল। শুধু বয়সের কারণে গালের কিছু জায়গায় ব্রণ আর ব্রণ পরবর্তী কালো দাগ গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। সে খুঁড়িয়ে হাঁটে না। চোখে কম দেখে না। গায়ে যেমন মাংস থাকলে এই বয়েসের একটি ছেলেকে সুঠাম দেখায়, সুদর্শনের তা ছিল। আছে। কাল রাত করে একসাথে বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে খাওয়া শেষ করে ঘুমোতে যাওয়া অব্দি সুদর্শন ছিল সুসম্পন্ন। এখন তাকে খুঁত ধরেছে। রাতের দুঃস্বপ্ন তাকে মনে আর শরীরে খোঁড়া করে দিয়েছে।
ঘুম ভাঙার পর অন্ধকার। অন্য কিছু চোখের সামনে দেখতে পেলে, পেতে থাকলে সুদর্শনের কাছে হয়তো তার স্বপ্নের তীব্রতা আর মনখারাপের উপর চড়া পড়ে যেতে পারত। তা আর হয়ে ওঠেনি। বরং বিছানা ছাড়ার পর থেকে সে সবচেয়ে বেশি ভেবেছে ওই স্বপ্নটাকে নিয়ে। একটা শিকার করে এনে ঘরের সবার প্রিয় সাদা পাংশুটে বিড়ালটা যেমন খেলিয়ে খেলিয়ে থাবা মারে শিকারের নরম দেহে। তার বেঁচে থাকার আকুতিকে আরও তীব্র করে তোলে। তেমনই সুদর্শন খেলছে ওই স্বপ্নটার থাবার তলায়। অবসন্ন শরীরে সবচেয়ে বেশি আসে মৃত্যুর চিন্তা। সেই মৃত্যু অব্দি হয়তো তাকে ওই থাবাটার দিকে ভয়ার্তভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে।
সকাল হতে আর বেশি বাকি নেই। আলো ফুটে উঠলে মানুষের চোখ যা দেখে, দেখতে শুরু করে, সেই সত্যকে কাল রাত থেকেই প্রশ্ন করতে শুরু করেছে সুদর্শন। একটা গোধিকা খামারের ঘাসগুলো আমূল নাড়িয়ে চলে যাচ্ছে পূর্বদিকের পুকুরটার দিকে। এত বড় হওয়া সত্ত্বেও কোনওদিন সুদর্শন গোধিকা দেখেনি। বাবার কাছে গল্প শুনেছে। বিবরণ পেয়েছে। দেবী চণ্ডীর সঙ্গে কেমন একটা মিলের কথা বলেছিল বাবা। সুদর্শন শুনেছে। অলৌকিকতার সঙ্গে ঘুলিয়ে ফেলেছে গোধিকাকেও। ভেবেছে বাস্তবে গোধিকা বলে কিছু নেই। হয় না। আজ এই মুহূর্তে নিজে না দেখলে বাবার কাছে শোনা ওই প্রাণীটার অস্তিত্ব সম্পর্কে তার সন্দেহ আরও প্রবল হত। কালকের স্বপ্নটাই তো এরকম বিশ্বাস অবিশ্বাস নিয়ে। অথচ এমন সময়ে গোধিকার রূপ সে ভালভাবে দেখতেও পেল না। ঘাসে ঢাকা হয়ে গেছে কিংবা তার দুঃস্বপ্নের ভাবনায়।
সুদর্শন পাগল হয়ে যাচ্ছে। এই পাগলামির শেষ হতে পারে কোনও একটা সিদ্ধান্তে। সেই সিদ্ধান্তের জন্য তাকে আরও অনেক কিছু ভাবতে হবে। সকাল হওয়ার অনেক পরে বাবা মা বিছানা ছাড়বে।
একদিন তার বাবা তাকে নিয়ে খুব গর্ব করল। বলল— ‘আমার ছেলে আর যাইহোক, মিথ্যে কথা বলবে না কোনওদিন। অন্তত ভুল কিছু বলে বা করে থাকলেও আমাকে এসে বলবে। আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত।’
মা-কে শোনানোর জন্য কথাগুলো বললেও সুদর্শন শুনতে পায়, এমনই উদ্দেশ্য আর অভিমুখ ছিল বাবার। বাস্তবিক বাবার আদলে ছোটবেলা থেকেই নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছিল সুদর্শন। বাবা তার কাছে এক আদর্শ মানুষ।
কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। ভাদ্র মাসের এই ভোরের বেলায় ঘাসের আগার চকচকে রূপ দেখে, শিশির না জল— ঠাহর করতে পারছে না সুদর্শন। বাবা প্রায়ই বলে, হয়তো আজ সকালে উঠেও বলবে, ‘মেয়েদের চোখে ছলছল জলের আভা দেখতে পাওয়া কোনও পুরুষের হীনতাকে তুলে ধরে।’
মায়ের মুখটা মনে করার জন্য সুদর্শনকে ভেতরের ঘুমন্ত বিছানার দিকে তাকাতে হয় না। বাবাকে পাশে নিয়ে মা কিংবা মাকে পাশে নিয়ে বাবা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে বা ঘুম করাচ্ছে। বাবাকে দেখলে, এখনও যেকোনও সময় মায়ের মুখটা খেলে ওঠে তার সামনে।
সুদর্শন এখনও খুব বড় হয়ে ওঠেনি। হয়ে উঠবে। উঠতে হলে তাকে কোন পালক আর কোন বিনি সুতোর ওপর হাত বোলাতে হবে, সেটা সে বোঝে। বোঝার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে তাকে প্রতি মুহূর্তে বাবার আশ্রয়ে আসতে হয়। বাবা তার পিঠের ওপর হাত ঘুরিয়ে কাঁধে হাত রেখে বুঝিয়ে দেয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করে। গল্পের ছলে স্নেহ করে। সুদর্শনকে অবাক করে দিয়ে কীভাবে যেন তার বাবা তার কাছে দেবতা হয়ে উঠছে। যে চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে, সে চোখ কোনও পাপ করেনি। এত নিশ্চিন্ত একটা মন নিয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে চায় সুদর্শন। স্কুল পেরিয়ে কলেজ কিংবা খেলার মাঠে অনেকের সঙ্গে তার জানাশোনা আছে। অনেক গুরুজন তার বাবাকে চেনে। সুদর্শনকে স্নেহ করে। পরামর্শ দেয়। কিন্তু সেসব কথা দিগন্ত অব্দি ভেসে ভেসে এক রকম মিলিয়ে যায়। ধাক্কা পেয়ে ফিরে আসে না। পথচলার জন্য সুদর্শনের বাবা তার আগে আগে হেঁটে চলছে যেন।
এই ক’দিন আগেই ধান্যখোলার মুরারি মহাপাত্র বাড়ি বয়ে এসে সুদর্শনকে শাসিয়েই গিয়েছিল একরকম। তার মেয়ে পড়ে স্কুলে। দ্বাদশ শ্রেণি। দেখতে সুন্দর। শুনতেও বোধহয়। সুদর্শন নাকি নজর ফেলেছে তার মেয়ের উপর।
—সমাজের সেই জায়গাটায় ঘা আছে রে বাবা, যেখানে লোভ আছে। কাকগুলোর কা কা চিৎকার আমরা শুনতে পাই, একটা ডামাডোল অনুভব করি কিন্তু যে দামাল ছেলেটা ঢিল ছুড়ে পালিয়েছে, তাকে ধরি না।
হলদি নদীর পাড়ের যে জায়গাটা পরপর দু’বর্ষায় ভেঙে গেছে, সেই জায়গায়ই নিশ্চিন্তে বসে আছে সুদর্শন। বাবা আছে তাই। কাঁচা পাকা মাথার এই মানুষটাকে এই ভাঙা বাঁধের থেকেও বেশি বিশ্বাস করে। ভর করে সে।
আজ ভাটা। হলদি সামনের কিছু অংশ জুড়ে কাদার মোলায়েম কাপড় গায়ে দিয়ে আছে।
—মানুষের এই জীবনটা আমরা দেখতে পাই, চোখের সামনে যা আছে।
কথাটা শুনে সুদর্শন বাবার চোখ ধরে হলদির পলি কাদায় স্থির হয়ে যায়। একটা চুনা মাছ থেকে গেছে কাদা লেপ্টে। খুঁজে খুঁজে মাছরাঙা তাকে ঠোকর মারছে।
—ওটা থেকেই জীবনের শুরু। ওর পরেই আসল জীবন।
দূরে একটা জেলেনৌকার স্থির অপেক্ষা আর সুদর্শনের দৃষ্টির মাঝে তার বাবার এলোমেলো চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।
বাবাকে সুদর্শন একবার কবি ভাবে। কল্পনা করে উঁচু মানের কোনও দার্শনিক হিসাবে। এইটুকু মাত্র জীবন পরিসরে বাবা তার কতখানি জায়গা জুড়ে আছে! আর কোনও পুরুষ বা প্রকৃতিতে তার মন বসে না। এইসব কল্পনার পরেও সে কেবল এই ভাবনা শেষ করে একটা স্বস্তিচিহ্নে যে, এই মানুষটা তার বাবা। কেবল তারই বাবা। যেখানে অলীক মেঘ আছে। বৃষ্টি আছে আর গাত্রদাহের বিরাম আছে। মনের সব কথা, সব সুতো সে বাবার সামনে মেলে ধরতে পারে। বাবা সেই সুতোর গিঁট ছাড়িয়ে সুদর্শনকে শেখায় গিঁট ছাড়ানোর উপায়।
গোধিকা কখন চলে গেছে সুদর্শনের দগদগে স্মৃতির ওপর দিয়ে। সে কুলিয়ে ওঠা অব্দি যতক্ষণ পেরেছে, তার নড়াচড়া দেখেছে নিশ্চল চোখ দিয়ে। মনের ভেতর অবিরাম বয়ে চলা ধূসর কিংবা তাজা স্মৃতিগুলো এলোমেলো করে গেছে তার সামনের দৃশ্য। সেই এলোমেলো দৃশ্যে একা দাগ রেখে পড়ে আছে ঘাসের গা থেকে জল মুছে দেওয়া পথ। বাদামী ভোর কীভাবে কমলা সকাল হয়ে উঠল, আজ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে দেখতে পারল না। সামনের ন্যাড়া নারকেল গাছটা এখন কমলার ছাড়ানো কোয়ার মত প্রাণের পরের অধ্যায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা মা এখনও ওঠেনি।
—একজন শিক্ষকের কক্ষনো পিতা হওয়া উচিত নয়। অন্তত ভাল পিতা সে কখনওই হতে পারে না।
বাবার কোনও কথা সুদর্শন মানে, কোনওটা মানতে পারে না কিন্তু অসীমের আশ্রয় থেকে সে পালাতে পারে না। দিন দিন মানুষটাকে ছাড়া এক মুহূর্তও নিজেকে কল্পনা করতে পারছে না সুদর্শন।
সূর্যের আলো ঘাই দিচ্ছে এবার। এইবেলা একটা তীর খুঁজে না পেলে সুদর্শন এরপর কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! পায়ের তলায় কোনও থল নেই। এত দুর্বলতা! এত অসহায় নিজেকে আর কখনও মনে হয়নি তার। বাজ পড়া নারকেল গাছটায় একটা পাখি এসে বসেছে। গোপাল কাকা একদিন বলেছিল,
—দেখিস, এখনই কেটে ফেলিস না গাছটাকে। হয়তো বেঁচে আছে।
এই যে এখন একটা পাখি এসে বসেছে, হয়তো প্রাণ ছড়িয়ে দিচ্ছে গাছটার শরীরে! এসব ভাবনা কাকে বলবে সুদর্শন! রাতের দুঃস্বপ্নটা না দেখলে, এখুনি সে বাবাকে টেনে নিয়ে এসে দেখাতে পারত! পারত না কি! অনেক হাতড়ে এই অকালেও সুদর্শন মনে করার চেষ্টা করল সে বাকুলের পীতু বুড়ির কথা। বাবা বারবার ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও, চিটে থেকে বাবাকে সে জিজ্ঞাসা করতে পেরেছিল,
—এই বয়সে এসে! কেন বাবা!
বাবা কিছুক্ষণ স্থির থেকে উত্তর দিয়েছিল,
—আত্মহত্যা করতে গেলে একজন মানুষের কতখানি মানসিক শক্তির দরকার হয়! একদিন নিজেই বুঝবি বাবা…
সেদিন আর তার পরের দিনগুলোতেও সুদর্শন বাবার কাছে পীতু বুড়ির চলে যাওয়া নিয়ে কিছু জানতে চায়নি। বাবা বলেছে যখন নিশ্চিত একদিন সে নিজেই বুঝতে পারবে।
বাবা চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে সুদর্শনের মা। মায়ের কত কান্না, আটকে যাওয়া, হাত বাড়িয়ে মিনতি করা— কোনও কিছুই বাবাকে টলাতে পারেনি। বাবার সঙ্গে একজন অচেনা স্ত্রীলোক। পরীদের সৌন্দর্যের ছাঁচে গড়া তার রূপ। বাবা মায়ের সামনে তার হাত ধরে আছে। সুদর্শন কঁকিয়ে উঠছে। পাগুলো দ্রুত চালিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছে বাবাকে। চিৎকার করছে। কিন্তু তার চিৎকার কেউ শুনছে না।
স্বপ্ন ছিঁড়ে বেরিয়ে এল নাকি স্বপ্নের আয়ু তাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল, বুঝতে পারে না সুদর্শন। ঘেমে যাওয়া শরীর নিয়ে অন্ধকার রুমের মধ্যে সে চোখ ঠাহর করতে থাকে। চমকে চমকে ওঠে, এখনই ভূত দেখার মত কিছু দেখে ফেলবে বোধহয়। খোলা জানালা দিয়ে ঝিঁঝির ডাক আর আধখানা চাঁদের মেঘ ল্যাপা আলো কানে আর চোখে এলে, দীর্ঘ না হলেও একটা শ্বাস পড়ে। বিছানা থেকে নেমে বাবা মায়ের ভেজানো দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। উচিত অনুচিতের দ্বন্দ্ব পেরিয়ে দরজায় হাতের তালু বসায় সুদর্শন।
আছে। এক টুকরো বিশাল মাংসপিণ্ডের মত অগোছালো পড়ে আছে বিছানায়।
পড়ে আছে!
মাংসপিণ্ড!
কোন পথে বইছে সুদর্শন? নিজেকে বইয়ে দেওয়া ছাড়া এ আর কী? চেতনার এমন ভাষা তাকে তাড়া করছে। একটা ঝুরি ধীরে ধীরে মাটিতে পুঁতে যাচ্ছে। একক কাণ্ড হয়ে যাচ্ছে সে। গাছ ভাবতে শুরু করছে লোকে। এক্ষুনি তার বাবা উঠে বসবে, তাকে ডাকবে। কিন্তু মাংসপিণ্ড ভাবতে শুরু করেছে যাকে, তার ডাকে সে ছুটে পালাতে গিয়ে হোঁচট খাবে না তো!
এক গর্ভবতীর পেট থেকে নবজাতক বেরোনোর পর লাল জল আর ফুল বেরোচ্ছে যেন। স্বপ্ন ক্রমে দুঃস্বপ্ন বনে যেতে থাকে। দুঃস্বপ্নের চারিদিকে এক ফাঁদ যেন গ্রাস করছে সুদর্শনকে। অন্ধকার চেপে বসছে তাকে। তখনই সে বাইরের দালানে এসে দাঁড়ায়।
অন্য সকালের মত নয় এই রোদ। এই রোদে মাথা রেখে ভরসা করা যায় না, বুঝতে পারছে সুদর্শন। মা দালান দিয়ে বেরিয়ে খিড়কি দরজা দিয়ে বাসি বাসন নিয়ে যায় ঘাটে। বাবার খালি গা। দালানে পাতা বেঞ্চটার ওপর বসতে গিয়ে সুদর্শনের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। সুদর্শন দেখে বাবার ভরাট ঘুমের ফোলা ফোলা চোখ। আর তাকাতে পারে না সেদিকে। নারকেল গাছটা বাজের ঘাতেই মারা যায়, স্বপ্নের অমঙ্গল থেকে নিশ্চিত হয় সুদর্শন। রঙিন পাখিটা এখন আরও স্পষ্ট। গাছটার টঙে বাজ পড়া গর্তের দিকে তাকিয়েই আছে। পাখিটার দিকে আঙুল তুলে কিছু জানতে চেয়েও আটকে যায় সুদর্শন। একটা দলা পাকানো পিণ্ড তার গলা দিয়ে অনেক কষ্টে নেমে যাচ্ছে। পাখিটা এতক্ষণ নীরব থাকার পর ডাকতে শুরু করেছে।

চিত্রণ : মুনির হোসেন
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »