দুহাজার বাইশ-এর বসন্ত কাল। হালকা শীতের ভাব ছড়িয়ে আছে গঙ্গার ওপর। এখানে গঙ্গা বেশ প্রশস্ত। ছোট ছোট ঢেউ জলে। এখনও মঠের কোনও গুরুভাইরা কেউ ঘাটে আসেননি। তিনি আকণ্ঠ অবগাহন করে ঘাটে এসে দাঁড়ালেন। প্রথম সূর্যের আলো চুল থেকে পা ধুইয়ে দিচ্ছে। সারা শরীর থেকে যেন জ্যোতি ফুটে বেরোচ্ছে। আবার কতদিন বাদে সেই গঙ্গাস্নান। দেহমন জুড়িয়ে গেল।
পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন বহু। কাটিয়েছেন অনেক সময় মায়াবতীতে, হিমালয়ের আনাচেকানাচে, কিন্তু বরাবর পাহাড়ের থেকে নদী-সমুদ্রকেই প্রাণবন্ত লেগেছে বেশি। ওরা বেগবান, কতকাল ধরে চলছে তো চলছে। প্রাণের সাড়া আছে। বাধা দিলে উত্তাল হয়। ধরতে চাইলে চলে যায়। চলমান ধারায় অবগাহন মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। নতুন প্রাণসঞ্চার করে।
সকাল সকাল ওঠবার অভ্যেস স্বামীজির। সেইটাই রয়েছে। গতকাল রাত্রিতে এসেছেন ঠিক ন’টায়। যখন ঠিক ছেড়ে গেছিলেন সেই সময়। মহারাজকে স্বপনে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মানা আছে পাঁচকান হতে। সবাই ওঠার আগেই সাতসকালে গঙ্গাস্নান করে স্বামীজি দোতলায় নিজের বাড়িতে ফিরে এলেন। বিছানা পাতাই আছে। কিন্তু বড় বাহুল্য। কষ্ট হল। এখন আর কলসিতে জল রাখা নেই। সুন্দর কাচের জাগে জল, সঙ্গে গ্লাস। রাত্রে ভাল করে দেখেননি, স্নান করে এসে ভাল করে ঘরটা দেখে ব্যথায় মন ভরে গেল। যেমন ছেড়ে গেছিলেন তেমন কি রাখা যেত না? তাহলে ও-পারেও কি এরকম বাহুল্যের মধ্যে গুরুদেব আটকে আছেন?
মনে মনে চিন্তা করলেন সময় বড় কম। যা কিছু কাজের কথা গুরুভাইদের বলে দিতে হবে। যা করে যেতে পারেননি সেই কাজগুলো গুছিয়ে তুলতে হবে। ধুতি আর ফতুয়া পরে মাটিতে ধ্যানে বসলেন অপরূপ মানুষটা। শারীরিক অসুবিধা, পেটের অসুবিধা, হার্টের অসুবিধা আছে যেমন রেখে গেছিলেন। এখন আর কিছু করা যাবে না। কিন্তু চোখ দুটি সেই উজ্জ্বল, সেই গভীর, চাইলে হৃদয়ের অন্তস্তল অবধি প্রবেশ করে দেখতে পান। এমন চোখ তো দেবতারই হয়।
অনেক চেষ্টাচরিত্র করে সময় মাত্র দিনকয়েক পাওয়া গিয়েছে। পরিচয় ছড়ানো যাবে না। জানলে সময় কমে যাবে।
দরজায় খুট খুট শব্দে ধ্যান ভাঙল। মঠের প্রধান মহারাজ এসেছেন। উনি এসেই গড় হয়ে সাষ্টাঙ্গে স্বামীজিকে প্রণাম করে হাতদুটি সামনে এনে দাঁড়ালেন। সাক্ষাৎ আরাধ্য দেবতা সামনে দাঁড়িয়ে। চেয়ে দেখছেন, এই সেই স্বামীজি! কত গল্প, কত কথা, কত কর্মের কথা শুনে বড় হয়েছেন। স্বয়ং সামনে বসে আছেন। সাদা একটি ধুতি আর ফতুয়া পরা। নিজেকেই নিজে বিশ্বাস করতে পারছেন না। হাত-পা মৃদু কাঁপছে। চোখ দুটি বিস্ফারিত। সারা শরীরে অদ্ভুত কম্পন। স্বামীজির কল্পনার অধিষ্ঠান আজ শাখা পল্লবিত হয়ে মহীরুহে পরিণত। কেমন লাগছে ওঁর?
স্বামীজির মুখে মৃদু হাসি। চুলগুলি কাঁচাপাকা। এখন আর অসুখে ভোগা ক্লান্ত মুখ নেই। বড় বড় চোখ। যেন অতলান্ত দেখতে পাচ্ছেন। এমন চোখও হয়? তাকিয়ে থাকলে নামানো যায় না। এও কি সম্ভব? উজ্জ্বল মুখে প্রশান্তি বিরাজ করছে। স্বামীজি পিঠে হাত রেখে খুব নরম স্বরে বললেন ‘তোমাদের শুভ হোক। আমি কি তোমাকে দেখেছি জীবদ্দশায়?’ মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়লেন প্রধান, ‘আজ্ঞে আমি তখনও জন্মাইনি।’
স্বামীজি আশ্চর্য হয়ে বললেন ‘কত বছর হল? এখন মনে হচ্ছে এই তো সেদিন। সেবার যাবার আগের দিন নিবেদিতা এসেছিল। পরিষ্কার মনে আছে। যাবার দিন শরীরটা ভালই ছিল। দিব্যি হালকা। গঙ্গায় মাছ ধরা হল। জমিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, ভাজা, টক খাওয়া হল। বিকেলে বেলুড় বাজার অবধি হেঁটে গিয়ে আবার ফিরে এলাম। শরীরটা খারাপই ছিল। হঠাৎ সন্ধেবেলা কি যে হল ধ্যানের মধ্যেই চলে যেতে হয়েছিল।’
‘আজ্ঞে, আপনি গেছেন ১৯০২। একশো কুড়ি বছর।’
‘ভাবাই যায় না।’ উঠে গঙ্গার দিকের জানলাটা খুলে দাঁড়ালেন। চারিদিকে চেয়ে দেয়ালে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘অনেক সংস্কার করা হয়েছে। দরজা, জানলা সেসব আর নেই। শুধু কাঠামোটাই আছে। এমনকি সেই লাল মেঝে যার ওপর আমি শেষ শুয়েছিলাম, সেটাও নেই। শুধু কিছু সামান্য চকচকে কাঠের আসবাব। আমারও মনে নেই এইসব তখন ছিল কিনা। এত পয়সা কি ছিল? মনে হয় না। যেমনকার তেমন রাখতেও আমাদের কার্পণ্য। সাহেবরা কিন্তু দেখেছি একেবারে হুবহু তুলে রাখে। মনে হবে লোকটা মনে হয় এখুনি উঠে গেছে ঘর থেকে।’
মিশনের মহারাজ একটু চুপ থেকে বললেন, ‘এখন যেমন চায় আসলে তেমনই করে রাখা হয়েছে।’
স্বামীজি প্রবলভাবে মাথা নাড়লেন। ‘আমাদের আসল শত্রু হচ্ছে অশিক্ষা, কুশিক্ষা। প্রকৃত শিক্ষা হলে এমন করে রাখতে না। এই ধরো আমার ঘরবাড়ি কেমন ছিল, সেটাকে দেখতে হবে সেই সময়ের ভিত্তিতে। মানুষ আসলে সেটাই দেখতে চায়। তোমরা এটাকে আধুনিক আবাসে পরিণত করেছ, মন্দিরে পরিণত হয়েছে।’
‘আপনার খাবার দিতে বলি?’ মহারাজ কথা ঘোরালেন।
‘বলো। শুধু দুধ আর মুড়ি, কলা থাকলে দিয়ো। রাত্রে বেশি খাওয়া উচিত হবে না।’
মহারাজ বললেন, ‘আপনি যখন বেরোবেন তখন আপনার সাথে একজন সদ্য সন্ন্যাস নেওয়া যুবককে দেব। সেই আপনাকে কলকাতা ঘুরিয়ে দেখাবে।’
হেসে ফেললেন, বললেন, ‘কলকাতা কে আমাকে চেনাবে?’
অনেক পাল্টে গেছে স্বামীজি।
‘তোমরা কলকাতা যাও কীভাবে? দ্রুতগামী নৌকা?’
‘না, এখন অনেকগুলো কংক্রিট-এর ব্রিজ হয়েছে। কয়েক মিনিট লাগে পার হতে।’
স্বামীজি একটু অবাকই হলেন। বললেন, ‘আমাদের অনেক সময় লাগত আসতে। পন্টুন ব্রিজ ছিল কিন্তু মাঝে মাঝে জাহাজ চলাচলের জন্যে বন্ধ থাকত। নদীর ওপর দেখে মনে হল গঙ্গা অনেক সরু হয়ে এসেছে।’
‘আপনি খেয়ে নিন, আমি দেখি সেই যুবক কোথায়?’
মহারাজ নেমে গেলেন। স্বামীজির বিস্ময় যেন যাচ্ছেই না। জানলা দিয়ে দেখে মনখারাপই হল। প্রতিটি ঘাস ছোট করে ছাঁটা। এখানে ওখানে যত্ন করে ফুলের সমারোহ করে রাখা আছে। যারা আসে তারা যেন সুন্দর একটা পরিবেশ পায়। প্রত্যেকটি বাড়ি সুন্দর হালকা গেরুয়া রঙে রাঙানো। এমনকি ব্যাটারি চালিত গাড়িও যেন দেখলেন।
আজ কলকাতা ও নিজের বাড়ি একটু দেখবেন। মানুষজন একটু দেখবেন। কাশীপুর, বলরাম বসুর বাড়ি, নিজের বাড়িটা দেখবার ইচ্ছে আছে। এখানে কিছুটা নির্জনতা আছে। শহর হলে খুব মুশকিল ছিল।
যুবক সন্ন্যাসী আকাশ মহারাজকে নিয়ে বেরিয়েছেন। মুখে মাস্ক, মাথায় গেরুয়া টুপি, গায়ে গেরুয়া উত্তরীয় আর ধুতি। মঠ থেকে বেরিয়ে স্বামীজি বললেন, ‘একবার বেলুড় বাজারটা দেখে তারপর তুমি যেমন নিয়ে যাবে সেরকমই ঘুরব, দেখব। শেষ চলে যাবার দিন একবার এসেছিলাম।’ এখন আকাশ-পাতাল তফাত। বড় বড় বাড়ি ঝাঁ-চকচকে রাস্তা। হেঁটেই চলে এলেন বেলুড় বাজারে। সেখান থেকে একটা গাড়ি ধরে হাওড়া স্টেশন।
হাওড়া স্টেশনে এসে স্বামীজি চমৎকৃত। ‘এত বড় হয়েছে স্টেশন? এতবড় স্টিলের হাওড়া ব্রিজ? বাহ! কী সুবিধা যে হয়েছে তোমাদের তোমরা জানো না।’
আকাশ বললে, ‘চলুন স্বামীজি স্টিমারে চাঁদপাল ঘাট যাই। এখন অফিসে টাইম নয় তাই ভিড় নেই বেশি।’ স্টিমারে উঠে যারপরনাই খুশি হলেন। ছেলেমানুষের মত একবার এদিক, একবার ওদিক গঙ্গা দেখতে লাগলেন। ছুটে এসে বললেন, ‘কতদিন, কতদিন বিকেলে বন্ধুরা মিলে নৌকা করে এসেছি। ব্রিজ তো লোহার ছিল না। যখনতখন বন্ধ থাকত। এই ব্রিজ তো অনেক পরে হয়েছে।’
এপারে এসে বড় বড় সব বাড়ি দেখে স্বামীজি বললেন, ‘আমি ঠিক এরকমই দেখেছি ইংল্যান্ডে টেমসের ধারে। চমৎকার।’ আকাশ বললে, ‘একটা গাড়ি ভাড়া করি, আপনি দাঁড়ান। নাহলে আপনার কষ্ট হবে।’
স্বামীজি আকাশের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আজ আমি অনেক সুস্থ। চলো হেঁটে ঘুরে দেখি যতটা পারি। আমাদের সময় এত গাড়িঘোড়া ছিল না। ঘোড়ার গাড়ি ছিল, ঘোড়ায় টানা ট্রাম ছিল কিন্তু অত পয়সা ছিল না পকেটে তাই হাঁটা।’ হাঁটতে হাঁটতে ফোর্ট উইলিয়াম পেরিয়ে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দূরে কালো পরী দেখে স্বামীজি দাঁড়িয়ে পড়ে আঙুল তুলে চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘ভাই, ওটা কি আকাশে? কালো পরী কোথা থেকে এল?’ আকাশ হেসে ফেলল, ‘ওটা তো ভিক্টোরিয়ার পরী। জানেন, ওটা বাতাসের ধাক্কায় ঘোরে।’ ছেলেমানুষের মত মুখে হাসি খেলে গেল। আকাশের হাত ধরে টানতে টানতে রেসকোর্স পেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এর সামনে। ‘ওফ!’ দেখতে দেখতে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। ‘চলো চলো সামনে গিয়ে দাঁড়াই।’ অপলক চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ‘এ আমি রাজস্থানে দেখেছি হোয়াইট মারকানা মার্বেল। চমৎকার আর্কিটেকচার। সঠিক অনুপাত। এরকমই কিছু সব ধর্ম সমন্বয় করে বেলুড় গুরুর জন্যে করব ভেবেছিলাম। তখন পারিনি। টাকা ছিল না। মন জুড়িয়ে গেল দেখে।’ চারিদিক তাকিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি দেখে বললেন, ‘আমাদের সময় ছিল, তবে এত আড়ম্বর ছিল না। কবে হল এই মেমোরিয়াল?’
আকাশ আন্দাজে বলল, ‘মনে হয় ১৯০৬ থেকে ১৯২১-এর মধ্যে। তবে ব্রিটিশরা তখন দিল্লিতে রাজধানী নিয়ে গেছে।’
স্বামীজি বললেন, ‘তিনটে দিঘি ছিল। দুটো তো ছোট হয়ে সরে গেছে। মিউজিয়ামের সামনেরটা দেখলাম ঠিকই আছে। মনুমেন্ট ছিল, আজ আছে। এখানে দুতিনতলা সব বাড়ি ছিল আর এখন কুড়ি বাইশ তলা। মিউজিয়াম, এশিয়াটিক সোসাইটি এরা সব ছিল, এখনও আছে। দেখে ভাল লাগল।’
আকাশ বলল, ‘আপনি দক্ষিণ কলকাতা যাবেন?’
উনি স্পষ্ট বললেন, ‘তখন তেমন কিছু ছিল না তাই দেখব না। আমার বাড়ির দিকে চলো।’
নিজে বাড়ির কাছে এসে উল্টো দিকে চাচার কেবিন দেখে, ‘এখনও আছে? বাহ! কাটলেটটা ভালই বানাত। কিন্তু যতদূর মনে হয় এপারেই ছিল।’ সামনে একটা বিশাল মন্দির, মূর্তি দেখে হতচকিত হয়ে দেখতে থাকলেন। ‘এরা কারা? আমার বাড়ি কোথায়?’ মুহূর্তে চোখ জলে ভরে গেল। ‘কষ্ট করে এর শরিকি ঝামেলা মিটিয়ে দিয়ে গেছিলাম, তার সব কোথায় গেল?’
আকাশ বললে, ‘স্বামীজি, আপনার বাসগৃহ রেনোভেশন করে এরকম চেহারা হয়েছে। ভিতরে চলুন, আপনার সব ঘরদোর একই রকম আছে। খুব সুন্দর।’
স্বামীজি গুম হয়ে অভিমানভরে পাথরের দেয়ালে হাত বুলোতে লাগলেন। টস টস করে জল পড়ে ফতুয়া ভিজে গেল। আকাশ কী বলবে বুঝে উঠতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল।
‘আপনার পছন্দ হয়নি? আপনি যাবেন না দেখতে আপনার ঘর? আপনার ভাইবোনদের, মা-বাবার ঘর?’
স্বামীজি নিজেকে খুব কষ্ট করে সম্বরণ করলেন। হেঁটে পাশের গলিটা উঁকি দিয়ে দেখলেন। তারপর বললেন, ‘আমি আমার ঘর, মায়ের ঘর খুঁজেছিলাম। পাথরের মন্দির দেখে আমি কী করব? এ আমার অচেনা। আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছিলাম নিজের বাড়ি, যেখানে আমি জন্মেছিলাম, দেখব বলে।’ মুখ লাল হয়ে আছে রৌদ্রে হেঁটে হেঁটে। ‘আজ মহেন্দ্র, ভূপেন্দ্রর কথা, রামদাদার কথা খুব মনে পড়ছে।’ সামনে রাস্তার ওপর নিজের মূর্তির দিকে তাকিয়ে চোখে জল ভরে এল আবার। শুধু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এসবের কি দরকার ছিল?’ ধীর পায়ে শ্যামবাজারের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘সুন্দর পাথরের মূর্তির চেয়ে তখনকার সময়কে ধরে রাখতে পারলে বেশি ভাল হত। আমাকে দেবতা বানিয়েছে। যা আমি কোনওদিন চাইনি। আমি সবার মাঝেই থেকেছি, অতি সাধারণ বেশেই থেকেছি। তবু মূর্তিতে রাজবেশ।’
সেন্ট্রাল এভিনিউতে গিরিশ ঘোষের বাড়ির সামনে এসে গিরিশচন্দ্রের বাড়িটা দেখে বললেন, ‘বেশ বেশ। এই তো অনেকটা এইরকমই ছিল। আর-একটু বড় ছিল।’ বলরাম বসুর বাড়িতে গুরুর ছবির সামনে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে ধ্যানস্থ হলেন। ঘর বন্ধ ছিল তাই কেউ দেখেনি সেভাবে। নিবেদিতার বাড়ি ও মায়ের বাড়ি দেখে বললেন, ‘এ বাড়িগুলো বরং অনেকটা আগের মত আছে। চলো, নৌকা করে ফিরি।’
আকাশ বললে, ‘স্বামীজি, এখন নৌকা পাবেন না বাগবাজার ঘাটে। স্টিমার আছে, চলুন তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব।’
মঠে ফিরে প্রধান মহারাজ এবং মঠচালনা সমিতির প্রথমদের ডাকলেন ঘরে।
প্রধান মহারাজ বললেন, ‘আপনি আজ এত ক্লান্ত, সকাল থেকে। এত হেঁটেছেন। কাল সকালে কথা বলি?’
ব্যস্ত স্বামীজি বললেন, ‘আমার আজ কাল বলে কিছু নেই। কিছু কাজ বাকি থেকে গেছিল। তাই এসেছি। আমি যথেষ্ট প্রাণবন্ত আছি। তোমরা এসো ঘরে।’
সন্ধ্যার আরতি, ঘণ্টার টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে। সূর্যাস্তের পর গঙ্গার দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া জানলা দিয়ে আসছে। স্বামীজি একবার করে দাঁড়িয়ে দেখছেন আবার হাঁটছেন ঘরে। গভীর চিন্তায় মগ্ন। মহারাজরা একে একে এসে প্রণাম করে ঢুকলেন ঘরে। কেউই ওঁকে দেখেননি। শুধু বইয়ে পড়েছেন, গল্প শুনেছেন।
সাদা ধুতি আর ফতুয়া পরে বসে আছেন মাটিতে। সারাদিনের ক্লান্তি নেই। আছে হতাশা, দুঃখ, পরাজয়ের বেদনা। চোখদুটি স্থির তাকিয়ে আছে সামনে কিন্তু মনে হচ্ছে অনেকদূরে কিছু দেখছেন। একটা তেজ ফুটে বেরোচ্ছে শরীর থেকে।
প্রধান মহারাজ বললেন, ‘স্বামীজি, এখন আর কেউ আসবে না মঠ বন্ধ। আপনি বলতে পারেন।’
স্বামীজি খুব ধীরে ধীরে বললেন, ‘বড় বেদনা। না এলেই ভাল হত। অনেক আশা, স্বপ্ন নিয়ে মঠ স্থাপন করেছিলাম। কিছু অসমাপ্ত কাজের কথা বলে যেতে পারিনি তাড়াহুড়োয়। কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না।’
মহারাজ বললেন, ‘আপনার সুবিধামত বলুন।’
‘ঠিক আছে, অনেক দেখলাম, শুনলাম। প্রথমেই বলি কলকাতার উন্নতি রাস্তাঘাটে, আকাশছোঁয়া বাড়িতে, ওভারব্রিজ, মেট্রো, ট্যাক্সি, বাস সবেতেই। এমনকি বাজারগুলোও পাকা হয়েছে। বড় বড় খেলার স্টেডিয়াম হয়েছে। অনেকটা পাশ্চাত্য দেশের মত লাগছে। মানুষ দৌড়াচ্ছে। মারামারি কাটাকাটি করছে, ভীষণ হিংসে করছে পরস্পরকে। এটা এত ছিল না। হিংসা, অহমিকার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি মুখে। আমি এরকম কল্পনা করিনি।’
মহারাজ বললেন, ‘লোকসংখ্যা প্রচুর বেড়েছে, শহর বেড়েছে।’
‘রাস্তায় ঘাটে শিক্ষার অবনতিই চোখে পড়ল।’
‘আমাদের কাজকর্ম কেমন দেখছেন?’
স্বামীজি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের মুখ নামিয়ে নিলেন। বললেন ধীরে ধীরে, ‘কথা তো অনেক বলার, তার মধ্যে যা না বললেই নয় সেটা হচ্ছে, বেদ বিশ্ববিদ্যালয়। যেদিন চলে যাই, তখনও বলেছিলাম বেদ বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে কুসংস্কারকে দূর করতে। বেদে অমুক আছে তমুক আছে বলে যারা সাধারণ মানুষকে ভুল বোঝায়, তাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। আদি বৈদিক যুগে মহিলাদের কত স্বাধীনতা ছিল। উচ্চশিক্ষা ছিল। সমাজে নানা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছিল। সেটা আজ ভুলে গেছেন মহিলারা। লোক পড়ুক, জানুক বেদকে, তবে তো কুসংস্কার দূর হবে। সেটা আজও হল না। মেয়েরা পুজো করতে পারে না। এসব বেদে নেই। মানুষ নিজের কাজের রকম অনুযায়ী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বেছে নিতে পারত। মেয়েরা শ্লোক লিখতে পারত। যজ্ঞে অংশ গ্রহণ করতে পারত। সেসব এখন কোথায়? পুজো কেন শুধু ব্রাহ্মণরাই করবে? সবার কোরান আছে, বাইবেল আছে, তাহলে বেদ থাকবে না কেন?’
ছোট মহারাজ বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা এগুলোই আগে করব। কেন হয়নি, জানি না।’
স্বামীজির মুখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠছে। অধৈর্য হয়ে বললেন, ‘নারীশিক্ষার কি অগ্রগতি হল? এত ছেলেদের স্কুল হল, সেগুলো খুব ভাল কাজ করছে কিন্তু মেয়েদের কি তেমন স্কুল আমরা দিকে দিকে করতে পেরেছি? পারিনি। নারীশিক্ষা না এগোলে জাতি এগোবে না। কাজ করতে হবে উদয়াস্ত, নাহলে খাবার জুটবে না। পেট ভরা দরকার সবার, না হলে কিছুই হয় না। এমনকি ধর্মচারণও নয়। অভুক্ত হয়ে ধর্ম হয় না। দেশের একটি প্রাণীও যদি অভুক্ত থাকে, তাহলে আমার কাজ আগে তাকে খাওয়ানো। সব জায়গায় অহংকারের কালো ছায়া। বাহুল্য বাড়তে বাড়তে উদ্দেশ্যকে ঢেকে ফেলেছে।’
মহারাজ বললেন, ‘মঠকে চেষ্টা করেছি আপনার মত করে সাজাতে।’
স্বামীজি মৃদু হাসলেন, ‘ঠাকুরের ঘর, আমার ঘর তখনকার মঠ কেমন ছিল সেটা বুঝবে কী করে মানুষজন? অনেক স্ট্রাকচার মনুমেন্ট মূর্তি হয়েছে। মানুষের কী উপকারে লেগেছে?’ একটানা অনেক কথা বলে থামলেন দম নেবার জন্যে। তারপর নিজেই হেসে বললেন, ‘আমি একা কিছুই না। এতবড় যজ্ঞ সবাই মিলে এগিয়ে এসে করতে হবে। যা হয়ে গেছে, গেছে। আজ তোমাদের কিছু রান্না করে খাওয়াব।’
মহারাজ বললেন, ‘আপনি এত সুন্দর গান গান। আমাদের কি সৌভাগ্য হবে না শুনবার?’
স্বামীজি বললেন, ‘সময় বড় কম। একটা প্রিয় গান শুনিয়ে যাই। বলেই চোখ বুজে ধরলেন:
‘‘মন চলো নিজ নিকেতনে।
সংসার বিদেশে, বিদেশির বেশে, ভ্রম কেন অকারণে…’’
শেষ হবার পরও কিছুক্ষণ দরদী কণ্ঠস্বর ঘরময় ঘুরতে লাগল। উদাস করে দেবার মত গান। চিত্রাপিতের মত বসে রইলেন সবাই। ছোট মহারাজ বললেন, ‘অপূর্ব, আমরা ধন্য স্বামীজি।’
পিঠে হাত রেখে উনি বললেন, ‘চর্চা করো। সাধনা করো। তোমরাও পারবে। অসাধ্য বলে কিছু হয় না।’
দুধ, চাল দিয়ে স্বামীজি নিজে হাতে পরমান্ন রেঁধে খাওয়ালেন মহারাজদের। রাত দশটা বাজে। সবার কাছে বিদায় চাইলেন। মহারাজরা নিজেদের সম্বরণ করতে পারলেন না। ‘শপথ নেওয়া আছে, বলতে পারব না বাইরে। না হলে সারা পৃথিবীকে আপনার সাধের মঠ দেখতে ফিরে আসার ঘটনা নিয়ে ভিডিয়ো করে ছড়িয়ে দিতাম।’
স্বামীজি উত্তর দিলেন না। প্রধান মহারাজকে বললেন, ‘বিশেষ করে মনে রেখো নারীশিক্ষা, নারী স্বাধীনতা আর বেদ বিশ্ববিদ্যালয়।’
চোখমুখে বেদনা নিয়ে প্রধান ও অন্যান্যরা ঘর ত্যাগ করলেন। সবাই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নমে এলেন। স্বামীজি দরজা বন্ধ করে আবার ধ্যানে বসলেন। মনে মনে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আর বললেন না যে উনি তিনদিনের জন্যে এসেছিলেন কিন্তু একদিন বাদেই চলে যাচ্ছেন।
ঘোরের মধ্যে যে যার ঘরে চলে গেলেন। পরদিন সকালে প্রধান মহারাজ ছুটতে ছুটতে এসে দরজা খুললেন। স্বামীজি নেই। ওঁর জামাকাপড় যেমন গোছানো ছিল তেমনই আছে। এমনকি চটিজোড়াও খাটের নীচে রাখা। উল্টে দেখলেন ঝকঝকে পরিষ্কার তলাটা। একেবারে নতুন চটির মত। ঘরে একটা সুন্দর ধূপের গন্ধ। ছবির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেই মুচকি হাসি লেগে ঠোঁটের কোণে। দুহাত জোড় হয়ে এল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। জীবন ধন্য হয়ে গেছে। উনি এসেছিলেন। মনের ক্যামেরায় ওঁর ছবি রইল। কোনও ভিডিয়ো, ছবি, রেকর্ডিং কিছুই তোলা হয়নি। মনের ভিতরকে উদীপ্ত করে গেছেন। ওঁর স্পর্শ, ওঁর গাওয়া গানের সুর ঘরময় ছড়িয়ে আছে। গঙ্গার ঠান্ডা বাতাস ঘরে এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে। উনি তাড়াহুড়ো করে নেমে এলেন। স্বামীজি অনেক অনেক কাজের কথা বলে গেছেন। কাজই মুক্তি, কাজই জীবন। সর্বাগ্রে কাজ করতে হবে।