Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

দেশেবিদেশে রবীন্দ্র আদর্শ সম্প্রসারণের দায় নিয়েছিলেন

বসন্তোৎসবের দিনে তিনি চলে গেলেন। তিনি আমাদের শিক্ষক সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

কতদিন তাঁর পায়ে আবীর দিয়েছি। সেই পাখানি স্পষ্ট চোখে ভাসে। আঁকাবাঁকা গিরিখাতের চিহ্নযুক্ত, বহু অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তাঁর ধবধবে সাদা পা, অথচ একবিন্দু নোংরা-মালিন্য নেই তাতে। হ্যাঁ, অবাক হয়েছিলাম।

ষোলো বছর বয়সে বাবার হাত ধরে প্রথম সোমেনদার বাড়ি যাই। বাবা খুবই শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে। বাঁকুড়ার লোক বলে বাবার বাড়তি একরকম ভাললাগাও ছিল। আমার প্রথম শান্তিনিকেতন যাওয়া আর সোমেনদার বাড়ি যাওয়া একসঙ্গেই ঘটেছিল। তাঁকে প্রথম দেখা আর শান্তিনিকেতনকে প্রথম অনুভব করা আমার একযোগেই। তাঁর স্বল্পায়তন বাসস্থানের গৃহসজ্জা, আসবাবের বিশিষ্টতা, তাঁর বাগানবিলাস, এমনকী তাঁর ব্যবহারের নিজস্বতা আমাকে প্রথম শান্তিনিকেতনের মূল সুরটি চিনিয়ে দেয়। শান্তিনিকেতনী ধারায় যদি কোনও যাপন সম্ভব হয়ে থাকে, তবে তাকে তিনি জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন। মনে পড়ছে, প্রথমদিনে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির একটি পিকচার পোস্টকার্ড উপহার পেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকে।

বাংলা বিভাগে পড়ার সুবাদে তাঁর কাছে পাঠগ্রহণ করার মহাসুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু অল্পবয়সে মতিস্থির থাকে না। পরে আফসোস হয়, যতটা নেবার কথা ততটা নিতে পারিনি বলে। সোমেনদা চার দেয়ালের মধ্যে পড়াতে পছন্দ করতেন না। তিনি আমাদের নিয়ে নানা জায়গায় ক্লাস নিতেন। আমরা তাঁর পিছুপিছু উত্তরায়ণে চলে যেতাম। তারপর কখনও কোনার্ক, কখনও পুনশ্চ, কখনও শ্যামলীর বারান্দায় বসে ক্লাস করতাম। এই পরিবেশ-রচনাটি আমাদের মনের ওপর গভীরভাবে প্রভাব ফেলত। তিনি আমাদের পড়ানোর সময় কতভাবে যে গুরুদেবের জীবন ও তাঁর শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গড়ার কাহিনিগুলো বলে যেতেন! শান্তিনিকেতনের শিক্ষা, তাঁর আদর্শকে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা করে গেছেন তিনি।

দেশে ও বিদেশে রবীন্দ্র আদর্শ সম্প্রসারণের দায় সোমেনদা নিয়েছিলেন। বিদেশিদের তিনি বাংলা পড়াতেন শুধু নয়, শান্তিনিকেতনের রেওয়াজ মেনেই সেই ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় পারিবারিক সম্পর্ক। আমাদের কত বিদেশের গল্প বলেছেন। গল্প শুনে মনে হত— জাপান বোধ হয় তাঁর খুব প্রিয় দেশ।

সোমেনদার বাবা গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। সোমেনদাও ছবি আঁকতেন। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ক তাঁর দীর্ঘ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রয়েছে। তাঁর গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও চিত্রকে বোঝার একটি সেতুবিশেষ। রামকিঙ্করের ওপরও তিনি কাজ করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে সোমেনদার পারিপাট্য রামকিঙ্করের বাহ্যিক আচারের বিপরীত হলেও শিল্পসাধকের ধর্মের দিক দিয়ে ভেতরে ভেতরে তাঁদের মিল ছিল। তাই তাঁর কাছে রামকিঙ্কর গভীরভাবে ধরা দিয়েছিলেন।

সোমেনদার কাছে শুনেছিলাম, তিনি কলাভবনের ইতিহাস নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। আমাদের অনুযোগ ছিল, অতি নিঁখুত কাজ করার জন্য তিনি অতিরিক্ত সময় নেন বলে। জানি না, সে কাজ কতদূর এবং তা প্রকাশ করার মত অবস্থায় আছে কিনা! তবে তা পড়তে ইচ্ছে করে।

আজ কত কথা মনে পড়ছে। সোমেনদা আমাদের আসানসোলের বাড়িতে এসেছিলেন। আমাদের পৈতৃক বাড়ি সোনামুখিতেও গিয়েছেন পারিবারিক দুর্গাপুজোর সময়। সেসময় অবশ্য আমি তাঁকে পেতাম না। বড়দের সঙ্গেই কথা বলতেন, যেহেতু তখন তাঁর আসা বাবার ডাকে।

তবে আমাদের ডাকে তিনি আমাদের কলেজে রবীন্দ্র চিত্রকলা নিয়ে বলতে এসেছেন। স্লাইড দেখিয়ে দেখিয়ে তিনি সম্পূর্ণ অপরিচিত রবীন্দ্র চিত্রকলাকে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক উপায়ে পরিবেশন করে ছাত্র এবং শিক্ষকদের আগ্রহ ও বিস্ময় উৎপাদন করেছেন। সোমেনদার বাচনভঙ্গী, ঋজু দৈহিক গঠন, সুশোভিত ধুতি-পাঞ্জাবি, হাই পাওয়ারের চশমা সবই দর্শক-শ্রোতাদের কাছে আকর্ষণের বিষয় ছিল। সোমেনদা খুব ভাল ইংরেজি জানতেন, ইংরেজ ঘরানার উচ্চারণ ছিল তাঁর। তবু যখন বাংলায় বক্তৃতা দিতেন তখন একটাও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতেন না। এমনই ছিল তাঁর ভাষার ওপর অধিকার। তিনি খুবই গভীর কথা বলতেন, বলতেন কিছুমাত্র গরিমা প্রকাশ না করেই, যাঁদের বলছেন, তাঁরা সর্ব অর্থে ছোট হলেও সর্বদা তাঁদের মান্যতা দিতে আমি দেখেছি।

শান্তিনিকেতনে আমাদের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাকেন্দ্রিক ভ্রমণে নিয়ে গেছি। সেখানেও সোমেনদাকে টেনে নিয়ে এসেছি। রবীন্দ্রভবনে কিংবা জহরবেদিতে বসে তিনি আমাদের ছাত্রছাত্রীদের রবীন্দ্রনাথকে চেনার পথগুলি নির্দেশ করেছেন।

কত গল্প শুনেছি। কয়েকটা কথা অদ্ভুতভাবে মনে আছে। খুব বলতেন, শান্তিনিকেতন পরিচালনার সময় রবীন্দ্রনাথের দারিদ্র্য নিয়ে। বলতেন, রবীন্দ্রনাথ তখন একবেলা খেতেন। জামাকাপড়ও তাঁর বিশেষ ছিল না। শিক্ষকদের মাইনে দিতে পারতেন না। সোমেনদা এসব শুনেছিলেন তাঁর পারিবারিক সূত্র থেকে। তাঁর পূর্বপুরুষ আশ্রমের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। আর একবার রাজনীতি প্রসঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গভীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা বলতে বলতে দুঃখ করছিলেন। বলছিলেন, রবীন্দ্রভবনে কী করে নেতাজি সম্পর্কে সব ফাইল লোপাট হয়ে গেছে, এমনকী সব তথ্য কালি দিয়ে এমন করে কেউ কেটে দিয়েছে, যাতে কিছু না বোঝা যায়।

দূরে চাকরি করি। বেশিরভাগ সময়ে ট্রেনেবাসে সময় চলে যায়। তাছাড়া, আমার চরিত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, যাঁকে শ্রদ্ধেয় ভাবি, তাঁর নিকটে সহজে যেতে পারি না। কেবলই ভাবি, এতে তাঁকে বুঝি বিরক্ত করা হয়। এই কারণে তাঁকে যতটা পাবার কথা ছিল, ততটা পাই না। সোমেনদাকেও যতটা পেতে পারতাম, ততটা পাইনি।

তবে এখনও তীব্র রোদে বের হলে সোমেনদার কথা মনে হয়। ভরদুপুরে ক্লাস শেষ করে তিনি প্রবল রোদের মধ্যে দিয়ে ঘরে ফিরতেন। একবার বললেন, রোদকে চাঁদের আলো ভাবলেই আর কষ্ট থাকে না। বলেই হা হা করে হাসি। এখনও যেন মাঝেমাঝেই তাঁর সেই হা হা করে ঘর কাঁপানো হাসি শুনতে পাই। মনে হয় খোলা মন ছাড়া অমন খোলা হাসিও সম্ভব নয়।

পরিশেষে একটি কথা মনে হলে ব্যথায় কাতর হই। একদিন ফোনে বললেন, তোমার শান্তিনিকেতনের বাড়িতে একবার যেতে চাই। তোমার পছন্দের সঙ্গে আমার খুব মিল আছে। এছাড়া আমার পরিচিত কয়েকজনের কাছেও তিনি এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

এই স্নেহবচনটি আমার পরম পাওয়া ঠিকই। তিনিই তো আমার দীক্ষাগুরু। তারপরই মনে হয়, শেষপর্যন্ত তাঁকে আমি আমার গৃহাঙ্গনে নিয়ে আসতে পারিনি। এ বেদনা আমার সারা জীবনেও যাবার নয়। তবে তিনি আমার মধ্যে, আমার মত হাজার ছাত্রছাত্রীর মধ্যে নানাভাবে নিশ্চিত থেকে গেলেন। সোমেনদা আশীর্বাদ করুন, এই থাকাকে যেন প্রকৃত শ্রদ্ধার সঙ্গে, সত্যের সঙ্গে বহন করতে পারি।

চিত্র: গুগল
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Mandal Anindita
Mandal Anindita
1 year ago

সাল ১৯৮৯। আমার ননদের হবে বিয়ে হয়েছে। শান্তিনিকেতন গিয়ে ওঁর বাড়িতে যাই। ননদের পিসেশ্বশুর তিনি। আমরা ছজন কমবয়সী। হট্টগোল চলছে। আমি সেই অবসরে ওঁর কাছে বসি। উনি বলছিলেন আমি শুনছিলাম। বলতে বলতে একটা কথা বলেছিলেন আজও ভুলিনি। বলেছিলেন, মনটা যদি বৃহতের সঙ্গে যুক্ত থাকে তবে জীবনের অশেষ ক্ষুদ্রতাকে অনায়াসে পেরিয়ে যাওয়া যায়। তারপর এভাবে আর বসা হয়নি। কিন্তু মনে আছে সেদিনের স্মৃতি। 🙏 প্রণাম জানাই।

Recent Posts

সুজিত বসু

সুজিত বসুর দুটি কবিতা

তারার আলো লাগে না ভাল, বিজলীবাতি ঘরে/ জ্বালাই তাই অন্তহীন, একলা দিন কাটে/ চেতনা সব হয় নীরব, বেদনা ঝরে পড়ে/ যজ্ঞবেদী সাজানো থাকে, জ্বলে না তাতে ধূপ/ রাখে না পদচিহ্ন কেউ ঘরের চৌকাঠে/ শরীরে ভয়, নারীরা নয় এখন অপরূপ/ তারারা সব নিঝুম ঘুমে, চাঁদের নেই দেখা/ অর্ধমৃত, কাটাই শীত ও গ্রীষ্ম একা একা

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বিশ্বকর্মার ব্রতকথা

বিশ্বকর্মা পুজোতেও কেউ কেউ বিশ্বকর্মার ব্রত পালন করে থাকেন। এমনিতে বিশ্বকর্মা যেহেতু স্থাপত্য ও কারিগরির দেবতা, তাই কলকারখানাতেই এই দেবতার পুজো হয়ে থাকে। সেখানে ব্রতকথার স্থান নেই। আবার কোন অলৌকিক কারণে এবং কবে থেকে যে এদিন ঘুড়িখেলার চল হয়েছে জানা নেই। তবে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন শহর ও গ্রামের আকাশ ছেয়ে যায় নানা রঙের ও নানা আকৃতির ঘুড়িতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

উত্তমকুমার কখনও বাংলাদেশে পা রাখেননি!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘৭১-পরবর্তী বাংলাদেশ উত্তমকুমারকে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়নি। টালিগঞ্জের কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে। অন্যদিকে ববিতা, অলিভিয়া ও আরও কেউ কেউ টলিউডের ছবিতে কাজ করেছেন। ঋত্বিক ঘটক, রাজেন তরফদার ও পরে গৌতম ঘোষ ছবি পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশে এসে, কিন্তু উত্তমকুমারকে আহ্বান করার অবকাশ হয়নি এখানকার ছবি-করিয়েদের।

Read More »
নন্দিনী কর চন্দ

স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্দরমহলে: কবিতার সঙ্গে গেরস্থালি

বিস্মৃতির অতলে প্রায় তলিয়ে যাওয়া এমন কয়েকজন মহিলা কবির কথা আলোচনা করব, যাঁরা তাঁদের কাব্যপ্রতিভার দ্যুতিতে বাংলা কাব্যের ধারাকে উজ্জ্বল ও বেগবান করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কৃষ্ণকামিনী দাসী, মোক্ষদায়িনী দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, লজ্জাবতী বসু, জগন্মোহিনী দেবী, গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, হিরণ্ময়ী দেবী, অম্বুজাসুন্দরী দাশগুপ্ত, সুরবালা ঘোষ প্রমুখ।

Read More »
মোহাম্মদ কাজী মামুন

বালকেরা অচেনা থাকে : এক অবিস্মরণীয় পাঠ অভিজ্ঞতা

ঘাসফুল নদী থেকে প্রকাশিত ‘বালকেরা অচেনা থাকে’ গল্পগ্রন্থটি যতই এগোনো হয়, একটা অনুতাপ ভর করতে থাকে পাঠকের মনে— কেন আগে সন্ধান পায়নি এই অমূল্য রত্নসম্ভারের! হ্যাঁ, রত্নসম্ভারই, কারণ একটা-দুটো নয়, প্রায় দশটি রত্ন, তাও নানা জাতের— লুকিয়ে ছিল গল্পগ্রন্থটির অনাবিষ্কৃত খনিতে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাইশে শ্রাবণ ও বৃক্ষরোপণ উৎসবের শতবর্ষ

কবির প্রয়াণের পরের বছর থেকেই আশ্রমবাসী বাইশে শ্রাবণকে বৃক্ষরোপণ উৎসব বলে স্থির করেন। তখন থেকে আজ পর্যন্ত এই দিনটিই এ-উৎসবের স্থায়ী তারিখ। বাইশের ভোর থেকেই প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় উৎসব। সকালে কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বিচিত্রভাবে একটি পালকি চিত্রিত করেন ছবি এঁকে, ফুল, লতাপাতায়। মঙ্গলধ্বনি দিতে দিতে এর পর পালকির ভিতরে টবের মধ্যে একটি চারাগাছকে স্থাপন করা হয়। অতঃপর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গীত-পরিবেশন-সহ আশ্রম-পরিক্রমা।

Read More »