বাংলা সাহিত্যের কল্লোল যুগের অন্যতম কথাসাহিত্যিক সরোজকুমার রায়চৌধুরী (১৯০৩-১৯৭২) আজ বিস্মৃতপ্রায়।
১৯০১ সালের ২০ আগস্ট অর্থাৎ আজকের দিনটিতে তিনি মুর্শিদাবাদের সালার থানার মালিহাটি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম মনোরঞ্জন রায়চৌধুরী। দাদা প্রদ্যুৎকুমার রায়চৌধুরী ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। সরোজকুমার সালার হাইস্কুল থেকে ১৯১৮ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করে বিহারের নামকরা হাজারিবাগ কলেজে ভর্তি হন। এখানেই তিনি সহপাঠী হিসাবে পান আর-এক সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে, যিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনামে সবার কাছে জনপ্রিয়। হাজারিবাগ কলেজ থেকে আইএ পাশ করে তিনি ভর্তি হন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। ১৯২১ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে পড়ার সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায়চৌধুরীর সংস্পর্শে এসে স্বদেশপ্রেমে প্রভাবিত হন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার জাতীয় বিদ্যাপীঠ থেকে বিএ পাশ করেন।
সরোজ কুমার রায়চৌধুরীর সাহিত্যজীবন শুরু ‘বৈকালী’ পত্রিকায়। সাপ্তাহিক ‘আত্মশক্তি’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘রমানাথের ডায়েরি’ প্রথম প্রকাশিত হয়। আর নেতাজির অনুপ্রেরণা ও উৎসাহে তিনি এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ‘কল্লোল’ ও ‘কালিকলম’ পত্রিকাতে তাঁর অনেক গল্প বের হয়েছে।
সরোজকুমার রায়চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু হয় দৈনিক ‘কৃষক’ ও ‘নবশক্তি’ পত্রিকার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি বিখ্যাত ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-য় যোগ দেন। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি আনন্দবাজারে সাংবাদিকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি সাপ্তাহিক ‘বর্তমান’ পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এছাড়াও দৈনিক বসুমতি, যুগান্তর সহ কলকাতার অজস্র পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। সরোজকুমার রায়চৌধুরীর ১৫টি উপন্যাস ও চারটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর জন্মভূমি মালিহাটিতে বৈষ্ণবদর্শনের একটা প্রভাব ছিল। দুই বিখ্যাত বৈষ্ণব পদকর্তা রোহিণী দাস ও রাধামোহন ঠাকুর এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর সাহিত্যের মধ্যে গ্রাম-বাংলার সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনের কথা যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনই রয়েছে গ্রামীণ বৈষ্ণবজীবনের প্রতিচ্ছবি।
তাঁর উপন্যাসগুলি হল: ‘বন্ধনী’ (১৯৩১), ‘শৃঙ্খল’, ‘আকাশ ও মৃত্তিকা’ (১৯৪০), ‘পান্থনিবাস’ (১৯৩৫), ‘ঘরের ঠিকানা’, ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘গৃহকপোতী’, ‘সোমলতা’, ‘হংসবলাকা’ (১৯৩৭), ‘ক্ষুধা’, ‘কালোঘোড়া’ (১৯৪৬), ‘অনুষ্টুপ ছন্দ’ (১৯৫১), ‘তিমির বলয়’, ‘নাগরী’ (১৯৬১), ‘নীল আগুন’ ইত্যাদি। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলি হল: ‘মনের গহনে’ (১৯৩৬), ‘দেহযমুনা’ (১৯৩৬), ‘রমণীর মন ও সন্ধ্যারাগ’ ইত্যাদি।
১৯৩১-১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তাঁর সব কিছুর সৃষ্টিকাল। ‘ময়ূরাক্ষী’, ‘গৃহকোপতী’ ও ‘সোমলতা’ মিলে তাঁর যে ত্রয়ী (ট্রিলজি) উপন্যাস, তার মধ্যেই ফুটে উঠেছে গ্রামীণ বৈষ্ণবদের জীবনযাপনের চালচিত্র। কিন্তু তাঁকে যে উপন্যাসটি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয় সেটি হল ‘কালোঘোড়া’। অথচ সেই ‘কালোঘোড়া’-র স্রষ্টা আজ আমাদের কাছে বিস্মৃতপ্রায়। ১৯৭২ সালের ২০ মার্চ কলকাতায় এই মহান কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান হয়।