কলিংবেল টিপতেই ভিতর থেকে কুকুরের সে কী ভয়ংকর ঘেউ ঘেউ। কলিংবেলের শব্দ না শুনতে পেলেও কুকুরের কান ফাটানো এই চিৎকার তো কানে যাবেই। তাই দ্বিতীয়বার আর বেল টেপেনি তিন্নি। এরই মধ্যে সদর দরজা খুলে সামনে এসে যিনি দাঁড়ালেন, তাঁকে দেখেই তার মনে হল, ইনিই তিয়াসের মা।
খুব কম দিন হল না, তিয়াসের সঙ্গে ও মিশছে। কিন্তু এ পথ দিয়ে যেতে যেতে দূর থেকে একদিন দেখালেও তিয়াস কখনও তাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসেনি। কিছু দিন হল তিয়াসের ছোটখাটো নানান আচরণ নিয়ে তিন্নির মনের মধ্যে বেশ তোলপাড় হচ্ছিল। সন্দেহটা যখন মনের মধ্যে একেবারে গেঁড়ে বসেছে, তখনই সে ঠিক করেছিল, আচমকা একদিন তিয়াসের বাড়ি গিয়ে দেখবে, সে যা ভাবছে, সেটা সত্যি কি না।
কিন্তু, প্রথম দিনই অযাচিতভাবে কোনও মেয়ের পক্ষে তো হুট করে তার প্রেমিকের বাড়ি যাওয়া ঠিক নয়। বাইরের লোকের কথা না হয় বাদই দিলাম, ওর বাড়ির লোকেরা কী ভাববে! তাই খুব ছোটবেলাকার বন্ধু রঞ্জনাকে সব কথা খুলে বলেছিল সে।
রঞ্জনা বলেছিল, সে নয় যাওয়া যাবে। কিন্তু তুই যে বলছিস, ও যখন বাড়ি থাকবে না, তখন যাবি। তুই বুঝবি কী করে ও কখন বাড়ি নেই?
তিন্নি বলেছিল, ও বাড়ি ঢুকলেই মোবাইল অফ করে দেয়। আর যতক্ষণ না বাড়ির বাইরে বেরোয়, ততক্ষণ অফই থাকে। ফলে ফোন করে যখন দেখব, ওর মোবাইল অন, তখন ও কোথায় আছে জেনে নেব। ওর বাড়ি তো বেশি দূরে নয়। যদি দেখি এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে ওর বাড়ি ফেরার কোনও সম্ভাবনা নেই, তখন যাব।
—ও যদি মিথ্যে কথা বলে? কাছাকাছি থেকেও যদি বলে দূরে আছি?
—না না, অতটা মিথ্যে বলবে কি! ও জানবে কী করে যে, ওর বাড়ি যাওয়ার জন্য আমি ওটা জানতে চাইছি। তা ছাড়া যে যাই বলুক, কিন্তু অতটা খারাপ না। আমাকে যথেষ্ট ভালবাসে। এই তো ক’দিন আগে, আমার জ্বর হয়েছিল দেখে উপোস করে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পুজো দিয়ে এসেছিল, যাতে আমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠি। আর ওর যদি খারাপ মতলবই থাকত, তা হলে সে দিন এমন সুবর্ণসুযোগ পেয়েও আমাকে ছেড়ে দিত না। এরই মধ্যে কবে যেন আমরা কোথায় একটা যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি সামনেই, কোনও বাড়িতে বোধহয় কোনও অনুষ্ঠান ছিল, রাস্তার পাশেই গাদাগুচ্ছের কী সব এঁটো পাতা-টাতা ফেলেছে। কতকগুলো কুকুর সেখানে কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। তুই তো জানিস, ছোটবেলায় আমাকে একবার কুকুরে কামড়েছিল। চোদ্দোটা ইজেকশন নিতে হয়েছিল। তার পর থেকে কুকুর দেখলেই আমি একশো হাত দূরে থাকি। আমাকে থমকে যেতে দেখে, ও বলেছিল, কোনও ভয় নেই। আমি তো আছি। চলো। বলেই, আমাকে অন্য পাশে নিয়ে যে দিকে কুকুর, সে দিকে চলে গিয়েছিল ও। আমরা কুকুরগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম। কুকুরগুলো তাকালও। কিন্তু কিচ্ছু করল না। তেড়ে আসা তো দূরের কথা, একটা ঘেউ ঘেউ পর্যন্ত করল না। জায়গাটা পেরিয়ে যাওয়ার পর ও বলল, দেখলে তো, তুমি যদি কিছু না করো, ওরাও তোমাকে কিছু করবে না। আমি বলেছিলাম, না বাবা, কুকুরকে আমি বিশ্বাস করি না। ওই একবারেই আমার শিক্ষা হয়ে গেছে। আর যেখানেই যাই, যেখানে কুকুর আছে, আমি কিছুতেই সেখানে যাব না। ও বলেছিল, আমার সঙ্গে থাকলে তোমাকে কখনও কোনও কুকুর কামড়াবে না। বলেই, হো হো করে হেসে উঠেছিল।
—তাতে কী হল? রঞ্জনা জিজ্ঞেস করতেই তিন্নি বলল, সেটাই তো বলছি। তার পর থেকে আমাকে নিয়ে বেরোলে, রাস্তায় কোথাও কোনও কুকুর থাকলে, আমি দেখতে না পেলেও, ও কিন্তু দূর থেকেই ঠিক দেখতে পেত এবং বুঝতে পারতাম, আমি যাতে ভয় না পাই, সে জন্য ও আমাকে আগলে নিয়ে যাচ্ছে। আর সত্যি কথা বলতে কী, কুকুরে আমার যে এত ভয় ছিল, সেটা কিছু আস্তে আস্তে ও-ই অনেকটা দূর করে দিয়েছে। যে আমার প্রতি এত কেয়ার নেয়, সে কি এত ছোটখাটো ব্যাপারে আমাকে মিথ্যে বলবে! আমার মনে হয় না।
—সেটা দ্যাখ। তুই যেটা ভাল বুঝবি। ও নেই দেখে হয়তো গেলি। তার পর গিয়ে দেখলি, ও বাড়িতে, তখন!
—তখন না-হয় যা হোক কিছু একটা বানিয়ে বলব। কিন্তু সত্যিটা তো জানতে পারব। প্রত্যেক দিন তো আর মনের মধ্যে সন্দেহ নিয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হবে না। আর আমি যেটা আঁচ করছি, সেটা যদি সত্যি হয়, তা হলে তো হয়েই গেল। এই সম্পর্কটাকে টিঁকিয়ে রাখার কোনও মানেই হয় না। তাই না?
—একদম। একদম ঠিক বলেছিস। অন্যমনস্কভাবে রঞ্জনা কথাটা বললেও, সে দিন থেকেই তক্কে তক্কে ছিল তিন্নি। আজ সকালেই যখন ফোন করে জানতে পেরেছে, তিয়াস এইমাত্র বেরোল, ফিরতে একটু দেরি হবে, তখনই ঠিক করে ফেলল, আর একমুহূর্ত দেরি নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর বাড়ি যেতে হবে। সেইমত সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে রঞ্জনাকেও বলে দিয়েছিল, রেডি হয়ে পাড়ার মুখে চলে আসতে।
তাও বেরোতে বেরোতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। মাথার উপরে বৈশাখ মাসের খাঁ খাঁ রোদ্দুর। তেমনই গরম। চার রাস্তার মোড়ে এসে একটা অটোয় উঠে পড়ল ওরা। দশ মিনিটের পথও নয়, অটোটা যত তিয়াসের বাড়ির কাছাকাছি আসতে লাগল, তিন্নি ততই ঈশ্বরকে মনে মনে ডাকতে লাগল, হে ঈশ্বর, আমি যেটা সন্দেহ করছি, সেটা যেন সত্যি না হয়, সত্যি না হয়, সত্যি না হয়…
দরজা খুলে অচেনা দুটো মেয়েকে দেখে তিয়াসের মা বললেন, কাকে খুঁজছ মা?
তিন্নির কানে তখন কোনও কথা ঢুকছে না। একমনে শুধু ঠাকুরকে ডাকছে, তিয়াস যেন বাড়িতে না-থাকে, না-থাকে, না-থাকে…
তিন্নিকে কিছু বলতে না দেখে রঞ্জনাই বলল, তিয়াস আছে?
উনি বললেন, না মা। ও তো একটু বেরিয়েছে।
—ও কখন আসবে?
—ডাক্তারের কাছে গেছে তো… কতক্ষণ লাগে!
—ডাক্তারের কাছে? কেন? ওর কী হয়েছে।
—না। ওর কিছু হয়নি। ওর ছেলেটা তো ক’দিন ধরে খুব ভুগছে…
ছেলে! তিন্নির পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে গেল। চারশো চল্লিশ ভোল্টের বিদ্যুৎ আছড়ে পড়ল তার ওপর। থরথর করে কেঁপে উঠল তিন্নি। তিয়াসের ছেলে আছে! ও বিবাহিত! তিন্নি এর আগে বিভিন্ন খবরের কাগজে পড়েছে, বদমাশ গোছের কিছু লোক আছে, যারা বিয়ের পরেও নিজের নাম ভাঁড়িয়ে, পরিচয় গোপন করে একের পর এক বিয়ে করে। কারও কারও কাছে এটা আবার পেশাও। যৌতুক হিসেবে যতটা যা গেল, পেল। বিয়ের পর দিন কিংবা তার ক’দিন পরে ‘একটু আসছি’ বলে কিংবা সদ্য বিয়ে করা বউকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সব সোনাদানা নিয়ে চম্পট দেয়। অনেক ক্ষেত্রে তার আগের বউও নাকি তার সঙ্গে সাঁটে থাকে। ভাবা যায়! এগুলো অবশ্য গ্রামের দিকেই বেশি হয়। তা বলে কি শহরে হয় না! শহরেও কিছু কিছু ছেলে আছে, যারা বাড়িতে বউ-বাচ্চা থাকলেও অন্য মেয়ে দেখলেই ছোঁক ছোঁক করে। এবং কারও সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়লেও সে যে বিবাহিত, সেটা বেমালুম চেপে যায়। এ সব এখন আকছারই ঘটে। কিন্তু তার জীবনে যে এ রকম কোনও ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা সে ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি।
কিছু দিন ধরে তিন্নি ওকে সন্দেহ করছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যাপারটা যে এতখানি, সেটা ভাবতেই পারেনি ও। ভেবেছিল, ও হয়তো অন্য কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়েছে। সেটা হয়তো ওর বাড়ির লোকেরা জানে। মেয়েটা হয়তো ওদের বাড়িতেও যাতায়াত করে। ওর মায়ের হয়তো তাতে সম্মতিও আছে। এ দিকে তার সঙ্গে এতদিনের সম্পর্ক, তাই তার মুখের ওপরে সরাসরি না-ও বলতে পারছে না। তাই তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোকেরা যাতে জানতে না পারে, সে জন্যই হয়তো বাড়িতে ঢুকেই মোবাইল অফ করে দিচ্ছে। কিন্তু এটা কী শুনল সে! কী! চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল। ঝাপসা চোখে রঞ্জনার দিকে তাকাল। দেখল, রঞ্জনাও তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোনও কথা হল না। তবু যেন চোখে-চোখে কত কথা হয়ে গেল। তা হলে এত দিন ধরে তিয়াস তার সঙ্গে খেলা করছিল! ছি ছি ছিঃ…
দুটো মেয়ে যখন এসেছে, তিয়াসের খোঁজ করছে, নিশ্চয়ই এরা তিয়াসের বন্ধু। সন্তানের বন্ধু তো সন্তানের মতই। তাদের কি দোরগোড়া থেকে খালিমুখে ফিরিয়ে দেওয়া যায়! তাই তিনি বললেন, ভিতরে এসো। —না না, ঠিক আছে মাসিমা। ও যখন নেই… পরে অন্য একদিন আসবখ’ন… রঞ্জনা বললেও তিন্নি তখন হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মাথা কোনও কাজ করছে না। সারা মুখ জুড়ে থমকে আছে একরাশ কালো মেঘ। আর বুকের মধ্যে সে কী হাহাকার! কান্না পেয়ে গেল তার। কিন্তু না, সে কাঁদবে না। তিয়াসকে সামনে পেলে সে শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করবে, ও কেন তার সঙ্গে এ রকম করল? কেন? কেন? কেন?
এটা তাকে জানতেই হবে। না, সে এখন বাড়ি যাবে না। তিয়াসের সঙ্গে আগে দেখা করবে, তার পরে অন্য কথা। কিন্তু তিয়াসের মাকে সেটা বুঝতে দিল না সে। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে রঞ্জনাকে বলল, চল না, উনি যখন বলছেন…
রঞ্জনা বলল, ও কখন আসবে তার কোনও ঠিক আছে!
—ডাক্তার দেখাতে আর কতক্ষণ লাগবে? তিন্নি বলতেই তিয়াসের মা-ও সায় দিলেন, না না, বেশিক্ষণ লাগবে না। এই তো সামনেই গেছে। আমার মনে হয়, এক্ষুনি চলে আসবে। ফোন করে দেখতে পারো। ওর কাছে তো মোবাইল আছে।
রঞ্জনা বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন তো। অ্যাই, তোর কাছে ওর নম্বর আছে না?
—আছে। কিন্তু এখন করা কি ঠিক হবে? ডাক্তারের কাছে গেছে যখন, ফোন করে বিরক্ত করার কোনও মানে হয় না। ধীরে-সুস্থে ডাক্তার দেখাক। আমরা বরং একটু অপেক্ষা করি, নাকি? কী বলিস?
—কতক্ষণ বসবি?
—খানিকক্ষণ তো বসি…
—যদি তার মধ্যে না আসে?
—তখন না হয় ফোন করব। কিংবা একটা চিঠি লিখে যাব।
তিয়াসের মা বললেন, হ্যাঁ মা, সেটাই ভাল। আমার বয়স হচ্ছে তো। কোনও কিছু আর মনে রাখতে পারি না। তোমরা বলে গেলেও, তোমাদের নাম হয়তো ঠিকমত মনে করে আমি ওকে বলতেও পারব না। রোদের মধ্যে আর দাঁড়িয়ে থেকো না। এসো এসো, ভিতরে এসো।
ওরা ভিতরে ঢুকল। কেমন যেন অন্ধকার-অন্ধকার মত। পুরনো আমলের দোতলা বাড়ি। সামনেই বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে বসার ঘর। খুব একটা সাজানো-গোছানো নয়। মুখোমুখি যে চারটে সোফা, সেগুলোও ব্যবহারে-ব্যবহারে জীর্ণ। মাঝখানে সেন্টার টেবিল। তাতে কয়েকটা মাগাজিন। সোফায় বসতে বসতে তিন্নিরা দেখল, ও দিক দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। তিয়াসের মা পাখার সুইচ অন করতে করতে বললেন, একটু চা খাবে তো মা?
দু’জনেই একসঙ্গে বলে উঠল, না না, থাক না।
—থাকবে কেন? তিয়াস থাকলে কি চা না খেয়ে তোমরা যেতে পারতে? তোমরা চায়ে চিনি খাও তো?
রঞ্জনা বলল, হ্যাঁ, খাই।
কিন্তু না, চা নয়। একটা ট্রে-তে চাপিয়ে আলাদা দুটো প্লেটে দুটো করে ছানার সন্দেশ আর দু’গ্লাস জল দিয়ে গেলেন তিনি। বললেন, আগে এটা খেয়ে নাও।
রঞ্জনা বলল, এ সবের কী দরকার ছিল মাসিমা…
উনি বললেন, নাও নাও, খাও। লজ্জা কোরো না। আমি চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছি।
ভদ্রমহিলা পিছন ফিরতেই প্লেট থেকে একটা সন্দেশ তুলে ঠোঁট দিয়ে আলতো করে একটুখানি ভেঙে মুখে নিল রঞ্জনা। টুকরোটা মুখে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দেখল, তিন্নির মুখ একেবারে থমথমে। চোখটাও ছলছল করছে। যেন এক্ষুনি বাঁধ ভেঙে কান্না বেরিয়ে আসবে। তাই রঞ্জনা বলল, এ রকম করিস না। উনি কী ভাববেন বল তো… নে, খা।
কান্না ভেজানো গলায় তিন্নি বলল, না রে, আমার গলা দিয়ে কিছু নামবে না।
—বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করবি বল। তবু আজ এলি দেখে তো ব্যাপারটা জানতে পারলি। না এলে তো জানতেই পারতিস না।
কাঁপা কাঁপা গলায় তিন্নি বলল, আমি এত বড় ভুল করলাম! মানুষ চিনতে আমার এত বড় ভুল হল!
—তোর হঠাৎ ওকে সন্দেহ হল কেন?
—আসলে আমি আর ও তো মাঝে মাঝে মিলেনিয়াম পার্কে যাই। আমি খেয়াল করিনি— আমাদের কলেজে তমন্না বলে একটা মেয়ে ছিল। ও নাকি আমাকে ওর সঙ্গে দেখেছিল। পরে রাস্তায় একদিন দেখা হওয়ায় ও-ই বলল, তিয়াসের সঙ্গে মেলামেশা করছিস? বুঝেসুঝে মিশিস। ও কিন্তু খুব একটা সুবিধের ছেলে না।
—তার পর?
—যতই কলেজের বন্ধু হোক, ও বলেছে দেখেই কি ওর কথা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? আমি এত দিন ধরে ওর সঙ্গে মিশছি, ও কেমন, আমি জানি না? আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তার পর থেকেই ওর অনেক আচরণ আমার চোখে পড়তে লাগল। আগে তো ও এ রকম করত না! কেমন যেন খটকা লাগল। তখন আমি দু’য়ে দু’য়ে চার মেলাতে লাগলাম। দেখলাম, সত্যিই ওর চালচলন বেশ সন্দেহজনক।
—কী রকম?
—যেমন, আগে খুব ঘন ঘন ফোন করত। কিন্তু ক’দিন হল, ফোন করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল। আমি করলেও সব সময় ঠিকমত ধরত না। ধরলে, আশপাশের গাড়িঘোড়ার শব্দে বুঝতে পারতাম, ও রাস্তায়। ওর কথা বলার ধরন দেখে বুঝতে পারতাম, ওর পাশে কেউ আছে। কিন্তু আমি যে সেটা বুঝতে পারছি, সেটা ওকে বুঝতে দিতাম না। যদি বলতাম, বাড়ি গিয়ে আমাকে একটা ফোন কোরো। ও বলত, ঠিক আছে। কিন্তু কোনও দিনই ফোন করত না।
—কেন?
—কেন আবার? বউ আছে না? বউ যদি টের পেয়ে যায়! এই সব ছেলেদের গায়ে না বিছুটি পাতা ঘষে দিতে হয়।
—ওর ব্যবসা আছে বলেছিলি না?
—ধুর, ওটা ওর নাকি? ওর বাবার। ওর বাবাই চালায়। ও মাঝে মাঝে দিয়ে বসে।
ওদের কথার মধ্যেই ক্রিং ক্রিং করে ফোন বেজে উঠল। রঞ্জনা চাপা গলায় বলল, কী রে, টেলিফোন বাজছে তো, ধরার কেউ নেই নাকি?
তিন্নিও কান খাড়া করল, হ্যাঁ, টেলিফোন বাজছে। তিয়াসের ব্যাপারটা নিয়ে ও একটাই টেনশনে আছে যে ও শুনতেই পায়নি ফোন বাজছে। খানিকক্ষণ পর রিংটা থেমে গেল। রিং হয়ে হয়ে থেমে গেল, না কি কেউ ধরল, বোঝা গেল না। তিন্নি বলল, কথায় কথায় আমি ওকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমাদের বাড়িতে ল্যান্ড ফোন নেই? ও বলেছিল, আছে তো। যে-ই বলেছিলাম, তা হলে ওই নম্বরটা দাও না… ও বলেছিল, ল্যান্ড নাম্বার দিয়ে কী করবে? আমি বলেছিলাম, বাড়ি ঢুকলেই তো মোবাইলের সুইচ অফ করে দাও। যদি কোনও দিন বিপদ-আপদ হয়, দরকারের সময় তোমাকে যদি মোবাইলে না পাই, তখন অন্তত ল্যান্ড ফোনে তো খবরটা তোমাকে দিতে পারব।
রঞ্জনা উৎসুখ হয়ে জিজ্ঞেস করল, তখন ও কী বলল?
—বলল, মোবাইলে না পেলে হোয়্যাটসআপ করে দেবে, তা হলেই হবে। আমি বলেছিলাম, তাও তোমার বাড়ির নম্বরটা দেবে না! ও মুখের উপরে বলে দিয়েছিল, না।
—জিজ্ঞেস করিসনি, কেন দেবে না?
—করেছিলাম তো… ও বলেছিল, ফোনটা তো মায়ের ঘরে। ফোন এলে মাকেই ছুটে গিয়ে ধরতে হয়। কিন্তু মায়ের শরীরটা তো ভাল নয়, তাই শুধু আমি নই, আমাদের বাড়ির কেউই আর কাউকে ল্যান্ড নাম্বার দেয় না। এবং আমরা নিজেরাও পারতপক্ষে এই ফোনে ফোন করি না…
সন্দেশে ফের আলতো করে কামড় বসাতে বসাতে রঞ্জনা বলল, শরীর খারাপ? কই, দেখে তো মনে হল না। দিব্বি হাঁটাচলা করছে। চা করছে। আসলে ওসব কিছু না। ল্যান্ড নম্বর না দেওয়ার যত সব ফন্দি-ফিকির। বুঝেছিস? আরে বাবা, মায়ের ধরতে যদি অসুবিধেই হয়, ফোনটা তো অন্য ঘরেও রাখতে পারে।
তিন্নি বলল, আমি কি সেকথা বলিনি? তখন ও বলেছিল, সে নয় রাখলাম। কিন্তু অন্য ঘরে ফোন রাখলে, সেটা ধরবে কে?
—তখন বললি না কেন, তোমার বউ…
—তখন কি আর জানতাম… তার পরেও যত বার ল্যান্ড নাম্বার চেয়েছি, ও প্রতিবারই কোনও না কোনও অজুহাত দেখিয়ে ঠিক এড়িয়ে গেছে। একবার তো বলেই ফেলল, টেলিফোন নম্বরের জন্য তুমি এ রকম করছ কেন বলো তো! ভেবে নাও না, আমাদের বাড়িতে ফোন নেই।
—সে কী রে?
—তা হলে আর বলছি কী। জানবি, যাদের মধ্যে গলদ থাকে, তাদের সঙ্গে কথায় পারবি না। আমি তো ভাবতেই পারছি না, ও এ রকম…
ওরা যখন কথা বলছে, হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। ক্রিং ক্রিং ক্রিং। মনে হল, কেউ বুঝি পর পর তিন বার সুইচে হাত ছুঁইয়েই ছেড়ে দিল। কিন্তু ঠিক ওটুকু আওয়াজেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ওদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে তিয়াসের মা বললেন, ওই যে, তোমাদের তিয়াস এসে গেছে।
কলিংবেলের শব্দ শুনে ওর মা কী করে বুঝলেন তিয়াস এসেছে! সত্যিই কি তিয়াস! দু’জনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকাল। উনি দরজা খুলতেই ওরা অবাক। হ্যাঁ, সত্যিই তিয়াস।
ওর মা কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ওদের দু’জনকে দেখে তিয়াস যেন ভূত দেখল। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কেমন ঘোর লাগা গলায় বলল, তোমরা?
তিন্নি ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কিন্তু কোনও কথা বলল না। রঞ্জনা বলল, এ দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তা, ও বলল, এটা তিয়াসদের বাড়ি। আমি বললাম, তা হলে চল না… দেখি ও আছে কি না। ও বারবার করে বারণ করেছিল। তবু আমি ওর কথা শুনিনি। প্রায় জোর করেই কলিংবেল টিপে দিয়েছিলাম। আপনার মা বললেন, আপনি নেই। তবে এখুনি ফিরে আসবেন। তাই…
তিয়াসের মা সন্দেশের প্লেট আর কাচের গ্লাস দুটো সেন্টার টেবিলে নামিয়ে ট্রে-টা নিতে নিতে তিয়াসকে বললেন, কী রে, তোর ছেলেকে কোথায় রেখে এলি?
—ও ঝিনুকের কাছে আছে। আসছে।
তিন্নি জানে, ঝিনুক তার বোন। তিয়াসের মুখেই শুনেছে, ও খুব ভাল মেয়ে। লর্ডস বেকারির কাছে এ কে ঘোষ মেমোরিয়াল স্কুলে সায়েন্স নিয়ে টুয়েলভে পড়ে। ওর কাছে তার কথা শুনে ও নাকি তিন্নির সঙ্গে আলাপও করতে চেয়েছিল। তা হলে কি সেটাও মিথ্যে কথা! যত খারাপই হোক, বাড়িতে জলজ্যান্ত একটা বউদি থাকতে কোনও ননদ কি তার দাদার প্রেমে সায় দিতে পারে! দাদার প্রেমিকার সঙ্গে আলাপ করতে চাইতে পারে! না, এটা হতে পারে না। তা হলে কি ও যা যা বলে, সবটাই মিথ্যে! তমন্না ঠিকই বলেছিল, ও খুব একটা সুবিধের ছেলে না। তিন্নি যখন এ সব ভাবছে, তিয়াসের মা বলে উঠলেন, ডাক্তার কী বলল?
—একটা মলম দিয়েছে আর তিন রকমের ট্যাবলেট। বলল, এতেই সেরে যাবে।
—তুই চা খাবি তো?
—বলেছি না, চায়ের ব্যাপারে আমাকে কখনও জিজ্ঞেস করবে না।
—জানি তো, চায়ে তোর কোনও ‘না’ নেই। তোমরা কথা বলো মা… চায়ের জল বোধহয় ফুটে গেল… ওর মা রান্নাঘরের দিকে যেতেই তিয়াস বলল, তুমি যে এ দিকে আসবে, কই, তখন তো বললে না?
—তুমিও তো বলেছিলে, আমি দূরে আছি। ফিরতে দেরি হবে।
—তখন কি আর জানতাম, ডাক্তারখানা আজ এত ফাঁকা থাকবে!
—এত বড় একটা ঘটনা তুমি আমার কাছে চেপে গিয়েছিলে?
—কী?
—কী, বুঝতে পারছ না?
—না।
—সে বুঝবে কী করে?
তিন্নির কথা শুনে রঞ্জনা বুঝতে পারল, ব্যাপারটা এ বার অন্য দিকে মোড় নেবে। তাই সেটাকে আটকাবার জন্য সে তিয়াসকে জিজ্ঞেস করল, আপনার ছেলের কী হয়েছে?
—আর বলবেন না। ক’দিন ধরে খুব ভুগছে…
—কী হয়েছে?
—প্রথমে ঘাড়ের কাছটায় একটু ঘা মত হয়েছিল। তার পর…
কথা শেষ হওয়ার আগেই ট্রে-তে করে তিন কাপ চা নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে তিয়াসের মা বললেন, মেয়ের কাছে গিয়েছিলি?
মেয়ে! রঞ্জনা আর তিন্নি দু’জনেই দু’জনের দিকে তাকাল। শুধু ছেলে নয়, মেয়েও আছে!
তিয়াসের মা ফের বললেন, ও কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে একা একা আছে। আমি একবারও যেতে পারিনি। জানিস তো, আমি সিঁড়ি ভেঙে উঠতে পারি না। পারলে একবার দেখা দিয়ে আসিস।
তিন্নি অবাক। এ কী বাড়ি রে বাবা! ছেলে অসুস্থ। মা অসুস্থ। মেয়েও কি অসুস্থ নাকি! না হলে উনি এ কথা বললেন কেন! তা হলে কি তিয়াসও অসুস্থ! নিশ্চয়ই অসুস্থ। তার সঙ্গে ও যা করেছে, সেটা কি কোনও সুস্থ লোকের কাজ!
তিন্নি যখন এ সব ভাবছে, প্লেটসুদ্ধ চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে নামাতে গিয়ে তিয়াসের মা দেখলেন, যেভাবে দিয়ে গিয়েছিলেন, তিন্নির দিকের প্লেটের সন্দেশ দুটো ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে। তাই তিন্নিকে বললেন, কী গো, এখনও খাওনি? নাও নাও, তাড়াতাড়ি শেষ করো। চা ঠান্ডা হয়ে যাবে যে…
উনি চলে যেতেই তিয়াসের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বেশ কড়া গলায় তিন্নি বলল, তোমার বউ কোথায়?
—বউ!
রঞ্জনা বলল, এই চুপ কর তো। এগুলো পরে হবে। মাসিমা শুনলে কী ভাববেন বল তো!
—কী আর ভাববেন! জানতে পারবেন, তাঁর ছেলে কেমন! তাঁর ছেলে কীভাবে একটা মেয়ের জীবন নিয়ে এত দিন ধরে ছিনিমিনি খেলেছে…
তিয়াস বলল, ছিনিমিনি খেলেছি! আমি?
—অনেক হয়েছে আর ন্যাকামি কোরো না। আমি সব জেনে গেছি।
—কী জেনেছ? তিয়াস গলা চড়াতেই রঞ্জনা বলল, চুপ করুন না তিয়াসদা। যা হওয়ার হয়ে গেছে।
—কেন চুপ করবে? দেখছেন না, আপনার বন্ধু কী সব উল্টোপাল্টা বলছে… ও কি আমার সঙ্গে এখানে ঝগড়া করতে এসেছে?
তিন্নির দিকে তাকাল রঞ্জনা, তুই চুপ করবি? নে, চা খা।
—না। আমি খাব না। চা তো দূরের কথা, ওদের বাড়ির এক গ্লাস জলও আমি ছোঁব না।
তিয়াস জিজ্ঞেস করল, কেন? আমি কী করেছি?
—এত কিছুর পরেও আবার জিজ্ঞেস করছ, কেন? আমি কী করেছি? তোমার লজ্জা করে না…
ঠিক তখনই এমন ক্র্যাড়…ড়…ড়… করে একটানা কলিংবেলটা বেজে উঠল যে তিন্নির কথা ভাল করে শোনাই খেল না। তিয়াস বলল, দাঁড়াও, দরজাটা খুলে দিয়ে আসি। ঝিনুক এসেছে।
ও উঠতেই দু’জনে সদর দরজার দিকে তাকাল। দেখল, একটি মেয়ে ঢুকল। কোলে একটা ছোট্ট খরগোশ। এই-ই নিশ্চয়ই ঝিনুক। তিন্নির মন তখন এতটাই খারাপ যে কোনও কিছু ভাবার মত অবস্থায় নেই। রঞ্জনা একটু অবাক হল। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে তিয়াস কী করে বুঝল, ওর বোন এসেছে। আরও অবাক হল, ওর বোনের ঢং দেখে। কিছু দিন আগে দেব আর কোয়েলের ‘প্রেমের কাহিনি’ নামে একটা সিনেমা এসেছিল। সেখানে খরগোশকে প্রেমের প্রতীক হিসেবে দেখানোর পর থেকে অনেক উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েই খরগোশ পোষা শুরু করেছে। পুরো ব্যাপারটাই কেমন যেন ন্যাকা ন্যাকা। ঝিনুকও যে তার ব্যতিক্রম নয়, এটা সে বুঝতে পারল। মনে মনে বলল, যত্ত সব আদিখ্যেতা।
ঝিনুক ঢুকতেই ওদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল তিয়াস। এ আমার বোন ঝিনুক। আর এ হল তিন্নি…
‘তিন্নি’ শব্দটা শুনেই ঝিনুক বলল, ও মা, তুমি তিন্নি? দাদার কাছে তোমার কত গল্প শুনেছি। আমি তো দাদাকে কবেই বলেছিলাম, তা হলে একদিন বাড়িতে নিয়ে আয়। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দে। যখনই এ কথা বলি, ও বলে, আজ নয়, কাল। কাল নয়, পরশু। অবশেষে নিয়ে এল তা হলে…
রঞ্জনা বলল, না। তোমার দাদা আমাদের আনেনি। আমরা নিজে থেকেই এসেছি।
—তাই নাকি? বাঃ। দারুণ ব্যাপার। সে-ই যখন এলে, আগেই তো আসতে পারতে। তোমাদের চিনে আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
খুব গম্ভীর গলায় তিন্নি বলল, না। কিন্তু তোমার বউদি কোথায়?
—বউদি! মানে?
—তোমার দাদার বউ।
—দাদার বউ? দাদা আবার বিয়ে করল কবে!
—তার মানে?
—আমি তো সেটাই তোমাকে জিজ্ঞেস করছি…
এ বার একটু থতমত খেয়ে গেল তিন্নি। বলল, না মানে… শুনলাম… ছেলেকে নিয়ে তোমার দাদা ডাক্তার দেখাতে গেছে…
কথাটা শুনেই হো হো করে হেসে উঠল ঝিনুক। ও, তুমি দাদার ছেলেকে চেনো না? বলেই, হাসতে হাসতে কোলের খরগোশটাকে দেখিয়ে বলল, এই তো দাদার ছেলে।
—এটা!
—হ্যাঁ, এই খরগোশটাকে ও এত ভালবাসে যে আমাদের বাড়ির লোকেরাই শুধু না, গোটা পাড়ার সবাই বলে, এটা ওর ছেলে।
—আর মেয়ে?
—মেয়ে তো উপরে। ইয়া বড়। একেবারে বাঘের মত। দেখলে কেউ বলবে না, ও কুকুর। ভীষণ বুঝদার। আমাদের প্রত্যেকের পায়ের শব্দ চেনে। আমাদের কলিংবেল টেপার শব্দ শুনেই বুঝতে পারে, কে এসেছে। টিভি চালিয়ে দিলে নীচে আর নামতেই চায় না। বসে বসে টিভি দেখে…
ঝিনুক বলেই যাচ্ছিল। আর সেটা হাঁ করে গিলছিল তিন্নি। সে কত কী না ভেবেছিল! আর যাকে নিয়ে তার এত সন্দেহ, সে কিনা একটা কুকুর! মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরিয়েও এল শেষ শব্দটা— কুকুর!
—হ্যাঁ। কেন, তুমি কি ভেবেছিলে? বলেই, তিয়াসের দিকে তাকিয়ে ঝিনুক বলল, কী কে দাদা, তুই ওকে তোর ছেলেমেয়ের কথা বলিসনি?
ঢোঁক গিলে তিয়াস বলল, আসলে আলাপের প্রথম দিনই আমি যখন জানতে পারলাম, ও কুকুরকে ভীষণ ভয় পায়, কুকুর থেকে একশো হাত দূরে থাকে— তখন আমার মনে হয়েছিল, আমাদের বাড়িতে কুকুর আছে শুনলে ও হয়তো এই কুকুরের ভয়েই আমার সঙ্গে আর মিশবে না, তাই…
—তাই বলিসনি? তুই কী রে?
রঞ্জনা বলল, সে নয় বলেননি ঠিক আছে। কিন্তু বাড়ি ঢুকলেই মোবাইলটা অফ করে দেন কেন?
তিয়াস মাথা নত করে বলল, না মানে… আসলে… অবলা জীব তো, ও তো অতশত বোঝে না। যদি হঠাৎ কখনও ডেকে ওঠে… আর সেই ডাক শুনে যদি তিন্নি জেনে যায় আমাদের বাড়িতে কুকুর আছে। তাই…
—সে জন্য মোবাইল অফ করে দিতে? সে জন্যই ল্যান্ড নম্বর দাওনি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল তিন্নি।
—না মানে… আসলে…
রঞ্জনা বলল, ও যখন ফোন করত, আপনি রাস্তায় থাকলে, আপনার সঙ্গে তখন কে থাকত?
—আমার সঙ্গে? কে?
—কেউ না থাকলে কথা বলতে বলতে তুমি অন্যমনস্ক হয়ে যাও কেন? তিন্নি জানতে চাইতেই তিয়াস বলল, আসলে তুমি ফোন করলেই আমি তটস্থ হয়ে যেতাম। দেখতাম, আশপাশে কোনও কুকুর আছে কি না। ভয়ে ভয়ে থাকতাম, হঠাৎ কোনও কুকুর ডেকে উঠবে না তো!
—তা হলে তমন্না ওই কথা বলল কেন? ফের প্রশ্ন করল তিন্নি।
—কোন কথা?
—তুমি খুব একটা সুবিধের না।
—আমি সুবিধের না? এটা তোমার মনে হল?
—এটা আমি বলছি না।
—তা হলে?
—তমন্না বলেছিল।
—সে তো বলবেই।
—কেন?
—কারণ, বাচ্চা।
—কার?
—আমার মেয়ের।
—তোমার মেয়ের? আঁতকে উঠল তিন্নি।
সেটা দেখেই তিয়াস তড়িঘড়ি বলে উঠল, না না। আমার মেয়ের না। আমার ডগির বাচ্চা। ওর বাচ্চা হবে শুনে তমন্না আমাকে আগেই বলেছিল, ওর বাচ্চা হলে আমাকে একটা দিস। আমিও বলেছিলাম, দেব। কিন্তু বেচারি তিনটে বাচ্চা দিলেও সব ক’টারই ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও কাউকে বাঁচাতে পারিনি। তমন্না সে কথা বিশ্বাস করেনি। ও ভেবেছিল, আমি বুঝি কারও কাছে তিনটে বাচ্চাই বিক্রি করে নিয়েছি। তাই বলেছিল, তুই আমাকে বললে কি আমি টাকা দিতাম না? শুনে, আমার মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। আমি ওকে যা-তা বলেছিলাম। সেই থেকেই ওর সঙ্গে আমার মুখ দেখাদেখি বন্ধ। মাঝে মাঝে এর-তার মুখে খবর পাই, বিভিন্ন লোকের কাছে আমার নামে ও যা-তা বলে। বলে, আমি নাকি মিথ্যেবাদী। লোককে কথা দিয়েও কথা রাখি না। আমি নাকি মোটেও সুবিধের না। তা হলে আমার নামে তোমাকেও বলেছিল?
—হ্যাঁ, বলেছিল তো। কিন্তু তুমি আমাকে এ সব আগে বলোনি কেন?
এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবে সে! কিছু একটা বলতে গিয়ে আমতা আমতা করতে লাগান। দাদাকে বিব্রত হতে দেখে তিন্নির দিকে তাকিয়ে ঝিনুক বলল, তুমিও পারো বাবা! কবে কোন কুকুর তোমাকে একবার কামড়েছে, সেই জন্য তুমি পৃথিবীর সব কুকুরকেই ভয় করতে শুরু করে দিয়েছ? তুমি জানো, শুধু কুকুর নয়, তুমি যদি বিষাক্ত সাপকেও ভালবাসো, সে ভুল করেও তোমাকে কখনও ছোবল মারবে না। কারণ, পশুপাখিরাও ঠিক বুঝতে পারে, কে তাকে ভালবাসে। বুঝেছ?
মাথা কাত করতে করতে তিন্নি যখন দেখল, সন্দেশ শেষ করে রঞ্জনা চায়ের কাপ হাতে তুলে নিয়েছে, তখন ও-ও প্লেট থেকে একটা সন্দেশ তুলে অর্ধেকটায় কামড় বসিয়ে দিল। আর সেটা দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল রঞ্জনা। বলল, কী রে, গলা দিয়ে এ বার নামবে তো?
সন্দেশ খেতে খেতেই মাথা কাত করল তিন্নি। বোঝাতে চাইল, নামবে। খুব নামবে।