Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

কল্পতারা

এক চিত্রশিল্পীর ছেলেবেলা নিয়ে একটি লেখা পড়েছিলাম৷ এই অস্থিরমতি শিল্পী জীবনভর ছবি ছাড়া আর কোনও ভালবাসায় টানা মন রাখতে পারেননি৷ কান-ঘেঁষে চলা ডানাকাটা বেশ্যাতেও তাঁর মন থাকত মেরেকেটে পাঁচ কী ছ’দিন৷ ফের নতুন কেউ৷ নতুন হতেই হবে৷

ভালবাসতেন কেবল ছোট ভাইটাকে৷ রাতের বেলা এক বিছানায় ঘুমোতেন৷ ভাই পাশে৷ শিল্পী দাদা শুধোতেন— ও ভাই! কী দেখিস উপরে? বোকা গলায় ভাই বলতেন— কী আবার দেখব? বিছানার উপর তো ছাদ! বলতে বলতেই দেখতেন, বিস্ফারিত হচ্ছেন পাশে শুয়ে থাকা দাদা; নাকের পাটা ফুলছে৷ চোখ আগুনপানা শিল্পী দাদার৷

ভয়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরতেন ভাই— ও দাদা, তুমি কী দ্যাখো? ঘোলাটে চোখে শিল্পীর উত্তর— ছাদ ফুটো হয়ে গ্যাছে, দেখতে পাস না ভাই? আর সেই ফুটো দিয়ে উঁকি দেয় আকাশ৷ ভাইয়ের মুণ্ডুটা উঁচিয়ে একনাগাড়ে বলেই চলেছেন দাদা— ওই দ্যাখ ভাই, কালো আকাশে লাল তারা৷

পড়তে পড়তে কাল শিউরে উঠেছি বহুদিন পর৷ কল্পনা কতদূর আলো-হাওয়া পেলে পাথরের ছাদে তারা গোনেন শিল্পী? এমন কল্পনা কি মঞ্চেও লাগে না? কল্পনায় যে মঞ্চ কখনও গৃহবাসীর আঙিনা— পরমুহূর্তেই তা কি হয় না ছেলেদের খেলার মাঠ? মঞ্চে যদি কল্পনা না লাগে তো লাগবে কীসে!

থিয়েটার একটি বয়ে যাওয়া নদী৷ কল্পনা সে নদীকে কতদূর পৌঁছে দেয় কত্ত কত্ত দূর! পাঁচ মিনিট আগে নির্দেশকও কি ঠাওরে উঠতে পারেন সেই কত্ত দূরটাকে? আচ্ছা বেশ, ধরুন একটি আলো ঝলমলে পাহাড়! মাপা যায়৷ চুড়োয় উঠে নাচাও যায়৷ কিন্তু কুয়াশা ঘেরা না দেখা ধরাতলেই যে কল্পনার জৌলুস৷ যদি তা হয় সমভূমি তাও আবছা তো! আনকা তো৷ আবছায়াতেই কল্পনার কথামালা৷ কল্পকথা৷ কথায় সাজানো গাথা৷ সেই থেকে মঞ্চে নামলেই বিড়বিড়—

এই থিয়েটার—
বরং থমকে যা খানিক
চেনা পথে পথ হারাবি
অচেনায় মানিক৷

থিয়েটারশিল্পী কিনা তাই কল্পনার কথা সাজাতে বসে প্রথমেই কল্পনা দিয়েই সাজিয়ে ফেললাম থিয়েটারকে৷ থিয়েটার তো আসে জীবনের পথ বেয়ে৷ অন্যভাবেও বলতে পারেন— থিয়েটার পৌঁছে যায় মানুষের জীবনের সমস্ত ফুটিফাটায়৷ কল্পনার লোভে একদিন নিজেকে নিয়েই একটা নাটক বানিয়ে ফেলব ভাবলাম একলাম৷ রিকুইজিশান একটা ধারালো কচকচে কাঁচি ও শাশুড়ি মায়ের আলমিরাতে সাজানো দুটো মাটির পাখি৷ মাটির পাখি বলল— তুই না মঞ্চে চাদর দুলিয়ে নদীকে বইয়ে দিস জনপদে৷ এবার আমায় জ্যান্ত করে আকাশে পাঠা৷ আমায় শ্বাস নিতে দিবি না হতভাগী? দেখিস না কতকাল কাচের আলমিরাতে প্রাণহীন হয়ে আছি আমি?

ব্যাস! আমার টাকে টুকটুকে সবুজ দুই মৃৎপক্ষী৷

হ্যাঁ তো৷ সুদর্শন কাঁচিটা দিয়ে কুচ কুচ করে চুলগুলো সেবার কেটেই ফেলল ময়ূরা৷ ঝরা ফুলের পাপড়ি হয়ে কাটা চুলের ডগা আগা সব উড়ে উড়ে ঘুরছিল তার ঘরে৷ খুকুকাল থেকেই মাথায় রাগ চড়লে এমনটাই করে আসে যে ময়ূরপক্ষী৷ রাগের চোটে কেন রাগ বা কার ওপর রাগ, সেটাই ধরতে পারি না৷ আর ধরতে না পেরে তার যত রাগ ঝামড়ে পরে শনের নুড়ি চুলে৷

সেদিনও ওরম৷ মাটির পাখি ওড়াতে না পেরে ওরম ফুটন্ত রাগ৷ কল্পনার চারাগাছ বৃক্ষ করতে না পেরে ঘরের মধ্যে নাটক তৈরির গোড়াতেই গ্লানি আর গ্লানি৷ চুল কাটতে গিয়ে রাগী ময়ূর দেখল, ডানদিকের চুল বড় হয়ে গ্যাছে৷ এমা! অন্যদিকটা কত্ত বেঁটে রে৷ দ্রুত হাত চালায় ময়ূরা৷ খাটো হতে লাগে ডানদিক৷ কিন্তু একটু বেশিই খাটো হয়ে গেল না? ধুর! বেঁটে সাইডটা দ্যাখো আবার কেমন দামড়া হয়ে যাচ্ছে! চুল কেটে কেটে থকে যেতে লাগল সেদিন নাট্যশিল্পী ময়ূরকুমার৷ তবু সমান হয় না দুপাশ৷ বিল্লিচোখ আর ঝিনুকঠোঁট আয়নায় লেপ্টে নিয়ে দেখতে লাগি নিজেকে৷

নাহ! রাগ আর চুলের রাগী রাগী ছাঁটে বড় কুচ্ছিত হয়ে গ্যাছে না তার মোটামুটি সুন্দর মুখটা? মাথাটা এক্কেরে পাখির বাসা৷ আচ্ছা পাখির বাসায় দুটো একটা বাসিন্দা আনলে কেমন হয়? তাহলেও কি একটু খুলবে না ময়ূরার ফসলকাটা ফাঁকা মাথা? শাশুড়ি মায়ের পুতুল আলমারি থেকে কমলা সবুজ মাটির জোড়া পাখি এনে মাথার মাঝে সেট করল ময়ূরা! না এইবার বেশ হয়েছে তার পাখির বাসাটি৷ আরে ভাই! গৃহস্থ না থাকলে কখনও ঘরবাসা জমে? পাখির বাসায় পাখিও তো তাই!

কিন্তু পাখিদুটো ওমন পলক না ফেলে চেয়ে আছে কেন ময়ূরার দিকে? চোয়াল অব্দি নড়ে না যে পাখির! আয়না দিয়েই মাথায় বসা মাটির পাখিকে ভেংচি মারল ময়ূর পাখি৷ মৃৎপক্ষী স্থির৷ একইরকম ত্যাবড়া মুখে বসে! আচ্ছা ওরাও কি ভেংচি কাটছে ময়ূরাকে? হাঁ করে দেখছেই বা কি এতসময় ধরে? রূপহীন পাগলপারা ময়ূরাকে? ক্লান্ত হয়ে ঘুমোলাম আমি৷

পরদিনের ভোর এল৷ জানলা খোলে ময়ূরা৷ মাথা গলায় শিকের ফাঁক দিয়ে! বাড়ির পাশেই খাটাল৷ গোবরের স্তূপে উড়ছে মস্ত মস্ত মাছি৷ হতাশ গাভীর দল৷ গা থেকে মাছি নড়াতেই পারছে না মোটে৷ আরে! আরে! তার মধ্যেই নাচছে দু-দুখানা মিশকালো সাদা ডুরে পাখি! কী নাম রে ভাই তোদের? আচ্ছা আছছা আচছাআ! বলতে হবে না নাম! তাকাচ্ছে দ্যাখো কটমট গর্বে! রাঙা রাঙা চোখে! ঝটপট ডানা মেলে উড়ে আয়৷ উড়ে এসে ঝুপ করে বোস আমার পাখির বাসা মাথায়! এ বাসা তো তোদের! তোদেরই রে! শুধু রাগের পোকাগুলো বেছে বেছে খেয়ে ফেল দেখি!

মাটির পাখি ফিরেছে তাদের কাচের আলমিরাতে! আসবে এখন প্রাণের পাখি৷ কী হয়! কী হয়!

এবার নতুন কোনও কল্পনাট্য!

নাকি আমার কল্পনার সেই— সেই জীবনটা!

চিত্র: গুগল
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

স্বামী বিবেকানন্দ : প্রয়াণদিনে স্মরণ

বিবেকানন্দই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক বাঙালি তথা ভারতীয়। রবীন্দ্রনাথ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান ১৯১২-পর্বে ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় যাওয়ার পর, এবং তার পরের বছর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু এর প্রায় কুড়ি বছর পূর্বেই বিবেকানন্দ শিকাগো-বক্তৃতা ও আমেরিকা-ইয়োরোপে এক নাগাড়ে প্রথম দফায় চার বছর থাকার সুবাদে আমেরিকার বিদ্বজ্জনমহলে যেমন, তেমনই জার্মানির মাক্সমুলার, ফ্রান্সের রোমাঁ রোলাঁ, রাশিয়ার টলস্টয় প্রমুখের শ্রদ্ধা এবং মনোযোগ আদায় করেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

প্রফুল্ল রায়: ব্রাত্য সময়ের কথাকার

প্রফুল্ল রায় নাকি অতীশ দীপঙ্করের বংশের। দেশভাগের অভিশাপেই দেশছাড়া হতে হয় তাঁকে, ১৯৫০-এ। একটা বিধুর বিষয় আমরা লক্ষ্য না করে পারি না। দেশভাগ সুনীল-শ্যামল-মহাশ্বেতা-শীর্ষেন্দু-অতীনদের কেবল ভূমিচ্যুত করেই ছাড়ল না, এমনকি তাঁদের কারুবাসনাকেও অন্যতর রূপ দেওয়ালো। দেশভাগ না হলে আমরা সুনীলের হাতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, শীর্ষেন্দুর ‘দূরবীণ’ বা প্রফুল্ল রায়ের ‘পূর্বপার্বতী’ পেতাম না, যেমন পেতাম না শওকত ওসমানের ‘কর্ণফুলি’ বা হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি।’

Read More »
শৌনক দত্ত

মন্দ মেয়ে ভদ্র অভিনেত্রী: সুকুমারী দত্ত

বিনোদিনী দাসীর বর্ণময় জীবনের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাওয়া এই ‘তারকা অভিনেত্রী’-র বহুমাত্রিক জীবনটিও কম রঙিন নয় বরং বিস্মৃত নক্ষত্র এক, যিনি ১২৮২ বঙ্গাব্দের ৩ শ্রাবণ (১৮৭৫ খ্রি., মূল্য ছিল ১ টাকা) ‘অপূর্ব্বসতী’ নাটকটি লিখে বাংলা নাট্যাতিহাসের প্রথম নারী নাট্যকার হিসেবে সুবিদিত হয়ে আছেন।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস ও কালিদাস

পণ্ডিতেরা তর্ক তুলেছেন, কালিদাস ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবস’ লেখেননি৷ কেননা একেবারে পয়লা আষাঢ়েই যে মেঘ নেমে বৃষ্টি আসবে, তা হয় না। তাঁদের মতে, ওটা আষাঢ়ের শেষদিন, ‘আষাঢ়স্য প্রশম দিবস’ হবে। কিন্তু প্রথম দিবস-ই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। এবং তা এতটাই যে, কালিদাসকে নিয়ে ভারত সরকার যে ডাকটিকিট বের করেছে, সেখানে ‘আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ শ্লোকটি উৎকীর্ণ।

Read More »
রূপকুমার দাস

রূপকুমার দাসের কবিতাগুচ্ছ

পড়তি বিকেলে আলতা রং রৌদ্রের রক্তিম ইজেলে,/ লজ্জারাঙা মুখ হত তরতাজা বসরাই গোলাপ।/ এখন ঈশানের মেঘপুঞ্জ ঢেকে দেয় সব কারুকাজ।/ বারুদের কটু ঝাঁঝে গোলাপের গন্ধ উবে যায়।/ নক্ষত্রের আলো কিংবা জ্যোৎস্নার ঝর্নাধারা নয়,/ বজ্রের অগ্নিঝলকে ঝলসে যায় উদভ্রান্ত চোখের নজর।/ হৃদয়ের ক্যানভাসে এঁকে রাখা আরাধ্যার চিত্রলেখা,/ অজানা শংকায় ডুবে যায় অন্ধকার সমুদ্রের জলে।/ সে সমুদ্র তোলপাড় লবেজান আমি তার পাই না হদিস।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য

সরকারিভাবে এবং বিত্তশালী অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় ভক্তি ও নিবেদনের সংস্কৃতিকেই ভারতীয় সংস্কৃতি বলে উপস্থাপনের উদ্যোগ অনেকটা সফল হলেও এই একমাত্র পরিচয় নয়। সমস্ত যুগেই যেমন নানা ধারা ও সংস্কৃতি তার নিজস্বগতিতে প্রবাহিত হয় তেমনই আধুনিক, উত্তর-আধুনিক যুগেও অন্যান্য ধারাগুলিও প্রচারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলা ও বাঙালি বড় ভূমিকা পালন করেছে। যে যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্য গড়ে তোলার কাজ চলছে সে যুগেই শান্তিনিকেতনে বসে রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নৃত্যের ভাষা খুঁজেছেন। নাচের বিষয় হিসেবেও গড়ে নিয়েছেন নতুন কাহিনি, কাব্য। পুরাণ থেকে কাহিনি নিয়েও তাকে প্রেমাশ্রয়ী করেছেন। নারীকে দেবী বা দাসী না মানুষী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ধর্মের স্থানে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগে গড়েছেন নতুন উৎসব।

Read More »