Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

মহম্মদ রফি: মৃত্যুর চার দশক পরেও সমান জনপ্রিয়

ভারত তথা উপমহাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমার মহম্মদ রফির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মুকুল দত্তের কথায় গেয়েছিলেন, ‘সে যেন আমার পাশে আজও বসে আছে/ চলে গেছে দিন তবু আলো রয়ে গেছে’। গানটি ১৯৮০ সালে পুজোর সময় বের হলে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। সত্যিই, তিনি না থাকলেও তাঁর আলো আজও অম্লান। মৃত্যুর চার দশকের বেশি সময়ের পরও মহম্মদ রফি সমানভাবেই জনপ্রিয়। আজ এই মহান সঙ্গীতশিল্পীর জন্মদিন। আসুন, আমরা তাঁর সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি।

শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও কয়েকবার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে ভূষিত, পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রাপক এই শিল্পীর উত্থান অনেকটাই অবাক করার মতই।

রফি সাহেবের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের পঞ্জাবের অমৃতসরের কাছাকাছি কোটলা সুলতান সিং গ্রামে, ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। বাবা মায়ের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর ডাক নাম ফিকু। নিজ গ্রামে এক ফকিরের ভজন গানকে অনুকরণ করেই গান গাওয়া শুরু করেন। জীবিকার সন্ধানে রফির পিতা হাজি আলী মহম্মদ ১৯২০ সালে লাহোর চলে যান। লাহোরের নুর মহল্লায় হাজি আলী মহম্মদের ছিল এক সেলুন। শৈশবে লাহোরে থাকার সময়ে রফির বড়ভাই মহম্মদ দীনের বন্ধু আব্দুল হামিদ রফির সঙ্গীত প্রতিভায় মুগ্ধ হন। হামিদ রফিকে নানাভাবে উৎসাহ দেন। হামিদের বোনের সঙ্গে পরবর্তীতে রফির বিয়ে হয়। হামিদ সাহেব রফির পরিবারের সম্মতি আদায় করে তাঁকে মুম্বই বা বলিউডে নিয়ে আসেন। সালটি ছিল ১৯৪৪। সেখানে তিনি পেয়ে যান ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান, ওস্তাদ আব্দুল ওয়াহিদ খান, পণ্ডিত জীবনলাল মাটটু এবং ফিরোজ নিজামীর মত বিখ্যাত শিল্পীদের। আর তাঁদের কাছ থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, কাওয়ালি, গজল, ভজন সহ বিভিন্ন ধরনের সঙ্গীত আয়ত্ত করেন।

হিন্দি, উর্দু, পঞ্জাবি, বাংলা সহ বহু ভারতীয় ও বিদেশি ভাষায় তিনি গান করেছেন। ১৯৪৪-১৯৮০ সাল পর্যন্ত তাঁর সঙ্গীত জীবনের সুবর্ণ যুগ। যদিও ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে রফি সাহেব লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে এল সায়গলের সঙ্গে জীবনে প্রথম দর্শকদের মুখোমুখি হয়ে কনসার্টে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের নির্দেশনায় লাহোরে নেপথ্যে কণ্ঠশিল্পী হিসাবে নিজের অভিষেক ঘটান রফি সাহেব। পঞ্জাবি ভাষায় নির্মিত ‘গুল বালোচ’ ছবিতে রফি দ্বৈত সঙ্গীত করেন বিখ্যাত শিল্পী জিনাত বেগমের সঙ্গে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৪৪ সালে। গানটির কথা ছিল, ‘সোনিয়ে নি, হীরিয়ে নি’। একই বছরে রফি সাহেব অল ইন্ডিয়া রেডিওর লাহোর কেন্দ্রে গান গাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পান।

১৯৪২ সালে বলিউডে শ্যাম সুন্দর পরিচালিত ‘গাঁও কি গোরি’ ছবিতে নেপথ্যে গায়ক হিসাবে অভিষেক হয় রফির। তারপর একের পর এক ছবিতে তিনি কণ্ঠ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ। রফি সাহেব মুম্বইয়ে থেকে গেলেন। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী নিহত হবার পর হুস্নলাল-ভগৎরাম, রাজেন্দ্র কৃষণ, রফি— ত্রয়ী একরাত্রেই কালজয়ী গান ‘শুনো শুনো অ্যায় দুনিয়াওয়ালো, বাপু কি অমর কহানি’ রচনা করে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর আমন্ত্রণে রফি গানটি ফের পরিবেশন করে মাতিয়ে দেন নেহরুজি সহ দর্শক শ্রোতাদের। ১৯৪৮ সালেই নেহরুজি তাঁকে রৌপ্য পদক দেন স্বাধীনতা দিবসে। এরপর শঙ্কর-জয়কিষণ, নৌশাদ, এস ডি বর্মণ, আর ডি বর্মণ, লক্ষ্মীকান্ত-প্যায়ারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি প্রমুখ সঙ্গীত পরিচালকদের সংস্পর্শে এসে তিনি জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে যান। পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। হিন্দি ছায়াছবিতে তাঁর প্রতিটি গান জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

যে অমর গীত তাঁকে চির অমরত্ব দান করেছে সেটি হল বিখ্যাত ‘বৈজু বাওরা’ ছবির ‘ও দুনিয়া কে রাখওয়ালে শুন দর্দে ভরে মেরে নালে’। এই গানের লেখক বিখ্যাত গীতিকার ও কবি শাকিল বদাউনি, সুরকার বলিউডের বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক নৌশাদজি। পঞ্চাশের দশকের এই গান তাঁকেও চির অমরত্ব দান করেছে। ১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই গানের পর গান রেকর্ডিং করতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হন রফি সাহেব। ওইদিন চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি রাত ১০টা ৫০ মিনিটে মারা যান। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শুধু শোকপ্রকাশই করেননি, কেঁদেও ফেলেছিলেন গায়কের প্রয়াণে। বলিউড-টলিউড সহ গোটা উপমহাদেশ শোকাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল সেদিন। রাষ্ট্রীয় শোক পালন করা হয়।

রফি সাহেবের স্ত্রীর নাম বিলকিস বানো। তাঁদের সন্তানরা হলেন নাসরিন আহমেদ, শাহিদ রফি, ইয়াসমিন রফি, সাঈদ রফি, পারভিন রফি, হামিদ রফি ও খালিদ রফি।

সুদীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে তিনি সঙ্গীত জগৎ মাতিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠের জাদুতে আজও মানুষ মোহিত হয়ে পড়ে। মৃত্যুর ৪২ বছর পরও তিনি উপমহাদেশের মানুষের কাছে চির অমর হয়ে আছেন। তাঁর সুললিত কণ্ঠ তাঁকে বানিয়েছে ‘সঙ্গীত সম্রাট’। জীবনে সব মিলিয়ে ২৬ হাজার গান করেন। অনেকেই অবশ্য দাবি করেন, রফি সাহেবের গাওয়া গানের সংখ্যা ৩৪ হাজার।

চিত্র: গুগল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × three =

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

আমার স্মৃতিতে ঋত্বিককুমার ঘটক

দুটো‌ জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর।‌ এক, তিনি কথা বলার সময় আত্মমগ্ন‌ থাকতেন। কারও দিকে‌ তাকিয়ে‌ কথা বলতেন না। তাকাতেন‌ হয় সুদূরে, আর নয়তো‌ চোখ বুজে‌ কথা বলতেন। আর দ্বিতীয় যা, তা হল‌ ঋত্বিকের চোখ। এত উজ্জ্বল আর‌ মরমী, এক-ই সঙ্গে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত আর লুব্ধক নক্ষত্রের মতো দীপ্ত, তা আর কারও মধ্যে দেখিনি। সত্যজিৎ-মৃণালের মধ্যেও না, যদিও ঘটনাচক্রে ওই দু’জনের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল অনেক বেশি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »