বিদ্যাসাগরের মা ভগবতী দেবী, বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগরকে আমরা বিদ্যার সাগর বলেই জানি। তাঁর পুরো নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। জন্ম ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮২০। শৈশব থেকে বিদ্যাসাগরের জীবনে পিতামাতার সঙ্গে পিতামহ রামজয় তর্কভূষণের প্রভাবও খুব বেশি পড়েছিল।
১৮১৩ সাল নাগাদ ঠাকুরদাস-ভগবতীর বিবাহ হয়; তার সাত বছর পর তাঁদের প্রথম সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র পরবর্তীকালে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করায় সেই বিদ্যাসাগর নামটিতেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর মূল পদবি যে বন্দ্যোপাধ্যায়— সে আর আমাদের অনেক সময় মনে থাকে না।
বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিল। ছেলেবেলা থেকেই বিদ্যাসাগর ছিলেন খুব জেদি, সংকল্পে অবিচলিত একগুঁয়ে মানুষ। নিজের সত্য থেকে তিনি নিজেকে কখনও ভ্রষ্ট করেননি। তবে মা ছিলেন তাঁর জীবনের শেষকথা। মাতৃ আজ্ঞা তাঁর কাছে ছিল অলঙ্ঘনীয়।
দুপুর নাগাদ বিদ্যাসাগর যখন জন্মান, তখন নবজাতকের পিতা বাড়ি থেকে কিছু দূরে হাটে গিয়েছিলেন। পিতামহ রামজয় পুত্র ঠাকুরদাসকে সুসংবাদটি জানাতে হাটের পথ ধরেন। ঠাকুরদাস ফিরছিলেন। পথেই দেখা হল। বললেন, একটা শুভসংবাদ আছে; আমাদের একটি এঁড়ে বাছুর হয়েছে। গোয়ালঘরে একটি গাভী প্রসবোন্মুখই ছিল। ঠাকুরদাস ঘরে ঢুকে গোয়ালঘরের দিকে এগলে রামজয় পুত্রকে হেসে বলেন— ওদিকে নয়, এদিকে এসো। তারপর সূতিকাঘরে নবজাতকের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন— ওই দেখো। ‘এঁড়ে’ শব্দের সাধারণ অর্থ হচ্ছে পুরুষজাতীয় গোরু বাছুর মহিষ ইত্যাদি। অন্য অর্থ তেজস্বী একরোকা একগুঁয়ে দুর্দমনীয়।
রামজয়ের এঁড়ে বাছুর বলাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল; কারণ ঠাকুরদাস পুত্র অল্প একটু বড় হতে না হতেই বুঝেছিলেন তাঁর পিতার মন্তব্য হাড়েহাড়ে সত্য।
বিদ্যাসাগর নিজেই বলেছেন, ‘‘আমি বাল্যকালে, মধ্যে মধ্যে অতিশয় অবাধ্য হইতাম। প্রহার ও তিরস্কার দ্বারা পিতৃদেব আমার অবাধ্যতা দূর করিতে পারিতেন না। এই সময় তিনি সন্নিহিত ব্যক্তিদের নিকট, পিতামহের পূর্বোক্ত পরিহাস বাক্যের উল্লেখ করিয়া বলিতেন— ‘ইনিই সেই এঁড়ে বাছুর; বাবা পরিহাস করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তিনি সাক্ষাৎ ঋষি ছিলেন; তাঁহার পরিহাসবাক্যও বিফল হইবার নহে; বাবাজি আমার ক্রমে এঁড়ে গোরু অপেক্ষাও একগুঁইয়া হইয়া উঠিতেছেন।’ জন্মসময়ে পিতামহদেব পরিহাস করিয়া আমায় এঁড়ে বাছুর বলিয়াছিলেন; জ্যোতিষশাস্ত্রের গণনা অনুসারে বৃষরাশিতে আমার জন্ম হইয়াছিল; আর সময়ে সময়ে, কার্য দ্বারাও এঁড়ে গোরুর পূর্বোক্ত লক্ষণ আমার আচরণে বিলক্ষণ আবির্ভূত হইত।’’
পিতামহের কথা বিদ্যাসাগরের জীবনে বর্ণে বর্ণে সত্য হয়েছিল। এঁড়ে গোরুর একগুঁয়েমিই তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। পদে পদে প্রতিটি কাজে যতই তিনি বাধা পেতেন ততই সে কাজটি সম্পন্ন করার জেদ চাপত তাঁর।
তিনি একদিকে কঠিন কঠোর একগুঁয়ে; আবার অন্যদিকে তিনি অতিশয় দরদী কোমল হৃদয়বান, করুণাসাগর। তাঁর মাতৃভক্তি প্রবাদে পরিণত। তাঁর মা শুধু নামেই ভগবতী নন, তিনি যেন ছিলেন সত্যিই সাক্ষাৎ ভগবতী। ঈশ্বরের মা-ই ছিলেন ঈশ্বরের কাছে পরমেশ্বরী, আর বাবা ছিলেন ঈশ্বরের পরমেশ্বর।

এই বাবাই ঈশ্বরচন্দ্রকে বীরসিংহ গ্রাম থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন পুত্রের আট বছর বয়সে। এই পিতার হাত ধরেই কলকাতায় আসার পথে মাইলস্টোনের মাধ্যমে ঠাকুরদাসের সহায়তায় 1 2 3 4 শিখেছিলেন। 19, এক মাইল এগিয়ে 18, আরও এক মাইল এগিয়ে 17; এইভাবে পথ চলতে চলতে ইংরেজি নিউমরল বা সংখ্যা 9 থেকে 1 পর্যন্ত শিখে ফেলা।
পিতা ঠাকুরদাসই ঈশ্বরচন্দ্রকে তাঁর ন’বছর বয়সে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে। সেটা ১৮২৯ সাল। সেই বিদ্যাসাগরই ১৮৫১ সালে লিখেছিলেন ‘সংস্কৃত ব্যাকরণের ইতিহাস’, তারপর ১৮৫৩-তে ‘সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ এবং পরে ক্রমে ক্রমে ‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ চার ভাগ। তিনি সারা জীবন অনেক বই লিখেছিলেন।
বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ দ্বিতীয় ভাগের অষ্টম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘পিতা মাতা’। বাবা মায়ের প্রতি বিদ্যাসাগরের সারাজীবনের যে শ্রদ্ধা ভক্তি কৃতজ্ঞতা তাই যেন উৎসারিত হয়ে দেখা দেয় তাঁর রচিত বালকপাঠ্য বইখানিতে। এ যেন বাবা মায়ের প্রতি পুত্রের ঋণস্বীকার। বাবা ঠাকুরদাস, মা ভগবতী, নিজে ঈশ্বরচন্দ্র; কিন্তু তাঁর নিজের বইতে কোথাও দেব-দেবী ঠাকুর-দেবতা মঠ-মন্দির এসবের কোথাও কোনও উল্লেখ নেই। কী আছে? আছে বাবা-মা, ভাই-বোন, মা-মাসি, বালকবন্ধুদের কথা ও বিদ্যালয়ের শিক্ষক মহাশয়দের কথা। ‘পিতা মাতা’ অধ্যায়ের প্রথম কথাটিই হল, ‘পৃথিবীতে পিতা মাতা অপেক্ষা বড় কেহই নাই।’
বিদ্যাসাগররা ছিলেন সাত ভাই তিন বোন। আমরা বলি, কে বলেছে ভগবতী দেবী দশ সন্তানের জননী ছিলেন? না, শুধু দশ সন্তান নয়, তিনি ছিলেন সমগ্র বঙ্গদেশের দুঃখিত পীড়িত অবহেলিত মানুষ মাত্রেরই জননী।
তৃতীয় পুত্র শম্ভুচন্দ্রের বিবাহ স্থির হয়েছে। বড় ছেলেকে মা চিঠি লিখে জানিয়ে দিয়েছেন— শত কাজ থাকুক, নির্দিষ্ট দিনে তোমাকে বাবা উপস্থিত থাকতেই হবে। তুমি না আসতে পারলে মনে আমি খুব কষ্ট পাব।
বিদ্যাসাগর তখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষক। ভাইয়ের বিয়ে মায়ের চিঠি। কলেজের অধ্যক্ষ ইংরেজ সাহেবের কাছে গিয়ে ছুটির জন্য দরখাস্ত জমা দিলেন বিদ্যাসাগর। কলেজে সে সময় পরীক্ষা চলছে। অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগরকে ভালবাসেন, অধ্যাপকের পাণ্ডিত্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও। কিন্তু পরীক্ষাপর্ব চলছে বলে সাহেব নিরুপায় হয়েই বললেন, ‘এই সময় তো কিছুতেই আমি ছুটি দিতে পারব না মিষ্টার বিদ্যাসাগর।’
বাড়ি ফিরে সারারাত ভাবলেন। একদিকে মা, আর-একদিকে কলেজ।
পরদিন সকালে প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করে বিদ্যাসাগর বললেন— আমার বিশেষ কাজে মা বাড়িতে যেতে ডেকেছেন। যদি আপনি ছুটি মঞ্জুর না করেন তাহলে নিরুপায় হয়ে আমাকে চাকরি ছেড়ে যেতে হবে। আমি পদত্যাগপত্র লিখেও এনেছি— আপনি গ্রহণ করুন।
সাহেব পরাধীন ভারতবর্ষের এই মধ্যবয়সী পণ্ডিতের মাতৃভক্তি দেখে বিস্মিত এবং অভিভূত! বিদ্যাসাগরকে অত্যন্ত সমীহ করে সাহেব বললেন— না না না, চাকরি ছাড়তে হবে না, আমি তোমার ছুটির দরখাস্ত অনুমোদন করছি। যাও বাড়ি যাও, মা খুশি হবেন।
মায়ের চিঠি দেরিতে পৌঁছেছিল। হাতে বেশি সময় নেই। পরদিনই যাত্রা। এদিকে সময়টা বর্ষাকাল। সঙ্গে এক ভৃত্য। কিন্তু সে-ভৃত্যও মাঝপথে অসুস্থ হওয়ায় তাকে কলকাতায় ফেরত পাঠিয়ে একাই যাত্রা করলেন। কলকাতা থেকে তারকেশ্বর পায়ে হেঁটে। হাঁটাটা তাঁর ছোটবেলা থেকেই অভ্যেস। রাত্রে তারকেশ্বরে কাটিয়ে পুনরায় সকাল থেকে গন্তব্যস্থলের উদ্দেশে পদব্রজে যাত্রা। বৃষ্টি-বাদল সঙ্গে লেগেই আছে। মনের মধ্যে শুধু একটিই কথা— মা ডেকেছেন! পৌঁছতেই হবে!
হাঁটতে হাঁটতে দামোদরের সামনে এসে পৌঁছলেন। বর্ষায় জলস্ফীত নদী তখন অশান্ত উদ্দাম। নদী পারাপারের কোনও খেয়া নেই ঘাটে। কিছু যাত্রী হতাশ হল দাঁড়িয়ে। কিন্তু নৌকা কখন আসবে সেই ভরসায় বসে থাকার সময় নেই বিদ্যাসাগরের। একবার ‘মাগো’ বলে ডেকে সেই খরস্রোতা নদীর জলে ঝাঁপ দিলেন। সাঁতরে পেরিয়ে চলে এলেন মায়ের মাতুলালয়ের গ্রামে। সেখানে খাওয়া-দাওয়া করে আবার যাত্রা। আবার নদী দ্বারকেশ্বর। তাও সাঁতরে পার হলেন।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বীরসিংহ এখনও অনেক দূর। গ্রামের পথে দ্রুত পা চালিয়ে চলেছেন। বিদ্যাসাগর— একাকী। চিরকালই একরোখা। যা স্থির করবেন তা করে ছাড়বেন। কেউ আটকাতে পারবে না। সুতরাং মধ্যরাত্রে বীরসিংহ গ্রামে মায়ের কাছে পৌঁছলেন বিদ্যাসাগর— ভগবতী দেবীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। মাকে খুশি করতে পেরে বিদ্যাসাগরের অন্তরে সে কী গভীর সুখ, কী এক অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতি।
বিদ্যাসাগরের চরিত্রের যা ছিল গুণ ও গৌরব তার অধিকাংশই মূলত বিদ্যাসাগর তাঁর মায়ের জীবনাচরণ ও চারিত্রমাহাত্ম্য থেকে পেয়েছিলেন।
একবার বিদ্যাসাগরের ইচ্ছে হয়েছিল বীরসিংহ গ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজো করেন।
মা কী বলেন? মায়ের অনুমতি ছাড়া বিদ্যাসাগর কোনও কাজই করতে পারেন না।
মা বললেন— বাবা, বীরসিংহ গ্রামে তো কত দুঃখী দরিদ্র মানুষ। তুই যদি সেই দীন দরিদ্র উপবাসী মানুষের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে পারিস, দেখবি তাতেই জগজ্জননী প্রকৃত খুশি হবেন। সেটাই হবে তোর প্রকৃত পূজা।
মায়ের কথাতেই বিদ্যাসাগর মাতৃপূজার প্রকৃত তাৎপর্য বুঝেছিলেন।
আর তাই নিজের মাকে একবার আহ্লাদে স্বর্ণ-অলঙ্কার উপহার দিতে চাইলে মা বলেছিলেন এসব আমি চাই না রে। এখন শীতকাল। গ্রামের লোকেরা বড় গরিব। শীতে বড় ওদের কষ্ট। পারলে বরং ওদের জন্য কয়েকটা কম্বল কিনে দিয়ে যাস। আর হ্যাঁ বাবা, গ্রামের ছোট-ছোট মেয়েগুলোর লেখাপড়া শেখার জন্য বীরসিংহে তুই একটা বিদ্যালয় বানিয়ে দে।
বিদ্যাসাগরের জীবনের সবচেয়ে যে বড় কাজ— স্বদেশে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন; তার পিছনেও মায়ের ছিল পূর্ণ আশীর্বাদ ও অনুমোদন।
বিধবাদের দুঃখ, সমাজে বহুবিবাহের ফলে মেয়েদের যে অসহ্য দুর্দশা— সে তো বিদ্যাসাগর তাঁর মায়ের চোখ দিয়েই দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। শাস্ত্র ঘেঁটে বিধবাবিবাহের সমর্থন খুঁজেছিলেন। দেশ জুড়ে বিদ্যাসাগরের এই কাজে তখন কী নিষ্ঠুর বিরোধিতা! কিন্তু যেখানে মায়ের সমর্থন আছে, পিতারও সমর্থন আছে, সেখানে বিদ্যাসাগর অকুতোভয়। পরে বুঝলেও, বঙ্কিমচন্দ্রও একসময় বিদ্যাসাগর-বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সংগ্রামে বিদ্যাসাগরই বিজয়ী হয়েছিলেন।
ভগবতী দেবীর কাছে বিদ্যাসাগরের এইসব সাফল্যই ছিল পুত্রের কাছ থেকে স্বর্ণহার উপহার পাওয়া। যাঁর বিদ্যাসাগরের মত সন্তান, তাঁর আবার কোন সম্পদের প্রয়োজন?
সেটা ১৮৬৯ সাল। বিদ্যাসাগরের মায়ের মৃত্যুর দু’বছর আগের কথা।
হ্যারিসন সাহেব সরকারি কর্মচারী। মেদিনীপুর অঞ্চলে এসেছেন। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। অল্প বয়স, সজ্জন, আদর্শবাদী যুবক। একদিন বিদ্যাসাগর বললেন, মা, হ্যারিসনকে একদিন বাড়িতে নেমন্তন্ন করে এনে খাওয়ানো যায়?
মা শুনেই বললেন— না যাবে কেন? তুই তাকে ডাক।
বিদ্যাসাগর হ্যারিসনকে আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন— তোমাকে আমার মাও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
সাহেব খুব খুশি হয়ে বললেন— তাহলে মায়ের আমন্ত্রণলিপি আমার চাই— সেই আমন্ত্রণেই যাব।
ভগবতী দেবী নিজের হাতে ছোট্ট একখানি আমন্ত্রণপত্র লিখলেন—
শ্রী শ্রী হরিঃ—
শরণংঅশেষগুণাশ্রয়
শ্রীযুত এচ্ এল্ হেরিসন মহোদয়
পরম কল্যাণভাজনেষু
আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র ঈশ্বরচন্দ্রের নিকট শুনিলাম, আপনি সত্বর কলিকাতা প্রতিগমন করিবেন। আমার নিতান্ত মানস, দয়া করিয়া তৎপূর্ব্বে একবার বীরসিংহের বাটীতে আগমন করেন, তাহা হইলে আমি যার পর নাই আহ্লাদিত হই। প্রার্থনা এই, আমার বাসনা পরিপূরণে বিমুখ হইবেন না। ইতি ২ ফাল্গুন ১২৭৫ সাল।
শুভাকাঙ্ক্ষিণ্যাঃ
শ্রীভগবতী দেব্যাঃ।
সাহেব ঈশ্বরচন্দ্রের পরিচয় আগেই সব জেনেছিলেন। ১৮৬৯ সালে বঙ্গদেশে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কার অপরিচিত? সাহেব ঘরে ঢুকেই বিদ্যাসাগরের মায়ের পায়ে হাত রেখে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করলেন। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তি বিদ্যাসাগরের জীবৎকালেই প্রবাদে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
সাহেব কি বিদ্যাসাগরের আখ্যানমঞ্জরী পড়েছিলেন? সেখানে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালবাসা নিয়ে তিনটি কাহিনি রয়েছে। বিদ্যাসাগরের মাতৃভক্তিই প্রতিফলিত হয়েছে এই লেখাগুলিতে। এইসব রচনা ইংরেজি নানা গ্রন্থ অবলম্বনে লেখা; কিন্তু অনুবাদ নয়। সুতরাং এইসব গল্পের মধ্যে বিদ্যাসাগরের নিজের মাতৃভক্তির কাহিনিও মিলেমিশে গেছে।
একটি আখ্যান মা ও ছেলের। ওই বালক পুত্রটি ছাড়া অসুস্থ রোগাক্রান্ত অসহায় মায়ের আর কেউ ছিল না। সেই বালক রাতদিন অন্যত্র কাজ করে যে সামান্য উপার্জন করেছে, তাতেই সেবাযত্নে মাকে বিপন্মুক্ত করেছে। শুধু তাই নয়, রাত্রে বাড়ি ফিরে মাকে এমনভাবে লিখতে পড়তে শিখিয়েছে যে ছেলের অনুপস্থিতিতে তিনি একা একা সহজ-সহজ বই পড়ে সারাদিনের নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে পারেন।
আর-একটি গল্প মা ও মেয়ের। গল্পের নাম ‘মাতৃবৎসলতা’। বিচারে মায়ের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। কিঞ্চিৎ সহানুভূতিসম্পন্ন কারাধ্যক্ষ ঠিক করল মহিলাটিকে ফাঁসি না দিয়ে না-খাইয়ে মারলেই তো হয়। মেয়ে কেবল মাকে দিনে একবার করে দেখতে আসার অনুমতি পেয়েছে। মেয়ের কোনও অনুমতি নেই সঙ্গে খাবার নিয়ে আসার। এদিকে অনেকদিন তো হল; বন্দিনী না-খেয়ে বেঁচে আছে কেমন করে! এই মনে করে কারাধ্যক্ষ পরের দিন আড়াল থেকে দেখেন ‘কন্যা, জননীকে স্তন্যপান করাইতেছে।’ বুঝলেন বন্দিনী এই কারণে আজও বেঁচে আছেন। বিচারকর্তা কন্যার এই বিস্ময়কর মাতৃভক্তি ও বুদ্ধিকৌশলের পরিচয় পেয়ে অভিভূত হয়ে কারারুদ্ধা কামিনীর অপরাধ যে শুধু মার্জনা করলেন, তাই নয়, কন্যাকে তার মাতৃভক্তির জন্য প্রভূত পুরস্কৃত করা হল। ‘যে স্থানে (রোম নগরে) এই অলৌকিক ব্যাপার ঘটিয়াছিল, সর্বসাধারণের প্রতি মাতৃভক্তির উপদেশস্বরূপ তাঁহারা (বিচারকর্তারা) এক অপূর্ব মন্দির নির্মিত করাইয়া দিলেন।’
ভগবতী দেবীর প্রতি বিদ্যাসাগরের যে অসামান্য মাতৃভক্তি, তা আমাদের মনের মন্দিরে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
শেষ হয়েও কথা শেষ হয় না। যে বিদ্যাসাগর শুধু বিদ্যার সাগর নন, দয়ার সাগর বলে জগতে বিখ্যাত, প্রাতঃস্মরণীয়; সেই মানুষটিই জীবনের শেষ প্রান্তে মাকে ছেড়ে বাবাকে ছেড়ে ভাই-বোনকে ছেড়ে নিজের সন্তানকে ছেড়ে দীনময়ী-স্ত্রীকে ছেড়ে সাংসারিক সমস্ত বিষয়কর্ম থেকে নিজেকে নির্লিপ্ত করে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন। জনে-জনে সকলকে চিঠি লিখে তাঁর বৈরাগ্য ও গৃহত্যাগের কথা জানিয়েছিলেন। ১২ অগ্রহায়ণ ১২৭৬ মাকে লিখলেন, ‘নানা কারণে আমার মনে সম্পূর্ণ বৈরাগ্য জন্মিয়াছে, আর আমার ক্ষণকালের জন্যও সাংসারিক কোন বিষয়ে লিপ্ত থাকিতে বা কাহারও সহিত কোন সংস্রব রাখিতে ইচ্ছা নাই।’ একই দিনে স্ত্রীকে লিখলেন, ‘আমার সাংসারিক সুখ-ভোগের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে, আর আমার সে বিষয়ে অনুমাত্র স্পৃহা নাই।’ সকলকে প্রায় একই বয়ানে চিঠি। কেবল মাকে শুধু অতিরিক্ত একটি ছত্র: ‘যদি আমার নিকট থাকা অভিমত হয়, তা হইলে আমি আপনাকে কৃতার্থ বোধ করিব এবং আপনার চরণ সেবা করিয়া চরিতার্থ হইব।’ অনেক দুঃখে অনেক বেদনায় জীবনে সকলকে তিনি ছাড়তে পেরেছিলেন, কেবল মাকে নয়।
চিত্রণ: মুনির হোসেন

পড়ে খুব ভালো লাগলো। লেখকের প্রতি অনেক অনেক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাই।