Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রবীন্দ্রনাথের গ্রাম ও শহরের সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তার প্রাসঙ্গিকতা

‘বিশ্বকবি’, ‘কবিগুরু’ এমন সব ভূষণে তাঁকে সজ্জিত করা হলেও প্রকৃত পরিচয়ে তিনি ছিলেন নিখাদ স্বদেশপ্রেমিক। দেশের যাতে ভাল হয় সে ভাবনা তাঁকে সর্বক্ষণ দখল করে থাকত। তেমন সব ভাবনার মধ্যে অন্যতম হল গ্রামপ্রধান আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরের সম্পর্ক বিষয়ক চিন্তাভাবনা। তিনি কী ভেবেছিলেন এমন বিষয়ে আর বাস্তবে তার কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে— সামান্য কথায় সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করা যাক।।

তিনি চেয়েছিলেন তাঁর স্বদেশ হবে ‘গ্রাম ও শহরের সম্মিলনতীর্থ’। কিন্তু তাঁর জীবদ্দশাতে এই দুয়ের মধ্যেকার অতলস্পর্শী বিচ্ছেদ তাঁকে পীড়া দিয়েছিল সমাধিক। সভ্যতার আমদানিতেই সেটি ঘটেছিল। তিনি তাকে ‘মরণদশা’ বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের দেহে ‘পক্ষাঘাতের’ লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তিনি বুঝেছিলেন, শহরবাসী গ্রামবাসীদের ছোট বা খাটো করে দেখে এবং রেখেছেও সেভাবে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে তৈরি হয়ে আছে মহাসমুদ্রের ব্যবধান। গ্রামবাসী ও শহরবাসী যেন একদেশে আছে কিন্তু তাদের এক দেশ নয় বা তারা এক দেশবাসী নয়।

শহরবাসী গ্রামবাসীর প্রতি অবজ্ঞা ও ঔদাসীন্য দেখায় যেটি আধুনিক সভ্যতার অবদান এবং রবীন্দ্রনাথ এই মনোবৃত্তিকে ‘বিকারগ্রস্ততা’ বলেছিলেন। একসময় দুয়ের মধ্যে জ্ঞাতি সম্পর্ক ছিল। বলা যায়, হৃদয়ের সম্পর্কের ঘাটতি ছিল না। যেন একই বাড়ির সদর ও অন্দরের সম্পর্কের মতো ছিল সেই সম্বন্ধ। ক্রমে সেই সম্পর্কের বাঁধন আলগা হতে হতে ছিন্ন হয়েছে।

তিনি অনুভব করেছিলেন, গ্রামের আছে ‘প্রাণ’ আর শহরের আছে ‘শক্তি’। ক্রমে গ্রামের ‘প্রাণ’-কে বিধ্বস্ত করে শহরের ‘শক্তি’ প্রসারিত হতে হতে সমগ্র দেশের প্রাণ নিঃশেষিত হতে চলেছে। তার ফলস্বরূপ বেড়েছে ধনলোভ— উভয় দেশবাসীর মধ্যে। ধনসম্পদের লোভ মানুষকে ‘প্রবল’ হয়ে ওঠার বাসনা জাগায় আর ‘পরিপূর্ণ’ হয়ে ওঠার সাধনাকে লুপ্ত করে। তখন দেশবাসীর মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিযোগিতার রূপ নেয় এবং সেই প্রক্রিয়ায় মানবিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়।

তিনি বুঝতে পারলেন, শহরের আধিপত্য গ্রামকে তার আপন স্বভাব-প্রকৃতি হারিয়ে নিঃস্ব হতে বাধ্য করে। বাস্তবে এখন তেমনটিই ঘটতে দেখা যাচ্ছে! অথচ যা ঘটতে পারত তা ঘটাতে পারলে কী ধরনের সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হত সেকথাও তিনি সেদিন বুঝিয়েছিলেন। গ্রাম ও শহরের বিচ্ছেদ রুখে দিতে পারলে প্রকৃতির দান ও মানুষের জ্ঞান দুয়ের সহযোগে যে সভ্যতা গড়ে ওঠে তেমন সভ্যতা আমরা দেশবাসী গড়তে পারতাম। পরিবর্তে, দেশ আমাদের মা আর সেই মাকে আমরা গুটিকয়েক আদুরে ছেলের মা বলেই দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম!

তিনি গ্রাম ও শহরের বিচ্ছেদকে বিশ্লেষণ করে দেখালেন—

* গ্রামবাসী আমাদের দেশে ধন উৎপাদক এবং অপরদিকে শহরবাসী অর্থ সঞ্চয়নে লিপ্ত সুবিধাভোগী মনুষ্যসম্প্রদায়।

* দেশের বৃহদাংশে ‘কোন কিছু নেই’। অন্যদিকে স্বল্পাংশে ‘সবকিছু আছে’। ভারসাম্য রক্ষা পাবে কিভাবে? তাই সভ্যতার নৌকো কাত হয়ে পড়বেই।

* শহরবাসী যদি ভাবে, অন্তত আমরা আছি বেঁচে তাহলে তা ভুল। মুমূর্ষের সঙ্গে সজীবের সহযোগের নাম— মৃত্যু।

* গ্রামের মাটি বাঁচার উপকরণ যোগায়। শহরের আকাশ ভাবের উৎপাদন ঘটায়। মাটির সঙ্গে যোগ বিচ্ছিন্ন করে শহরবাসী হাওয়ায় ভেসে বাঁচতে চাইছে। ফলে বর্ষণ হচ্ছে না। মনুষ্যত্বের চাষও তাই ঘটছে না।

* শহরের কৃত্রিম আলো ঢেকে দিচ্ছে গ্রামের প্রাণ— প্রকৃতি। তাতে দুর্যোগের ঘনঘটা ঘনিয়ে উঠছে ক্রমশ।

* গাছের মতো গ্রামের শিকড় ডালপালা ছড়িয়ে ব্যাপ্ত হতে পারে শহরের আকাশ ও আলোকের দিকে। পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে, শহুরে রীতি-নীতি গ্রামীণ স্বভাব-রীতিকে নষ্ট করে দিচ্ছে ক্রমশ।

বিশ্বকবি বুঝেছিলেন এভাবে যে, বিশ্বব্যাপী আত্মসংহারের কর্মকাণ্ড চলছে আর তার প্রভাব পরিলক্ষিত হতে চলেছে গণতন্ত্রের আপাত মহিমাদীপ্ত আমাদের দরিদ্র-প্রধান দেশেও।

সর্বার্থে আলোক-সন্তান এই মানুষটি সেদিন যেমন গ্রাম ও শহরের বিচ্ছেদ-ভাবনায় কাতর হয়েছিলেন তেমনই আবার ভবিষ্যতের অন্ধকারময়তা তিনি যেন তাঁর আলোকদীপ্ত অন্তরে স্পষ্ট দেখতে পেয়ে সাবধানবাণী শুনেছিলেন এবং সেই সঙ্গে পরিত্রাণলাভের পথও প্রদর্শন করে গেছেন। সেটুকু বলেই এবার থামা যাক।

শহর গ্রামকে যত অবজ্ঞা করেছে গ্রাম তত যেন শহরকে নকল করার চেষ্টায় মরিয়া হয়েছে এবং নিজের নিজস্বতা বিসর্জন দিয়ে শহরের কৃত্রিমতাকে বিস্তৃতি দেওয়ার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছে। বিষক্রিয়াকে গ্রামবাসী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সবকিছুতে ব্যবহার করার কাজে সাফল্য অর্জন করেছে বিস্ময়কর মাত্রায়। গ্রামবাসীর এইপ্রকার অধঃপতনের সুড়ঙ্গপথে বণিক, ধনিক, স্বদেশী শাসক, বিদ্রোহী ঘাতক, সকলে মিলে ঢুকে পড়ে গ্রামগুলিকে কলুষিত করে ফেলেছে নিরন্তর প্রচেষ্টায়। অধঃপতিত রাজনীতির প্রকোপে গ্রামবাসী আজ আত্মধ্বংসী প্রক্রিয়াতে অভ্যস্ত হয়েছে। ‘কিছু করা চাই’ বলে যারা হুঙ্কার দেয় তারা যে-সত্য মানে না সেটি হল, তাদের মুখের সঙ্গে হাত মেলে না। উদ্যোগে দেশের লোকই বাদ পড়ে যায়। দেশসম্পদ-লুটেরা আজ দেশে আধিপত্য বিস্তার করে গ্রামের মানুষদেরও সেই লক্ষ্যে ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে। দেশসম্পদ ও মানবসম্পদ উভয়েরই ধ্বংস তুমুল গতিতে ঘটে চলেছে, লক্ষ করা যাচ্ছে। এই আশঙ্কাই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাই মুক্তির দিশাও তিনি দেখিয়ে গেছেন—

গ্রাম ও শহরের একমাত্রিক একীকরণ নয়। উভয়ের সম্মিলিত শক্তি দানা বাঁধা চাই নিজ নিজ স্বভাব-প্রকৃতি বজায় রেখেই। দেশকল্যাণবোধে দৃপ্ত বিশ্বজয়ী মানুষটি তাই সেদিন সত্যোচ্চারণ করেছিলেন স্পষ্ট ভাষায়—

মনের যে দৈন্যে মানুষ সবদিকেই মরতে বসে, সেই দৈন্যই ‘আজ’ আমাদের গ্রাস করছে। মিথ্যা, কপটতা, নরঘাতী নিষ্ঠুরতায় মানবচিত্ত ‘আজ’ কলুষিত। সত্যদ্রষ্টা মানুষটির এই উচ্চারণ আজকের দিনেও প্রযুক্তির দাপাদাপিতে মানুষ নামক শ্রেষ্ঠ প্রাণীর মত্ততার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়িত হয়েছে প্রখর মাত্রায়। তাঁর সেদিনের ভাবনার বাস্তবতা বিষয়ে আমাদের নতুন করে বলার কিছু নেই। কেবল তাঁর দেখানো মুক্তি-পথের দিশা মেনে গ্রাম ও শহরের সকল দেশবাসী যেন সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ বাঁচানোর মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হতে পারে— এই শুভকামনা জানাই কবির শুভ জন্মদিন উদযাপন কালে। আমরা যেন ভুলে না যাই তিনি বলেছিলেন—

ধনীর ধনে নয়, গ্রামবাসী ও শহরবাসী সাধারণের সম্মিলিত শক্তিতেই রয়েছে দেশবাসী সকল মানুষের মুক্তি।

চিত্র: গুগল

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

শুভ্র মুখোপাধ্যায়

নগর জীবন ছবির মতন হয়তো

আরও উপযুক্ত, আরও আরও সাশ্রয়ী, এসবের টানে প্রযুক্তি গবেষণা এগিয়ে চলে। সময়ের উদ্বর্তনে পুরনো সে-সব আলোর অনেকেই আজ আর নেই। নিয়ন আলো কিন্তু যাই যাই করে আজও পুরোপুরি যেতে পারেনি। এই এলইডি আলোর দাপটের সময়কালেও।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঋত্বিক ঘটক ও বাংলাদেশ

ঋত্বিক ঘটকের জীবনের প্রথম বাইশ বছর (১৯২৫-১৯৪৭) কেটেছে মূলত পূর্ব-বাংলায়, যা এখনকার বাংলাদেশ। তাঁর জন্ম ঢাকার ২,ঋষিকেশ দাস রোডের ঝুলন বাড়িতে। ১৯৪৭, অর্থাৎ দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগে পর্যন্ত তিনি মূলত পূর্ব-বাংলায় কাটান। আমরা দেখব, পূর্ব-বাংলা যেমন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল, সে-দেশ, সে-ভূমির প্রভাব তদনুরূপ ঋত্বিকেরও পড়েছিল তাঁর চলচ্চিত্রে।

Read More »
মণিকর্ণিকা রায়

অনুগল্প: অর্জন

অসহায় বৃদ্ধের খাওয়া হয়ে গেলে মাঝেমাঝে গল্পও করত ওঁর সাথে। আদিত্য লক্ষ্য করেছিল এই ব্যাপারটা যেন তার মনে একটা বদল আনছে— যেন রোজ তার শরীর-মন জুড়ে সঞ্চালিত হচ্ছে এক অদ্ভুত আনন্দের অনুভূতি। যেন সে সত্যিই মানুষ হয়ে উঠছে।

Read More »
মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ

জীবনানন্দ দাশের সময়চেতনা: পুরাণ, প্রকৃতি ও আধুনিক নিঃসঙ্গতার নন্দনতত্ত্ব

পৌরাণিক, মনস্তাত্ত্বিক ও প্রকৃতিগত সময়চেতনা তাঁকে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগে এক স্থায়ী ও ব্যতিক্রমী মহাকবির আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাঁর শিল্পকর্ম আমাদের শেখায়— দ্রুত ধাবমান জীবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ধীরে চলতে, নীরবতার গভীরে কান পাততে এবং প্রতিটি ক্ষণিকের মাঝে অনন্তের ইশারাকে খুঁজে পেতে। তাঁর সাহিত্য ভবিষ্যতের প্রতিটি সংবেদনশীল পাঠকের জন্য আধুনিকতার এক অমূল্য পাঠ হয়ে থাকবে, যা মানুষের জীবনকে শিল্প ও প্রকৃতির একাত্মতায় আবিষ্কার করতে সাহায্য করে এবং প্রমাণ করে দেয়— কাব্যই চূড়ান্ত আশ্রয়, যখন সমস্ত পথ ফুরিয়ে যায়।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

জীবনানন্দ: প্রয়াণদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

হেমন্তকাল ও জীবনানন্দ অভিন্ন, ওতপ্রোত ও পরস্পর পরিপূরক। তাঁর কবিতায় বারবার নানা অনুষঙ্গে, বিভঙ্গে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে হেমন্তের বসতি যেন। ‘হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শুধু/ শিশিরের জল’, ‘ধানক্ষেতে, মাঠে,/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা’! কুয়াশা আর শিশির, এই দুই অচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হেমন্তের, চিনিয়ে দেন তিনি। ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল’, হেমন্তকে বাহন করে এই যে প্রকৃতির অপরূপতা মেলে ধরা, তা অন্য কোন বাঙালি কবির আছে?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

দুর্গা মাঈ কী! জয়!

ঢাকা বা সমগ্র বাংলাদেশে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা আদায়ের চল খুব একটা নেই। মণ্ডপে এসেই পাড়ার লোক চাঁদা দেন। জবরদস্তি করে চাঁদা আদায়ের যে বীভৎসতা কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে আছে, তা অন্তত ঢাকা আর বরিশালে দেখিনি। পুজোর দিনেও অনেকে এসে প্যান্ডেলের পাশে চাঁদা আদায়কারীদের টেবিলের সামনে এসে চাঁদা দিয়ে যান। পাড়ার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। স্বেচ্ছায় এসে চাঁদা দিয়ে যান। এটা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

Read More »