২০১৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে স্নোগান নির্ধারণ করেছিল Beat Plastic Pollution; আবার এই ২০২৩ পৌঁছে, বিশ্ব পরিবেশ দিবসে রাষ্ট্রপুঞ্জ যখন ওই একই শ্লোগান সামনে রেখে বিশ্ববাসীকে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধের আহ্বান জানায়, বুঝতে অসুবিধে হয় না প্লাস্টিক সারা বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ। ২০১৮-র বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রধান আয়োজক দেশ ছিল আমাদের ভারতবর্ষ। আর ২০২৩-এ আয়োজক দেশ পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি কোস্ট ও সহায়ক দেশ নেদারল্যান্ডস। আইভরি কোস্টের রাজধানী প্রতিদিন গড়ে ২৮৮ মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমিয়ে পরিবেশকে ভারাক্রান্ত করে; ম্যালেরিয়া, নিউমোনিয়া আর ডায়রিয়ায় জীর্ণ শিশুস্বাস্থ্যের কারণগুলোর ৬০ শতাংশ দায়ী করছে এই দেশটির বিপর্যস্ত বর্জ্য-ব্যবস্থাপনায় কলুষিত পরিবেশকে। অপরদিকে নেদারল্যান্ডসের কঠিন বর্জ্যের মাত্র ১৪ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য; বাকি ৮৬% প্লাস্টিক বর্জ্য কাজে লাগিয়ে নেদারল্যান্ডস তৈরি করছে বিদ্যুৎ আর ঘর গরম রাখার জন্য উত্তাপ-ব্যবস্থা। কয়লা পুড়িয়ে এসবের ব্যবস্থা করতে গেলে বাতাসে নির্গত হত বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড। নেদারল্যান্ডসের প্লাস্টিক বর্জ্য-নির্ভর সুস্থিত অর্থনীতি ও নিষ্কলুষ পরিবেশ এখন এক বড় দৃষ্টান্ত। প্লাস্টিক-ব্যবস্থাপনায় দুই বিপরীত অবস্থানে থাকা দুই দেশকে একসঙ্গে ২০২৩-এর পরিবেশ দিবসে রাষ্ট্রপুঞ্জ বিশ্বের দরবারে এনে জানিয়ে দিল প্লাস্টিক বর্জ্য যেমন মাথাব্যথার কারণ, তেমনই তার সুষ্ঠু বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা আমাদের নতুন সুস্থিত প্রতিকারের পথ দেখাতেও সক্ষম।
বিগত ছয়-সাত দশক ধরে আমাদের ধরাধামে রসায়নাগারগুলি ক্রমাগত উন্নত থেকে উন্নততর যে জড়বস্তুটির আমদানি করেছে সেটি হল প্লাস্টিক। বেলজিয়ামের বিজ্ঞানী লিও বেকেল্যান্ড সেই ১৯০৯ সালে প্রথম আজকের অজর-অক্ষয় প্লাস্টিকের আদিরূপটি আবিষ্কার করেছিলেন। নাম রেখেছিলেন বেকেলাইট। আমরা যারা পাঁচের-ছয়ের দশকে মানুষ তারা সকলেই সাদা চিনেমাটির ওপরে খয়েরি কিংবা কালো রঙের ঢাউস ইলেকট্রিক সুইচ দেখেছি। বিদ্যুতের কুপরিবাহী হবার কারণে একশো বছর আগেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু হয়ে উঠেছিল এই বেকেলাইট, আজকের উন্নত নানান ধরনের, নানান কাজের প্লাস্টিকের পূর্বসূরি। প্লাস্টিক, আজকের দুনিয়ায় দিনাতিপাতের জন্য একান্ত জরুরি এই অমোঘ বস্তুটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এখন নানা রূপে জড়িয়ে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই যে টুথব্রাশ ব্যবহার করি আর রাতে শোবার সময় যে সুইচটি টিপে আলো নেভাই, সবকিছুতেই নানা রূপের প্লাস্টিক। বেকেলাইটের উদ্ভাবনার পর থেকে বহু অর্থব্যয়ে বিশ্বজোড়া অসংখ্য গবেষণায় নানান কাজের উপযোগী নানা ধরনের প্লাস্টিক আমরা আবিষ্কার করেছি। একদিন যদি আমরা ঠিক করি, সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে শোবার আগে সেদিন কোনও জিনিসই ব্যবহার করব না যার সঙ্গে প্লাস্টিকের সম্পর্ক আছে, তাহলেই দৈনন্দিন জীবনে প্লাস্টিকের ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকার চিত্রটি সম্যক স্পষ্ট হয়ে যাবে। এই সময়ের প্রতিটি কাজই কোনও না কোনওভাবে প্লাস্টিকের ওপর নির্ভর করে আছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রীর বোতল, মোড়ক ইত্যাদি থেকে শুরু করে কম্পিউটার যন্ত্রাংশ কিম্বা আসবাবপত্র থেকে জুতো, পেসমেকার থেকে মহাকাশযান— কোথায় নেই প্লাস্টিকের ব্যবহার! প্লাস্টিক বিভিন্ন কাজে যত উপযুক্ত হয়ে উঠেছে ততই তার ব্যবহার বেড়েছে আর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ১৯৫০-এ সারা বিশ্বে বছরে মোটামুটি ২৩ লক্ষ টন প্লাস্টিক উৎপাদনের হার একলাফে বেড়ে ২০১৫-য় প্রায় ৫০০০ লক্ষ টন ছুঁয়েছে। এই বৃদ্ধির হারে বাৎসরিক উৎপাদন বাড়াতে থাকলে ২০৫০ সালে ১০,০০০ লক্ষ টন প্লাস্টিক তৈরি করবে। ভারতেই ২০১৮-১৯-এ প্রায় তেত্রিশ লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্যের হিসেব জানাচ্ছে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ; অর্থাৎ ওই সময়ে আমরা দিনে প্রায় ৯২০০ টন প্লাস্টিক জঞ্জাল জমিয়েছি।
অবাধ্য প্লাস্টিক বর্জ্য
অভিধানগত অর্থ যদিও নমনীয় কিন্তু বাস্তবে মানুষের তৈরি এই প্লাস্টিক বস্তুটি মোটেই তেমন নমনীয় নয় যে ব্যবহারের পরে সেটি প্রকৃতিতে ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে যাবে বরং সে ব্যাপারে এই প্লাস্টিক ভয়ানক গোঁয়ার গোবিন্দ আর নাছোড়বান্দা। দীর্ঘকাল অবিকৃত থাকে, কিছুতেই তার উপাদানগুলি প্রকৃতিতে মুক্তি পায় না। মানুষের সভ্যতার তাগিদে রসায়নাগারে তৈরি এই প্লাস্টিক প্রকৃতির স্বাভাবিক ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়ার সাহায্যে জৈব বিয়োজনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেহেতু জৈব বিয়োজন হয় না তাই জলে কিংবা মাটিতে পড়ে থাকা প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ, পরিত্যক্ত পলিথিন চাদর, ব্যানার-ফ্লেক্স, কম্পিউটার যন্ত্রাংশ, ভাঙা আসবাবপত্র, ব্যবহৃত বাসন ইত্যাদি দীর্ঘদিন অবিকৃত পড়ে থাকে। কাগজ, কাঠ, শস্যখেতের জৈব আবর্জনার মতো প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে বিনষ্ট করারও উপায় নেই। প্লাস্টিক আবর্জনা পোড়ানো মারাত্মক ক্ষতিকর, কেননা প্লাস্টিক পুড়ে ডাইঅক্সিন গ্যাস মিশ্রিত যে ধোঁয়া তৈরি হয় সেটি ক্যানসার রোগের কারণ হয়ে ওঠে। তবু অসচেতনতার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশেই, বিশেষত ভারতে, যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়াতে দেখি। উন্নত দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে বিনষ্ট করার বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ব্যবস্থা কিছু হয়েছে বটে তবে সেসব আমাদের মতো গরিব দেশে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এসব প্লাস্টিক আবর্জনা যে শুধু মাটিতে বা জলাশয়েই জমছে তাই নয়, নদীপথে ও উপকূলবর্তী এলাকা থেকে সমুদ্রেও পৌঁছে যাচ্ছে। পরিবেশে বিভিন্ন বর্জ্য প্লাস্টিকের ক্ষয়ের হার অত্যন্ত ধীর; হিসেবে দেখা যাচ্ছে পলিইরিথেন ফোম পরিবেশে অনায়াসে ৫০০০ বছর টিকে থাকতে পারে। এখন ডিসপোসেবল ডায়াপার ব্যবহারের চল বেড়েছে কিন্তু ওই বর্জ্য ডায়াপার অবিকৃত ৫০০ বছর প্রকৃতির জায়গা জুড়ে কাটিয়ে দেবে। আর ‘পেট’ বোতল থাকবে ৪৫০ বছর। এইসব ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক সামগ্রী আবার দীর্ঘকাল পরিবেশের তাপে-চাপে ভেঙেচুরে প্রথমে বড় প্লাস্টিকের টুকরো (৫ মিমি-র চেয়ে বড় ব্যাসের macroplastic), পরে ছোট ছোট টুকরো (৫ মিমি-র চেয়ে ছোট ব্যাসের microplastic) আর শেষে অতি সূক্ষ্ম মিহি গুঁড়ো গুঁড়ো (১ মিমি-র এক লক্ষ ভাগ থেকে এক হাজার ভাগের এক ভাগ মাপের nanoplastic) ন্যানো প্লাস্টিককণা হয়ে মিশে যাচ্ছে নদী, পুকুর, হ্রদ, সমুদ্রে, এমনকি ভূগর্ভস্থ পানীয়জলের ভাণ্ডারে। এই ন্যানোপ্লাস্টিক এখন আমাদের সমস্ত পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। খাবার লবণে প্রতি কিলোগ্রামে ৭ থেকে ৭০০টি দানা মিশে রয়েছে। এমনকি বোতলের পানীয়জলে ১১-১৩টি ন্যানোপ্লাস্টিক দানার সন্ধান পাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। আর এই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পরিবেশের জীবকূলের মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের জালে জীবদেহে জমা হতে থাকছে; সবজি, মাছ, মাংসের মাধ্যমে ঢুকে পড়ছে আমাদের শরীরে। জন্মলগ্ন থেকে ১৯৭০ অবধি প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার অনেক সীমিত ছিল। কিন্তু তার পর থেকেই ক্রমশ আমরা সমস্ত কাজে প্লাস্টিক-জাত জিনিসপত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। ২০০০ সালের পর থেকে গড়ে এই বিশ্বে ৩০০০ লক্ষ টন প্লাস্টিক আবর্জনা পরিবেশে যোগ হচ্ছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে এখনও অবধি আমরা কম-বেশি ৮৩,০০০ লক্ষ টন প্লাস্টিক তৈরি করেছি তার ৬০ শতাংশই আবর্জনা হিসেবে ছড়িয়ে আছে পৃথিবীর পরিবেশে। আর সেই অক্ষয় অব্যয় আবর্জনাভারে পৃথিবীর স্বাস্থ্য আজ বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।
হরেক প্ল্যাস্টিক হরেক কাজ
নানান কাজের জন্য উপযুক্ত মানের ও চরিত্রের বিভিন্ন রকমের প্লাস্টিক তৈরি হয়েছে। সেগুলিকে মোটামুটি সাত রকমে ভাগ করা যায়। প্রথমেই বলি ‘পেট’ বা Polyethylene Terepthalate (PET), যেটিকে প্লাস্টিক বোতল হিসেবে খুব চেনা। জল, নানা রকম পানীয়ের বোতল, রান্নাঘরের হরেক রকম জার-শিশি-বোতল, এছাড়াও ফিল্ম, আসবাবপত্র এমন বহু নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র PET-দিয়ে তৈরি। সারা পৃথিবীতে প্রতি মিনিটে দশ লক্ষ পেট বোতলে নানান পানীয়ের কেনাবেচা হয় আর ব্যবহারের পরেই সেই বিপুল সংখ্যার বোতল বর্জ্য প্লাস্টিক। এরপর আছে High Density Polyethylene (HDPE) যেটিকে আমরা পুরু বড় ক্যারিব্যাগ, ময়লা জমানোর ব্যাগ, দুধ, তেল ইত্যাদির শক্তপোক্ত পাউচ এমন সব নানান কাজে ব্যবহার হতে দেখি। এর আর-এক ধরন হল Low Density Polyethylene (LDPE) যেটি নানান ছোট/মাঝারি মাপের পলিব্যাগ, কৌটো, বোতল তৈরি করতে কাজে লাগে। নিত্যদিনের আরেক সঙ্গী হল Polyvinyl Chloride (PVC), যেটির ব্যবহার নানান রকম পাইপ, তারের বিদ্যুৎ-নিরোধী আস্তরণ, দরজা-জানলার ফ্রেম, আসবাব এমন সব বিভিন্ন কাজে। Polypropylene (PP)-র ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে ভাল মানের একবার ব্যবহার করে ফেলে দেবার মতো কাপ, চামচ ইত্যাদি, বোতলের ছিপি/ঢাকনা, বোতলের পানীয় খাবার স্ট্র, যানবাহনের যন্ত্রাংশ, স্ক্রু, বোল্ট, নানা শিল্প-কারিগরি যন্ত্র, ফাইবার এমন হাজারো কাজে। এরপর রয়েছে Polystyrene (PS) যেটি সস্তার একবার ব্যবহার করে ফেলে দেবার মতো কাপ, চামচ থালা, বাটি, ফোমের গদি, কম্পাক্ট ডিস্ক ইত্যাদি তৈরি করতে কাজে লাগে। এই ছ’রকম প্ল্যাস্টিক উচ্চতাপে গলে যায় (thermoplastic) তাই এগুলোর পুনর্ব্যবহার, পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ সম্ভব কিন্তু অপর ধরনে যেগুলি রয়েছে সেগুলি তাপে গলে না (thermosetting plastic) আর পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ সম্ভব হয় না। সেগুলিরও কিন্তু রোজকার ব্যবহারে বহু কাজ। যেমন ল্যামিনেটেড মাল্টিলেয়ার ফিল্ম (multi-layered laminated film-এর উৎপাদন PWMHR-এর ২০১৮-র নতুন সংশোধনে বন্ধ করা হয়েছে), যার ব্যবহার হরেক প্রসাধনী ও খাদ্যদ্রব্যের মোড়কে, নানা কাজে ব্যবহারের বস্তা, হেলমেট, জুতোর সুকতলা, নাইলন এমন বিভিন্ন কাজে। চকোলেট, প্যাকেটের আলুভাজা ইত্যাদির রংচঙে প্যাকেট সবেতেই ওই মাল্টিলেয়ার ফিল্মের ব্যবহার। আইন হয়েছে, আইনের ফাঁক দিয়ে কাজ গুছিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও তৈরি থাকে। একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া এইসব মনকাড়া রঙিন মোড়ক পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির করছে কেননা এগুলো বেশিরভাগেরই পুনর্নবীকরণ অসম্ভব।
ক্যারিব্যাগের ভার: বইতে পারি না আর
প্ল্যাস্টিকের সবচেয়ে চালু যে জিনিসটি প্রতিদিনের কাজে মোক্ষম জায়গা করে নিয়েছে সেটি হল ক্যারিব্যাগ বা পলিব্যাগ। আর সেইমতো আসমুদ্র হিমাচল উড়ে বেড়াচ্ছে বর্জ্য প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ। সমুদ্রের গভীরে কিংবা হিমালয়ে বরফাবৃত শৃঙ্গ সবখানেই বর্জ্য প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি। তাই ক্রমাগত বর্জ্য প্লাস্টিকের প্যাকেটের পাহাড় জমে উঠছে আমাদের পরিবেশের সর্বত্র। সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে সারা বিশ্বে ৫০,০০০ কোটি প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ একবার ব্যবহার হবার পরেই পরিবেশে ঠাঁই নেয়। শহর আর মফস্বলের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়ে এই জঞ্জাল। নিকাশিব্যবস্থায় জমে উঠে বর্ষায় জল বহনের কাজে বড় বাধা তৈরি করছে; বাড়ছে বর্ষায় পথে জল জমে থাকার সমস্যা। চাষের জমিতে পলিব্যাগের পাতলা চাদরের আস্তরণ বাতাস ঢোকার পথ বন্ধ করে উর্বরতা কমাচ্ছে। পাহাড়ের ঢালে বর্জ্য পলিব্যাগের বোঝার জন্য পাহাড় অঞ্চলে ধসের ঘটনা বাড়ছে। এই দুষ্কর্মে ক্যারিব্যাগের দোস্ত হল গুটখা-পানমশলার মতো হাজার রকম নেশা অথবা মুখশুদ্ধির ছোট ছোট ফেলে দেওয়া প্যাকেট। সমীক্ষা বলছে, ভারতের নালা-নর্দমায় জমে থাকা বর্জ্যের ২২ শতাংশ এই গুটখা-পানমশলার ছোট ছোট প্যাকেট আর ২৭ শতাংশ ক্যারিব্যাগ। অথচ আমরা দেখি ক্যারিব্যাগ-বিরোধী প্রচার যতখানি প্রচারের আলো পায়, ওই তামাকজাত নেশা ও মুখশুদ্ধির হরেক রকম অজস্র একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া প্যাকেটগুলো নিয়ে তেমন ঘোরতর আপত্তি কে কবে শুনেছি! বড় বড় কোম্পানির কয়েকশো হাজার কোটি টাকার ব্যবসা যেখানে জড়িয়ে থাকে সেখানে রাষ্ট্রের কণ্ঠস্বর খানিক কমজোরি হয়ে পড়বে তাতে আর বিস্ময় কী! সে যা হোক, ক্যারিব্যাগের ব্যবহার আটকাতে সরকারি বন্দোবস্তের চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই, কেননা গত ১৯৯৯-এর প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহার সংক্রান্ত আইনি বন্দোবস্ত (Plastic Waste Management and Handling Rules; PWMHR), ২০১১ সালে ও পরে ২০১৬ সালে পরিবর্তন করে ২০ মাইক্রন পুরু পলিথিন চাদরের ব্যাগ ক্রমশ বেড়ে ৪০ মাইক্রন ও পরে ৫০ মাইক্রন হয়েছে। ২০২২-এর ১ জুলাই থেকে ৭৫ মাইক্রনের থেকে কম পুরু প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ব্যবহার আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মূল উদ্দেশ্য, যত পুরু হবে তত দামি হবে আর তাই ক্যারিব্যাগের দাম বাড়লে তার যথেচ্ছ ব্যবহার কমবে। এছাড়াও একটা বড় পরোক্ষ কারণ আছে। আমাদের মতো গরিব দেশে বহু মানুষের জীবিকা বর্জ্য-নির্ভর। তাঁরা আমাদের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার কাজটি করেন নীরবে। সেই কাগজকুড়ানিরা পাতলা প্লাস্টিক কুড়োতে চান না। কেননা বাজার-চালু মাপের ক্যারিব্যাগের প্রায় ৩৫০টি পাতলা ক্যারিব্যাগ জমা করলে এক কিলোগ্রাম হবে যার বাজার মূল্য তিন থেকে পাঁচ টাকা। এই সামান্য অর্থের জন্য তাঁদের পরিশ্রম অনেক বেশি। মোটা চাদরের ক্যারিব্যাগ হলে কুড়ানিদের হাত ঘুরে এইসব বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের পথে যেতে পারবে। তবে পাতলা বা মোটা যেকোনও ক্যারিব্যগের ব্যবহার আমাদের প্রত্যেককে সতর্কভাবে কমিয়ে ফেলতে হবে। নাহলে এই ভয়ংকর বস্তুটি থেকে পরিবেশকে মুক্তি দেবার জন্য কোনও ব্যবস্থাই কার্যকরী হবে না। ক্যারিব্যাগ ব্যবহারে সতর্কতার নজির গড়েছে ডেনমার্ক। আমেরিকায় জনপ্রতি বছরে ক্যারিব্যাগের ব্যবহার যেখানে ৩৬৫টি সেখানে ডেনমার্কে মাত্র চারটি। ক্যারিব্যাগ যে শুধু শহর-মফস্বলেই সীমাবদ্ধ তা তো নয়; ছড়িয়ে আছে গ্রামে এমনকি মানুষের হাতে হাতে অরণ্যের পরিবেশেও। বর্জ্য খাদ্যদ্রব্য ভরে পরিবেশে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক প্যাকেট আমাদের পড়শি প্রাণীদের শরীরে, অরণ্যে বন্যপ্রাণীর শরীরে ঢুকে পড়ছে। জঙ্গলে বেড়াতে যাওয়া যেমন আমাদের দেশে তেমনই অরণ্য-সম্পদে সমৃদ্ধ পৃথিবীর নানা দেশে বেশ জনপ্রিয় পর্যটন। এই অরণ্য-পর্যটন শুধুমাত্র স্থানীয় অর্থনীতিই নয়, অনেক ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ জরুরি। অথচ বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে উদাসীন অনেক পর্যটক প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে নির্মল অরণ্য পরিবেশ ও অরণ্যচারী জীবের স্বাস্থ্য ধ্বংস করছে; আইন আছে কিন্তু আইন-রক্ষার ব্যবস্থা তেমন পাকা নয় সেইসব দেশে এই ক্যরিব্যাগ দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে নির্বিচারে আর কোথাও আবার নানান আইনি নিয়ন্ত্রণের বেড়াজালের ফাঁকফোকর আজ থেকে প্রায় তিন দশক আগে আন্নামলাই ব্যাঘ্রবনের ভারাগালিয়ার শোলা জঙ্গলে হাতির মলে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ছবি ছাপা হয়েছিল স্যাঙ্কচুয়ারি এশিয়া পত্রিকায়। সম্প্রতি করবেট জাতীয় উদ্যানের ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেন একটি ছবি প্রকাশ করেছেন যেখানে একটি চিতা মুখে প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নিয়ে বসে আছে। কত যে রাস্তার কুকুর, বেড়াল, গোরু এমন সব চরে খাওয়া প্রাণীগুলোর সঙ্গে বনবাসী অরণ্যচারী পশু-পাখিও ক্যারিব্যাগ খেয়ে মরছে তার কোনও সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই।
চল তোরে দিয়ে আসি সাগরের জলে
প্রতি বছরে প্রায় ৮০ লক্ষ টন প্লাস্টিক আবর্জনার ঠাঁই হয় সমুদ্রে। ইতিমধ্যেই ১৫০০ লক্ষ টন আবর্জনা জমা হয়েছে আমাদের সাগর-মহাসাগরগুলিতে। সমুদ্রে ভাসমান রয়েছে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি নানান প্লাস্টিকের টুকরো আবর্জনা। সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর আর নদীপথে এই আবর্জনা ক্রমাগত জমছে সাগর-মহাসাগরে। সমুদ্রের প্লাস্টিক আবর্জনার ৯০ শতাংশ আসে পৃথিবীর ১০টি নদীপথে আর তার ৬টি আছে আমাদের এশিয়া মহাদেশে। হিসেব বলছে, ভারত-বাংলাদেশের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীপথে বছরে ৭২,৮৪৫ টন প্লাস্টিক আবর্জনা আমাদের বঙ্গোপসাগরে জমা হচ্ছে। বায়ুপ্রবাহ ও সাগর-মহাসাগরের নানান স্রোতের তাড়নায় এই আবর্জনার সমুদ্রপথে পৃথিবী পরিক্রমা চলতে থাকে, বছরের পর বছর। স্রোতের ঘূর্ণিতে মহাসাগরের মধ্যে বিশাল বিশাল আবর্জনার দ্বীপ তৈরি হয়েছে। উত্তর আটলান্টিক আর উত্তর-মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে এই সব ভাসমান আবর্জনার দ্বীপগুলোর আয়তন ৭,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার (প্রায় মায়ানমারের আয়তনের সমান) থেকে ১,৫০,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের (প্রায় রাশিয়ার আয়তনের সমান) চেয়েও বড়। সমুদ্রের তলদেশেও প্রায় ১৪০ লক্ষ টন প্লাস্টিক আবর্জনা জমা হয়েছে। এইসব আবর্জনা ক্ষয়ে ছোট হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক আর ন্যানোপ্লাস্টিক রূপে সাগর-মহাসাগরে ছড়িয়ে পড়েছে। সমুদ্রের তলদেশে জমা হয়েছে ১৪০ লক্ষ টন প্লাস্টিক আবর্জনা। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপ হেন্ডারসন, যেটিতে কোনও কালে মানুষ বসবাস করেনি, আর মানুষ বসবাস করে এমন উপকূলবর্তী শহরগুলি অন্তত ৩০০০ কিলোমিটার দূরে। এমন পাণ্ডববর্জিত হেন্ডারসন দ্বীপের মিহি সাদা বালুতটে ৩৭০ লক্ষ টন বর্জ্য প্লাস্টিক জমা হয়েছে। তটভূমিতে হাঁটলে প্রতি বর্গ কিমিতে কম-বেশি ৬৭২ টুকরো প্লাস্টিক ছড়িয়ে আছে। সামুদ্রিক মাছ, পাখি, কচ্ছপ, সিল, সিন্ধুঘোটক, বিভিন্ন প্রজাতির তিমি সকলেই আজ এই সমুদ্র-দূষণের শিকার। ৮০০-র বেশি সামুদ্রিক প্রাণির প্রজাতি প্লাস্টিক বর্জ্য খাবার হিসেবে ভুল করে খেয়ে ফেলে অসুস্থ হচ্ছে, অসহায়ভাবে প্রাণ দিতে হচ্ছে। সামুদ্রিক পাখির প্রজাতির ৬০ শতাংশ এমন অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই হারে সমুদ্র-দূষণ চলতে থাকলে আগামী ২০৫০-এ হয়তো ৯৯ শতাংশ পাখির প্রজাতি দূষণের শিকার হয়ে পড়বে। এখনই প্রতি বছর কম-বেশি ১০০০টি সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী প্লাস্টিক-দূষণে মারা যাচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে মাছধরার প্লাস্টিকের বর্জ্য জালে। এমন বর্জ্য প্লাস্টিক সুতোর জালে কচ্ছপ, সিল, এমন নানান প্রাণী জড়িয়ে গিয়ে মারা যাচ্ছে। প্লাস্টিক আবর্জনায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানান প্রবাল প্রজাতি। প্রবালের বৃদ্ধির গতি অতি ধীর; বছরে ০.৮ থেকে ১.২ সেমি মাত্র। প্রবাল প্রজাতির বৈচিত্র্য নষ্ট হলে তাদের ফিরে পাওয়া সহজ হবে না। যে হারে প্লাস্টিক-দূষণ হচ্ছে সেটিই যদি অব্যাহত থাকে তবে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ কার্যক্রম (United Nations Environment Program) জানাচ্ছে, আগামী ২০৫০-তে আমাদের সাগর-মহাসাগরে মাছের থেকে বেশি সংখ্যায় বর্জ্য প্লাস্টিকের টুকরোগুলো ভেসে বেড়াবে। অথচ কমা দূরে থাক বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। ২০২১ থেকে ২০২৮-র মধ্যে বিশ্বে ৫.০ শতাংশ হারে যৌগিক বাৎসরিক বৃদ্ধির (Compound Annual Growth Rate) আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই বিশ্বের পরিবেশবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ক্রমশ চওড়া হচ্ছে।
আমাদের জঞ্জালকুড়ানিরা
ভারতে প্রতিদিন ১৫,০০০ টনের-ও বেশি পরিমাণে বর্জ্য প্লাস্টিক পরিবেশে জমা হচ্ছে। এরমধ্যে প্রায় ৬,০০০ টন সরাসরি পরিবেশে পড়ে থাকে আর বাকিটা পুনর্নবীকরণের পথে নতুন প্লাস্টিক সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়। আর এই বিপুল বর্জ্য সংগ্রহের কাজটি সম্ভব হয় আমাদের দেশের হতদরিদ্র অন্তেবাসী কাগজকুড়ানিদের জন্যই। ভারত, নেপাল, বাংলাদেশের মতো বেশিরভাগ গরিব দেশেই প্লাস্টিক বর্জ্য কুড়িয়ে জীবননির্বাহ করে বিপুল সংখ্যায় মানুষ। বেশিরভাগ শিশু, কিশোর-কিশোরী আর মহিলাই এই কুড়ানির কাজে যুক্ত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যত রকম উপায় হতে পারে তার সবকিছুই সহ্য করে অসামান্য দক্ষতায় কাজ করে চলেছেন আমাদের শহর-মফস্বলের কাগজ-কুড়ানিরা। আমাদের দেশে ১৫ থেকে ৪০ লক্ষ মানুষের জীবিকা বর্জ্য-নির্ভর। কম-বেশি মাসে ১৫০০ থেকে ১৫০০০ টাকার বেশি রোজগার হয় না, কিন্তু তারাই এখনও প্লাস্টিক আবর্জনার পুনর্নবীকরণের ১০০ শতাংশ কাজ নীরবে করে চলেছেন। উপযুক্ত জনসচেতনতা ও উন্নত আবর্জনা সংগ্রহ ও পৃথকীকরণের ব্যবস্থা সত্ত্বেও আমেরিকায় যেখানে ৩০ শতাংশের বেশি বর্জ্য পেট বোতল পুনর্নবীকরণ হয় না সেইখানে আমাদের কুড়ানিরা নিখরচায় ৭০ শতাংশ বর্জ্য পেট বোতলের পুনর্নবীকরণের ব্যবস্থা করেন। জানুয়ারি ২০০০ সালের Municipal Solid Waste (Management and Handling) Rules, যেসব নিয়ম-কানুন ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে Environmental Protection Act 1986-এর আওতায় লাগু হয়েছে, তারই নির্দেশমতো এখন শহর-মফস্বলের পুর এলাকায় বাড়ি-বাড়ি আবর্জনা সংগ্রহের কাজ চলছে। কিন্তু সেখানেও জনসচেতনতার অভাবে পৃথক সংগ্রহের জন্য পাত্র দেওয়া সত্ত্বেও পচনশীল ও প্লাস্টিক জঞ্জাল সব একাকার। সেখানেও সংগ্রহ, পৃথকীকরণ ও আলাদা করে প্লাস্টিকজাত আবর্জনা বস্তাবন্দি করার কাজটি সেই কুড়ানি-নির্ভর। আবর্জনা সংগ্রহের এই ব্যবস্থা পঞ্চায়েত স্তরে চালু হয়নি; অথচ মাথাপিছু প্লাস্টিক জিনিসের ব্যবহারে শহর গ্রামের মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। তাই আমাদের গ্রামের পরিবেশ দ্রুত প্লাস্টিক আবর্জনায় ভরে উঠছে।
ভারতে নথিভুক্ত ও অনথিভুক্ত ৭৫,০০০-এর বেশি প্লাস্টিক আবর্জনা ও ৩১২টি বৈদ্যুতিন বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ও পুনর্নবীকরণ ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলির মিলিত পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম পরিমাণে বর্জ্য সংগ্রহ করা হয় আমাদের দেশে। তাই দেশের প্লাস্টিক বর্জ্য পুনর্নবীকরণ কারখানাগুলি নির্ভর করে বিদেশ থেকে আমদানি করা বাছাই ও পরিষ্কার বিদেশি প্লাস্টিক জঞ্জালের ওপর। এর মূল কারণ কুড়ানি থেকে বেশ কতগুলি হাত ঘুরে কারখানা পর্যন্ত পৌঁছতে বর্জ্যের যা দাম পড়ে তার থেকে ঝাড়াই-বাছাই করা পরিষ্কার বর্জ্যের টনপ্রতি দাম কম পড়ে। অথচ দেশের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহের কাজটিকে আরও মজবুত করার উৎসাহ তেমন দেখি না। রাষ্ট্র সাহায্য করলে কুড়ানিরাই বর্জ্য সংগ্রহ, পৃথকীকরণ ও পরিষ্কার করার কাজ আরও অনেক বেশি দক্ষতায় ও পরিমাণে করতে পারতেন। ফড়ে-কাবাড়িরা মাঝের থেকে কুড়ানিদের পরিশ্রমের দামে পকেট ভরাচ্ছে আর দীনহীন প্রান্তিক মানুষ হয়ে বেঁচে রয়েছেন তারাই আসলে যারা আমাদের প্লাস্টিক বর্জ্যের বোঝার হাত থেকে পরিবেশকে অনেকাংশে মুক্তির পথ দেখান। এখন আইন করে বর্জ্য আমদানি বন্ধ করা হয়েছে। তবুও প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্প সমস্ত আইনকে উপেক্ষা করে শিল্পে এগিয়ে থাকা উন্নত দেশগুলি থেকে বর্জ্য প্লাস্টিক আমদানি করছে। কেননা এই প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলির ক্ষমতার তুলনায় দেশের সংগ্রহ অপ্রতুল। ২০১৯-এ বর্জ্য পেট বোতলের আমদানির পরিমাণ ছিল ১,২১,০০০ মেট্রিক টন! নানান চোরাপথে, আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ২০২২-এ এদেশে হাজির হয়েছে নানান উন্নত দেশের ৯৩,০০০ মেট্রিক টন বর্জ্য পেট বোতল।
২০২১-এর ৪ আগস্ট Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর ৫৪তম সভায় আলোচনার সারাৎসারে মারাত্মক চিন্তার বিষয় উঠে এসেছে। যে হারে সারা বিশ্বে নানান কাজের জন্য প্লাস্টিক উৎপাদন করা হচ্ছে সেই হার যদি এখনই দ্রুত কমিয়ে ফেলা না যায় তাহলে ২০৩০ নাগাদ প্রতি বছরে শুধুমাত্র প্লাস্টিক থেকেই প্রায় ১.৩৪ বিলিয়ন টন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হবে; এই পরিমাণ ওই একই সময়ে অন্তত ৩০০টি নতুন ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণের সমান। আমার গরিব দেশের প্রান্তিক কাগজকুড়ানিরা সমাজের প্রায় অলক্ষ্যে থেকে সরকারের একটি পয়সাও দাবি না করে কী যে সুচারুভাবে শহর-মফস্বলের কঠিন আবর্জনা থেকে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য পৃথক করার দুরূহ কাজটি করে চলেছেন, ভাবলেও অবাক হতে হয়। সেই কাজের অর্থমূল্য বিপুল, অথচ সমাজ কোনও আমলই দিল না। এমনকি এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে এই কুড়ানিদের কাজ ‘কার্বন ক্রেডিট’ পাবার যোগ্য। এবার রাষ্ট্র ঠিক করুক এই অসংগঠিত কর্মীকুলকে সংগঠিত করে দেশের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও পুনঃনবীকরণের কাজ আরও নিবিড় করে তুলবে নাকি এই কুড়ানিরা কোনও দেশি-বিদেশি নামী শিল্পপতির বর্জ্য-নির্ভর শিল্পে সামান্য অনুদানের ময়লা-প্রান্তিক শ্রমিক হয়ে বেঁচে থাকবেন!
প্রশ্ন হাজার
প্লাস্টিক নিয়ে কথা বললেই আমাদের মনে কিছু সংশয় জেগে ওঠে। ক্যারিব্যাগ না হয় বর্জন করলাম, কিন্তু পাঁউরুটির সিঙ্গল ইউজ মোড়কের কী হবে? গুটখা, পানমশলার মতো নানান মুখশুদ্ধির কোটি কোটি মোড়ক কিংবা বিস্কুট, শুকনো খাবার, প্রসাধনীর নানান সুদৃশ্য রঙচঙে মাল্টিলেয়ার প্লাস্টিক প্যাকেটের কী হবে? শুনেছি এইসব ফেলে দেওয়া মাল্টিলেয়ার প্লাস্টিক মোড়কের পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ সম্ভব নয়; তাহলে? এই আসন্ন বর্ষায় কোটি কোটি মানুষের মাথার ছাদ কয়েকশো কোটি বর্গ মিটার প্লাস্টিকের চাদর। সেগুলো অচিরে আবহাওয়ার তাড়নায় (weathered) ছিঁড়ে, ভেঙেচুরে গুঁড়ো হয়ে কোথায় গিয়ে পৌঁছয়? একই দশা হয় কয়েক হাজার কোটি মাইল দীর্ঘ নানান ব্যাসের প্লাস্টিকের দড়ির; নানা কাজে ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোনা (woven plastic sheet) বস্তা কিংবা পরিত্যক্ত ব্যানার, ফ্ল্যাগ, হোর্ডিংয়ের। কেন আমার দেশে প্যাকেজড পানীয়জলে কমবেশি তেত্রিশটি ন্যানোপ্লাস্টিক কণা পাওয়া যায়? কীভাবে আমাদের ভূগর্ভস্থ জলের ভাঁড়ারে প্লাস্টিক দূষণ পৌঁছে যাচ্ছে? সারা বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বেশি হারে বেড়ে চলা প্লাস্টিক শিল্পকে কি কোনও সরকার সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে পারবে? তাহলে পেট্রোলিয়াম শোধনের উপজাতগুলির কী হবে? কেন পরপর দু’বছর রাষ্ট্রপুঞ্জ বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান Stop Plastic Pollution না করে ‘Beat Plastic Pollution’ করল? কেন ভারতকে এই গত বছরেও বিপুল পরিমাণ বর্জ্য প্লাস্টিক জঞ্জাল ভিনদেশ থেকে আমদানি করতে হল তার পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে মদত দিতে? তবে কি এই ক্রমাগত ৪০, ৫০, ৭৫ মাইক্রনের আইন শুধু ‘মনকে চোখ ঠারা’? কেন ৫০ নয়, কেন ৭৫ মাইক্রন? Plastic Wastes Handling and Management Rules ২০১৪, ১৬, ১৮, ২-এর অ্যামেন্ডমেন্টেও আমরা কেন এসব প্রশ্নের সদুত্তর পাচ্ছি না? ভাবতে হবে, এখনই দ্রুত আমাদের ‘ভাবা প্র্যাকটিস’ করার সময়, কেননা কাজে নামার সময় দ্রুত হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।
পরিত্রাণের রাস্তা
পরিবেশরক্ষার আন্দোলনে ভারত যে বেশ অগ্রণী দেশ একথা কেউ অস্বীকার করেন না। আপ্পিকো-চিপকো-সায়লেন্ট ভ্যালি-বৃহৎ নদীবাঁধ-সহ নানা পরিবেশ আন্দোলন আমাদের দেশকে বিশ্বের সামনের সারিতে এনেছে। সেইমতো প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ থেকে বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রতিরোধী বন্দোবস্ত হোক, সবক্ষেত্রেই ভারত অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে এসেছে। ২০১৮-য় রাষ্ট্রপুঞ্জ সেই কারণেই উন্নয়নকামী বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতবর্ষকে প্লাস্টিক-বিরোধী কর্মকাণ্ডের আমন্ত্রণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। প্লাস্টিক দূষণ-বিরোধী কর্মকাণ্ড শুধুমাত্র আর ব্যবহারকারীর স্তরে সীমাবদ্ধ রাখার দিন শেষ। একবারের জন্য ব্যবহার করার পলিব্যাগগুলিও আমাদের মতো দরিদ্র দেশে পরিবেশে বর্জ্য হিসেবে ছুড়ে ফেলার আগে নানা কাজে দু-একবার ব্যবহার করা হয়; উন্নত দেশে জল খাওয়া হলেই বোতলটি বর্জ্য, কিন্তু দরিদ্র দেশগুলিতে সেগুলি পুনর্ব্যবহারের জন্য সরাসরি বর্জ্য হয়ে উঠতে সময় নেয়। এই টুকরো টুকরো সময়ের যোগফলে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের কাজটি কিছু বেশি সময় পায়। ইতিমধ্যেই বর্জ্য প্লাস্টিক বিয়োজনের জন্য নিত্যনতুন ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান মিলছে। প্রক্রিয়াকরণের জন্য নতুন সুস্থিত বন্দোবস্তের আবিষ্কার হচ্ছে। বর্জ্য প্লাস্টিকের সুতোয় বোনা জার্সি পরে ভারতের ক্রিকেট টিম ওয়ার্ল্ড কাপ খেলে নতুন পথের দিশা দিয়েছে বিশ্বকে। বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল আজ এক বড় সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। এমন হাজারো রাস্তা খুললেও প্রতিক্ষেত্রেই নানান প্রতিবন্ধকতাও আছে। সবচেয়ে বড় শত্রু অণুপ্লাস্টিক বা ন্যানোপ্লাস্টিক। পানীয়জল থেকে সমুদ্রতল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে ন্যানোপ্লাস্টিক। অথচ বিশ্বের সবদেশেই প্লাস্টিক শিল্প সবচেয়ে অর্থকরী শিল্পগুলির অন্যতম। তাই কোনও দেশেই নীতিনির্ধারকেরা কার্যকরীভাবে প্লাস্টিক শিল্প বন্ধ করায় তেমন সচেষ্ট নয়। হয়তো সেই কারণেই Stop Plastic Pollution স্লোগানের বদলে Beat Plastic Pollution প্রচারে আসে। কিন্তু ওই সূক্ষ্ম তফাৎ আমাদের ভাবায়।
উপসংহার
প্লাস্টিকের হাজার সুবিধে থেকে আমার দরিদ্র দেশের মানুষ তড়িঘড়ি মুখ ফেরাবে এমন মনে হয় না। ভেন্ডার কামরায় সম্যক দেখেছি একটা ক্যারিব্যাগে প্ল্যাটফর্মের কল থেকে জল ভরে এনে কয়েকজনকে তৃষ্ণা মেটাতে। আমরা কি পারব তাদের এই বিনি পয়সার সহজে বহন করা যায় এমন কোল্যাপ্সিবল জলের বোতলটি কেড়ে নিতে। ভারতের সব গরিব মানুষের মাথা বাঁচাতে চালের ওপর পেতে রাখা প্লাস্টিক চাদর কীভাবে সরিয়ে দেব! যেসব বেসরকারি পরিবেশ-প্রাণ সংস্থা সারা বছর প্লাস্টিক-বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকে তারাও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ হিসেবে প্লাস্টিক চাদর পৌঁছে দিতে বাধ্য হয় ভারতের উপকূলবর্তী অত্যন্ত সংবেদনশীল পরিবেশে বসবাসকারী দুর্গত মানুষদের কাছে। চট, কাপড় বা কাগজ যে প্ল্যাস্টিক ব্যবহারের পুরোপুরি বিকল্প কোনওদিনই হবে না সেটি চাহিদা ও যোগানের সহজ ঐকিক নিয়মেই বুঝে নেওয়া যায়। কাগজ মানেই অরণ্য সম্পদের ক্ষতি। সে তো কিছুতেই পরিবেশবান্ধব হতে পারে না। পাট ও তুলো চাষের জন্য অতিরিক্ত জমি ও জলের যোগান কোথায় যে পলিব্যাগের বিপুল চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উঠবে! তাই প্লাস্টিক-বিরোধী আন্দোলনকে হতে হবে বহুমাত্রিক। নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বিকল্পের ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রিত উৎপাদনের সঙ্গে সচেতনভাবে আমাদের অবশ্য একবার ব্যবহার করেই ফেলে দেবার মতো প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে। যেখানে সম্ভব সেখানেই বিকল্প ব্যবহারে জোর দিতে হবে। সতর্কভাবে দেখতে হবে যেন আমার ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার-প্রক্রিয়াকরণের পথে যেতে পারে। রাজ্যের অনুষ্ঠান, সেমিনার ইত্যাদির পরে ব্যানারটি কোথায় গেল কে হিসেব রাখে! রাজনীতির যুদ্ধে ব্যবহার হওয়া বিস্তর নেতা-নেত্রীর গগনচুম্বী ফ্লেক্স-ব্যানারের খবরই বা কে রাখে! সম্প্রতি খবরে এসেছে আমাদের রাজ্যে ও দেশের নানান জায়গায় প্লাস্টিক সঞ্জাত নানান পাতলা-মোটা চাদরের টুকরো বিটুমেনের সঙ্গে মিশিয়ে নীল রঙের জল-নিরোধী টেঁকসই রাজপথ তৈরি হচ্ছে। এই ধরনের রাস্তা ইতিমধ্যেই বিদেশে কিছু দেশে পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন এই প্লাস্টিক পথের চারপাশে আমাদের নিশ্বাস নেবার বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশতে থাকবে না তো! আগামী সময় জানাবে তেমন মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা বাতাসে ভাসতে থাকলে আমাদের শরীরে তার কী প্রভাব পড়বে।
জন্মলগ্ন থেকে উন্নত প্লাস্টিক তৈরির গবেষণায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয় হয়েছে তার ০.০০০১ ভাগও খরচ হয়নি সুস্থিত বিয়োজন-পুনর্ব্যবহার-পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের গবেষণায়। তেমনই গবেষণায় উপযুক্ত অর্থ বিনিয়োগ করে সুস্থিত প্লাস্টিকের গবেষণাকে সামনের সারিতে আনতে হবে। রাষ্ট্র নির্ধারিত পাড়ায় পাড়ায় শুধুমাত্র ক্যারিব্যাগ বর্জনের আন্দোলনে সীমিত থাকার সময় আর নেই এখন। সব দেশকেই বিশ্বজোড়া আন্দোলনে সামিল হতে হবে যেখানে প্রতিটি দেশের বিজ্ঞানীদের বর্জ্য প্লাস্টিকের সুস্থিত বিয়োজনের গবেষণায় উৎসাহ দিতে হবে। বহুমাত্রিক প্রতিরোধ ছাড়া আন্দোলন আটকে থাকবে ক্যারিব্যাগে, আর প্লাস্টিক উড়ে বেড়াবে স্থলে-জলে-অন্তরীক্ষে। প্লাস্টিক-বিরোধী যুদ্ধের বিষয়টি আদতে নানান তর্ক-বিতর্কের। এই লেখা যদি কিছু বিতর্ক তৈরি করে তবেই হয়তো আঞ্চলিকভাবে প্লাস্টিক-দূষণ মুক্তির আন্দোলন দিশা পেতে শুরু করবে।
খুব ভালো লিখেছেন।
An extremely important article. Should be read by all and its prescriptions followed immediately before it is too late.