ঋ ভু চ ট্টো পা ধ্যা য়
প্রসাদকাকুর কোয়ার্টারে টিউসন পড়াতে যাচ্ছি, নিজের নয় কোম্পানির কোয়ার্টার, তবে নামেই কোয়ার্টার, চারদিকটা যেভাবে সাজানো হয়েছে তাতে অট্টালিকাও হার মানবে। বাগানে একটা বড় ঘর করা আছে, আমার ঠাঁই এই বাগানের ঘরেই। দরজাটা খুলে ঘরটাতে ঢোকার আগে আমাকে ছোট্টু বলে একবার ডাক দিতে হয়। ছোট্টু প্রসাদকাকুর নাতি, বয়স ছয় প্লাস, ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আমার পড়ানোর বিদ্যেতেও কুলিয়ে যায়। ছেলেটা বেশ গাবদাগুবদো, ফর্সা। আমি ভুলোরাম বললেই সামনের ভাঙা দাঁত নিয়ে বলে, ‘দাদি ভি আমাকে বুদ্ধুরাম বলে ডাকে।’
প্রথম প্রথম অবশ্য দাদি বা মায়ের সাথে আমার কথা বলবার সৌভাগ্য হয়নি। এমনকি প্রথম পড়ানোর কথা বলতে যাওয়ার দিনেও কাকুর সাথেই কথা হয়। তারপরেও মাঝে মাঝে কাকু এসে জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন পড়ছে?’ আমার মুখ থেকে ভাল শোনার পরে প্রতিবারের কাকু একটাই কথা বলেন, ‘একটু ভাল করে দেখো।’ কাকুরা আমাদের পাড়ার লোক হলেও পাড়ার কারও সাথেই মেশেন না। পুজোর চাঁদা নিতে গেলেও দোকানে যেতে হয়। আমাদের কাছের দেবীপুর বাজারে কাকুদের একটা ছোট কাপড়ের দোকান আছে, সেখানে গাবলুদা বসে। তবে আমি বিভিন্ন কারণে বাজারে গেলে কোনওদিন কোনও কাস্টমারকে দোকানের সামনে দাঁড়াতে বা দোকান থেকে কিছু কিনতে দেখিনি, শুধু গাবলুদাকে দোকানের ভিতরে বসে ঢুলতে দেখেছি।
দোকানটা না চললেও কাকুরা আমাদের পাড়ার অন্যতম পয়সাওয়ালা পরিবার। বাড়িতে দুটো টু-হুইলার, একটা ফোর-হুইলার ছাড়াও দুটো ঘরে এসি লাগানো রয়েছে। কাকু কোম্পানি থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পরে কোনও এক চিটফান্ডের দৌলতে হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে যান। তারপরেই কোয়ার্টারের সঙ্গে আর-একটা ঘর তৈরি থেকে আরম্ভ করেন বাড়ি কেনা, বাজারে কাপড়ের দোকান দেওয়া— সব কিছু হয় বলে আমার শোনা। কাকু নাকি চিটফান্ডের এজেন্ট ছিলেন।
মাসের মধ্যে অন্ততপক্ষে দুই থেকে তিন দিন কাকুদের কোয়ার্টারে ওই চিটফান্ডের অন্যান্য এজেন্টরা এসে মিটিং করত, সেই সঙ্গে থাকত ঢালাও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন। পরের দিন কোয়ার্টারের সামনে এঁটোপাতা, গ্লাস পড়ে থাকতে দেখতাম। গাবলুদা ছিল এক্কেবারে অকম্মার ঢেঁকি, পাড়ার সবাই অন্তত তাই মনে করত। আমাদের থেকে বয়সে বড় হলেও দরকার হলে ছোট থেকে বড় সবাইকে দাদা বলে সম্মোধন করে। শুনেছি প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে ছ’টার মধ্যে কাকু গাবলুদাকে ঘুম থেকে জোর করে তুলে মাঠে ছুটতে বা হাঁটতে পাঠাতেন। আমিও গাবলুকে মাঠে হাঁটতে দেখেছি। মাঝে মাঝে কাকুও মাঠে যেতেন। একসঙ্গে দুজনকে দুভাই মনে হত, কাকু অন্যদিকে গেলেই দাদা মাঠের মধ্যে ঘুমিয়ে যেত, কাকু এসে চিৎকার করলে দাদা আবার হাঁটতে আরম্ভ করত।
গাবলুদার আর-একটা পাগলামি ছিল, বড় বয়স অবধি প্রায়ই আশেপাশে কোয়ার্টারের বাগানে ঢুকে হয় ফুল তুলে নিত, না হয় গাছ ছিঁড়ে দিত বা টব উল্টে দিত। অনেকবার ধরাও পড়েছে, পাড়ার অনেকের কাছে মারধোরও খেয়েছে। অনেকে আবার টানতে টানতে কাকুর কাছেও নিয়ে গিয়েছে। কাকুও অত বড় গাবলুদাকে সবার সামনেই উত্তমমধ্যম দিয়ে দিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যারা অভিযোগ জানাতে গেছে তাদেরও খারাপ লেগেছে। কখনও আবার অভিযোগ না জানিয়েই ফিরে এসেছে, যাতে গাবলুদা পাগলামি করলেও কাকুর কাছে মারধোর না খায়। এর মধ্যেই একদিন গাবলুদার বিয়ের কথা শুনতে পেয়েই আমরা অবাক হয়ে গেলাম। পাড়ার কাকুরা জটলা করে বিভিন্ন ধরনের সরস মন্তব্য করতে লাগল। কাকিমা, মাসিমা বৌদিদের কয়েকটা দিনের আলোচনার অন্যতম উপাদান হয়ে উঠল গাবলুদার বিয়ে। অবশ্য আলোচনা করা হলেও এই বিয়েতে পাড়ার কারও নিমন্ত্রণ ছিল না, এমনকি ডেকোরেটর, ক্যাটারারও বাইরে থেকে এল। পাড়ার সবাইকে মাইকের গান শুনে আর সাজানো আলো দেখেই মন ভরাতে হল।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গাবলুদার ছেলে হল। হঠাৎ এই খবরটা শুনে পাড়ার সবাই আবার আগের মতোই জটলা জমিয়ে আলোচনা করতে আরম্ভ করল। কিন্তু প্রসাদকাকুরা পাড়ার অন্য কারও সাথে না মেশবার জন্য ভাল কোনও খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশ্য বিয়ের পরেও গাবলুদা বেশ কয়েকবার ফুল চুরি বা অন্যান্য অপকর্মের জন্য মারধোর খেয়েছে, কখনও আবার আগের থেকে বেশি। গাবলুদার বউ খুব সুন্দরী, রাস্তায় বের হলে অনেকে ট্যারা চোখে তাকিয়ে গাবলুদাকে মনে মনে খিস্তি করে।
আমি এই প্রসাদকাকুর নাতিকে টিউসন দেওয়ার প্রস্তাব পেয়ে প্রথমে অবাক হলেও পরে বুঝলাম, অত সব ভেবে আমার কী দরকার? পড়াব, পেমেন্ট নেব, মাঝে অত লচপচের কী আছে? তারপরেই প্রসাদকাকুর নাতিকে পড়াতে আরম্ভ করলাম। এমনিতে কাকু যতই আন বা অ্যান্টি-স্যোসাল হোন, নাতির ব্যাপারে এক্কেবারে পারফেক্ট। স্থানীয় এক ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে নাতিকে ভর্তি করেছেন, প্রতি সকালে ঠিক সাড়ে ছ’টা থেকে পৌনে সাতটার মধ্যে নাতিকে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিতে আসেন। ছুটির দিনে দেখি, কোনওদিন নাতিকে নিয়ে বাজারে যাচ্ছেন অথবা সাইকেল চালানো শেখাচ্ছেন। কোনওদিনই গাবলুদাকে বউদির সাথে ঘুরতে দেখিনি। বউদি কোথাও গেলে হয় কাকু না হয় কাকিমা, তবে প্রসাদ কাকিমাকে দেখলে বোঝা যেত এই গর্ভে গাবলুদা না জন্মালে সেটা চরম আশ্চর্যের বিষয় হত।
||২||
প্রসাদকাকুর নাতিকে দেড় বছর পড়ালাম। এই দেড় বছরে বাড়ির বাকি সদস্যদের সাথে সেরকমভাবে আলাপ না হলেও বুঝতে পারলাম বাড়ির ভিতর দিয়ে একটা চাপা স্রোত বয়ে যায়। আমি বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতাম। ছোট্টু প্রায়ই বলত, ‘আমার দাদাজি খুব রাগী আছে, পাপাকে খুব মারে।’ ‘কেন’ জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘দাদাজি টাকা দেয়।’ আমার শুনে খারাপ লাগত, বাইরে অনেকবার প্রসাদকাকুকে লোকজনের সামনে গাবলুদাকে মারতে দেখেছি। ঘরেও নিয়মিত মারে, এই কথাটা শুনে খারাপ লাগল। কথাটা কারও সাথে আলোচনা করলাম না। ভয় ছিল, আলোচনা করলে যদি টিউসনটা চলে যায়। অবশ্য আমার ভাগ্যটা ভাল নয়। চিটফান্ডের কী সব কেলেঙ্কারির জন্য প্রসাদকাকুর অবস্থা আস্তে আস্তে পড়তে আরম্ভ করল। এইসব কথা ছোট্টুর মুখ থেকে শুনিনি। একদিন সকালে চিৎকার শুনে বাইরে এসে দেখি কাকুর কোয়ার্টারের সামনে একটা জটলা। তাদের মধ্যেই কয়েকজন কাকুর নাম ধরে গালাগাল করছে, দু’একটা চড় মারবার আওয়াজও শুনতে পেলাম।
আর-একটু বেলা হতে বাইরে বেরিয়ে শুনলাম, কাকু নাকি অনেক লোকের টাকা নয়ছয় করে নিজে বিভিন্ন জায়গায় জমি ফ্ল্যাট আরও অনেক কিছু কিনে নিয়েছেন। এইসবের পরে সন্ধেবেলা কাকুর বাড়িতে পড়াতে যেতে সাহস হল না। কিন্তু ছোট্টুর কথা মনে পড়লেই খারাপ লাগত। আমি পড়ানোর পর ছেলেটার অনেক উন্নতি হয়েছে, এ খবরটা কয়েকদিন আগেই ছোট্টুর মা আমাকে জানিয়েছিলেন। তাছাড়া মাসের দুটো সপ্তাহ পড়ানো হয়েছে, এই সময় ছেড়ে দিলে পেমেন্টটাও পাব না। এই সব ভাবনা থেকেই কয়েকদিন পরে কাকুর কোয়ার্টারে গিয়ে বাগানের ঘরের সামনে গিয়ে ছোট্টুর নাম ধরে ডাকতেই ওর মা হিন্দি টানে বাংলাতে বললেন, ‘ওর দাদা বলছে, এই মাসের পরে পড়ানোটা কিছু দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হবে। এখন একটু অসুবিধা আছে। তবে ছোট্টু খুব কান্নাকাটি করছে। কিন্তু কী করব ভাই, তোমাকে বলতে পারি না, পরে পেমেন্ট নেবে। তাছাড়া কবে সব ঠিক হবে তাও তো জানি না।’
আমার মাথাতে হঠাৎ আকাশ ভেঙে পড়ে। মাসের শুরুতে কড়কড়ে হাজার টাকা আর পাওয়া যাবে না। আরও কয়েকটা টিউসন থাকলেও এই রকম পাইকারি হাজার টাকার নয়। ছোট্টুদের বাড়িতে বসে নিজের মনেই বললাম, ‘আমার এই মাসের টাকাটাও গেল।’ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি কি কাল থেকেই বন্ধ করে দেব?’
—‘না না, এই মাসটা চালিয়ে দাও, তবে এই মাসেই পেমেন্টটা দিতে একটু দেরি হবে।’
বউদির কথামতো আমি মাসটা শেষ করে টিউসনটা বন্ধ করলাম। দেখতে দেখতে আরও ছয় মাস পেরিয়ে গেল। এর মাঝে প্রসাদকাকুদের বাড়িতে বাইরে লোকের উৎপাতের সাথে প্রায়ই পুলিশের গাড়িও চোখে পড়ত। শুনলাম কাকু নাকি ফেরার। এদিকে আমার শেষ মাসের টিউসনের পেমেন্টটাও বাকি ছিল। এমনকি শেষের দিন বউদি বলেছিলেন, ‘আমি কয়েকদিনের মধ্যেই তোমাকে পেমেন্টটা পাঠিয়ে দেব।’ কিন্তু কয়েকদিনের জায়গায় কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও পেমেন্টের নামগন্ধ না পেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। মা-বাবাকে জিজ্ঞেস করতে মা ওদের বাড়ি গিয়ে পেমেন্টটা নিয়ে আসার কথা বলে। দুদিন পরে কিছুটা ইতস্তত করে প্রসাদকাকুর বাড়িতে গেলাম। অন্যদিনের মতো বাগানের দরজাতে বেল বাজাতেই ছোট্টু দরজা খুলল। অনেকদিন পরে আমাকে ওইরকমভাবে দেখতে পেয়ে তার চেহারাতেও একটা প্রাথমিক আনন্দের ঝলক দেখতে পেলাম। ছোট্টুর কথাতে ঘরের ভিতর গেলাম। পড়াশোনা সংক্রান্ত কয়েকটা কথা বলতেই ছোট্টুর মা ওই ঘরে আমাকে দেখতে পেয়ে কিছু ফর্মালিটির কথা বলেন। আমি উত্তর দিয়ে পাল্টা ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করতেই তির্যকভাবে বলে উঠলেন, ‘আমার আবার থাকা?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনাদের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় বইছে, অনেক ঝামেলা সামলাতে হল। অনেক কিছুই শুনতে পাচ্ছি, কাকুও সমস্যাতে পড়ে গেছেন।’
—‘সমস্যা নয়, বলো পাপ। মহাপাপের ফল। আরও হবে, সব শেষ হয়ে যাবে।’
কথাগুলো শুনে বুঝলাম কাকুর ওপর বউদির খুব রাগ। কিন্তু আমি তো বাইরের লোক, স্বভাবতই আমার কোনও রকম মন্তব্য করা ঠিক নয়, শুধু জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকুরা নেই?’ বউদি ছোট্টুকে হিন্দিতে অন্য ঘরে পড়তে বসবার জন্যে বললেন। ছোট্টু চলে যেতেই বউদি আমার সামনে একটা চেয়ারে বসে লম্বা একটা শ্বাসের সাথে বলে উঠলেন, ‘তোমার পেমেন্টটা ভাই দু’মাসে দেব।’
আমার টাকার দরকার থাকলেও দাঁত বের করে বললাম, ‘ঠিক আছে।’ তারপরেই বউদি একটা পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বললেন, ‘পরের মাস থেকে তুমি আবার পড়াতে এসো, তবে আমি হাজার টাকা পেমেন্ট দিতে পারব না, সাতশো টাকা দেব।’
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। এর আগে কোনওদিন বউদি এত কথা আমার সাথে বলেননি। আমিও তাই সাহস পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কাকুরা কোথায়?’ বউদি দরজার দিকে একবার দেখে বললেন, ‘কাউকে বলবে না, পুলিশের খাতাতে ফেরার, কিন্তু দুজনেই বিহারে গ্রামের বাড়িতে বহাল তবিয়তে থাকছে। পুলিশ অবশ্য সব জানে।’
আমি কোনও কথা না বলে সব শুনলাম। কিছু সময় পরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর গাবলুদা?’
—‘দোকানে। এখন আমিও মাঝে মাঝে দোকানে বসি।’
—‘আপনিও দোকানে বসছেন? খেয়াল করিনি।’
—‘না বসলে তো চলবে না। এখন তো আর শ্বশুর টাকা পাঠায় না। সংসারের খরচ, তোমার দাদার ওষুধের খরচ কীভাবে চালাব?’
—‘দাদাকে কি ডাক্তার দেখাচ্ছেন?’
—‘হ্যাঁ, শ্বশুরমশাই দেশের বাড়ি চলে যাওয়ার পরেই ডাক্তার দেখানো আরম্ভ করেছি। হাসপাতালে একজন ভাল ডাক্তার বসছেন, কী যে বলে নিউরোসাইক্রিয়াটিক, ওনাকেই দেখাচ্ছি। আসলে তোমার দাদা কিন্তু জন্মগত নয়, একবার মাথায় জোরে আঘাত লেগে এই রকম হয়ে গেছে।’
গাবলুদা আমার থেকে বয়সে বড়, ছোটবেলাতে কী হয়েছে আমার মনে থাকবার বা জানবার কথা নয়। তাই বউদি যা বলছিল, আমি সব শুনে যাচ্ছিলাম। বৌদি কিছুসময় চুপ থেকে আবার বলতে আরম্ভ করলেন, ‘আমার জীবনটা এক্কেবারে শেষ হয়ে গেল, পড়াশোনা শিখলাম, ভাবলাম একটু অন্য রকম ভাবে বাঁচব, হল না। জানো, আমার বংশের মধ্যে আমিই স্কুল শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, কিন্তু লাভ হল না।’ বউদি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
—‘কিন্তু বউদি আপনি যখন বিয়ে করেন, তখন তো গাবলুদা অসুস্থ, তাহলে বিয়ে করলেন কেন?’
—‘‘অসুস্থ মানে, বউভাতের রাতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনি আমাকে মারবেন না তো?’ আমি কী উত্তর দেব ভাবার আগেই দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।’’
লক্ষ করলাম বউদি শেষের কথাটা বলবার সঙ্গে সঙ্গে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন। কিছু সময়ের মধ্যেই নিজেকে ঠিক করে বললেন, ‘তুমি বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট, তারপরে বাইরের লোক, সব কথা তো বলা যায় না। তবে জানো, আমার বিয়ে হয়েছে একটা শিশুর সাথে। সেই বউভাতের রাত থেকে আমার চোখের জল পড়া আরম্ভ হয়েছে, এখনও পড়ছে, যতদিন বাঁচব হয়তো ততদিন পড়বে।’
শেষের কথাগুলো শুনেই মাথার ভিতর একটা প্রশ্ন ঝাঁপিয়ে উঠল। ‘এই ছোট্টু কে?’ কিন্তু প্রশ্নটা তো সোজাসুজি করা যায় না। কোনও রকমে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ছোট্টু জন্মাবার সময় তো গাবলুদা ঠিক ছিল?’
—‘ভাই সব প্রশ্নের উত্তর হয় না, আর সব উত্তরের প্রশ্ন হয় না। ছেলে আর ভাইয়ের একটা আজব রিস্তা, সব তো বলা যাবে না।’
কিছুসময় চুপ থেকে একটা লম্বা শ্বাস টেনে বলে উঠলেন, ‘তোমাকে বিশ্বাস করে এত কথা বললাম, তুমি প্লিস কাউকে বলবে না।’
বুঝলাম, বেশি সময় এইখানে বসে থাকার কোনও মানে হয় না। কী বুঝলাম তার চেয়েও বেশি, কী শুনলাম। কিন্তু কিছুই কাউকে বলা যাবে না। আর বেশি কথা বলবার মতো মানসিকতা থাকল না। বউদিকে আসছি বলে ছোট্টুদের কোয়ার্টারে থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এলাম। মাথায় আরও অনেক জটলা পাকানো প্রশ্ন আসছে। রাস্তার বাঁদিক থেকে ডানদিকে গাড়ি ছুটছে। আমি কিছু সময় দাঁড়িয়ে রাস্তা পার হবার জন্যে পা বাড়ালাম।