Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

প্রভাত চৌধুরী: তাঁর কবিতার মধ্যে পাই একজন একনায়ককে

পোস্টকার্ডটা খুঁজলেই পাওয়া যাবে। ৩৬ ডি, হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট থেকে এসেছিল। তারিখটা মনে নেই। গত শতাব্দীর শেষ দশকের মাঝামাঝি সময়ে।

আমি তখন গোবরডাঙায় থাকি। গোবরডাঙা থেকে কালীঘাটের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। অনার্স তৃতীয়বর্ষের পরীক্ষা দিয়ে ফলের অপেক্ষায় আছি। এই চিঠিটাই আমাকে ডেকে নিয়েছিল হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। অর্থাৎ ‘কবিতাচর্চার কবিতা পক্ষিক’-এ। এরপর থেকে ‘কবিতা পাক্ষিক’ দপ্তরের সঙ্গে আমার গাঁটছড়া পাকাপোক্তভাবে বাঁধা হয়ে যায়। পরে এই দপ্তর উঠে আসে ৪৯, পটলডাঙা স্ট্রিটে। আর আমাদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়ে ওঠে, অনিবার্য হয়ে ওঠে।

আমরা যারা ‘কবিতা পাক্ষিক’-কে আমাদের আশ্রম বলে মানি, তারা ‘কবিতা পাক্ষিক’ আর প্রভাত চৌধুরীরকে সমার্থক বলেই জানি। এটা শুধুমাত্র অফিসিয়াল কারণে নয়, আমাদের ভালবাসার দাবিতে ‘কবিতা পাক্ষিক’ প্রভাতদা হয়ে ওঠে বা প্রভাতদা হয়ে ওঠেন ‘কবিতা পাক্ষিক’। এইরকম একটা মানুষকে ভাল না বেসে থাকা যায়! নবীন কবিদের যিনি সন্তানস্নেহে প্রশ্রয় দেন, পরিপোষণা দেন তাঁর কথাটা না ভাবাই অপরাধ!

এতদিন ধরে দেখছি কত দ্রুত তিনি নবীনতম কবিরও বন্ধু হয়ে ওঠেন। যেভাবে সেই কবে তিনিও আমার প্রভাতদা হয়ে উঠেছিলেন। ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে শুধুমাত্র ৫টি কবিতা পাঠিয়েছিলাম হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। সেই পাঁচটি কবিতা পড়েই তিনি তাঁর স্বভাববিরুদ্ধভাবেই আমাকে চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, চিঠি পেয়েও যখন আমি কালীঘাটে যাচ্ছি না, তিনি আমার পরিচিত এঁকে-ওঁকে চিঠি লিখে বা মুখে মুখে তাগাদা দিয়েছেন। এভাবেই আমার মত অপ্রতিভ, গেঁয়ো আর মুখচোরা একজনকে তিনি বাংলার মফস্বলি গলি থেকে রাজপথে তুলে এনেছেন। শুধু তাই নয় নিরন্তর প্রশ্রয় দিয়েছেন নিজের মত লিখতে, বা লেখা বা আঁকা বা বানান নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। চিন্তাচেতনায় এত আপ-টু-ডেট কবিব্যক্তিত্ব আমি খুব কমই দেখেছি।

এসব কারণে উদারহৃদয় এই মানুষটি তথা ‘কবিতা পাক্ষিক পরিবার’ আমার আত্মস্থল। এই প্রিয়তা শুধুমাত্র একজন দরদী সম্পাদক হিসেবে নয়, তাঁর কবিতারও জন্য। আমি তাঁর কবিতার একজন ভক্তপাঠক।

এবার প্রভাত চৌধুরীর কবিতা বিষয়ে কিছু কথা বলি। আমরা যারা ওঁর নিয়মিত পাঠক, তারা জানি ওঁর কবিতার স্পষ্ট দুটি ভাগ আছে। একভাগে তিনি আধুনিক, অন্যভাগে অধুনান্তিক। দুটি ভাগের মধ্যে যেমনটা স্বাভাবিক এবং ধারাবাহিক একটা যোগসূত্র; ক্ষীণ হলেও থাকে, থাকা উচিতও, তা প্রায় নেই বললেই চলে। সন্ন্যাসীদের যেমন পূর্বাশ্রমের যাবতীয় সম্পর্কচ্ছেদ করে আসতে হয়, প্রভাত চৌধুরীও এক্ষেত্রে তেমনটা করেছেন। তাই তাঁকে একজন সন্ন্যাসী কবি বলাই যায়।

আধুনিকতাকে বিসর্জন দিয়ে এসেছিলেন তিনি। আধুনিকতার যে সমস্ত বাজারচলতি প্রবণতা ও প্রকরণ ছিল, তা বেশ ভালভাবেই তাঁর কবিতার মধ্যে উপস্থিত ছিল তখন। দুটি ধারার মধ্যে যেখানটাতে একটি ম্লান সমধর্মিতা আছে তা এখন আর তাঁর কাব্যকলার মধ্যে পড়ে না, পড়ে আচরণে, স্বভাবে। আমার মনে হয়, তাঁর কবিতার মধ্যে সামন্ততন্ত্রের একটা প্রকট দার্ঢ্য রয়েছে। শব্দকে শাসন করার, পাঠকের মেজাজ-মর্জিকে নিজের ইচ্ছার পথে চালিত করার দাপুটে ক্ষমতা রয়েছে তাঁর কবিতার মধ্যে। আসলে তাঁর আধুনিক কবিতায়, সমাজতান্ত্রিক খোলসের আড়ালে যিনি একজন সামন্ততান্ত্রিক কবি ছিলেন, তার খোলস ভেঙে বেরিয়ে এসে তিনি যথাযথ কবি হয়ে ওঠেন অধুনান্তিক পর্বে। এই কারণে তিনি উত্তর আধুনিক কবি নন মোটেই। অধুনান্তিক কবি।

প্রভাত চৌধুরীর কবিতার যে শৈলীটা তাঁকে, তাঁর সমসাময়িক কবিদের থেকে আলাদা করেছে, তা হল তাঁর বাচনভঙ্গি। আমি তাঁর কবিতার মধ্যে একজন একনায়ককে পাই। এই প্রবণতা আমি কবি বিনয় মজুমদারের গল্পের মধ্যে দেখেছি। বিনয় মজুমদারের গল্পগুলি কথোপকথনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। সেই গল্পগুলি বলতে বলতে তিনি, পাঠককের কথার মারপ্যাঁচে নিজের ভাবনাবৃত্তে নিয়ে আসেন বা আসতে বাধ্য করেন। এই রকমই একটা প্রবণতা আমি আবিষ্কার করি কবি প্রভাত চৌধুরীর কাব্যভাষায়। কিন্তু দুজনের ভাষার পার্থক্য অনেক। বিনয় মজুমদার তাঁর গল্পের পাঠককে একটা কোনও তত্ত্বের মধ্যে বা ভাবনার মধ্যে জবরদস্তি ঢুকিয়ে দেন। যেন তত্ত্বটা তাঁর প্রমাণ করার দায় থেকেই তিনি এটা করছেন। কিন্তু প্রভাত চৌধুরী কবিতায় পাঠককে নিয়ে ছেলেখেলা করেন, মজা করেন। তাঁর কাব্যভাষা খানিকটা আত্মকথা ঢঙের, কিন্তু নিখাদ আত্মকথা নয়। পাঠকের ভাবনাকে তিনি নিজের ইচ্ছেমত দুমড়ে-মুচড়ে ছুড়ে ফেলে দেন। একটা কোনও বিষয়কে বা ভাবনাকে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেন ঠিকই, কিন্তু পাঠককে বোঝানোর কোনও দায় তাঁর নেই।

প্রকৃতপক্ষে কথা এবং কথার ছল, এই দুই প্রবণতার চলনে, প্রভাত চৌধুরীর কবিতার কাব্যভাষা একসময় ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। আসলে পোস্ট-মডার্নিজমের শব্দ ও শব্দার্থের খেলাগুলি, তাঁর কবিতায় প্রকটভাবেই উঠে আসে। শুধু উঠে আসে না, একটি মায়াজাল তৈরি করে। মায়াজাল না বলে বলা চলে মায়ামোহ। তাঁর এই কাব্যভাষা এতটাই আগ্রাসী যে, সতর্ক না হলে, বিশেষত কবিরা সচেতন না থাকলে, এটা তাঁদের নিজস্ব কাব্যভাষাকে ধ্বংস করে দেবে। এই কারণে তাঁকে ঘিরে থাকা কবিদের প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থাকতে হয়। থাকতে হয়, কিন্তু অধিকাংশই যে থাকতে পারেন না, তাও ঠিক!

চিত্র: লেখক
5 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
J.Ghosh
J.Ghosh
3 years ago

প্রনাম জানাই?

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »