তখন চকচকে পরিপাটি সকাল। মর্নিং ওয়াকের জন্য বরাদ্দ সময় শেষ হয়েছে ঘণ্টা তিনেক হল। ঘাস আর মাটি লাগা স্নিকারটা খুলেই হাল্কা গরমজলে স্নান সেরে নিলেন তারা। তারপরেই হাত লাগালেন ডায়েট ব্রেকফাস্টে। আজ মধ্যমণি হানি ফ্লেভার্ড কর্নফ্লেক্স। এসব খেলে নাকি পেটের মেদ ঝরে ঝড়ের গতিতে। বলিউড সুদর্শনা ক’দিন আগেই তো টিভিতে উদোম সমতল পেট দেখিয়ে তাই প্রমাণ করতে চেয়েছেনl
কর্নফ্লেক্সের সম্পূর্ণ আমেজ আর পরিমিত নিজস্ব দম্ভ চোখেমুখে মেখে তাদের মধ্যেই একজন বললেন, ‘কীরে তোরা কি জানতিস মিস্টার ধনঞ্জয়ের পূর্বপুরুষের ঘোড়াশালে তিনশো হাতি আর হাতিশালে দুশো ঘোড়া ছিল। কয়েকশো উটও। সেসব নিয়ে আফগানদের বিরুদ্ধে কী ফাইটটাই না দিয়েছিল! যে যাই বলুক ভাই ওরা না থাকলে না দেশটা আজ পাক্কা সিরিয়া-ফিরিয়া হয়ে যেত। হিন্দুস্থান রাইসিং-এ কাল একটা আর্টিকল বেরিয়েছে। পারলে পড়িস।’
অন্যজন লাফিয়ে উঠে উত্তেজনায়, ‘তাই নাকি! আর কী পড়লি বল। ধনঞ্জয়বাবুর ওপর লেখা যে কী করে মিস করলাম। বল বল তাড়াতাড়ি বল।’
‘আফগানদের খেদানোর পর যখন শান্তি, বীভৎস শান্তি চারদিকে, তখন ওরা মানে মিস্টার ধনঞ্জয়ের পূর্বপুরুষরা ভোররাতে বৈদিক বনস্পতির নীচে ধ্যানমগ্ন হত। কাক বক কাকাতুয়া সব তখনও কিন্তু ঘুমাচ্ছে। বনস্পতির পাশে পবিত্র গান্ধর্ব জলাশয়। জলে পিলপিল রাজহাঁস আর বিপুল পদ্মফুল। সেই জলে অবগাহন করে পদ্মাসনে পাঁচ ঘণ্টার ননস্টপ ধ্যান। পায়ে বিছে-টিছে কামড়ালেও কেউ কিছু টের পেত না। ওনলি মেডিটেশন উইদাউট এনি কমার্শিয়াল ব্রেক।’
‘কী বলিস! কমার্শিয়াল ব্রেক! এটাও লেখা ছিল নাকি?’
‘আরে ধুর। ওটা আমার সেন্স অফ হিউমর।’
তারা এবার হাসলেন। দুজনেরই দাঁত ও গায়ের রং সাদা। দাঁতে আয়ুর্বেদিক মাজন আর ত্বকে আয়ুর্বেদিক লোশন। দাম বেশি হলেও তারা আজকাল সেগুলোই কেনেন। হাসতে হাসতে আস্তে আস্তে তারা জুসে চুমুক দিলেন। ব্রেকফাস্ট-টেবিলের পাশেই জানলা। জানালায় চোখ রাখলে দেখা যায়, দুটো নির্মীয়মাণ হাইরাইজার, দুটো পতনশীল উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটা জমজমাট শপিং মল আর তার থেকে দূরে, অনেকটাই দূরে কিছু অবশিষ্ট ধানখেত। এই জানলাতেই যত্নে রাখা হয়েছে অর্গানিক মানিপ্ল্যান্ট। গ্রিল পেঁচিয়ে অনেক ওপরে যাতে উঠতে পারে তার যুতসই ব্যবস্থা।
কয়েক সপ্তাহ ধরেই হোর্ডিং পড়েছে শহর জুড়ে। এয়ারপোর্ট থেকে ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির বাড়ি পর্যন্ত, এক কিলোমিটার অন্তর। হোর্ডিংয়ে ধনঞ্জয় বাঘছাল পরে ধ্যান করছেন। কোলে একটা হরিণশিশু তার পায়ের লোমগুলো কচি ঘাস ভেবে খেয়ে নিচ্ছে। ধনঞ্জয় কিন্তু নির্বিকার। অন্য একটা হোর্ডিংয়ে ময়ূরের ঠোঁটে আফগানি আখরোট তুলে দিচ্ছেন নিজের হাতে। শ্যাম্পু করে দিচ্ছেন আরবের উটগুলোকে। পাশেই কিছু তাগড়াই চিতা। সামনে অ্যান্টিলোপের টাটকা মাংস। কিন্তু ব্যাটাদের খিদে নেই।
বাজারে কলরব, দিন সাতেক পরেই ধনঞ্জয় দেশে ফিরছেন।
দেশের হালচাল দিনকাল নিয়ে আলোচনায় মেতেছিলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক ও সেচ দপ্তরের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। বছর দুয়েক আগে আঞ্চলিক ইয়োগা ইভেন্টে দুজনেই যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে যোগাসন করতে করতে মিটিমিটি হাসতে হাসতেই যোগাযোগ। দেশের শত্রুমিত্র সম্পর্কে দুজনেরই মতের মিল নিবিড়। এই নিবিড় মিলে কোথাও ফাটল ধরেছে কিনা তা যাচাই করে নিতে মোবাইলে মাঝেমধ্যেই তাদের কথাবার্তা চলে। সেদিনও চলছিল। শিক্ষক বললেন, ‘ক’জন পারে মুখের ওপর সত্যি কথা বলতে। ধনা আমাদের ঘরের ছেলে। স্কুল থেকেই বরাবর ব্রিলিয়ান্ট। কখনও সেকেন্ড হয়নি। তিন তিনটে ডক্টরেট। আমি জানতাম ও পারবে। কমেন্ডেবেল ওয়ার্ক।’
ইঞ্জিনিয়ারের প্রশ্ন, ‘ওয়ার্কটা কীসের ওপর যেন?’
‘আরে ওই যে দেবদত্ত ভ্যাকসিন। এবার নোবেলটা উনি পাচ্ছেনই। আমি ড্যাম সিওর। কী মাইন্ড ব্লোইং কনসেপ্ট! ভাবা যায়! ভ্যাকসিনটা পড়লেই নাকি মানুষের ভিতরের মানুষটা গলগল করে বেরিয়ে আসবে।’
‘মানুষের ভিতরের মানুষ বলতে?’
‘মানে আসল মানুষটা। সব তো শালা মুখোশ পরে আছে। ভিতর ভিতর কী চলছে সেটা কি আমরা থোড়াই প্রকাশ করি। প্যান্টের ভিতর, বুকপকেটে, টুপির নিচে, সিগারেটের প্যাকেটে লুকিয়ে রাখি। কিন্তু মন! মনকে লুকোবে কী করে! ভ্যাকসিনটা পড়লে মন আর প্রাইভেট প্রপার্টি থাকল না বস। ওপেন টু অল। ইনহিবিসনের এক্সিভিসন। কী বুঝলেন?’
‘আচ্ছা, মানে… ওরে বাবা এ তো পুরো গুবলুট কেস মশাই। আমার গায়ে এই ভ্যাকসিন পড়লে তো সর্বনাশ! বউয়ের সামনে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে চুমুটুমু খেতে… তারপর আরও কত কী… কে জানে কী আছে মনে… এ তো কেলেঙ্কারি কাণ্ড! আমি এই ভ্যাকসিন নেবই না। নট অ্যাট অল।’
‘কিন্তু ভ্যাকসিন কমপালসারি মশাই। নিতেই হবে সবাইকে। কোনও ছাড় নেই। আপনি তো শুধু নিজেরটা ভাবছেন, এবার ভাবুন তো কত চোর, ডাকাত, ধর্ষক, কালোবাজারি আর বিশেষ করে ওই সিউডো আঁতেলেকচুয়ালগুলোকে আলাদা করা যাবে। তারপরে সবক’টার পেছনে ক্যাত করে লাথি মেরে দেশ থেকে বিদায়। থেকে যাবে শুধু সাদা মনের মানুষগুলো। পিওর ব্লাড। কমেন্ডেবল ওয়ার্ক। কী বলেন?’
‘এ বিষয়ে আমি কিন্তু আপনার সাথে একমত। মানে দেশের জন্য এটুকু স্যাক্রিফাইস তো করাই যায়। বউয়ের কাছে নয় কাঁচা খিস্তি আর থাপ্পড় খাব। আর তারপর না হয় দুদিন হোটেলে খাব। রাগ কমাতে দুটো গয়না, তিনটে কসমেটিক্স কিনে দিলেই তো… আচ্ছা, ভ্যাকসিনের এফেক্ট ক’দিন থাকবে? পারমানেন্ট নয় তো?’
‘না না একমাস।’
‘আর সাইড এফেক্ট?’
‘সাইডে না। ওপরে আর নিচে আছে।’
‘মানে?’
‘মানে যারা ওপরের সারিতে আছে তারা আরও ওপরে যাবে, সেখানে স্কাই ইজ নো লিমিট, মানে অ্যাটমোসফিয়ার-টিয়ার ছাড়িয়ে স্টেলার ইন্টারস্টেলার… যতদূর যাওয়া যায় আর কী… আর নিচের জন আরও নিচে… ম্যানহোলের গু-মুতেরও নিচে… সেখান থেকে ঘুটঘুটে পাতাল হয়ে যতদূর নামানো যায়… তবে বলছে এই এফেক্টটাও টেম্পোরারি।’
‘সত্যি বলতে কী, একটু টেনসন হচ্ছে কিন্তু। পোলিও ভ্যাক্সিন নয় কিনা। বেশ কড়া মাল মনে হচ্ছে। কী থেকে কী ছোটবড় হয়ে যাবে! ডিটেলসটা কোথায় পাব বলুন তো?’
‘গুগলে ধনঞ্জয় প্লাস দেবদত্ত লিখে সার্চ মারুন সব বলে দেবে। যা বললাম তা সত্যি কিনা যাচাই করতে নেশন টিভি চ্যানেলে চোখ আর আমার ওপর ভরসা রাখুন। কী বুঝলেন?’
‘না না। সত্যিই তো। ঠিক ঠিক। কমেন্ডেবেল ওয়ার্ক বটে। তা এয়ারপোর্ট যাচ্ছেন নাকি ধনঞ্জয়বাবুকে ওয়েলকাম করতে?’
‘আলবাত যাব। আগেই ছুটির অ্যাপ্লাই করে রেখেছিলাম।’
‘ছুটি নিলেন? কাল বলছিলেন অফিসে দারুণ চাপ। প্রজেক্ট ডেলিভারি মিস হলে চাকরি চলে যেতে পারে। ছুটি পাবেন?’
‘আরে বসও তো ছুটি নিয়েছে মশাই। বসের বস। বসের বসের বস। ব্যস, ধনঞ্জয় বলতেই সিক লিভ অ্যাপ্রুভড।’
প্রত্যেকটি হোর্ডিংয়ে, প্রত্যেকটি ব্যানারে একই জিনিস দেখানো হচ্ছে বারংবার। ধনঞ্জয়ের হাতে ভ্যাকসিনের শিশি। ইনি অবশ্য আসল ধনঞ্জয় নন। তার হুবহু লুক অ্যালাইক। ভ্যাকসিনটাও ফেক। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে লুক অ্যালাইক বললেন,
নতুন ভারত, নতুন দেশ
সাদার শুরু, কালোর শেষ
মৌজ মাস্তি চিন্তালেস
আহা বেশ বেশ বেশ।
সঙ্গে সঙ্গে একটা বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এল। তার নাম পরী। সে বোবা। সে হাসে না যেহেতু যা দেখে বাচ্চারা হাসে তেমন কিছুই এখনও পর্যন্ত ঘটেনি তার জীবনে। কাতুকুতু দিলেও সে হাসে না। ধনঞ্জয় তাকে কোলে তুলে নিলেন। চুমু খেলেন পরম আদরে। পরীর মধ্যে তবু কোনও হেলদোল নেই। তার হাসিহীন বেবাক চাহনিকে পাত্তা না দিয়েই তাকে একগাল হেসে ভ্যাকসিন দিলেন ধনঞ্জয়। সঙ্গে সঙ্গে পরী তাকে জড়িয়ে ধরল। খুব আদর করল ঠিক যেমন সন্তানেরা অনেকদিন পর বাবাকে পাওয়ার পর করে থাকে। পরীর সারা মুখ জুড়ে এখন শুধুই হাসি। এই হাসি আসল নয়, ফেক, অ্যানিমেশনের ভেল্কি। এই ছিল দেবদত্ত ভ্যাকসিনের প্রোমোশনাল ক্যামপেইনের মূল অংশ। সমস্ত টিভি চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়েছে। এই প্রোগ্রাম শেষ হবার পর থেকেই জনগণের মুখে মুখে কেবল ধনঞ্জয় আর পরীর নাম। এটা-সেটা কানে আসে, যেমন, ধনঞ্জয়বাবুর গ্ল্যামার! উফ গাল তো নয়, কাশ্মীরি আপেল। ফ্রেঞ্চ কাটটা কেমন বচ্চন বচ্চন না? অসাম স্পিকার মাইরি! আর পরী! ও মাই গড! কী কিউট না মেয়েটা! পুরো কিউটি পাই।
পরের দিনই সারা দেশ জুড়ে সকল শ্রেণির মানুষকে ভ্যাকসিনের ফার্স্ট ডোজ দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে এক মাস পরে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের মধ্যের ভ্যাকসিনের প্রতিক্রিয়া বুঝে।
আজ আবার ধনঞ্জয় চ্যাটার্জির জন্মদিন। আর আজই তিনি দেশে ফিরছেন। উড়োজাহাজে তার চারপাশে তার ডান ও বাঁ হাতের বিশ্বস্ত মানুষেরা। তিনি আজ নিজের হাতে পরীকে ভ্যাকসিন দেবেন। উত্তাল মহাসাগর থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট ওপরে ধনঞ্জয়ের মুখে স্মিত হাসি। এয়ার-হস্টেসের গাঢ় ভার্মিলিয়ন লিপস্টিক ছুঁয়ে বেরিয়ে আসা সমস্ত অনুরোধ তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। বিনয়ী গলায় বলেছেন, ‘মা আমার, চা, কফি, স্কচ কিছুই স্পর্শ করব না আমি, আয়ুর্বেদিক পানীয় ছাড়া আমি যে কিছুই পান করি না মা। মা আমার।’
পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট নিচে তখন স্যাঁতসেঁতে দুপুর। গল্পে মেতেছিলেন স্বনামধন্য চিত্রপরিচালক ও সুপার স্পেশালিটি হসপিটালের নামকরা সার্জেন। চিন্তায় দুশ্চিন্তায় দুজনের মনের মিল অনেক। তাই তো তারা বন্ধু। চিত্রপরিচালক বললেন, ‘কী মুশকিলে পড়লাম মাইরি।’
‘কেন রে কী হল?’
‘শুটিংয়ে শালা কেউ আসেইনি। কত লোকসান বল তো! ভ্যাকসিন নেওয়ার পর কী জানি কী হয়েছে, সব ব্যাটা মন্দিরে গিয়ে ভিড় করেছে। দুর্গা কালী চণ্ডী বিশালাক্ষী বামাক্ষ্যাপা হনুমান! কোনওটাই ছাড়েনি। জঙ্গলে কোথায় একটা শ্যাওলা মাখা পাথরে সিঁদুর মাখা ছিল সেখানে পর্যন্ত সাষ্টাঙ্গে মাথা দিয়ে আমাদের একমাত্র কমেডিয়ানটা… কী বলব! যেখানেই ঠাকুর দেখতে পাচ্ছে দৌড় লাগাচ্ছে। মন্দিরগুলোর অবস্থা দেখেছিস? উপচে পড়ছে।’
‘আর বলিস না। আমাদের পাড়ায় শ্যামলদা, কত বড় আই পি এস অফিসার, পাড়ায় একটা ছোট শিবমন্দির আছে, সেখানে সকাল থেকে ঢুকে শিবলিঙ্গটাকে কোলবালিশের মত জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ওর মনে এই ছিল! আর মদের দোকানগুলো! ওরেব্বাস, পুরো মৌচাক কেস! আমার বউ কলেজে গিয়ে বলল নাইন্টি পারসেন্ট স্টুডেন্ট টিচার নাকি হাওয়া। জাস্ট গন। কোথায় মালগুলো বডি ফেলেছে কে জানে! ডেঞ্জারাস ভ্যাকসিন মাইরি। আমি বেঁচে গিয়েছি। ডাক্তারদের নাকি সবার শেষে দেওয়া হবে। কী করে যে বানাল এমন? কোনও মেডিকেল সায়েন্সই এক্সপ্লেন করতে পারছে না।’
‘সায়েন্স দিয়ে তো হয়নি সাহেব। খবরে তো বলল, লক্ষ লক্ষ বছর আগের বৈদিক বিদ্যা তন্ত্রমন্ত্র কাজে লাগিয়ে হয়েছে। শেকড়বাকড় জড়িবুটি কী সব বলছিল। একটা ফিউশন এক্সপেরিমেন্ট। হান্ড্রেড পার্সেন্ট দেশি।’
‘ছাড়ুন তো, ওরকম বলে। সুপার অ্যাডভান্সড বায়োজেনেটিক্স ছাড়া এমন ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ লক্ষ বছরের প্রাচীন বৈদিক সভ্যতার বিজ্ঞানকেও অবজ্ঞা করা যায় না। তখন তো এসব ওদের নখদর্পণে ছিল। হাইব্রিড কিছু একটা বানিয়েছে মনে হয়।’
‘তাই হবে। আরে শোন না, মাথায় একটা আইডিয়া ঘুরছে। ধনঞ্জয়বাবুকে নিয়ে রামায়ণের রিমেক করব ভাবছিলাম। এখন তো রামায়ণ, মহাভারত মার্কেটে হেভি খাচ্ছেl চেহারায় ব্যক্তিত্বে ফাটাফাটি একটা তেজ আছে আই মাস্ট অ্যাডমিট। অনেকটা বশিষ্ঠমুনির মত দেখতে, তাই না!’
‘না না, খবরে তো বলছিল যাজ্ঞবল্ক্যর রক্ত ওর শরীরে।’
‘দাঁড়া দাঁড়া, মনে পড়েছে। কাশ্যপ কাশ্যপ। অবশ্যই কাশ্যপ। অনেক দিন আগের কথা বুঝলি, এই ভ্যাকসিনের কনসেপ্টটা যখন ধনঞ্জয়বাবুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, মেধায় শাণ দিতে নাকি সোজা কৈলাশের গুহায় দিনরাত তপস্যা। সেখানে খাবার বলতে বরফকুচি আর ইয়াকের দুধ। সেখান থেকে সোজা জয়সালমের। পাহাড় থেকে মরুভূমি! আমরা তো শালা হাক্কা চাউমিন আর চিলি চিকেনের বাইরে কিছু ভাবতেই পারি না। আর তিনি কী খেলেন, ফণিমনসার ছাল, ক্যাকটাস! তাও আবার তেল ছাড়া! ইনক্রেডিবল হজম ক্ষমতা!’
‘আচ্ছা কাঁটা কি উনি বেছে খান?’
‘একেবারেই না। পথের যা কিছু কাঁটা গোগ্রাসে সাবাড় করেন।’
‘হুম। আমাদের হসপিটালেও আসছেন নেক্সট উইক। আমাদের ডাক্তার-নার্সদের সে কী উত্তেজনা। একবারটি চরণ ছুঁয়ে দেখতে চায় ওরা। ধনঞ্জয়বাবু বলছিলেন, বৈদিক মেডিকেল সায়েন্সের ওপর একটা কোর্স চালু করবেন ফার্স্ট ইয়ারে। তোরা তো ওকে একটা উপাধি-টুপাধি দিতে পারিস। ওয়ার্ল্ড সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তো তোর হাতের মুঠোয়। ওরকম একটা পাহাড়প্রমাণ লোক, কখন কী কাজে লেগে যায়। তোর রামায়ণের রিমেকটাও…’
‘মন্দ বলিসনি। কিন্তু কী দেব?’
‘ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অফ কোর্স।’
‘তুই আছিস কোথায়! অলরেডি পাঁচটা ঝোলাতে।’
‘ও বাবা, তাই! তাহলে এ বছরের অস্কারটা ওকে দিলে কেমন হয়?’
‘অস্কার! সে তো শুধু সিনেমার জন্য দেয় রে। ওকে কী করে দিই।’
‘নো অসুবিধা। অস্কার পাওয়া লোকজন আজকাল ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট পাচ্ছে। তাহলে ইউনিভার্সিটির ডক্টরেট অস্কার পাবে না কেন? একশোবার পাবে।’
‘হুম, সেটার একটা টু গুড লজিক আছে বটে। কিন্তু কোন ক্যাটাগরিতে দেব। বেস্ট অ্যাক্টর, সিনেমাটোগ্রাফি, অরিজিনাল স্ক্রিপ্ট, মেকআপ, কমেডি, কীসে?’
‘এইত্তো, ধরতে পারলি না। লক্ষ বছরের ইতিহাস তিনি একাই ধারণ করছেন। ঐতিহ্যটা বোঝ। হরপ্পা পাটলিপুত্র অযোধ্যা হয়ে আজকের ডিজিটাল ইন্ডিয়া। তিনিই তো একমাত্র প্রতিনিধি। লাইফটা একবার দেখ। লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট ওর জন্য পারফেক্ট। সঙ্গে একটা কাশ্মীরি শাল। কাশ্মীরের শাল, সেগুন, মিনার, চিনার তো এখন আমাদেরই। ধনঞ্জয়বাবুর গায়ে জড়িয়ে পড়লে আরও বেশি করে আমাদের মনে হবে।’
ধনঞ্জয় এই এলেন বলে। তার জন্য স্পেসাল কার্পেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইজরাইল থেকে আমদানি এই বিশেষ কার্পেট। পা রাখলে মনে হবে ফুট ম্যাসাজ চলছে। তার আবিষ্কার ইজরায়েলে ম্যাজিক করার পরেই এই উপহার। রানওয়ে থেকে ধনঞ্জয়ের প্রাসাদের সিংহদরজা পর্যন্ত কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝখানে গাছটাছ, গ্রন্থাগার-ফোন্থাগার, হেরিটেজ-ফেরিটেজ, বস্তিফস্তি যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সবই উপড়ে ফেলা হয়েছে বিদেশি বুলডোজারে। খালবিল সবই বোজানো। জলাশয়ের বাস্তুতন্ত্র এখন হাই-কোয়ালিটি কুইক সিমেন্টের তলায়।
সন্ধে সাতটা। উলুধ্বনি শঙ্খধ্বনিতে এয়ারপোর্ট মাতোয়ারা। আকাশে, বাতাসে, সমস্ত এল ই ডি ব্যানারে শুধুই ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি। ভক্তদের ভিড় সামলাতে পুলিশ হিমশিম খাচ্ছে তাই সামাল দিতে আই পি এস থেকে প্যারামিলিটারি ফোর্স সবই হাজির। প্রণাম, সেলফি, হ্যান্ডশেকের জন্য মুখিয়ে আছে উত্তেজনায় উল্লাসে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারানো লাখো জনতা। এই ভ্যাকসিন নিরোধের থেকেও নিরাপদ, বাচ্চাদের বাবা-মাকে তা বোঝাতে উড়োজাহাজের ভিতরেই তিনি আজ নিজের তৈরি ভ্যাকসিন নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়েছেন। ছুচটা ফুটতেই তার মুখে ক্রমশ ছড়াতে থাকা দৈবিক প্রশান্তির ক্লোজআপ ধারাবিবরণী সঙ্গে লাইভ টেলিকাস্ট করেছে দেশের সমস্ত নিউজ চ্যানেল সমস্ত ভাষায়। এমনকি খান ত্রিশেক আদিবাসী ভাষাতেও। ধনঞ্জয়ের শরীরে তখন আদি শঙ্করাচার্যের সময়ের উত্তরীয়। বিশেষ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সেই উত্তরীয়টি পরেই তিনি এয়ারপোর্টে কার্পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন। সবাই দেখছে তার সারা শরীর থেকে বেরিয়ে আসা প্রাচীন ঋষিতুল্য এক অভূতপূর্ব অতিলৌকিক আভা। মানুষের প্রতি সীমাহীন সহানুভূতি, দেদার করুণা, অনাবিল ভালবাসা ইত্যাদির মাত্রা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে চালচলন ঠিক যেমন হয় ধনঞ্জয়ের হাবেভাবে তারই নিখুঁত প্রতিফলন। ‘আমার মিত্র, ভাই ও বোনেরা, এই সবই হল আমার দেবদত্ত ভ্যাকসিনের সুফল’, স্লো মোশানে হাত নেড়ে জনতাকে উদ্দেশ করে কেবল এই মনের কথাটুকুই জানালেন। খড়ম পায়ে টকাস টকাস শব্দ করে ধনঞ্জয় চড়ে বসলেন গোলাপ, রজনীগন্ধা, ক্যালেন্ডুলায় ঢাকা হেলিকপ্টারে। নাম পুষ্পক। গন্তব্য তপোবন হাব। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার এই হাবটি হবে ধনঞ্জয়ের ভবিষ্যতের গবেষণাগার। তপোবনের ঠিক মধ্যিখানে থাকবে তার নিজের ব্রোঞ্জের মূর্তি, উন্মুক্ত। আর খাঁচায় গিনিপিগ, আরবের উট, ইরানের পায়রা, কেনিয়ার চিতা ইত্যাদি। আপাতত পরীকে আনা হয়েছে সেখানেই। চমৎকার লেজার আলোর কারুকাজে ভরা মঞ্চে সে একাই দাঁড়িয়ে। পরীকে নিজের হাতে ভ্যাকসিন দেবেন আজ ধনঞ্জয়। তার গবেষণা বলছে ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেই পরী হয়ে উঠবে তপোবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেখানকার আজীবন সমর্পিত হাসিমুখ সেবাদাসী।
জনতার উদ্দেশে হাত নাড়তে নাড়তে ধনঞ্জয় স্টেজে উঠলেন। পরীকে কোলে তুলে নিলেন। গোটা বিশ্বের চোখ আটকে টিভি স্ক্রিনে। পরী তো বোবা। তার মুখে হাসি নেই। ভ্যাকসিনের ভিতরের তরল পরীর নরম মাংসের ভিতর চালান করলেন ধনঞ্জয়। আস্তে আস্তে পরীর মুখে হাসি ফুটল। কী নির্মল! নৈসর্গিক সেই হাসি! হাসির পরতে পরতে মানুষের প্রতি সীমাহীন সহানুভূতি, দেদার করুণা, অনাবিল ভালবাসার স্পষ্ট আভাস। ভেল্কি নয়, ষোল আনা খাঁটি। কেউ খেয়াল করেনি, পরীর হাতের মুঠোয় লুকোনো ছিল একটা সিরিঞ্জ! মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা আসল মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে প্রয়োজনীয় তরল মজুত এই সিরিঞ্জের ভিতর। তিরিশ ফুট দূরের ব্যারিকেডের ওপারে লাখো মানুষ ছানাবড়া চোখে দেখতে প্রস্তুত ধনঞ্জয়ের দৈব ম্যাজিক। তাদের মধ্যেই লুকিয়ে ছিলেন ধনঞ্জয়ের লুক অ্যালাইক রবিদাস বাউরি। আজ তিনি বিশেষ কারণে মুখে ভুষো কালি মেখে এসেছেন। সেই প্রমোশনাল ক্যাম্পেইনের পর থেকেই তার সঙ্গে পরীর বন্ধুত্ব গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠেছে। রবিদাসের নাতনিটা আজ বেঁচে থাকলে এতদিনে ঠিক পরীর মতই দেখতে হত। কার্পেটের পথ করতে যেদিন পরীদের বস্তি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল তখন থেকেই পরীর দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। রোজ দুবেলা রান্না করে নিজের হাতে খাইয়েছেন। মাথার চুল আঁচড়ে দিয়েছেন। রূপকথার গল্প শুনিয়েছেন প্রতিদিন শোয়ার আগে। পরীকে তিনি বুঝিয়েছেন, দুনিয়ার আজব সব নিয়মের কথা। যে নিয়মের নাচন খেলায় মানুষ প্রায়শই হয়ে ওঠে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! রবিদাস পরীকে শিখিয়েছেন, কতরকম ফুল কীভাবে ফোটে, কীভাবে তৈরি হয় গান, কীভাবে দুহাত, দুপায়ের একটা প্রাণী ক্রমশ মানুষ হয়ে ওঠে আর কতরকমের মানুষ কত রকমভাবে মরে যায় প্রতিদিন। পরী চুপচাপ থেকে সবই শুনেছে মন দিয়ে।
এটা বুঝতে রবিদাসকে খুব বেশি বুদ্ধি খরচা করতে হয়নি যে, উড়োজাহাজে ধনঞ্জয়ের ভ্যাকসিন নেওয়া ছিল আসলে আপাদমস্তক দেখানেপনা। অ্যানিমেশনের ভেল্কিও হতে পারে। পরিকল্পনামাফিক নিজের চেহারার মাহাত্ম্যকে কাজে লাগিয়ে তরতাজা একখানা ভ্যাক্সিন রবিদাস যোগাড় করেছিল। সিরিঞ্জটা আজ সে পরীকে দিয়েছে। সেটাই হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রেখেছিল পরী। ধনঞ্জয়ের হাত তার পেটের ওপর পড়তেই হাসতে হাসতেই পরী সিরিঞ্জটা গেঁথে দিল ধনঞ্জয়ের গলায়। তারপর ব্যারিকেড ভেঙে উল্লাসিত চিৎকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল রবিদাসের পিঠের ওপর।
পরবর্তী ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ঘটে যাওয়া যে সমস্ত খবরগুলো দেশের প্রত্যেকটি নিউজ চ্যানেল আড়াল করেছিল তার মধ্যে সভ্য ভাষায় প্রকাশ করার মত দুটি ঘটনা হল এইরকম, ধনঞ্জয় তিনটি বোবা নাবালিকাকে ধর্ষণ করেই থেমে থাকেননি, তপোবন লণ্ডভণ্ড করে আরবের উট এবং গিনিপিগের সঙ্গেও সঙ্গমের চেষ্টা চালিয়েছেন। নিজের প্রাসাদের প্রাইভেট রুমের মখমলি কোলবালিশদুটি নখের আঁচড়ে ফর্দাফাই করে ভিতরে জমে থাকা হাজার হাজার ডলারের নোটগুলো চিবিয়ে খেতে খেতে উদোম শরীরে ফণা বাগিয়ে হাওয়ায় লাগাতার ছোবল মেরেছেন…।
দুনিয়ার কী ভাল আর কীইবা খারাপ তা হাড়েমজ্জায় বুঝে নিয়েছিলেন হাতেগোনা কিছু মানুষ। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর তাদের শরীরে-মনেও পরিবর্তন আসে। এমনিতেই ভাল মানুষের প্রতি সহানুভূতি, করুণা, ভালবাসা প্রকাশে তারা এক নাছোড়বান্দা জাত। আর খারাপের প্রতি ঠিক ততটাই ক্রোধ শরীরের চামড়া ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে আসতে চায়। এই বোধই আরও অনেক বেশি গভীরতর হয়েছে ভ্যাকসিনের প্রভাবে। মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে সহজ সুন্দর নতুন পৃথিবী গড়ার কাজ তারা হাতে নিয়েছেন। শহরের এই তাণ্ডব থেকে নিজেদের সরিয়ে তারা সকলেই জড়ো হয়েছেন দূরের এক জঙ্গলে। এখনও পর্যন্ত সেখানে পাখিরা নিশ্চিন্তে কুহু ডাকে। জোড়া কাঠবেড়ালি নির্ঝঞ্ঝাট খেলে বেড়ায়। রবিদাস জানেন সেই স্থানের ঠিকানা। পরীকে পিঠে নিয়ে তীব্র গতিতে তিনি ছুটে চলেছেন সেদিকেই।
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
