যদি বলি এ জীবন ক্ষণস্থায়ী ঠিক সাবানের বুদবুদের মতই, খুব ভুল বলা হবে কি? জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যবর্তী অনন্ত শূন্যে ভাসতে থাকা স্বচ্ছ বেলুনে বন্দি নীরব দর্শক ছাড়া আমি, তুমি, সে কেউই তো আর কিছু নই। তবুও ছায়াপথে ভ্রাম্যমাণ পথিকের মনে আশা থাকে, মোহ থাকে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে। অন্যকে ঘাস-চাদরের মত পায়ে দলে তরতরিয়ে উপরে উঠে যাওয়ার স্বপ্ন থাকে। দীর্ঘ সূর্যস্নানের অন্তে মায়া পৃথিবীকে শেষবারের মত বিদায় জানানোর আগে সযত্নে ছড়ানো বীজের অঙ্কুরোদগম দেখে যাওয়ার সুপ্ত বাসনাও থাকে। তবে যে মানুষ একেবারে শিখরে দাঁড়িয়ে তার কিন্তু কোনও পরবর্তী গন্তব্য নেই। স্বপ্নেরা বরফের ছুরির মত জমাট বেঁধে বাতাসে ভাসমান। কী এক সম্পৃক্ত, ভরাট অবস্থান! ডাইনে বাঁয়ে ঊর্ধ্বে সমস্ত পথ এক্কেবারে বন্ধ। নিচে নামলেই পদস্খলন। নিশ্চিত মৃত্যু! তার চারিপাশে একাকীত্বের নিশ্ছিদ্র কুয়াশা। নীল ব্যথার মত ঘন তানহা সুরের সংলাপ। ঘালিবের শায়েরির মত প্রেম ও শোকের শ্যাওলা মাখা গভীরতা। আবার পার্থিব ত্বকে খচিত হীরকখণ্ডের কখনও ম্লান না হওয়া দ্যুতি! সেই কারণেই কি প্রতিটি পতন অনিবার্য? দমকা বাতাসের মত আহ্লাদি আর সুগন্ধি সাবান ফেনার মত হালকা, মোলায়েম? জীবন জানে, বন্ধু পরিবৃত সিংহাসন থেকে খসে যেতে যেতেই তারারা সত্যিকারের প্রেমে পড়ে। মুগ্ধ হয় পাথরকুচির ছাপোষা লাবণ্যে। দিনান্তে নিজের বাসার ঝুলবারান্দা ঘেঁষে রংচটা লোহার গ্রিলে এসে বসে দৃশ্যপ্রেমী কবুতরের মত। আর তখনই শুরু হয়, আনকোরা একটি গল্পের ডুব সাঁতার।
এক
মেয়েটার পরনে পাতলা ফিনফিনে নাইটি। লাল চেক চেক গামছাটা ওড়নার মত দুই ভাঁজে খোয়াবহীন সমতল বক্ষদেশের ওপর ফেলা। পাকারাস্তার ধারে যেখানে নুড়ি-পাথর, বালিমাটি ফুঁড়ে লোহার নলের মাথাখানা উঁচু হয়ে উঠেছে, তার চারপাশে কোনও বাঁধানো চাতাল নেই। ক’টা বড় পাথর আর ভাঙা ইট গুঁজে রাখা। বস্তির লোকজনের কাছে এই ব্যবস্থাই অনেক। ইটের ওপর বসে গোলাপি প্লাস্টিকের বালতিতে ভাঙা মগ ডুবিয়ে ব্যস্ত হাতে জল তুলছে আর মাথায় ঢালছে মেয়েটা। গা থেকে নেমে আসা জল নিচু ঢাল বেয়ে গিয়ে পড়ছে পানা ভর্তি ডোবায়। স্নানের দৃশ্যটাকে আকর্ষক বলা চলে না। তবুও রাস্তার লোক দেখতে দেখতে যাচ্ছে। উপভোগ করছে কিনা সেকথা অবশ্য তারাই বলতে পারবে। মেয়েটার তাপ-উত্তাপ নেই। তার পিছনে লাইনে এখন তিনজন। দুজন স্থূলকায়া মহিলা, একজন ঢ্যাঙা পুরুষ। লালচে শুকনো চুলগুলো ব্রহ্মতালুর কাছে জড় করে দশ টাকার মতিচুর লাড্ডুর সাইজের খোঁপা বেঁধেছে মেয়েটা। একে গায়ে কোনওদিন সাবান ঘষতে দেখেনি বিশাখ। তবে শুকনো পোশাক পরে এই মেয়েই যখন টিনটিনদের নেড়া ছাদে জামা মেলতে আসবে, রোদ্দুর পিছলে যাবে শ্যামলা চামড়ায়। চওড়া ভুরু দুটো কপালে তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়াবে। নাকের নোলকটা চিকচিক করবে। আপন মনে হাসবে সে। পরিদের মত উন্মাদ ভঙ্গিতে ভেজা চুল ঝাড়বে। তারপর চমকে উঠে চেঁচিয়ে উত্তর দেবে,
‘যাই গো কাকিমা।’
সরু কোমর, গলার হাড় দুটো বড্ড উঁচু। খুব একটা স্বাস্থ্যবতী নয়। ফুটে ওঠার মুখে বুনো ফুলের কলির গায়ে যেমন সোনালি আলোর আভা খেলা করে, তেমন একটা জ্বলজ্বলে ভাব এসেছে বটে ক্ষয়াটে শরীরে। সহজে চোখ ফেরানো যায় না। মানে, বিশাখ চোখ ফেরাতে পারে না। ঠিক দুপুর বারোটায় টাইমের কলে জল এলে মেয়েটা স্নানে আসে। বিশাখ জানলার ধারে চলে আসে সেই সময়। সিগারেট ধরায়। মিনিট পাঁচ-ছয় মাত্র। অথবা সেকেন্ড-মাইক্রোসেকেন্ডের নির্ভুল যোগফল আসলে তার চেয়েও কম। ওইটুকু সময় মেয়েটাকে ভিজতে না দেখলে বিশাখের মনটা চঞ্চল হয়ে থাকে সারাদিন। কাজে ভুলভ্রান্তি তো হয়ই। রাতেও ঘুম আসতে চায় না। গোটা দিন মাথাটা ঝিম মেরে থাকে। এমন নয় যে মেয়েটাকে না দেখলে বিশাখের আঁকা হবে না। তবুও স্নানপর্ব দেখাটা অভ্যাস করে ফেলেছে বিশাখ।
‘মরবি না মানে? হুম? দাঁড়া দাঁড়া… দেখাচ্ছি তোকে!’
পুপুলি রান্নাঘরে কুস্তি লড়ছে। এক হাতে ঝাঁটা। অন্য হাতে বেগন স্প্রে। বেগুনি লিলি ফুলের গায়ে জমা শিশিরের মত কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গাঢ় নীল স্লিভলেস কামিজের নিচে রংচটা লেগিংস হাঁটু পর্যন্ত গোটানো। ওড়নার বালাই নেই। উন্নত বুক শাসন করছে পাতলা শরীরকে। বিশাখদের রান্নাঘরে আরশোলার উৎপাত বড্ড বেড়েছে। কালচে লাল কুচো কুচো আরশোলা। ঝাঁটা দিয়ে মারতে গেলেই ফসকে পালায়। কিলবিল করে দেওয়াল বেয়ে উঠে যায় সিলিংয়ে। জোট পাকিয়ে আটকে থাকে। আজ এই যুদ্ধটার কোনও প্ল্যান ছিল না। কিন্তু সাতসকালে চায়ের কাপে একটা জ্যান্ত আরশোলা পাওয়ার পর থেকেই পুপুলির মেজাজটা খাপ্পা হয়ে রয়েছে। বিশাখ বেশ বুঝতে পারছে বাক্যবাণগুলো আসলে কীটপতঙ্গের উদ্দেশে নয়, ওর দিকেই ছুড়ে দিচ্ছে পুপুলি।
‘এই যে মহোদয়, উদাস নয়নে সারাবেলা প্রকৃতির রূপ না দেখে বউকে একটু সাহায্য করলেও তো পারেন। একা হাতে আর কতদিক সামলাব আমি?’
পুপুলি রানি রাসমণি বালিকা বিদ্যালয়ে চাকরি করে। ইংরেজি পড়ায়। বিশাখ ছিল একটি নামকরা দৈনিকের অলংকরণ শিল্পী। পাস্ট টেন্স ব্যবহারের কারণ গত মাসে ওর চাকরিটা চলে গিয়েছে। যদিও চাকরি চলে যেতেই দুম করে ওদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েনি। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিতও নয়। বেসরকারি চাকরি। ইচ্ছে করলেই কাঁধ থেকে ধুলোর মত দায় ঝেড়ে ফেলতে পারে সংস্থা। পুপুলি মাসে যা পায়, তা দিয়ে ভদ্রভাবেই ওদের দুজনের চলে যাবে। মা গত হতে দেশের জমিজমা বিক্রি করে ফ্ল্যাটটা কিনেছিল বিশাখ। টু বি এইচ কে। খোলামেলা। বড় হলঘর, গঙ্গামুখী ব্যালকনি। কাচের দরজা-জানলা। সামান্য কিছু ব্যাঙ্ক লোন রয়ে গিয়েছে এখনও। বিশাখ নিশ্চিত যে ওইটুকু ম্যানেজ করতেও কারও কাছে হাত পাততে হবে না। তবে চাকরিহীন হয়ে বর্তমানে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে ওর মনে। পুপুলির ঘাড়ে বসে খাবে? হাত পেতে সিগারেট, বডি স্প্রে, রেজর আর আফটার শেভের জন্য টাকা চাইবে? ভাবলেই গাটা কেমন গুলিয়ে ওঠে বিশাখের। না, এখনও পর্যন্ত যদিও সেরকম কিছুই হয়নি। গত মাসের মাসকাবারি বাজার এখনও ফুরোয়নি। বরাবরই ফর্দের চেয়ে কিছুটা বেশি কেনে বিশাখ। কিন্তু পরের বার থেকে বিলিং সেকশনে দাঁড়িয়ে কি পুপুলি টাকা দেবে? দৃশ্যটা কল্পনা করলেই নিজেকে একেবারে বেকার আর অপদার্থ মনে হতে থাকে বিশাখের। যদিও ও পুরো বেকার নয়। ফ্রিল্যান্সিং ও আগেও করত। এখনও করে। ভালই কাজ রয়েছে হাতে। শুধু কপালের ওপর থেকে সংস্থার ছাপটা মুছে যেতে বিশাখ আজকাল কেমন যেন অ্যাবানডানড মনে করে নিজেকে। একজন পরিত্যক্ত কর্মী। নাকি একটি পরিত্যক্ত পোষ্য! অফিস যাওয়ার পথে এমন তো কতবার দেখেছে বিশাখ। পোষা কুকুর বিড়ালকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে মালিক। কারও কারও গলায় নাম লেখা দামি কলার। কারও মালিক আবার সেই বন্ধনটুকু থেকেও মুক্ত করে দিয়েছে। আদরের গন্ধ আর গলায় অদৃশ্য চিহ্ন নিয়ে সেই লোমশ প্রাণীটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেনা মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কেউ বা চলচ্ছক্তিহীন, রোগের তীব্র কামড়ে কাতর; মৃত্যুর অপেক্ষায় নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে। ইশারায় লেজ নাড়ানোর ক্ষমতা কমে আসতেই মালিক বলে দিয়েছে,
‘যাও প্রিয়, এবার তোমার ছুটি।’
সেই ক্রূর বাণী এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না প্রাণীটা। অবিশ্বাসের আচমকা আঘাতে প্রায় মৃতই বলা চলে। বিশাখও তেমনি। মৃতপ্রায়! রজত সেন যেদিন বিশাখকে নিজের কেবিনে ডেকে বললেন,
‘এবার আর রক্ষা করা গেল না রে বিশাখ। আগের দু’বার যাহোক করে হলেও আটকাতে পেরেছিলাম। কিন্তু…’
নানারকম অ্যাবসট্র্যাক্ট ফিগার ফেব্রিক করা সুতির পাঞ্জাবি আর হাতের কব্জিতে রুপোর চওড়া রিস্টলেট পরা মোটা থপথপে মানুষটাকে সেদিন হঠাৎ করেই নিজের বস বলে মনে হয়েছিল বিশাখের। অথচ বিগত দশটা বছরে রজতদাকে কোনওদিন নিজের দাদা কাম বন্ধুর থেকে বেশি কিছুই মনে করেনি ও। শুধু একটা চেয়ারের তফাত! তাই না? রজতদা অন্যদিনের মত উঠে দাঁড়াননি। বিশাখও চাকরি বাঁচানোর জন্য কাকুতিমিনতি করতে পারেনি। সেটা ওর স্বভাববিরুদ্ধ। বরং রজত সেনই নিজে থেকে হিসেবপত্র নিয়ে বসেছিলেন,
‘আমার মনে হয়, তোর খুব একটা অসুবিধে হবে না। মানে আমার মতে হওয়ার কথা নয় আর কী! দেখ ছদ্মনামে তো তুই কাজ করতিসই, এবার থেকে সেই আড়ালটা আর রাখবি না। যা করবি ডাঁট সে করবি। সিম্পল!’
কত সহজে বিশাখের এনার্জি বুস্ট করছিলেন ভদ্রলোক। বিশাখের জিভ থেকে আলটাগরা তখন তেতো স্বাদে ভরে উঠছে। একটাও শব্দ খরচ করতে ইচ্ছে করেনি ওর।
‘ঠিক হ্যায় রজতদা। আলবিদা! রাস্তায় দেখাফেকা হলে চিনতে অস্বীকার করো না আবার!’
‘হা হা হা! পাগল না পেট খারাপ!’
উভয়পক্ষই বেশ অর্থবহ হাসি বিনিময় করেছিল।
***
সিঙ্কে জমে থাকা বাসনগুলো বিশাখকে মাজতে বলেছে পুপুলি। মেয়েটাও আজ তাড়াতাড়ি ক’মগ জল ঢেলে পালাল। স্টিলের কড়াইতে আনমনে স্ক্রচবাইট বোলাতে বোলাতে কলেজের দিনগুলোর কথা ভাবছিল বিশাখ। কী নরম আর শান্ত স্বভাবের ছিল পুপুলিটা! স্ফটিকের পুতুলের মত স্বচ্ছ, আলো আলো। কোন এক মায়ামন্ত্র বলে সেই কৈশোর থেকেই বিশাখের আশেপাশে মেয়েরা প্রজাপতির মত উড়ে বেড়ায়। কোনওকালেই ও ক্যাসানোভা ছিল না। হতেও চায়নি। তবুও দলে দলে মেয়ে এসেছে, গিয়েছে। ওর হাতে লেখা আর আঙুলে রং আছে বলেই কি? কত যে অচেনা নারীর বার্তা পড়ে রয়েছে ফেসবুকের মেসেজ বক্সে! মাঝরাতে প্রেরিত সেসব জিজ্ঞাসা দেখলে আচ্ছা আচ্ছা সংযমীর তপস্যাও ভঙ্গ হয়ে যাবে।
‘আপনি পোট্রেইট আঁকেন? আমি একটু অন্য ধরনের ছবি চাইছি। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাব। নির্ভার। নিরাবরণ! কী পারবেন? উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেব কিন্তু।’
উফ! মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে বিশাখের। না, এসব প্রলোভনে কখনও পা দেয়নি ও। তবে নিরামিষ প্রেম ওর নাগালে এসেছে একধিক বার। অনেক অনেক আগে সন্দেহ শব্দটার সঙ্গে পুপুলির কোনও পরিচয় ছিল না। সে তখন বিশাখকে ভালবাসত। সংসারের জাঁতাকলে পড়েই হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মেয়েটা এখন একটা গরম চকোলেটের বল। আদুরে কামড় দিলেও জিভ পুড়ে ফোসকা পড়ে যায়। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বিশাখ দেখল পুপুলি রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতব্যাগের ভেতর থেকে খালি বিস্কুটের প্যাকেটগুলো গারবেজ ব্যাগে ফেলছে। স্লেট রঙের শিফন শাড়ি পরেছে পুপুলি। শরীরের ভাঁজগুলো স্পষ্ট। খোলা চুল। চোখে ঘন নীল কাজল। আজকাল বেশ পরিপাটি করে সাজে পুপুলি। চেহারাও আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। পুপুলি ফরসা নয়। তার কাজল চোখের দিকে তাকালে কৃষ্ণকলি কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ে যায়। বিশাখ একটা সিরিজ করেছিল পুপুলিকে আধার করে। তুলি ধরলেই তখন এক ছাঁচের অবয়ব। সকলেই খুব পছন্দ করেছিল সেই কাজ।
‘তুই খাবি না?’
‘আর সময় কোথায়? বিস্কুট দিয়েই চালিয়ে নেব।’
শ্যাম্পু করা রেশমসম চুলগুলো পালকের মত উড়িয়ে দিল পুপুলি। বিশাখ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু জগজিৎ সিংহের গলাটা একখানা ভারি গজল নিয়ে তৃতীয় পুরুষের মত ওদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতব্যাগ থেকে ফোনটা বের করতে করতেই চুলে ক্লাচ আটকে নিল পুপুলি। কল্পনার আকাশ থেকে ঝপ করে মাটিতে পড়ে গেল বিশাখ। খেয়াল হল, ওর ডানাটা এখন ভাঙা।
দুই
‘হ্যালো! হ্যাঁ হ্যাঁ… এবার বল। শুনতে পাচ্ছি।’
‘বেরিয়ে পড়েছ? আমি কিন্তু আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।’
‘জাস্ট বেরোলাম। সকাল থেকে রাজ্যের কাজ। একটা হেল্পিং হ্যান্ড নেই। আমি আর পারছি না।’
‘ওকে ওকে রিল্যাক্স বেব! রেগে গেলে তোমাকে আবার বেশি সুন্দরী লাগে। রাস্তায় তোমাকে বেশি সুন্দর দেখালে আমার চাপ আছে।’
‘আহ! সব সময় ফ্লার্ট কোরো না তো ঋজু। আমি সিরিয়াসলি বলছি আর তুমি…’
‘আচ্ছা স্যরি স্যরি। এ… এই আমি কান ধরছি। আপনি আসুন ম্যাডাম। কথা দিচ্ছি এখন থেকে সিরিয়াস রিপ্লাই পাবেন।’
দুজনেই হেসে ওঠে। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে হাতব্যাগে পুরে নেয় পুপুলি। আজ আর স্কুলে যাবে না। মাঝে মাঝে নিজেকেও তো একটু ডানা ছড়ানোর সুযোগ দিতে হয় নাকি! ঋজুর কাছে পুপুলি নিজেকে মেলে ধরতে পারে। আকাশের মত উদার আর মেঘের মত কোমল স্বভাব ঋজুর। ভাগ্যিস! এই মানুষটার সঙ্গে আচমকাই আলাপ হয়েছিল পুপুলির। কলকাতায় ঋজুর আর কিচ্ছুটি নেই। বাড়ি-ঘর, মা-বাবা, স্ত্রী সমস্ত পিছুটান মুক্ত হয়ে ঋজু এখন দুবাইতে স্থিতু। কিন্তু এই যে পাঁচ-ছ’মাসে একবার হুস করে কলকাতায় উড়ে চলে আসা, সপ্তাহখানেকের জন্য একটা শান্ত নদীর পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসা, আলো ঝলমলে হাসির মুহূর্ত কুড়িয়ে নেওয়া এসব তো কেবল পুপুলির জন্যই। পারমিতা ওরফে পুপুলি। আদুরে পুপুলি কবে যে ঋজুর অন্তরের অনেকখানি জায়গা দখল করে নিয়েছে স্বয়ং সময়ও বোধহয় টের পায়নি সে কথা। ভাড়ার ক্যাবে উঠে ওটিপিটা বলে গা এলিয়ে দিল পুপুলি। বাইরে রোদের তেজ কমে এসেছে। আকাশের গা থেকে কৃষ্ণ কালো মেঘের রং চুঁইয়ে ধীর পায়ে নেমে আসছে শুনশান পথের বুকে। হাতের পাতার ওপর ঋজুর আঙুলের স্পর্শ কল্পনা করতে করতেই পুপুলি বৃষ্টি মাখতে থাকল। ক্যাব তখন পক্ষীরাজের গতিতে হাইওয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে চলেছে।
***
ক্যানভাস জুড়ে নীলের নানা শেড। নানা মুডে আজ শুধু নীল রং নিয়েই খেলছে বিশাখ। বৃষ্টি এসেছে। খোলা জানলা গলে জলের কণা ঢুকে পড়ছে হলঘরে। আজ আর মেশিনে বসতে ইচ্ছে করছে না। হাতে আঁকবে। তুলির নির্যাসে নিজেকেও রঙিন করবে। টিনটিনদের খোলা ছাদে একলা ভিজছে সস্তার নাইটিটা। হঠাৎ বিশাখের মনে পড়ল মাস দুয়েক আগে টিনটিন একটা বিজনেস প্রজেক্টের ব্যাপারে কী যেন বলতে এসছিল। বিশাখ তখন তুমুল ব্যস্ত। কাউকে দেওয়ার মত পাঁচটা মিনিটও সময় নেই ওর হাতে। রোগা ফরসা গালে মেচেতার দাগওয়ালা ছেলেটাকে ও বলেছিল,
‘শোন না, নেক্সট মান্থে কোনও একটা রবিবার তোর সঙ্গে বসি? বড্ড চাপে রয়েছি রে বাবু।’
‘ওহ শিওর শিওর! যেমন তুমি বলবে। বাই বিশাখদা। অফারটা ভুলে যেয়ো না কিন্তু।’
ছেলেটা লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছিল। তাকে আর ডাকাই হয়নি। কম্প্যুটার টেবিল থেকে ফোন তুলে নিয়ে টিনটিনের নম্বর ডায়াল করল বিশাখ।
‘হাই বিশাখদা। কী খবর?’
‘চলছে রে। আচ্ছা তুই কি বাড়ি আছিস? আসতে পারবি এখন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বাড়িতেই তো। আসছি আমি।’
জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ফোঁটা মাখতে মাখতে সিগারেট ধরাল বিশাখ।
তিন
‘আজ স্কুলে যাসনি মা?’
‘না মা। ঋজু এসেছে। ওর সঙ্গে একটু বেরিয়েছিলাম। এখন ফিরছি।’
‘আর বিশাখ?’
‘সে আবার কী করবে? বাড়িতে রয়েছে। রং, তুলি, কম্প্যুটার, গল্পের হেডপিস, বইয়ের প্রচ্ছদ, আকাশ দেখা এইসব নিয়ে।’
‘পুপুলি, এত অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিস কেন রে মা? এই বিশাখকেই তো তুই ভালবেসে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলি। ওর কাজ নিয়ে আগে তুই কত কথা বলতিস!’
‘আমি আর পারছি না মা। একটা কুঁড়ে, উদাসীন, পাগলকে নিয়ে আর চলতে পারছি না আমি। আমিই ওকে চিনতে ভুল করেছি। বিশাখ হয়তো একজন ভাল শিল্পী, ভাল মানুষ; কিন্তু একজন ভাল হাজব্যান্ড ও কোনওদিন হতে পারবে না। কোনওদিন না।’
ফোনের অপর প্রান্তে দীর্ঘশ্বাসের বাষ্প জমা হয়। মাকে কথাগুলো বলে খুব হালকা লাগছে পুপুলির। ঋজু আজ সরাসরি প্রোপোজ করেছে পুপুলিকে। পুপুলি জানে, ঋজু ওকে কোনওদিন জোর করবে না। ও যদি সারা জীবন শুধুই বন্ধুত্ব রাখতে চায়, তাইই রাখবে ঋজু। বিশাখকে আর আগের মত ভাল না বাসলেও তাকে পুরোপুরি সরিয়ে দিতে পারবে কিনা পুপুলি নিজেও জানে না। ভেবে দেখেওনি সে ব্যাপারে। এত বছরের অভ্যেস! ঝাঁকড়া চুলের ভিতর থেকে উঁকি মারা ওই কচি কচি মুখটা দেখতে না পেলে কি ভাল থাকবে পুপুলি?
***
‘তাহলে ওই কথাই রইল? কী? খুশি?’
‘ইয়েস ইয়েস ইয়েস! থ্যাংস আ লট বিশাখদা। তুমি জানো না আমার কতদিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে।’
‘কিন্তু টিনটিন, তুই ওদের জোর করছিস না তো?’
‘না না। একদম না বিশাখদা। আমরা পাঁচজনই তোমার ফ্যান। বিলিভ মি, তুমি রাজি হয়েছ শুনলে দীপ, সায়ন, কুশলরা আনন্দে পাগল হয়ে যাবে।’
‘বেশ! দেখা যাক তোদের কতখানি সন্তুষ্ট করতে পারি।’
সিঁড়িতে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল টিনটিন আর পুপুলির। টিনটিন একগাল হেসে জানতে চাইল,
‘কেমন আছ বউদি?’
‘চলছে রে। এই টিনটিন, তোদের নতুন কাজের মেয়েটা কি আমাকে একটু হেল্প করতে পারবে? এই সকালের দিকটা? বড্ড প্রেশার পড়ে যায় রে।’
‘কে? ঝুমকো? তুমি রাখবে ওকে? আচ্ছা দাঁড়াও আমি বাড়ি ঢুকেই মায়ের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’
‘প্লিজ টিনটিন। খুব হেল্প হয় রে আমার।’
সোফার ওপর ব্যাগটা রেখে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ঘাড়ে-মুখে জল দিতে দিতে ফেসওয়াশের টিউব হাতে পুপুলি বিশাখের দিকে তাকাল।
‘কচি কচি ছেলেগুলোর মাথা না খেলেই নয়?’
‘মানে?’
বিশাখ অবাক হয়ে গেল।
‘মানেটা জলের মত পরিষ্কার। নিজে তো কিছুই করতে পারলি না। এবার এই বাচ্চা ছেলেগুলোর ভবিষ্যৎটাও কি অন্ধকারে ডুবিয়ে দিবি?’
খুব জোরে চেঁচিয়ে কী সব বলতে গিয়েও দেওয়ালের গায়ে দুটো ঘুঁষি মেরে একদম শান্ত হয়ে গেল বিশাখ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘পুপুলি, তোর যদি মনে হয়, এক ছাদের নিচে থাকাটা আর সম্ভব নয়, তাহলে তুই চলে যেতে পারিস। কথা দিলাম, আমি আটকাব না। কিন্তু এইভাবে রোজ রোজ আমাকে মারিস না। প্লিজ! আই বেগ অফ ইউ।’
চার
‘অটোগ্রাফ প্লিজ!’
টিনটিনের পাশে বসে আনমনে কী যেন ভাবছিল বিশাখ। বছরখানেকের মধ্যে এত বড় সাফল্য স্বপ্নেও আশা করেনি ওরা। কিন্তু সেটাই এখন বাস্তব। চাকরি হারানো বহু ছেলেকে ভাল স্যালারিতে হায়ার করেছে ‘বুদবুদ’! নতুন ফ্যাশন, জুয়েলরি, হোম ডেকর ব্র্যান্ড। অবশ্য গোটা পরিকল্পনাটাই টিনটিনের। শুধু ডিজাইনগুলোতে নিজের স্বপ্নের কণা কণা মিশিয়ে দিয়েছে বিশাখ। মাত্র একুশ-বাইশ বছরের ছোট ছোট পাঁচটা ছেলে একজোট হয়ে যে এত বিরাট কাণ্ড করে ফেলবে বিশাখ বুঝতেই পারেনি।
‘আপনিই তো বিশাখ দাশগুপ্ত? বুদবুদের ডিজাইনার?’
‘ইয়েস ম্যাম। হি ইজ দ্য জিনিয়াস ম্যান বিহাইন্ড দ্য বুদবুদ।’
টিনটিনের কথায় সামান্য লজ্জা পেয়ে হাসতে হাসতে তার পিঠের ওপর একটা হাত রাখল বিশাখ। মহিলা নিজের ডিজাইনার ডায়েরির একটি পাতা খুলে দিয়েছেন বিশাখের হস্তাক্ষর নেওয়ার জন্য।
***
আধা হিন্দি আর আধা বাংলায় ঝুমকো একটা গান ধরেছে। গুনগুন সুর ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। মেয়েটার মাথায় ভরপুর ছিট। আজ আবার কী রাঁধছে কে জানে? ঝালের চোটে প্রায়ই বিশাখের ঠোঁট পুড়ে যায়। তবুও মেয়েটাকে বকতে ইচ্ছে করে না। সন্ধ্যার দিকে দুবাই থেকে পুপুলির একটা মেসেজ এসেছিল। খুব প্রশংসা করছিল বুদবুদের। বুদবুদের আউটলেটের ব্যাপারেও নাকি এবার বিশাখদের ভাবা উচিত। সে কথাও লিখেছে পুপুলি। জ্ঞান দেওয়া স্বভাবটা আজও যায়নি মেয়েটার!
শোয়ার ঘরের দেওয়াল আলমারি খুলে হঠাৎ করেই জাসমিন সাবানের গন্ধটা পেল বিশাখ। জুঁই ফুলের গন্ধ পুপুলির খুব পছন্দের। বিশাখের মনে পড়ে গেল, ঝুমকোর স্নান দেখার কথা। পুপুলি কি আন্দাজ করেছিল কিছু? সন্দেহ করেছিল বিশাখকে? মানুষ বিশাখকে পুপুলি ভালবেসেছিল ঠিকই; কিন্তু ছয় বছরের প্রেম আর আট বছরেরে সংসারে একবারের জন্যও পুপুলি শিল্পী বিশাখকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করেনি। অবশ্য ভুলও হতে পারে বিশাখের এই ভাবনা। একের চোখে যা অভাব, অন্যের চোখে তা যে পূর্ণতা নয়, কেমন করে জানবে একলা মন? তবে ঋজুকে পারফেক্ট সংসারী করে তুলতে পুপুলি ঠিক কীভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে, সে কথা জানতে বড্ড ইচ্ছে করে বিশাখের। যাইহোক, হাতের তালুতে জুঁইগন্ধওয়ালা ধবধবে সাদা সাবানটা নিয়ে হাঁক দিল বিশাখ,
‘একবার এদিকে শোন ঝুমকো।’
‘যাচ্ছি গো দাদা।’
রোগা লম্বা ঘাস ফড়িংয়ের মত তিড়িং তিড়িং করতে করতে এসে হাজির হল ঝুমকো।
‘হাত পাত।’
‘সা— বা— ন?! উম্মমম… কী ভাল গন্ধ গো!’
‘এবার থেকে মাখবি। রোজ।’
‘ফুরিয়ে গেলে?’
‘আবার এনে দেব।’
সাবানটা বুকের কাছে চেপে ধরে ঝুমকো একবার গোল হয়ে পাক খেয়ে নিল। কে বলবে রোগা রোগা কাঠিসার চেহারার এই মেয়েটাই এখন বুদবুদে ভর করে পাক খেয়ে বেড়ায় ওয়েবসাইটের পাতায় পাতায়! তণ্বী ধনী তরুণীরা এই শ্যামলা মেয়েটার মত করে সাজবে বলেই ছুটে আসে বারবার!
হলঘরের জানলা থেকে টিনটিনদের ছাদের দিকে তাকাল বিশাখ। এই তো ক’মাস আগে দেখা সেই শ্যামলা পরিটা এখন বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের তালুতে সাবান ঘষছে। এইবার হয়তো টুপ করে ঢুকে পড়বে বড়সড় একটা রঙিন সাবানের ফেনার ভিতরে! বিশাখের চোখের সামনেই উড়ে উড়ে বেড়াবে। তারপর জানলা গলে টিনটিনদের খোলা ছাদ, ছাদ পেরিয়ে নীল আকাশ, আকাশপথে একলা চাঁদকেও ছুঁয়ে ফেলতে পারে। দুবাইতে বসে পুপুলি কি দেখতে পাবে ঝুমকোর এই উড়ান?
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে পাঁচমিশালি একটা তরকারির গন্ধ। তলাটা বোধহয় ধরে গিয়েছে। ভালই। গরম ডাল আর ভাতের সঙ্গে একটু একটু পুড়ে যাওয়া সব্জি খেতে খুব ভালবাসে বিশাখ।