বাংলা কবিতায় বিনয় মজুমদারের স্থানাংক নির্ধারণ সহজ নয়। জীবনানন্দ-পরবর্তী অনেক মহীরুহের মধ্যে তিনি সর্বোত্তম কিনা এই প্রশ্নে বিতর্ক অশেষ। বিনয়, উৎপল, কিয়দংশ শক্তি, এবং স্বদেশ সেন— এই বিগ ফোর এ-যাবৎ আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত ও বিপর্যস্ত করেছে।
শিল্প তার নিয়তি নিজেই ঠিক করে। সে ঠিক করে কার কাছে যাবে, কতদূর যাবে। দর্শক/পাঠক/শ্রোতার পছন্দ বোঝার ক্ষমতা শিল্পের সহজাত। রাজানুগ্রহে তৈরি হলেও স্ফিংস নির্মাতা(রা) অবশ্যই জানতেন তাঁরা কী করছেন, কেন করছেন, কতগুলো শতাব্দী আগত রসিককে বিমূঢ় করে যাবে এই কারু। স্ফিংসও জানত।
যে-কোনো শিল্পের মতো কবিতারও প্রাণ আছে। তাৎক্ষণিক হোক অথবা দীর্ঘমেয়াদি, কবিতা তার পাঠক খুঁজে সম্পর্কস্থাপন করে।
বিনয়ের কবিতা পাঠককে কনফিডেন্স দেয়। কোনো নির্দিষ্ট কবিতার আপাত-সম্পর্কহীন ইমেজারিগুলো পরপর এত নিখুঁতভাবে সাজানো যে মনে হয় জন্মসূত্রে তাদের রক্ত, লসিকা, তরুণাস্থি এক। কল্পনা-প্রতিভায় চূড়ান্ত হয়েও বিনয় মিথ্যে কথা লেখেন না।
‘শিশুকালে শুনেছি যে কতিপয় পতঙ্গশিকারী ফুল আছে’
‘কিছুটা সময় দিলে তবে দুধে সর ভেসে ওঠে’
‘অথচ আলেখ্যশ্রেণি কিছুটা দূরত্বহেতু মনোলোভা হয়ে ফুটে ওঠে’
প্রতিটি পঙ্ক্তি-চিত্র বাস্তব জগতের কথা বলে। কবিতার অভ্যস্ত পাঠক না হয়েও তাই আনন্দ খুঁজে পায় অনেকে। বিনয়, পাঠককে খুব সহজেই পুনরাবিষ্কারের চক্রান্তে ঠেলে দেন।
২
“রঙ আমার আত্মা দখল করে নিয়েছে। রঙ নিয়ে আমাকে আর আলাদা করে ভাবতে হয় না।” —পল ক্লি
এ কথা লিখিত সত্য, বিনয় মজুমদার মুখে মুখে ৩৪ মাত্রার মহাপয়ার বলতে পারতেন। আর তা কোনো কবিতা রচনার অভিপ্রায় নয়। উচ্চারিত প্রতিটা বাক্যই বস্তুনিষ্ঠ জগতের বর্ণনা। ভূগোল হিসেবে ঠাকুরনগর দু’নম্বর প্ল্যাটফর্ম, অসীমের চায়ের দোকান, মহিষাকাঠি গ্রামের পথ, কুয়াশা অধ্যুষিত শিমুলপুর।
“আমার কবিতার ছন্দের সঙ্গে জিহ্বার সম্পর্ক প্রধান এবং কানের সম্পর্ক অপ্রধান।”
‘আমার ছন্দ’ নিবন্ধে বিনয় এক ছন্দোসূত্র প্রস্তাব করেন:
পংক্তি = ৮.ক +/- ২
(যেখানে ক = ০, ১, ২, ৩, ৪…)
বাংলা অক্ষরবৃত্তের ধ্রুপদ গড়ন এই সূত্রে বাঁধা। ক-এর মান ২ হলে পংক্তির মাত্রাসংখ্যা ১৪ অথবা ১৮। অর্থ, পয়ারের যাত্রা শুরু।
বিনয়ের পয়ার এলায়িত সুন্দর। তাঁর অক্ষরবৃত্ত বাংলার আবহমান কাব্যগুলির (‘মনসামঙ্গল’, ‘লক্ষ্মীর পাঁচালী’ ইত্যাদি) নির্দিষ্ট পয়ারের সুর মানে না। বরং কালিদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের মন্দাক্রান্তা ছন্দ বিনয়ের হাতে বিবর্তিত হয়ে ‘ফিরে এসো, চাকা’-র মহাপয়ার তৈরি হয়। এ-কথা স্বয়ং বিনয়ের।
—আপনি পয়ারে লিখলেন কেন?
—আমি পয়ারে লিখেছি, কারণ মাইকেল মধুসূদন পয়ারে লিখেছে, রবীন্দ্রনাথ পয়ারে লিখেছে, জীবনানন্দ পয়ারে লিখেছে।
৩
”It is the job of poetry to clean up our word-clogged reality by creating silences around things.” —Stéphane Mallarmé
যদি তর্কাতীত ঘটনা হয়, তবে বিগ ব্যাংয়ের মুহূর্তেও বিকট শব্দ হয়েছিল। পুরুষ-নারীর মিলন, সন্তানপ্রসব, খাদ্যগ্রহণ, জলপান, শ্বাসপ্রশ্বাস সহ জাগতিক প্রতিটা ঘটনার নির্দিষ্ট শব্দ আছে। এমনকী নিরবচ্ছিন্ন, নীরব বাতাসও শুকনো পাতাকে নাগাড়ে দোলা দিলে তার চলনে শব্দ হয়। একইভাবে প্রতিটা শব্দের বিপরীতে আছে নৈঃশব্দ্য। বিগ ব্যাং পরবর্তী কয়েক বিলিয়ন বছরের অভিজ্ঞতায় পৃথিবীও নিজেকে গড়েপিটে নিয়েছে তুলনামূলক শান্ততার দিকে, পরবর্তী বিস্ফোরণের জন্য। যৌনতা পরবর্তী স্নায়ুশৈথিল্য, খাদ্যগ্রহণ পরবর্তী শ্লথ শারীরিক গতি — অনুসারী প্রতিটা ঘটনাই নীরবতার দিক।
কবিতাও ব্যতিক্রম নয়। রুমির ‘মসনভি’, বাশোর হাইকুসম্ভার, বোদলেয়ারের ‘লে ফ্লর দ্যু মাল’ সহ যে-কোনো বড়ো মাপের কাব্য আমাদের বিস্মিত, অর্থাৎ নীরব করে।
‘আঘাত দেবে তো দাও। আর নেই মৃত স্মৃতিরাশি।
অনেক মদিরা পান করেছি, হে আঁখি, ওষ্ঠ, চাকা।
রক্তের ভিতরে জ্যোৎস্না; তবু বুঝি, আজ পরিশেষে
মাংসভোজনের উষ্ণ প্রয়োজন; তোমার দেহের কথা ভাবি—
নির্বিকার কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে অন্ধকার, সুখ
এমন আশ্চর্যভাবে মিশে আছে; পৃথিবীতে বহু
গান গাওয়া শেষ হল, সুর শুনে, ব্যথা পেয়ে আজ
রন্ধনকালীন শব্দ ভালোবেসে, কানে কানে মৃদু
অর্ধস্ফুট কথা চেয়ে, এসেছি তোমার দ্বারে, চাকা।
মুগ্ধ মিলনের কালে সজোরে আঘাতে সম্ভাবিত
ব্যথা থেকে মাংসরাশি, নিতম্বই রক্ষা ক’রে থাকে।’
প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া এই কবিতার শেষ দুই পংক্তির অর্থ বুঝতে বই পড়া লাগে না। প্রাগৈতিহাসিক সত্য, অথচ বিনয় তাঁর ক্রাফটের গুণে একে উপপাদ্যের সিদ্ধান্ত হিসেবে দাঁড় করালেন।
‘বিনয়ের অনেক কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে আমরা বুঝি কবিতার তেমন এক অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গেছি: যেন এরপর আর কোনও কবিতা হয় না। অর্থাৎ কবিতাগুলির মধ্যে ‘ফাইনালিটি’র উপাদান আছে।’
উৎপলকুমার বসু লিখিত এই ‘ফাইনালিটি’ হল শব্দ, বাক্য ও কবিতার শেষ পরিণতি, যা আসলে নৈঃশব্দ্য বৈ কিছু নয়।
৪
‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড কাব্যগুলোর একটা। ছ’টি দীর্ঘ কবিতা। আপাতভাবে মহাপয়ারে বাঁধা সঙ্গমের বর্ণনা। এই বই বাজারসফল নয়। অথচ এমনই কাব্য যাকে অনায়াসে ‘ত্রিপিটক’-এর পাশে রেখে পড়া যায়, বাউলের দেহতত্ত্ব দিয়ে যাচাই করে দেখা যায়। এই ছ’টি দীর্ঘকবিতা এক কালসীমাবৃত্ত, যার ভিতর চব্বিশ ঘণ্টা লুকিয়ে আছে। আর আছে বিন্যস্ত সরল স্ট্রিম অফ কনশাসনেস।
‘ভুট্টা সিরিজ’ নিয়ে আলোচনা হয় কম। কারণ, এগুলো নাকি বিনয়ের মেজর কাজ নয়। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক মানে তো শুধুই ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’, ‘সুবর্ণরেখা’ অথবা ‘কোমলগান্ধার’ নয়, একটা ‘অযান্ত্রিক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ আর ওঁর তৈরি ছোটবড় প্রত্যেক তথ্যচিত্র, এমনকী ‘On the Cultural Front’ নামের মহার্ঘ্য থিসিস। তেমনই বিনয়ের বিবর্তনে ‘চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি’-ও উল্লেখ্য। এমনই এক সিরিজ যা সেক্সুয়ালিটিকে প্রতীকে বোঝায়। আর এই প্রতীক repetitive হয় না। কখনো ‘চাঁদ’ কিংবা ‘ফুল’ অর্থে ‘নারী’… ‘কলাগাছ’ অথবা ‘ভুট্টা’ মানে ‘শিশ্ন’, ‘ঘাস’ মানে ‘যোনিরোম’। ঠিক যেন ডায়েরির নগ্ন ও সুন্দর একেকটা এন্ট্রি। এই কবিতা বিনয়ের মেজর, সাব-মেজর অথবা মাইনর, যেরকম কাজই হোক তা বাংলা ভাষায় বিশিষ্ট, পূর্বাপরহীন।
৫
Falsifiability তত্ত্বের প্রস্তাবনায় কার্ল পপার লিখেছিলেন, যে-কোনো প্রকল্পকে বিজ্ঞানের সূত্র হয়ে উঠতে গেলে তাকে বাস্তব পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে একবার সত্য, আরেকবার মিথ্যা বলে প্রমাণিত হতে হবে।
উদাহরণ:
* সব মরুভূমিতে বালি থাকে না। তবে যত মরুভূমি দেখা যায়, সর্বত্র বালি।
* সব দাঁড়কাক কালো নয়। যদিও চারিদিকে যত দাঁড়কাক, সকলেই কালো।
আমার ধারণা, বিনয় মজুমদার সামান্য হলেও এই তত্ত্বের উপভোক্তা। ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ পরবর্তী তাঁর তুলনামূলক কম আলোচিত কবিতাগুলোর মধ্যে অদ্ভুত কিছু লক্ষণ দেখা যায়:
* গণিত ভাবার কালে কখনও সর্বনামকে দেখাই যায় না
* অশ্বিনী তারার লোকগুলির মাতৃভাষা বাংলা। পরনে সুন্দর
সুন্দর জামাকাপড়। অশ্বিনী তারার লোকগুলির সঙ্গে কথাবার্তা বলা যায়* রজনী যে বলেছিল ‘পৃথিবীর সব বই ভুল’ সেই
রজনীও দাঁড়িয়ে রয়েছে
আমার ধারণা বই ভুল নয় সব
এই তিন দৃষ্টান্তে বিনয় আগেকার মতোই দ্ব্যর্থহীন, চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছলেন। কিন্তু, পরীক্ষিত সত্য বলছেন না, যেমন বলেছিলেন ‘ফিরে এসো, চাকা’-র অধিকাংশে:
‘মুকুরে প্রতিফলিত সূর্যালোক স্বল্পকাল হাসে’
‘অতি অল্প পুস্তকেই ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে’
‘উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে তার এই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়’
পরিবর্তিত বিনয় অনেক বেশি ক্রূর। সুখপাঠ্য ভালো কবিতা লেখার মোহ থেকে বহুদূরে তিনি। তৎসম শব্দ কমিয়ে চলতি কথায় আপাত-সরল পয়ারে একের পর এক দ্বন্দ্ব রচনা করলেন। সারল্যের এই রস পেতে কিছু জটিলতা অবশ্যই প্রয়োজন।
৬
মানুষের অবচেতন তার ভাষা তৈরি করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাষাই আবার মানুষের অবচেতনকে নিয়ন্ত্রণ করে।
যে ঠাকুরনগরে জীবনের বেশিরভাগ সময় বিনয় কাটিয়েছেন তা আসলে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র সংস্করণ। ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, জলির পাড় সহ বাংলাদেশের সবক’টা এলাকার মানুষের বসবাস। ‘আজ দ্বিপ্রহরে আহারাদি সমাপন করিলাম’— এমন ভাষায় কথা বলা এই ডেমোগ্রাফের মানুষের ভাবনার অতীত। বরং ‘দুপুরের দিকে খিল তুলে পান্তাভাত খাইলাম।’ — এরকম বাক্য তার ভাবনায় স্বাভাবিক।
বিনয় এই স্বাভাবিকতার প্রতি সৎ। এই এলাকার মানুষ ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর সততা প্রশ্নাতীত। ঘনিষ্ঠ গ্রামবাসীদের কাছে বলা তাঁর কথা, কিংবা ডায়েরির অধিকাংশ লেখা এর জোরালো প্রমাণ। ‘নির্মাণের খসড়া’, ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থে তিনি তাঁর নিজের কবিতার পুরনো রীতি ভেঙেচুরে বেরিয়ে এসেছেন। পাঠকের কাছে এই বিনয়ও নিশ্চয়ই ধীরে ধীরে শিক্ষক হয়ে উঠবেন:
‘সমস্ত প্রশ্নের আগে চিন্তা আসে মাটি কে বানালো
পৃথিবীর মাটি?
মাটি তৈরি হয়ে গেলে তদুপরি জীব।’