Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

রানি জ্যোতিষ্মতী দেবের কবিতা

শরদাগমে।

বরষার শেষে ওই শরৎ আসিল।
অভিনব কি মাধুরী ধরণী ধরিল॥
সজল জলদজালে করি বিদূরিত।
ধরায় শরৎ ঋতু হল উপনীত॥
মেঘমালা নাহি আর গগনেতে ঘিরে।
জলধর মাঝে নাহি দামিনী বিচরে॥
ভীমরবে নাহি হয় অশনি পতিত।
করকা বরিষে নাহি হয় ঝঙ্কাবাত॥
প্রবল বারির স্রোতে নাহি ভাসে ধরা।
জলাশয়ে স্রোত নাহি বহে খরতরা॥
বহিতেছে মৃদু মৃদু সুমন্দ মলয়।
মৃদুল হিল্লোলে দোলে তরু লতাচয়॥
নির্ম্মল গগন মাঝে হাসে শশধর।
বিতরিয়া সুধাধারা ধরণী উপর॥
নীলাম্বর মাঝে ওই পাতিয়া আসন।
বিরাজিত রহিয়াছে রজনীরঞ্জন॥
ধবলবরণ শশী সুবিমল ভাতি।
উজলিয়া দশদিশি শরতের রাতি॥

করে সকলের প্রাণে পুলক সঞ্চার।
জ্যোৎস্না-পুলকিত নিশী ঢালে সুধাধার॥
শোভিতেছে তারামালা বিমল অম্বরে।
শারদ-গগনে ওই সুধাকরে ঘিরে॥
ভালবাসে সবে এই শরতের শশী।
ভালবাসে সকলেতে তারাগণ-হাসি॥
কুমুদিনী সুখে সরে রহে প্রস্ফুটিত।
শারদ-গগনে হেরি শশী সমাগত॥
লয়ে অতুলন রূপ শোভার ভাণ্ডার।
কাহার চরণে যেন দিবে উপহার॥
দিবাকর লুকাইয়া রহে মেঘজালে;
নাহি সে কালিমা আর প্রভাকর-ভালে॥
মেঘমুক্ত হইয়াছে শরতের রবি।
সে উজ্জ্বল প্রভাময় হেরি দীপ্ত ছবি।
আলোকিত দশদিক্‌ রবির কিরণে।
শরতেরে সমাগত হেরিয়া ভুবনে॥
সরোবরে সুখ ভরে হাসে সরোজিনী।
শরতের নীলাকাশে হেরি দিনমণি॥
লইয়া হৃদয়ভরা নব পরিমল।
পূজিবে কাহারে মনে বাসনা প্রবল।৷

হরষিত সবে এই শরৎ সময়।
হইয়াছে ধরাতল আনন্দিতময়॥
পথ ঘাট মাঠ কিবা নব দূর্ব্বাদলে।
আবরিত রহিয়াছে কিবা সুকৌশলে॥
পাতিয়া রেখেছে ধরা হরিৎ আসন।
সুশিল্পীর কারুকার্য্য করি প্রদর্শন॥
কাহারে বসিতে দিবে ভাবিয়া সে মনে।
বিছাইয়া রাখিয়াছে অতীব যতনে॥
ফুটিয়াছে নানা জাতি সুরভি কুসুম।
সুবাসেতে মোহে প্রাণ শোভা মনোরম॥
কাশ কুসুমের শোভা কাননে অতুল।
রক্ত জবা নাগেশ্বর পারুল বকুল॥
অতসি অপরাজিতা করবী সেফালি।
কুন্দ কুসুমের শোভা শিরীষ বান্ধুলি॥
গন্ধরাজ চাঁপা গ্যাঁদা ফুটে কৃষ্ণকলি।
দোপাটির পরিপাটি হেরি যে কেবলি॥
লয়ে এই সুরভিত কুসুমসম্ভার।
কাহার চরণে যেন দিবে উপহার॥
হাসিতেছে সকলেতে হরিষ অন্তরে।
হাসিছে প্রকৃতি সতী শরতেরে হেরে।৷

উৎসাহেতে রহে সবে উৎসুক হইয়া।
যেন কি বাঞ্ছিত দ্রব্য লভিবে বলিয়া॥
পূজিবারে যেন কোন অভীষ্ট দেবতা।
হইয়াছে সকলের প্রাণে একাগ্রতা॥
প্রফুল্লিত সকলেই শরৎ-শোভায়।
সৌন্দর্য্যের বাসভূমি যেন বসুধায়॥
হইয়াছে ধরাতল রম্য নিকেতন।
প্রকৃতির লীলাভূমি সুন্দর শোভন॥
হেরি এই অতুলন শোভা মনোরম।
বিষাদেতে ব্যাকুলিত এ হৃদয় মম॥
উঠিতেছে দিবানিশি প্রাণে হাহাকার।
নয়নেতে ঝরিতেছে বারি অনিবার।
বিষময় জ্ঞান হয় এ বিমল শোভা।
কিছুই আমার কাছে নহে মনোলোভা॥
এই দীপ্ত তেজোময় ভানুর কিরণ।
এই নব দূর্বাদল হরিৎ আসন।৷
নীলাম্বরে শোভা করে ওই তারামালা।
মাঝে মাঝে রহে তাহে বিজলীর খেলা॥
সুনীল গগন পটে শশধরে হেরি।
হৃদয়ের জ্বালা আর নিবারিতে নারি।৷

এই তরুলতারাজি এই নদী-জল।
মণ্ডিত হয়েছে রবিকিরণে সকল॥
ওই যে মনের সুখে পাখী করে গান।
অবিরত তটিনীতে উঠে কলতান॥
নিরানন্দ সুখহীন সকলি দেখায়।
দুঃখপূর্ণ হেরিতেছি সুখের ধরায়॥
হৃদয়েতে নাহি ফুটে হরষের ফুল।
সুখের উচ্ছ্বাসে মন না হয় আকুল॥
জীবনের কালমেঘ দূর নাহি হয়।
বিহনে সে হৃদয়ের আলো জ্যোতির্ম্ময়।
বিনা সেই প্রাণেশ্বর এ দেহের প্রাণ।
হৃদয় হয়েছে যেন অশান্তির স্থান॥
কোথা মম প্রাণনাথ কোথায় এখন।
কাঁদাইয়া অভাগীরে হয়ে বিস্মরণ॥
এস এস ওহে নাথ নিকটে আমার।
শরতের শোভা যত দিব উপহার॥
হৃদি-পদ্ম প্রদানিব তোমার চরণে।
প্রণয়-চন্দন তাহে মাখায়ে যতনে॥
মানস-কুসুম লয়ে দিব গাঁথি মালা।
বাসনার উপচারে সাজাইব ডালা।৷

সাজাইয়া দিব আমি সাধনার সাজি।
এসহে হৃদয়-নাথ হৃদয়েতে আজি॥
বিছাইয়া দিব প্রাণ হরিৎ আসন।
ফলে ফুলে সুশোভিত দিব রিপুগণ॥
হইবেক হৃদয়েতে প্রেমের ঝঙ্কার।
পাখীর কাকলি তাহা হবে প্রাণাধার॥
সুখের হিল্লোল প্রাণে বহিবে তখন।
শরতের শান্তিময় মৃদু সমীরণ॥
চিদম্বরে প্রেমচন্দ্র তুমি প্রেমময়।
প্রকৃতির শোভা তুমি সকল সময়॥
দিব জ্যোৎস্না ঢালি পদে প্রণয়ের ধারা।
প্রেমের কিরণে শোভা হবে মনোহরা॥
দিব তবে ঢালি পদে নয়নের নীর।
শরতের সুবিমল বারি তটিনীর॥
মেঘমুক্ত হবে মম এই হৃদাকাশ।
উজ্জ্বল রবির রূপে হইয়া প্রকাশ॥
এস এস হৃদয়েতে হৃদয়রাজন!
হৃদয়ের পূজা মম করহ গ্রহণ॥
এসহে হৃদয়সনে হৃদয়-দেবতা।
লহ হৃদয়ের পূজা লহ একাগ্রতা।৷

সর্ব্বদাই প্রকৃতির এ মন-ভবনে।
মিলিয়া আত্মায় মম, রয়েছ গোপনে॥
লইতেছ পূজা সদা সাদরে সম্ভাষি।
নিরিবিলি হৃদয়েতে রহি দিবানিশী॥
হে আরাধ্য দেব মম হৃদয়বল্লভ।
বাঞ্ছিত রতন তুমি মূর্ত্তিমান্ দেব॥
জীবনের অধীশ্বর হৃদয়ের রাজা।
আজীবন হৃদয়েতে করিব হে পূজা॥
পূজান্তেতে উপহার দিব এই প্রাণ।
জীবনান্তে দিও মোর তব পদে স্থান।৷

[কবিতাটি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘মালা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]

চিত্র: গুগল
Advertisement
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | প্রথম পর্ব

আমাদের খেলা করা দরকার, তাই আমাদের কয়েকজন ছেলে মিলে ক্লাব তৈরি করতে হবে। কোথায় করা যায়? — অমুক জায়গায় — ওই জায়গাটা পড়ে আছে, তা যাদের জায়গা তারা বললেন, “ওই তো ওখানে জঙ্গল হয়ে আছে, তা যদি তোমরা জঙ্গল-টঙ্গল পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে ক্লাব তৈরি করতে পার তো করো।” আমাদের আর পায় কে — আমরা মহাবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম সেই জঙ্গলে। উদ্ধার করলাম। উদ্ধার-টুদ্ধার করে এর বাড়ি থকে চারটে বাঁশ, ওর বাড়ি থেকে তিনটে হোগলা এভাবে যোগাড়-যন্ত্র করে-টরে একটা চালাঘর তৈরি করা হলো। সেই চালাঘরকেই বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে সেখানে আমাদের নতুন লাইব্রেরী তৈরি হলো। ক্লাবের নাম হলো ‘সেনহাটি অ্যাথলেটিক ক্লাব’।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

বাঘের হাত থেকে বাঁচতে বাঘেশ্বরীদেবীর পুজো! সেই থেকেই ‘বাগনান’!

ছোট্ট ওই ভূখণ্ডটি বাঘের উপস্থিতির জন্যই তখন ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয় বলে প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক তারাপদ সাঁতরার অভিমত। এই বিষয়ে তিনি আরও জানান, আরবি ভাষা অনুযায়ী ‘নান’ কথার অর্থ হল ‘চরভূমি’। ‘নান’ শব্দের আরও একটি অর্থ হল ‘ছাউনি’। তখন কাছারিপাড়া ছাড়াও নদী সংলগ্ন বেশ কয়েকটি এলাকায় ইংরেজ সেনাদের ছাউনি ছিল বলে জানা যায়। যার মধ্যে খাদিনান, পাতিনান, খাজুরনান, বাইনান, চিৎনান, মাছিনান ইত্যাদি জনপদগুলি উল্লেখযোগ্য। যেহেতু নদীর চরে বাঘেশ্বরী দেবীর পুজো হত, সেই জন্য প্রাথমিকভাবে এলাকাটি ‘বাঘনান’ নামে পরিচিত হয়। পরবর্তীকালে ‘বাঘনান’ অপভ্রংশ হয়ে ‘বাগনান’-এ পরিণত হয়েছে।

Read More »
আবদুল্লাহ আল আমিন

কবিগান: সমাজবাস্তবতা, বিষয়বৈভব ও রূপবৈচিত্র্য

এমন লোকপ্রিয় বিষয় বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই। বাংলা ভাষা, সঙ্গীত ও সাহিত্যে কবিগান ও কবিয়ালদের অবদানের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিগান সংগ্রহ এবং এ বিষয় পাঠ্যতালিকাভুক্ত করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে কবিয়ালদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান কিংবা কবিগানকে সংরক্ষণে কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আলোচ্য গ্রন্থের লেখক এ গানকে সংরক্ষণ করার সুপারিশ করেছেন। কারণ তিনি মনে করেন, এই গানের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে লোকায়ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা দিক যার অধিকাংশই অনালোচিত ও অনালোকিত রয়েছে অদ্যাবধি।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

মহাত্মা অশ্বিনীকুমার: মৃত্যুঞ্জয়ী প্রতিভা

সর্বভারতীয় রাজনীতির সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন জড়িয়ে ছিলেন, এবং জাতীয় কংগ্রেসে নিয়মিত যোগ দিতেন। কংগ্রেসের আবেদন-নিবেদনের রাজনৈতিক কার্যক্রম দেখে সিপাহী বিদ্রোহের পূর্ববর্তী বছরের জাতক এবং প্রখর প্রজ্ঞাবান অশ্বিনীকুমার ১৮৯৭-এর কংগ্রেসের অমরাবতী অধিবেশনে দৃঢ়তার সঙ্গে একে ‘Threedays’ mockery’,— ‘তিনদিনের তামাশা’ বলে উল্লেখ করেন। দুর্ভাগ্য দেশের, তাঁর কথা অনুধাবন করলেও কেউ গুরুত্ব দেননি। সে-অধিবেশনের সভাপতি চেট্টুর শঙ্করণ নায়ারকে নিয়ে অক্ষয়কুমার-অনন্যা পাণ্ডে অভিনীত বায়োপিক তৈরি হয়েছে। অথচ সারা উপমহাদেশ-কাঁপানো অশ্বিনীকুমারের মূল্যায়ন আজ-ও অপেক্ষিত।

Read More »
দীপক সাহা

বন্দুকের মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে লেন্সবন্দি করেছেন সাইদা খানম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপমহাদেশের বিখ্যাত প্রায় সকল ব্যক্তিত্ব— ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, ইন্দিরা গান্ধী, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী, বেগম সুফিয়া কামাল, মৈত্রেয়ী দেবী, মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আশাপূর্ণা দেবী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়— কার ছবি তোলেননি! সেই সঙ্গে রানি এলিজাবেথ, মাদার টেরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্নের মতো বিখ্যাত মানুষদের ছবিও তুলেছেন। এই বিশাল তালিকায় আরও তিনটি নাম যুক্ত করে না দিলে অন্যায় হবে। চন্দ্রবিজয়ী নিল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন তিনি।

Read More »
সন্দীপ মজুমদার

মামলায় জয়ী হয়ে থোড় কুঁচি দিয়ে কালীর আরাধনা করেন জমিদার-গিন্নি

দেবী কালিকার খড়ের মেড় দেখে মজুমদার গিন্নি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন, মামলার রায় যদি তাঁদের পক্ষে যায় তাহলে কলাগাছের থোড় কুঁচো দিয়ে হলেও জগজ্জননী মা মহাকালীর পুজো করা হবে, আর যদি মামলার রায় তাঁদের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে ওই খড়ের মেড় দামোদরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। যদিও সেদিন দুপুরের মধ্যেই আদালত থেকে মজুমদার জমিদার পক্ষের জয়লাভের খবর পৌঁছেছিল থলিয়ার মজুমদার বাড়িতে। মজুমদার-গিন্নিও অক্ষরে অক্ষরে তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। মামলায় জয়লাভের খবর পাওয়া মাত্রই জমিদার-গিন্নির নির্দেশে প্রায় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দীপাবলি উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে যায়।

Read More »