শরদাগমে।
বরষার শেষে ওই শরৎ আসিল।
অভিনব কি মাধুরী ধরণী ধরিল॥
সজল জলদজালে করি বিদূরিত।
ধরায় শরৎ ঋতু হল উপনীত॥
মেঘমালা নাহি আর গগনেতে ঘিরে।
জলধর মাঝে নাহি দামিনী বিচরে॥
ভীমরবে নাহি হয় অশনি পতিত।
করকা বরিষে নাহি হয় ঝঙ্কাবাত॥
প্রবল বারির স্রোতে নাহি ভাসে ধরা।
জলাশয়ে স্রোত নাহি বহে খরতরা॥
বহিতেছে মৃদু মৃদু সুমন্দ মলয়।
মৃদুল হিল্লোলে দোলে তরু লতাচয়॥
নির্ম্মল গগন মাঝে হাসে শশধর।
বিতরিয়া সুধাধারা ধরণী উপর॥
নীলাম্বর মাঝে ওই পাতিয়া আসন।
বিরাজিত রহিয়াছে রজনীরঞ্জন॥
ধবলবরণ শশী সুবিমল ভাতি।
উজলিয়া দশদিশি শরতের রাতি॥
করে সকলের প্রাণে পুলক সঞ্চার।
জ্যোৎস্না-পুলকিত নিশী ঢালে সুধাধার॥
শোভিতেছে তারামালা বিমল অম্বরে।
শারদ-গগনে ওই সুধাকরে ঘিরে॥
ভালবাসে সবে এই শরতের শশী।
ভালবাসে সকলেতে তারাগণ-হাসি॥
কুমুদিনী সুখে সরে রহে প্রস্ফুটিত।
শারদ-গগনে হেরি শশী সমাগত॥
লয়ে অতুলন রূপ শোভার ভাণ্ডার।
কাহার চরণে যেন দিবে উপহার॥
দিবাকর লুকাইয়া রহে মেঘজালে;
নাহি সে কালিমা আর প্রভাকর-ভালে॥
মেঘমুক্ত হইয়াছে শরতের রবি।
সে উজ্জ্বল প্রভাময় হেরি দীপ্ত ছবি।
আলোকিত দশদিক্ রবির কিরণে।
শরতেরে সমাগত হেরিয়া ভুবনে॥
সরোবরে সুখ ভরে হাসে সরোজিনী।
শরতের নীলাকাশে হেরি দিনমণি॥
লইয়া হৃদয়ভরা নব পরিমল।
পূজিবে কাহারে মনে বাসনা প্রবল।৷
হরষিত সবে এই শরৎ সময়।
হইয়াছে ধরাতল আনন্দিতময়॥
পথ ঘাট মাঠ কিবা নব দূর্ব্বাদলে।
আবরিত রহিয়াছে কিবা সুকৌশলে॥
পাতিয়া রেখেছে ধরা হরিৎ আসন।
সুশিল্পীর কারুকার্য্য করি প্রদর্শন॥
কাহারে বসিতে দিবে ভাবিয়া সে মনে।
বিছাইয়া রাখিয়াছে অতীব যতনে॥
ফুটিয়াছে নানা জাতি সুরভি কুসুম।
সুবাসেতে মোহে প্রাণ শোভা মনোরম॥
কাশ কুসুমের শোভা কাননে অতুল।
রক্ত জবা নাগেশ্বর পারুল বকুল॥
অতসি অপরাজিতা করবী সেফালি।
কুন্দ কুসুমের শোভা শিরীষ বান্ধুলি॥
গন্ধরাজ চাঁপা গ্যাঁদা ফুটে কৃষ্ণকলি।
দোপাটির পরিপাটি হেরি যে কেবলি॥
লয়ে এই সুরভিত কুসুমসম্ভার।
কাহার চরণে যেন দিবে উপহার॥
হাসিতেছে সকলেতে হরিষ অন্তরে।
হাসিছে প্রকৃতি সতী শরতেরে হেরে।৷
উৎসাহেতে রহে সবে উৎসুক হইয়া।
যেন কি বাঞ্ছিত দ্রব্য লভিবে বলিয়া॥
পূজিবারে যেন কোন অভীষ্ট দেবতা।
হইয়াছে সকলের প্রাণে একাগ্রতা॥
প্রফুল্লিত সকলেই শরৎ-শোভায়।
সৌন্দর্য্যের বাসভূমি যেন বসুধায়॥
হইয়াছে ধরাতল রম্য নিকেতন।
প্রকৃতির লীলাভূমি সুন্দর শোভন॥
হেরি এই অতুলন শোভা মনোরম।
বিষাদেতে ব্যাকুলিত এ হৃদয় মম॥
উঠিতেছে দিবানিশি প্রাণে হাহাকার।
নয়নেতে ঝরিতেছে বারি অনিবার।
বিষময় জ্ঞান হয় এ বিমল শোভা।
কিছুই আমার কাছে নহে মনোলোভা॥
এই দীপ্ত তেজোময় ভানুর কিরণ।
এই নব দূর্বাদল হরিৎ আসন।৷
নীলাম্বরে শোভা করে ওই তারামালা।
মাঝে মাঝে রহে তাহে বিজলীর খেলা॥
সুনীল গগন পটে শশধরে হেরি।
হৃদয়ের জ্বালা আর নিবারিতে নারি।৷
এই তরুলতারাজি এই নদী-জল।
মণ্ডিত হয়েছে রবিকিরণে সকল॥
ওই যে মনের সুখে পাখী করে গান।
অবিরত তটিনীতে উঠে কলতান॥
নিরানন্দ সুখহীন সকলি দেখায়।
দুঃখপূর্ণ হেরিতেছি সুখের ধরায়॥
হৃদয়েতে নাহি ফুটে হরষের ফুল।
সুখের উচ্ছ্বাসে মন না হয় আকুল॥
জীবনের কালমেঘ দূর নাহি হয়।
বিহনে সে হৃদয়ের আলো জ্যোতির্ম্ময়।
বিনা সেই প্রাণেশ্বর এ দেহের প্রাণ।
হৃদয় হয়েছে যেন অশান্তির স্থান॥
কোথা মম প্রাণনাথ কোথায় এখন।
কাঁদাইয়া অভাগীরে হয়ে বিস্মরণ॥
এস এস ওহে নাথ নিকটে আমার।
শরতের শোভা যত দিব উপহার॥
হৃদি-পদ্ম প্রদানিব তোমার চরণে।
প্রণয়-চন্দন তাহে মাখায়ে যতনে॥
মানস-কুসুম লয়ে দিব গাঁথি মালা।
বাসনার উপচারে সাজাইব ডালা।৷
সাজাইয়া দিব আমি সাধনার সাজি।
এসহে হৃদয়-নাথ হৃদয়েতে আজি॥
বিছাইয়া দিব প্রাণ হরিৎ আসন।
ফলে ফুলে সুশোভিত দিব রিপুগণ॥
হইবেক হৃদয়েতে প্রেমের ঝঙ্কার।
পাখীর কাকলি তাহা হবে প্রাণাধার॥
সুখের হিল্লোল প্রাণে বহিবে তখন।
শরতের শান্তিময় মৃদু সমীরণ॥
চিদম্বরে প্রেমচন্দ্র তুমি প্রেমময়।
প্রকৃতির শোভা তুমি সকল সময়॥
দিব জ্যোৎস্না ঢালি পদে প্রণয়ের ধারা।
প্রেমের কিরণে শোভা হবে মনোহরা॥
দিব তবে ঢালি পদে নয়নের নীর।
শরতের সুবিমল বারি তটিনীর॥
মেঘমুক্ত হবে মম এই হৃদাকাশ।
উজ্জ্বল রবির রূপে হইয়া প্রকাশ॥
এস এস হৃদয়েতে হৃদয়রাজন!
হৃদয়ের পূজা মম করহ গ্রহণ॥
এসহে হৃদয়সনে হৃদয়-দেবতা।
লহ হৃদয়ের পূজা লহ একাগ্রতা।৷
সর্ব্বদাই প্রকৃতির এ মন-ভবনে।
মিলিয়া আত্মায় মম, রয়েছ গোপনে॥
লইতেছ পূজা সদা সাদরে সম্ভাষি।
নিরিবিলি হৃদয়েতে রহি দিবানিশী॥
হে আরাধ্য দেব মম হৃদয়বল্লভ।
বাঞ্ছিত রতন তুমি মূর্ত্তিমান্ দেব॥
জীবনের অধীশ্বর হৃদয়ের রাজা।
আজীবন হৃদয়েতে করিব হে পূজা॥
পূজান্তেতে উপহার দিব এই প্রাণ।
জীবনান্তে দিও মোর তব পদে স্থান।৷
[কবিতাটি ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘মালা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া।]