মধ্যযুগের অধিকাংশ রাষ্ট্রই ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যেখানে ধর্মের ঐশীবাণী কিংবা প্রত্যাদেশের আলোকে সবকিছু ব্যাখ্যা করা হত। পুরোহিত ও যাজকরাই ছিলেন সর্বেসর্বা। কোনও তত্ত্ব বা যুক্তির ধার ধারত না তারা। কিন্তু হাল আমলে রাষ্ট্র মানে মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান। কারণ অসাম্প্রদায়িক আদর্শ ছাড়া কোনও রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারে না। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির জনগণের মধ্যে একাত্মতা প্রতিষ্ঠা-ই এর মূল লক্ষ্য। তাই গণতন্ত্রের সংগ্রামে ধর্মপ্রাণ-সহনশীল মানুষের সমাগম থাকতে পারে, কিন্তু ধর্মব্যবসায়ী মতলববাজদের কখনওই সেখানে ঠাঁই নেই। ধর্মব্যবসায়ীরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ পছন্দ করে না। মওলানা আবুল কালাম আজাদ, আবুল হাশিম, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীরা ধার্মিক ছিলেন। কিন্তু বৃহত্তর জনগণের কল্যাণে তাঁরা প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজে বিশ্বাস করতেন। আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু মনন-চিন্তনে, কর্মে-জীবনচর্যায় ছিলেন ধর্মসহিষ্ণু ও অসাম্প্রদায়িক। যে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয়গান তিনি গেয়েছেন, সেখানেও ধর্মনিরপেক্ষতা নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে তিনি হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আদিবাসী-সহ জাতিধর্ম নির্বিশেষে সমগ্র বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির কথা বলে গেছেন। মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত এই জননেতা সারাজীবন সকল ধরনের ভেদবুদ্ধি ও সংকীর্ণতা রুখে দাঁড়াতে চেয়েছেন প্রবলভাবে। তিনি এমন এক মানবদরদি, হৃদয়বান বাঙালি ছিলেন, যিনি একজন বাঙালিকেও অবিশ্বাস করেননি, একজন বাঙালিকেও শত্রু জ্ঞান করেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’— বঙ্গবন্ধু এই আপ্তবাক্য আমৃত্যু অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন।
দুই
যে ব্যক্তি নিজ ধর্মের প্রতি আস্থাশীল এবং বিবেকবান, তিনি স্বভাবতই উদার, পরমতসহিষ্ণু ও অসাম্প্রদায়িক হন। ভারতীয় লেখক-সাংবাদিক সাবা নাকভির লেখা ‘ইন গুড ফেইথ’ পড়ে সেই বার্তাটিই পাওয়া গেল। সাবা নাকভি লিখেছেন, ‘বিমান ভট্টাচার্য কালীঘাটের এক পূজারী ব্রাহ্মণ, যিনি কালীমায়ের পূজার পাশাপাশি তপসিয়ায় মানিকপিরের মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে যান প্রতিদিন। আর এই কাজটি তিনি একই ভক্তিতে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে করে চলেছেন।’ ভাবতে অবাক লাগে, যেখানে উপমহাদেশ জুড়ে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যেখানে এক ধর্ম অপর ধর্মকে প্রবল প্রতিপক্ষ মনে করে, সেখানে একজন পূজারী ব্রাহ্মণ এই স্পিরিটটা পেলেন কোথায়? বিমান ভট্টাচার্যের এই বহুমুখী আধ্যাত্মিক ও মানবিক সত্তার উৎস-ই বা কোথায়? তাঁর অধ্যাত্মচর্চার কি কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে? অবশ্যই আছে। তবে হ্যাঁ, বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ ধরনের ধর্মীয় আচার-আচরণ করা সহজসাধ্য নয়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় যে, বাঙালি ও ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের গভীরে এই সমন্বয়বাদিতা, এই সহমর্মিতার অবস্থান রয়েছে সুপ্রাচীন কাল থেকে। ভারতীয় সমাজে আবহমান কাল থেকে পরস্পরবিরোধী মত ও ভাবনা পাশাপাশি অবস্থান করেছে। কোনও একটি মতের হেজিমনি নিয়ে ভারতীয় সমাজ বেঁচে নেই। সব ক্ষেত্রেই নানা মত-পথকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলেও দেখা যায় যে, বৈদিক সাহিত্যের অবস্থান ছিল মানবিকতা, সমন্বয়বাদিতা ও সামাজিক ন্যায্যতার পক্ষে। সম্প্রতি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জন স্ট্রাটন হাউলে তাঁর ‘আ স্টর্ম অব সংস: ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য আইডিয়া অব দ্য ভক্তি মুভমেন্ট’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে ধর্মীয় সমন্বয়বাদের ঐতিহ্য ছিল এবং আজ পর্যন্ত সেটি বহমান রয়েছে। মধ্যযুগের বাঙালি কবি বড়ু চণ্ডীদাস উচ্চারণ করেছিলেন ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। এজন্যই বোধ হয়, ভারতীয় লেখিকা নয়নতারা সেহগাল বলতে পেরেছেন, ‘উত্তর ভারতের মানুষ হিসেবে আমি সংস্কৃতিগতভাবে নিজেকে আধা মুসলমান মনে করি’। সেহগাল আরও বলেন, “অভিনেতা ও পতৌদি নবাবের ছেলে সাইফ আলী খান বলেছেন, ‘আমাদের এই মহান দেশ আসলে সংকর, আমাদের ভিন্নতাই আসলে আমাদের এমনটা বানিয়েছে। আমি গির্জায় প্রার্থনা করেছি, আবার আমার স্ত্রী কারিনার সঙ্গে মন্দিরে গিয়েছি। কারিনাও দরগা গিয়ে মাথা নত করেছে, মসজিদে নামাজ পড়েছে। আমরা যখন বাড়ি পরিশুদ্ধ করেছি, তখন হবন আয়োজন করেছি, পবিত্র কোরআন পাঠের আয়োজন করেছি। আর একজন পুরোহিত পবিত্র জল ছিটিয়েছেন। আসলে ভারত যেন নানা সুতোয় বোনা এক কাপড়ের মতো’।” (নয়নতারা সেহগাল, ‘মানুষের ঐক্য ও বাকস্বাধীনতার লড়াই’, প্রথম আলো, ৪ ডিসেম্বর ২০১৫।)
মোগল আমলে শাজাহান-পুত্র দারাশিকোর বেদচর্চা ও উপনিষদের অনুবাদকর্ম, সম্রাট অশোক থেকে আকবরের রাষ্ট্রনীতির মধ্যেও আমরা অসাম্প্রদায়িক মানবিকতা ও সমন্বয়বাদিতার বার্তাটিই খুঁজে পাই।
তিন
মোগল আমলের ভারতবর্ষ যে উদার ও অসাম্প্রদায়িক ছিল তার প্রমাণ মিলেছে সম্রাট শাজাহান-কন্যা জাহানারা রচিত আত্মজীবনী থেকে। অন্তঃপুরবাসিনী এই রাজনন্দিনী নিভৃতে আত্মজীবনী লিখতেন। পরবর্তীকালে এই আত্মজীবনী এক দুর্গের ভগ্নস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়। জাহানারার আত্মজীবনী পড়ে স্পষ্টতই জানা গেল যে, সম্রাট আকবর মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তিনি সম্রাট অশোকের সমন্বয়বাদী নীতি অনুসরণ করতেন। দ্বীন ই-ইলাহি প্রতিষ্ঠাকালেও তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা উচ্চারণ করেছেন বারবার। মুহূর্তের জন্য অমুসলমান সম্প্রদায় বিশেষত, হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিস্মৃত হননি। শাহজাহান-কন্যা জাহানারার আত্মজীবনী থেকে আরও জানা যায় যে, আকবরের জীবনচর্যা ও ধর্মচর্চায় ছিল ইসলামি সুফিবাদের প্রবল উপস্থিতি। তাঁর সমকালে ইসলামের যে-ধারাটি বিকশিত ও প্রসারিত হয় সেটি ছিল সর্বতোভাবে উদার ও মানবিক ধারা। আকবরের আমলে ভারতের জনজীবন ও রাষ্ট্রনীতি ছিল ধর্মীয় সম্প্রীতির আলোয় উদ্ভাসিত। মোগল রাজবংশের এই দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী সম্রাট ছিলেন বহু গুণের অধিকারী এক বিরলপ্রজ ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন একাধারে প্রজাহিতৈষী, স্থিরপ্রাজ্ঞ, পরমতসহিষ্ণু, দয়ালু ও শিল্প-সাহিত্যানুরাগী। অন্যের মন জয় করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। খুব সম্ভবত, এসব কারণে বিশাল ভারতবর্ষকে এক সুতোয় গেঁথে একটি একক রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। রাজপুত জমিদাররা অন্য সম্রাটদের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করলেও সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বিধি-বিধান ও আদেশ-নিষেধ মেনে নিয়েছিলেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সম্রাট আকবর রাজপুতদের সঙ্গে সখ্য-সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য রাজপুতকন্যা যোধাবাঈ-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। আকবর-পুত্র জাহাঙ্গীরের ধমনীতে যেমন মুসলমান-মোগল রক্তপ্রবাহ ছিল এবং তেমনই ছিল হিন্দু-রাজপুত রক্ত। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী অর্থাৎ শাহজাহানের মাতাও ছিলেন রাজপুত-কন্যা। রাজপুতরা সম্রাট আকবরের অনুগত ও গুণগ্রাহী ছিলেন। আকবর রাজপুতদের আপনজন মনে করে সমীহ করতেন, তেমনই রাজপুতরাও সম্রাটের সঙ্গে সখ্য-সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। মোগল ও রাজপুতদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এক নিবিড় সখ্য-সম্পর্ক। এর ফলে ভারতবর্ষে বইতে থাকে সম্প্রীতির হাওয়া, সুদৃঢ় হয় রাজনৈতিক সংহতি। এর প্রভাব শাসনকার্য পরিচালনা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, জীবনচর্যা, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় পড়তে থাকে। ক্রমাগতভাবে মোগলরা ভারতীয় হয়ে ওঠেন, মোগলদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে রাজপুতরাও পারস্য সংস্কৃতির অনেক কিছুই আত্তীকরণ করে নেন। রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চস্তর থেকে নিম্নস্তর পর্যন্ত সর্বত্র উদার ও সহনশীল চিন্তা-ভাবনার বিস্তার ঘটে। জওহরলাল নেহরু তাঁর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, তাঁর (আকবর) রাজসভা সকল ধর্মের লোকের, এবং যারাই নতুন মতপ্রচার করেছেন কিংবা নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছেন, তাদের মিলনের স্থান হয়ে উঠেছিল।’ তাঁর রাজসভায় আবুল ফজল, আবদুর রহিমের মতো মুসলিম বিদগ্ধজনেরা যেমন ছিলেন, তেমনি বীরবল, রাজা মানসিংহরাও ছিলেন। তিনি সকল ধর্মমতের জন্য এতই উদার ছিলেন যে, গোঁড়া মুসলমানরা তাঁকে সহ্য করতে পারত না। সবার সহযোগিতা নিয়ে তিনি একটি শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ ভারত নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সম্ভবত রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনৈতিক প্রয়োজনে, সব মানুষের জন্য গ্রাহ্য একটা ধর্মমত প্রবর্তনের করার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন সারাজীবন। কিন্তু এই ধর্মমত অন্যের ওপর জোর করে চাপাতে চাননি কখনওই। তাঁর রাজত্বকালে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক নিবিড় হওয়ায় পরস্পরের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান বৃদ্ধি পায়।
মোগলদের অসাম্প্রদায়িক ও সহনশীল ঐতিহ্য সমৃদ্ধ করতে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে সম্রাট শাহজাহান-পুত্র দারাশিকো অন্যতম। উপনিষদের সারমর্ম অবলম্বনে তিনি রচনা করেন ‘সর ই-আসবারে’। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বসে শাহজাহান-কন্যা জাহানারা যে আত্মকথা রচনা করেন, তাকে অসাম্প্রদায়িক ভাবনার মূল্যবান দলিল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এ কালের রাষ্ট্রচিন্তক ও ভাবুকরা।
চার
বলতে দ্বিধা নেই, মোগল আমলে হিন্দু মন্দির ধ্বংস এবং হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু হিন্দু নির্যাতনের সেই হিংসাশ্রয়ী ইতিহাস তর্পণ করে একুশ শতকের তৃতীয় দশকে মুসলমানদের ওপর নির্যাতন করা কি ন্যায়ানুগ হবে? নাগরিকপঞ্জির নামে অসমীয় মুসলমানদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত হচ্ছে? কোনও বিবেকবান হিন্দু এটি সমর্থন করবেন না, করতে পারেন না। যে-ধর্ম এক যুবককে ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলার নির্দেশ দেয়, সেটা কি সনাতন ধর্ম? নাকি ‘রাজনৈতিক হিন্দুত্ব’? ক’দিন আগে, রন্তিদেব সেনগুপ্তের লেখা এক প্রবন্ধ থেকে জানলাম যে, ১৯২৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর দিল্লিতে নিজ বাসভবনে আব্দুর রশিদ নামের এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন আর্য সমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দ। এই হত্যাকাণ্ডের কি সমর্থন করা যায়? না, কখনওই নয়। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের প্রতি তীব্র ঘৃণা জানিয়েই বলছি, গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পিছনে যারা হিন্দু মৌলবাদীদের সম্পৃক্ততা খুঁজে বেড়ান, তারা কিন্তু স্বামী শ্রদ্ধানন্দের হত্যাকাণ্ডের বিরূদ্ধে কোনওকালেই প্রতিবাদ করেননি। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ‘স্বামী শ্রদ্ধানন্দ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ রচনা করেন। ‘প্রবাসী’-র মাঘ ১৩৩৩ সংখ্যায় প্রকাশিত এই নিবন্ধে তিনি লেখেন, ‘যদি মুসলমান মারে আর আমরা পড়ে পড়ে মার খাই, তবে জানবো এ সম্ভব করেছে শুধু আমাদের দুর্বলতা।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবৎকালে কোনও ধরনের ভীরুতা কিংবা ধর্মান্ধতা সমর্থন করেননি। অথচ আজ ধর্মের নামে উগ্রতা সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ ১৯৪৬-এর কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি উসকিয়ে দিতে ‘সিংহবাহিনী’ গঠন করেছে। নতুন করে স্মরণ করা হচ্ছে ১৯৪৬-এর হিন্দু রক্ষাকর্তা যোগেশ মুখার্জিকে। এতে উপমহাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়ছে, বাড়ছে হিংসা-হানাহানির সম্ভাবনাও। তরুণ সমাজ বিভ্রান্ত হয়ে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঝুঁকছে। আইনি সুরক্ষা না থাকায় বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমছে। ১৯৪১ সালের সেনসাস অনুযায়ী, পূর্ববাংলায় হিন্দুর সংখ্যা ছিল ২৯ শতাংশ। এখন তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ শতাংশে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের আগে ঢাকা শহরে শতকরা ৭০ শতাংশ হিন্দু অর্থাৎ ২ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে ১ লক্ষ ৪০ হাজার-ই হিন্দু ছিল। এখন ঢাকার স্থানীয় হিন্দুরা নেই বললেই চলে। বৃহত্তর খুলনা ও ফরিদপুর জেলার মতুয়াদেরও দেশ ছাড়তে হয়েছে। প্রথমে তারা টিকে থাকার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কারণে জমিজমা হারিয়ে দেশ ছেড়েছেন বাধ্য হয়ে। ইসলাম ধর্মের মধ্যে আহমাদিয়া সম্প্রদায়ের মতো ক্ষুদ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী রয়েছে। এরা অনেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সংখ্যালঘুদের সংশয়, সন্দেহ ও নিরাপত্তহীনতা দূর করতে হবে। নইলে, সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে না।
সাম্প্রতিককালে পুরো উপমহাদেশ জুড়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। কেবল উপমহাদেশ নয়, সারা বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের নাম ধর্মীয় সন্ত্রাস তথা জঙ্গিবাদ। ধর্মের উদ্দেশ্য যদি মানবকল্যাণ হয়, তাহলে একে ঘিরে এত হানাহানি, এত রক্তপাত কেন? হোসেনি দালানে বোমা হামলা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে শিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী-সহ বিভিন্ন চার্চের যাজক, হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের পুরোহিতদের। পূজা এলেই প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়, হামলা চালানো হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের আশ্রম ও মন্দিরে। এসব ঘটনা রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ায়, অস্থিরতা বাড়ায়। বিভেদ-বিভ্রান্তির রেখাটি গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। তবে এসব ঘৃণ্য অপতৎপরতার জন্য কোনও বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়কে দায়ী করা যায় না। এ পরিস্থিতিতে ইসলাম ও মুসলিম-মৌলবাদকে যেমন গুলিয়ে ফেলা যেমন ঠিক হবে না, তেমনই হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে একাকার করে দেখাও ইতিহাসসম্মত হবে না। নির্মোহ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে রাজনীতি, ধর্ম ও ইতিহাসের বিশ্লেষণ করতে হবে। নইলে ইতিহাস ও রাজনীতির অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি জাতিগত দাঙ্গা ও ধর্মীয় উগ্রবাদ উসকিয়ে দেবে, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও বিভাজনের ক্ষতটাকে আরও দগদগে করে তুলবে।
পাঁচ
মার্কসবাদী তাত্ত্বিক ও লেখক রাহুল সাংকৃত্যায়ন তাঁর ‘আকবর’ নামক গ্রন্থে ইতিহাসের নির্মোহ বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, অশোকের পর আমাদের দেশে দ্বিতীয় মহান ধ্রুবতারা আকবর। অশোকের মতো আকবর ছিলেন সকল ধর্মের প্রতি উদার ও শ্রদ্ধাশীল। এই সম্রাট ছিলেন প্রবলভাবেই আস্তিক, তিনি মোটেই নাস্তিক ছিলেন না। তিনি বিশ্বের সব ধর্মকে সত্য ও মহৎ বলে জানতেন। ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি তাঁর মনস্তত্ত্ব ও জীবনচর্যায় ঠাঁই পায়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, আকবরের এই রাষ্ট্রভাবনা ও আধ্যাত্মিকতা থেকেই ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি রচিত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের প্রেরণাও আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির বুনিয়াদ অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন ও ভাবুকতা সব সময় ধর্মান্ধতা-গোঁড়ামি-সংকীর্ণতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে। আজ উপমহাদেশ জুড়ে এই প্রশ্নই বারবার উচ্চারিত হচ্ছে যে, কোন দর্শনের আলোকে আমরা চলব? অশোক-আকবরের প্রদর্শিত অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার পথে, না কি উগ্র ধর্মান্ধতার পুতিগন্ধ সর্বাঙ্গে লেপটে নিয়ে অন্ধকারের পথে? সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে একসাথে চলব, না কি বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একা চলব? আজ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান-সহ গোটা বিশ্বের মানবসমাজ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি, তাই আজকের এই সমস্যাদীর্ণ পরিস্থিতিতে সম্রাট শাহজাহান-কন্যা জাহানারার গ্রন্থটি আলোকবর্তিকাস্বরূপ। গ্রন্থটি সাম্প্রদায়িক সংকট মোচনে সাহায্য করবে। পথ দেখাবে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ভারতবর্ষের রাজনৈতিক সংহতি, স্থিতিশীলতার জন্য বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের বর্তমান শাসকদেরও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নেহরুর দেখানো বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার পথে হাঁটতে হবে। ভারতের অধুনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অবশ্য ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ সব কা বিশ্বাস’-এর ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশকেও অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিকতার পথে-ই চলতে হবে। প্রতিবেশীর সঙ্গে বিবাদ-বিরোধ জিইয়ে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক বিভাজনমূলক, অযৌক্তিক ধর্মাশ্রয়ী অপরাজনীতি পরিত্যাগ করে উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক দর্শনের ভিত্তিতে যে-দেশের অভ্যুদয়, সে দেশ কেন সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের অন্ধগলির দিকে পা বাড়াবে? আর কেনই বা পাকিস্তানিদের বিষমাখানো রাজনৈতিক সংস্কৃতি গ্রহণ করে ভ্রান্ত পথে চালিত হবে? পাকিস্তানিরা তো স্পর্শকাতর ধর্মভিত্তিক আবেগ ব্যবহার করে দু’যুগ আমাদের হীনম্মন্য করে রেখেছিল। তাদের দর্শন ও সাংস্কৃতিক আদর্শ নির্মিত হয়েছিল কেবল ভারতবিরোধী প্রত্যয় থেকে। পাকিস্তানের গণবিচ্ছিন্ন শাসক ও তাদের তল্পিবাহকরা দেশ ও জাতির জন্য এমন এক দর্শন ও সাংস্কৃতিক পরিচয় দাঁড় করাতে চেয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল কেবল বিদ্বেষ ও বৈরিতা। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশ এমন দর্শনহীন ঋণাত্মক আদর্শের পথে পা বাড়াবে না। অসাম্প্রদায়িকতা, মানবিকতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ কোনও অশুভ শক্তির সঙ্গে আপস করবে না। ১৯৪৭ সালের আগে ও পরে ধর্মের নামে কম সংঘাত হয়নি, আর এ সব সংঘাতের জন্য কেবল ইংরেজদের ভেদনীতি কিংবা জিন্নাহ’র দ্বিজাতিতত্ত্বকে দায়ী করে বসে থাকলে চলবে না, এর মূল কারণ বের করতে হবে। প্রাক-ব্রিটিশ যুগেও সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মানবিক ঐক্যতানের পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমান বিরোধ ছিল। আসলে, এসব সংঘাতের জন্য আমাদের জেদ, অহমিকা, পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অন্ধত্ব-ই দায়ী। ঐতিহাসিক ও রাজনীতি-বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বীজ আমাদের সমাজ ও রাজনীতির ভেতরেই নিহিত আছে। ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানিদের অপরাজনীতি কেবল তা উসকিয়ে দিয়েছিল। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, এদেশের অধিকাংশ মুসলমান এই ভূখণ্ডের সন্তান, তারা বহিরাগত নন, তারা হিন্দু বা অন্য ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত মুসলমান। ‘জিন্নার ঠাকুরদা হিন্দু ছিলেন, বেনজির ভুট্টোর পূর্বপুরুষ রাজপুত ছিলেন, ফারুক আবদুল্লা আসলে রঘুরাম কাউলের বংশধর।’ (দেশ, ১৭ আগস্ট ২০১৯) কাজেই শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এ ভূখণ্ডে যারা বসবাস করছেন, তারা নিশ্চিতভাবেই মুসলমানদের আত্মীয় ও পূর্বপুরুষ। আত্মীয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-বিরোধ করতে নেই, বিরোধ বাধলেও তার মীমাংসা জরুরি। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণ ও নবায়ন করা দরকার। সারা বিশ্বের মুসলমান সম্প্রদায়কে একপ্রাণ, একজাতি ভাবা যেমন ইতিহাসসম্মত নয়; তেমনই এক জল-হাওয়ায় পরিপুষ্ট, একই গাত্রবর্ণের হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা ভাবাটাও অনৈতিহাসিক। ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, নৃতাত্ত্বিক গঠনের নিরিখে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিবেচনা করা দরকার।
দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, শতাব্দীর পর শতাব্দী পাশাপাশি বাস করার পরও এক ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্মের অনুসারীদের খুন ও জখম করেছে। এই হানাহানি, খুনোখুনি করে কেউ কি লাভবান হতে পেরেছে? এককথায় উত্তর: না। তাহলে, কেন এত হানাহানি, এত খুনোখুনি করছি? কেনই-বা বছরের পর বছর বিকৃত ও ভ্রান্ত ইতিহাসের দায় আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি? ভারতে মুসলমানরা যখন হত্যার শিকার হয়েছে, তখন হিন্দুরা হয়েছে বাংলাদেশে কিংবা পাকিস্তানে। রবীন্দ্রনাথ পল্লীকবি জসীমউদদীনকে বলেছিলেন, ‘কেন যে মানুষ একের অপরাধের জন্য অপরকে মারল। ও দেশের মুসলমানেরা হিন্দুদের মারল। তাই এ দেশের হিন্দুরা মুসলমানদের মেরে তার প্রতিবাদ করবে, এই বর্বর মনোবৃত্তির হাত থেকে দেশ কী ভাবে উদ্ধার পাবে, বলতে পার?’ জানি, এর উত্তর কেউ দিতে পারবেন না। কবে যে এই বর্বরতার অবসান হবে, আর কবে যে আমরা মুক্তি পাব, তাও জানি না! তারপরও মানুষের প্রতি আস্থা রেখে বলতে চাই, মানুষকে অপমান করে, খুন করে, হানাহানি-খুনোখুনি করে মহৎ কিছু করা যায় না। তাই সবাইকে নিয়ে বাংলাদেশকে এগোতে হবে। নইলে তার সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। ধর্ম নয়, ‘অর্গানাইজড রিলিজিয়ন’-কে পরাস্ত করে সত্যিকারের ইনক্লিউসিভ সমাজ নির্মাণ করতেই হবে। উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। সব ধর্মের ভালটা নিয়ে আমাদের আরও ভাল হতে হবে। অন্ধকারের শক্তিকে পরাস্ত করে পৌঁছুতে হবে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মানবিকতার প্রসন্ন ভোরে।