লেখাটি চাঁদ নিয়ে। তবে যে চাঁদের গল্প এখানে বলব, তা অন্য চাঁদ। আমাদের পৃথিবীর চাঁদ নয়। আমাদের সৌরজগতে রয়েছে দুশোটির বেশি চাঁদ। অধিকাংশ গ্রহেরই চাঁদ রয়েছে, কেবল বুধ (মার্কারি) এবং শুক্র (ভেনাস) ছাড়া। প্লুটো এবং অন্য বামনগ্রহ সহ অ্যাস্ট্রয়েডগুলিরও তুলনামূলক ছোট সাইজের চাঁদ আছে। বৃহদাকার গ্রহ শনি-র (স্যাটার্ন) রয়েছে এক ডজনেরও বেশি সংখ্যক চাঁদ। আমরা বৃহস্পতির একটি চাঁদের কথা বলব। বৃহস্পতি গ্রহ, ইংরেজিতে যাকে আমরা ‘জুপিটার’ বলি, আকার আয়তনের দিক দিয়ে আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ।
চাঁদ যে ‘ন্যাচারাল-স্যাটালাইটস’ বা উপগ্রহ, যা গ্রহদের চারপাশে ঘোরে, তা আমরা সবাই জানি। আমাদের পৃথিবীর চাঁদ যেমন মাত্র একটা। জুপিটারের ধারাপাতে আমাদের পৃথিবী গ্রহের মত ‘এক-এ চন্দ্র’ বললে ভুল হবে। জুপিটারের কিন্তু একটা চাঁদ নয়। জুপিটারের চারপাশে ক’টা চাঁদ ঘোরে, জানেন? মোট ৬৪টা চাঁদ আবিষ্কার হয়েছে এখনও পর্যন্ত। জুপিটারের প্রথম চারটি চাঁদ আবিষ্কার করেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। ১৬১০ সালে। গ্যালিলিওর জুপিটারের চাঁদ আবিষ্কারের আগে অবধি মানুষ জানত একটাই চাঁদ রয়েছে, যা পৃথিবীর। আর একটা কথা বলা দরকার, তা হল আমাদের চাঁদের কোনও নাম না থাকলেও, সৌরজগতে অন্য গ্রহের চাঁদগুলির আলাদা আলাদা নাম দেওয়া হয়েছে। যেমন গ্যালিলিও আবিষ্কৃত চারটি চাঁদের নাম হল Io, Europa, Ganymede and Callisto।
![](https://bhalobhasa.com/wp-content/uploads/2022/10/Io-moon-of-Jupiter.jpg)
গ্যালিলিও আবিষ্কৃত জুপিটারের চারটি চাঁদের মধ্যে Io (আইয়ো) আলাদা রকমের। ১৯৭৯ সালে ‘ভয়েজার-১’ থেকে জুপিটারের চাঁদ ‘আইয়ো’-র পৃষ্ঠতলের ছবির সঙ্গে পরিচিত হয়েছে মানুষ। এছাড়া ‘আইয়ো’ নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্যও পাওয়া গিয়েছে। জানা গিয়েছে, এই চাঁদ অন্যগুলির থেকে আলাদা রকমের। সেসব কথা থাক। আজ ‘আইয়ো’-কে নিয়ে একটি জমাটি গল্প বলতে চাই। পৌরাণিক গল্পটি বস্তুত দারুণ এক প্রেমকাহিনি। তারপর আবার পরকীয়া!
সরাসরি গল্পে চলে আসি এবার।
হিন্দু পুরাণে যেমন আকাশের দেবরাজ হল ইন্দ্র। বজ্র ও বিদ্যুতের দেবতাও তিনি। লাতিন মাইথোলজিতে সেরকম আকাশের দেবরাজ হল ‘জুপিটার’। গ্রিক মাইথোলজিতে একেই বলা হয় ‘জিউস’। গ্রিক মাইথোলজির একটি চরিত্র ‘আইয়ো’। ঈশ্বরদের রাজাধিরাজ জুপিটারের স্ত্রীর নাম ছিল জুনো। সে ছিল প্রচণ্ড হিংসুটে প্রকৃতির মহিলা। হিংসা হবে নাই-বা কেন? স্বামী জুপিটারের প্রেমিকার সংখ্যা যে অনেক। আসলে জুপিটার কিছুতেই এড়াতে পারত না সুন্দরী মহিলাদের আকর্ষণ। বার বার জড়িয়ে পড়ত প্রেমের ফাঁদে। স্বাভাবিকভাবেই স্ত্রী জুনো সব সময় অবিশ্বাস করে স্বামী জুপিটারকে।
প্রেমিকার সঙ্গে থাকার সময় যাতে সহজে কেউ চিনে ফেলতে না পারে, বিশেষ করে স্ত্রী, তাই নানান কৌশল অবলম্বন করত জুপিটার। কী রকম কৌশল? প্রেমিকার সঙ্গে থাকার সময় ছদ্মবেশ ধারণ করে নিত জুপিটার। কখনও রাজহাঁস, কখনও ঈগল কখনও বা মেঘের রূপে। ‘মৌচাক’ সিনেমার সেই রঞ্জিত মল্লিক আর মিঠু মুখার্জির বাঘের মুখোশ পরা পার্কে প্রেম করার কথা মনে পড়ে যাবে হয়তো পাঠকের।
জুপিটারের প্রেমিকাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ‘আইয়ো’। সেই আইয়ো-র প্রেমে পড়ে তখন হাবুডুবু খাচ্ছে জুপিটার। স্ত্রীকে এড়িয়ে প্রেম করার জন্যে এইসময় সে বেছে নিয়েছে একটি দারুণ কৌশল। স্ত্রী যাতে চিনতে না পারে, সেজন্যে জুপিটার কালো মেঘের আদলে নিজের রূপ পরিবর্তন করে নিত। এইভাবে নিজেকে মেঘের আড়ালে রেখে, স্ত্রী জুনোকে লুকিয়ে আইয়োর সঙ্গে মিলিত হত জুপিটার।
একদিন হয়েছে কী, আইয়ো আর জুপিটার ঘনিষ্ঠ হয়ে আছে। এদিকে জুনো পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখতে পেল আইয়োকে। আর আইয়োর পাশেই দেখা যাচ্ছে ঘন কালো মেঘ। স্বামীকে তো ভালই চেনে। সন্দেহ প্রকট হল জুনোর। নির্ঘাত তাঁর গুণবান স্বামী মেঘের রূপ ধরে আইয়োর সঙ্গে প্রেম করছে। জুনো সটান পৌঁছে গেল ওই জায়গায়।
![](https://bhalobhasa.com/wp-content/uploads/2022/10/Jupiter_and_Io_-is-a-painting-by-the-Italian-High-Renaissance-artist-Antonio-da-Correggio-around-1530.jpg)
যে মুহূর্তে জুনো ওই জায়গাতে পৌঁছল, চতুর জুপিটার তা বুঝতে পেরে, পলকের মধ্যে সে আইয়োকে একটি সাদা গোরুতে রূপান্তরিত করে দিল। যাতে করে স্ত্রী কিছু বুঝতে না পারে। ‘চরিত্রবান’ স্বামীকে তো ভালই চেনে জুনো। পাকা গোয়েন্দার মত জুনো বুঝতে পারল, আইয়োকে ‘গোরু’-তে রূপান্তরিত করে দিয়েছে স্বামী, চোখে ধুলো দেওয়ার জন্যে। স্বামীর কায়দাটি বুঝতে পেরে, গোরুটিকে দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে রাখল জুনো।
তারপর ফিরে গিয়ে জুনো তাঁর নিজস্ব ভৃত্য ‘আরগুজ’ দৈত্যকে পাঠাল গোরুটিকে পাহারা দেওয়ার জন্যে। ভৃত্য দানব ‘আরগুজ’-এর ছিল একশোটি চোখ। তবে ঘুমোনোর সময় আরগুজের সব চোখগুলি একসঙ্গে ঘুমাত না। কয়েকটি চোখ খোলা এবং জাগ্রত অবস্থাতে থাকত। জুনো বারবার করে আরগুজকে বলে দিয়েছিল, সে যেন সব সময় সজাগ থাকে যাতে গোরুরূপী বন্দি আইয়োকে চোখে চোখে রাখতে পারে।
![](https://bhalobhasa.com/wp-content/uploads/2022/10/Thousand-eye-monster-Son-of-Jupitor-and-the-Cow-Io.jpg)
এদিকে জুপিটার তার ছেলে মার্কারিকে সেখানে ডেকে পাঠাল, যাতে করে সে গান আর হাবিজাবি গল্প করে আরগুজকে সম্পূর্ণ ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিতে পারে। যেন ওর সবক’টি চোখ বন্ধ হয়ে যায়। জুপিটার যেমনটি চেয়েছিল, তাই হল। একের পর এক অজস্র গল্প শোনাতে থাকে মার্কারি। শুনতে শুনতে একসময় আরগুজ গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। সেই সুযোগে, আরগুজকে হত্যা করল মার্কারি।
যেই না এই খবর জানতে পারল জুনো, প্রচণ্ড রাগে ফেটে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে জুনো একটি ডাঁশ মাছি পাঠাল, যাতে মাছিটি গোরুরূপী আইয়োর গায়ে কামড়ে লেগে থাকতে পারে সব সময়। ব্যাস, এতেই দারুণ মুশকিলে পড়ে গেল আইয়ো। অন্যদিকে জুপিটারেরও আর কিচ্ছুটি করার থাকল না। বাধ্য হয়ে জুপিটার, স্ত্রীর কাছে অঙ্গীকার করল যে, সে ভবিষ্যতে আর আইয়োর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না। স্বামীর এই প্রতিজ্ঞার পরে আইয়োকে মুক্তি দিল জুনো। আইয়ো তারপর ইজিপ্টে গিয়ে বসবাস করতে লাগল।
এখানেই গল্পের নটে গাছটি মুড়ল।
সৌরজগতের অজানা অজস্র চাঁদের খোঁজ খবর দিয়ে শুরু করে সব শেষে আইয়ো চাঁদের এক তুমুল প্রেম কাহিনী শোনালেন… নতুন এই স্টাইলটা দারুণ লাগল। 🙂❤️
খুব ভালো লাগল আপনি এই লেখার স্টাইলটি নিয়ে বললেন বলে। অনেক ধন্যবাদ জানাই।