প্রাচীনকাল থেকেই আমাদের দেশে গুরুর স্থান পিতামাতার পরেই। ‘গুরু’ শব্দটি ‘গু’ এবং ‘রু’ এই দুটি সংস্কৃত শব্দ দ্বারা গঠিত। ‘গু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার বা অজ্ঞতা এবং ‘রু’ শব্দের অর্থ অন্ধকার দূরীভূত করা। ‘‘অজ্ঞান তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া। চক্ষুরুন্মিলিত যেন তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।’’ ‘গুরু’ শব্দ দ্বারা এমন ব্যক্তিকে নির্দেশ করা হয়, যিনি অন্ধকার দূরীভূত করেন, অর্থাৎ যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান তিনিই গুরু। গুরু আমাদের মনের সব সংশয়, সন্দেহ, অন্ধকার দূর করেন এবং নতুন পথের দিশা দেখান। তাই গুরুকে শ্রদ্ধা জানাতে বৈদিক যুগ থেকেই গুরু পূর্ণিমা পালিত হয়ে আসছে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এই পূর্ণিমায় গুরুকে শ্রদ্ধা জানালে গুরুর অক্ষয় আশীর্বাদ মেলে।
গুরু-শিষ্য বলতেই আমাদের যাঁদের কথা প্রথমেই মনে পড়ে তাঁরা হলেন, আয়োধধৌম্য ও আরুণি বা উদ্দালক, রামানন্দ ও কবীর, দ্রোণাচার্য ও অর্জুন, শ্রীরামকৃষ্ণদেব ও বিবেকানন্দ, শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমা, বীরসা মুন্ডা ও আনন্দ পাণ্ডে, উপগুপ্ত ও সম্রাট অশোক, বিবেকানন্দ ও নিবেদিতা, বাবাসাহেব ভীমরাও ও মহাদেব আম্বেদকর, সন্ত তুকারাম ও ছত্রপতি শিবাজী এমনই সব বর্ণময় ব্যক্তিত্বের কথা। কিন্তু আজ এই লেখায় যাঁদের নিয়ে আলোচনা করব তাঁরা নামে চেনা হয়েও যেন গুরু-শিষ্যর তালিকায় পরিচয়ের প্রকাশে জনমানসে অনেকটাই অপরিচয়ের অবগুন্ঠনে আবৃত। এঁরা হলেন শিষ্যা মীরাবাঈ আর গুরু সন্ত রবিদাস বা রাইদাস। ভক্তিবাদের অন্যতম সাধিকা ছিলেন মীরাবাঈ। তাঁর উপলব্ধিতে হিন্দুধর্মের ভক্তিবাদ এবং ইসলামের সুফিবাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে।
১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে রাজস্থানের কুড়কী নামক গ্রামে মীরাবাঈয়ের জন্ম হয়। তিনি রাঠোর বংশে জন্মেছিলেন। তাঁর পিতা রত্নসিংহ ছিলেন রাও দুদাজির চতুর্থ পুত্র। কুড়কী অঞ্চলের বারোখানা গ্রামের জায়গির উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে তিনি কুড়কীতে গড় স্থাপন করেন। মীরাবাঈ তাঁর একমাত্র কন্যা। মীরাবাঈয়ের শৈশব জীবনের একটি ঘটনা প্রচলিত। একবার বিয়ের উৎসবে বরযাত্রীসহ বর চলেছে। বাড়ির মেয়েরা সকলে অবাক হয়ে বরকে দেখছে। তখন ছোট্ট মেয়ে মীরা তার মাকে বলে— আমার বর এমন করে কবে আসবে? ছোট্ট মেয়েকে প্রবোধ দেবার জন্য মা বলেছিলেন— তোর বর ঠাকুরঘরেই আছে। গিরিধারী গোপালজি তোর বর। ওঁর সঙ্গেই তোর বিয়ে হবে। এই কথা শুনে মীরাবাঈ শিশুমনের সহজ বিশ্বাসে ভেবেছিল, সত্যি গোপালজি তার পতি পরমেশ্বর। গিরিধারীকেই তাই স্বামী হিসেবে ভালবেসে ফেলেছিল মেয়ে।
মাত্র আটবছর বয়সে মীরার মায়ের মৃত্যু হয়। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বাবা খুবই বিপদে পড়েন। তখন এগিয়ে আসেন ঠাকুরদা রাও দুদাজি। তিনি মীরাকে নিজের কাছে নিয়ে যান। বিরাট রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরে রাজকীয় বিলাসের মধ্যে মীরার জীবন কাটতে থাকে। তবে রাও দুদাজি ছিলেন ভক্তিপ্রাণ মানুষ। নিজের প্রাসাদের কাছে তিনি চতুর্ভুজজির একটি সুরম্য মন্দির তৈরি করেন। সেখানে সাধুসন্ন্যাসীরা প্রায়ই এসে ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতেন। মীরা সেইসব আলোচনার একনিষ্ঠ শ্রোতা। এই ক্রমাগত উদার ভক্তিসাধনার পরিমণ্ডল মীরার মনকে ক্রমশই ঈশ্বরের প্রতি চালিত করতে থাকে। ধর্মচর্চার পাশাপাশি মীরার তালিম চলে গান ও শিল্পকলার।
মীরাবাঈ এই সময় থেকে গান লিখতে শুরু করেন তাঁর গিরিধারীর উদ্দেশে। প্রচলিত কিছু মতানুসারে, সারাজীবনে মীরাবাঈ কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে প্রায় পাঁচ সহস্রাধিক কবিতা, ভজন, পঙ্ক্তি রচনা করেছেন, যা আজও অমর হয়ে রয়েছে প্রেমভাব এবং প্রার্থনার এক অপূর্ব সংমিশ্রণের সাহিত্য হিসেবে। এও যেন রবীন্দ্রনাথের চৈতালি কাব্যগ্রন্থের পুণ্যের হিসাব কবিতায় চিত্রগুপ্তের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘‘যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।”
‘‘আর কত কাল গিরিধারী লাল
আড়ালে আড়ালে রবে
নয়নেরই জল ঝরে অবিরল
দরশন দেবে কবে?
আড়ালে আড়ালে রবেতোমার চরণে প্রভু এই তনুমন,
পূজার কুসুম সম করি নিবেদন।।
আকুল তোমার লাগি আমার পরাণ।।
তবে কি বিফলে যাবে?
আড়ালে আড়ালে রবে
আর কত কাল গিরিধারী লাল
আড়ালে আড়ালে রবেদেখা যদি নাহি দিবে ওগো দয়াময়
তবে কেন দিলে আশা ভরিয়া হৃদয়।
মীরার পরানে দোমারি কামনা।।
সে আশা মিটিবে কবে?
আড়ালে আড়ালে রবে
আর কত কাল গিরিধারী লাল
আড়ালে আড়ালে রবে।’’মীরার ভজন। পদকর্তা: শ্রীমতি মীরাবাঈ
১৫১৬ সালে মীরাবাঈয়ের বয়স যখন আঠারো, তখন তাঁর বিবাহ হয় মেবারের শিশোদিয়া বংশের রাজা রাণা সঙ্ঘের পুত্র রাজপুত যোদ্ধা ভোজরাজ সিংয়ের সঙ্গে। বিয়ের পর তিনি মীরাট ছেড়ে চলে আসেন চিতোরে। শ্বশুরবাড়িতে এসেও মীরা ভোগবিলাসের চেয়ে বেশি মন দিয়েছিলেন নিজের কর্তব্যকর্মের প্রতি। সাংসারিক কাজের থেকেও পূজার্চনা, সাধুসঙ্গ তাঁর কাছে অনেক বেশি প্রিয় ছিল। তাঁর কৃষ্ণপ্রেম ও সাধনভজন নিয়ে অচিরেই রাজপ্রাসাদের ভিতর অসন্তোষ জমা হতে শুরু করে। কিন্তু তাঁর কৃষ্ণপূজার কথা রাজপ্রাসাদের সীমানা ছাড়িয়ে প্রচার হতে থাকে দূরদূরান্তে। অল্পদিনের মধ্যেই তা ছড়িয়ে পড়ে দাসদাসী থেকে নগরবাসীর মধ্যে। সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। বহু অপমান আর অপবাদ তাঁকে সহ্য করতে হয়। কিন্তু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে সর্বশক্তিমান, তিনিই যে জগতের অধীশ্বর এবং তাঁকেই যে মীরা স্বামীর স্থান দিয়েছেন এই বিশ্বাসে তিনি স্থির থাকেন। মীরার শাশুড়ি তাঁকে তাঁদের কুলদেবী ‘ভীমা’-র আরাধনা করার জন্য নিমন্ত্রণ জানালে মীরাবাঈ জানান, তাঁর পক্ষে তাঁর ‘গিরিধারী গোপাল’ ভিন্ন অন্য কাউকে পূজা করা সম্ভব নয়। তাঁর এই কথায় রাজপ্রাসাদের ভিতরে মীরা-বিদ্বেষী ক্ষোভ তীব্র হতে থাকে এবং তাঁর স্বামীও তাঁকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেন। কিন্তু মীরার কৃষ্ণের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাস দেখে ভোজরাজের মনেও মীরার প্রতি এক প্রচ্ছন্ন স্নেহ ও শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেয়। মীরার ‘গিরিধারী গোপাল’-এর জন্য তিনি একটি মন্দির তৈরি করে দেন, যা আজও বর্তমান।
মীরার কঠোর জীবন সংগ্রাম শুরু হয় তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পরে। ১৫২১ সালে মোগল সম্রাট আকবরের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যু হয় রাণা ভোজরাজের। মীরার শ্বশুর মীরাকে নির্দেশ দেন স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে। কিন্তু মীরা দৃঢ়ভাবে তাঁর শ্বশুরকে জানিয়ে দেন যে, তাঁর পক্ষে সহমরণে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তাঁর প্রকৃত স্বামী হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যাঁর কোনও মৃত্যু হয় না। মীরার এই যুক্তি শুনে তাঁর শ্বশুর প্রবল অসন্তুষ্ট হলেও রাজপরিবারের সম্মানার্থে মীরাকে ত্যাগ করতে পারেন না। কিছুদিনের মধ্যেই মীরার শ্বশুরও যুদ্ধে প্রাণ হারালে রাজা হন মীরার দেওর রাণা রতন সিংহ। এরপরই মীরার উপর অত্যাচার চরমে ওঠে। তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা হয় বারংবার। কখনও বিষভর্তি পাত্র দিয়ে আবার কখনও সাপের ঝুড়ি দিয়ে। কিন্তু প্রতিবারই মীরা অদ্ভুতভাবে প্রাণে বেঁচে যান।
স্বামীর মুত্যুর পরে মীরা অনুভব করেন ইহজাগতিক স্নেহ মমতা ভালবাসা সবই এক মায়া, যার স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। এই উপলব্ধি মীরাকে কৃষ্ণের প্রতি আরও আকৃষ্ট করে তোলে। মীরা এরপর মেবারের রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে আবার মীরাটে চলে আসেন। কিন্তু এখানেও তাঁর ঠাঁই হয় না। তাঁর কাকার বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবের কারণে মীরাট থেকে কৃষ্ণলীলাভূমি বৃন্দাবনে চলে আসেন মীরা। বৃন্দাবনে এসে মীরা তীব্রভাবে কৃষ্ণ প্রেমভক্তিতে আপ্লুত হয়ে পড়েন ও শ্রীকৃষ্ণের দর্শনলাভের জন্য পাগলপারা হয়ে ওঠেন। তাঁর ভজন সঙ্গীতের মধ্যে কৃষ্ণপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তিনি তার গিরিধারীর খোঁজে আকুল হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে শুরু করেন।
সন্ত রবিদাস ছিলেন এইসময়ে ভক্তি আন্দোলনের একজন বিখ্যাত সহজিয়া সাধক, অতীন্দ্রিয়বাদী কবি ও সমাজসংস্কারক। মধ্যযুগীয় রত্নাবলী শিরোনামে লেখা আছে যে, রবিদাস রামানন্দের কাছ থেকে তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন এবং তিনি রামানন্দী সম্প্রদায় ঐতিহ্যের অনুসারী ছিলেন। তিনি অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাত, রাজস্থান এবং হিমালয়ে অবস্থিত বিভিন্ন তীর্থস্থান পরিদর্শন করেছিলেন। আঞ্চলিক ভাষায় তাঁর কাব্যিক স্তোত্র অন্যদের অনুপ্রাণিত করায়, বিভিন্ন পটভূমির লোকেরা তাঁর শিক্ষা এবং নির্দেশনা প্রার্থনা করেছিলেন। অধিকাংশ গবেষক বিশ্বাস করেন যে, রবিদাস শিখ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গুরু নানকের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। রবিদাসের কবিতায় ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এমন, যেখানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণির অসম নাগরিক নেই, নেই বৈষম্যের প্রয়োজনীয়তাও।
ভক্তমাল গ্রন্থ অনুসারে, রবিদাস ছিলেন বিশুদ্ধ বাগ্মী, যাঁরা তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন তাঁদের আধ্যাত্মিক সন্দেহ দূর করতে সক্ষম, তাঁর নম্র উৎপত্তি এবং আসল জাতের কথা বলতে ভয় পাননি। ভক্তমাল পাঠে আরও বলা হয়েছে যে, রবিদাসের শিক্ষা বৈদিক ও প্রাচীন শাস্ত্রের সঙ্গে একমত, তিনি নন-ডুয়ালিজমের সদস্যতা নিয়েছিলেন, লিঙ্গ বা বর্ণবৈষম্য ছাড়াই ব্রাহ্মণ-সহ সবার সঙ্গে আধ্যাত্মিক ধারণা এবং দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং তাঁর দক্ষতা এমন একজন ব্যক্তিকে প্রতিফলিত করেছে যিনি সর্বোচ্চ তপস্বীর অভ্যন্তরীণ বিষয়বস্তুতে পৌঁছেছিলেন। গবেষক ক্যারেন পেচিলিসের মতে, অধিকাংশ উত্তর-আধুনিক পণ্ডিতরা রবিদাসের ভাবনাকে ভক্তি আন্দোলনের মধ্যে নির্গুণ দর্শনের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেন। শিখদের আদিগ্রন্থে তাঁর চল্লিশটি কবিতা লিপিবদ্ধ আছে। তিনি মানবসমাজকে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গের বিভাজন থেকে মুক্ত করতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তির আধ্যাত্মিক মননচর্চা ও সাধনায় একত্ববাদের স্বাধীনতার প্রচারক ছিলেন।
একদিন উগ্র সামাজিক পীড়নে বিধ্বস্ত, সংকীর্ণ লোকনিন্দায় ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে মীরাবাঈ শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরে পৌঁছলে সন্ত রবিদাসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তিনি সেখানে আধ্যাত্মিক মুক্তির বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। মীরাবাঈ তাঁকে মন্ত্রদীক্ষা দিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি জাতিতে চামার আর মীরাবাঈ জাতিতে ঠাকুর বলে মীরাবাঈয়ের আরও লাঞ্ছনার কারণ হয়ে দাঁড়াবেন ভেবে প্রথমে অস্বীকার করেন। পরে মীরাবাঈয়ের বারংবার অনুরোধ ও আকুতি দেখে সম্মত হন এবং মীরাবাঈকে দীক্ষা দেন। তাঁর মন্ত্রের স্পর্শে মীরার তাপিত, উদভ্রান্ত হৃদয় বহু জটিল প্রশ্নের সহজ উত্তর পেয়ে আরও নিবিড়ভাবে নিজেকে চিনতে পারে।
Rabidas says, what shall I sing?
Singing, singing I am defeated.
How long shall I consider and proclaim:
absorb the self into the Self?This experience is such,
that it defies all description.
I have met the Lord,
Who can cause me harm?Hari in everything, everything in Hari –
For him who knows Hari and the sense of self,
no other testimony is needed:
the knower is absorbed.
এযেন চৈতন্যদেবের সেই একশ্রেণির দাম্ভিক রীতিনীতি সর্বস্ব ধর্মব্যবসায়ীদের ধর্মকে তাদের পৈতৃক সম্পত্তি ভাবার বিরুদ্ধে সমাজে আলোড়ন ফেলে দেওয়া বাণীরই প্রকাশ। ‘কিবা বিপ্র, কিবা নামী, শূদ্র কেন নয়? যেই কৃষ্ণতত্ত্ববেত্তা সেই গুরু হয়।।’ ‘পৃথিবীতে মানুষ এসেছে প্রেমধর্মকে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দেবার জন্য। প্রেমধর্ম ছাড়া সব কিছুই বৃথা।’ ‘জীবে প্রেমের মাধ্যমেই আসল অভীষ্ট পূর্ণ হয়। সকলের প্রতি ভালবাসা প্রদান না করলে কখনও আমরা ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারব না।’
এরপর মীরাবাঈ শান্ত ভক্তিতে বিশ্বাসী, সহজিয়া ভক্তিবাদের ওপর বারোশো থেকে তেরোশো ভজন রচনা করেছিলেন। এই গানগুলি সারা ভারতে জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে এলস্টোন এবং সুব্রহ্মনিয়ম মীরাবাঈ রচিত নির্বাচিত কিছু গান ও কবিতা ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। মীরাবাঈয়ের কিছু ভজন রবার্ট ব্লাই কর্তৃক মীরাবাঈ ভার্সনস্ শিরোনামেও প্রকাশিত হয়।
মীরার খ্যাতির পাশাপাশি তাঁর রচনা করা ভজনগীতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর খ্যাতি এবং আধ্যাত্মিকতা লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে মোঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। সম্রাট আকবর যেহেতু বিভিন্ন ধর্মীয় পথ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন, তাই তিনি মীরাবাঈয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। কিন্তু সমস্যা হল আকবর এবং মীরার পরিবার একে অপরের প্রতিপক্ষ এবং দীর্ঘদিনের চলা যুদ্ধে উভয়পক্ষের অনেকেই মারা গিয়েছেন। কিন্তু কোনও প্রতিবন্ধকতা সম্রাট আকবরকে তাঁর উদ্দেশ্য থেকে হটাতে পারেনি। ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তানসেনকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হন মীরার কাছে। আকবর তার প্রাণবন্ত সঙ্গীত এবং ভক্তিমূলক গানে এতটাই আসক্ত হয়েছিলেন যে, ফিরে যাওয়ার সময় মীরার চরণে তাঁর পরিহিত মূল্যবান গলার মালা উৎসর্গ করে যান। যদিও তাঁদের সাক্ষাতের ব্যাপার নিয়ে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে।
রাজকুমারী হয়ে জন্ম নিলেও মীরা আত্মার শান্তি খুঁজে পান সাধারণ মানুষের সাহচর্যে। সকল যন্ত্রণা সমালোচনা আক্রমণের প্রত্যুত্তরেও মীরা তাঁর সহজ ভক্তি, ঔদার্য সহনশীলতাকে বিসর্জন দেননি। তাঁর জীবন ভক্তি প্রেম সৌহার্দ্যের এক উজ্জ্বল নিদর্শন। মীরাবাঈ দেখিয়েছেন যে, কেবলমাত্র প্রেমের মাধ্যমেই একজন সাধক ঈশ্বরের সঙ্গে মিলিত হতে পারেন। রাজপুত এই নারী যেন আর-একবার শিখিয়েছেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কৃষ্ণপ্রেমে বিলীন হতে প্রাসাদের বিলাসিতা বিনা দ্বিধায় ত্যাগ করেছেন তিনি। তিনি উগ্র, হিংস্র সমাজব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের মত করে কাটিয়েছেন সারা জীবন, আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে! মীরাবাঈ তাঁর গুরু রবিদাস সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটি হুবহু ইংরেজিতে তুলে দিলাম। একজন সদগুরুর থেকে শিষ্যর শাশ্বত প্রাপ্তির বাণী রয়েছে এতে:
My Beloved dwells in my heart,
I have actually seen that Abode of Joy.
Mira’s Lord is Hari, the Indestructible.
O Lord, I am mad for Your love,
but who can understand my pain?
None but the wounded can know of the
anguish of the wounded.Drink the nectar of the Divine Name,
O human! Drink the nectar of the Divine Name!
Leave the bad company,
always sit among righteous company.Hearken to the mention of God (for your own sake).
Concupiscence, anger, pride, greed, attachment:
wash these out of your consciousness.Mira’s Lord is the Mountain-Holder,
the suave lover.
Soak yourself in the dye of His colour.But I kept searching for the secret
Of that Realm but none could reveal it.
When Sant Ravidas, my Master, I met
He gave my soul the clue
to that Eternal Abode.
Then I ascended and met my Beloved;
And my anguish was finally allayed.When Ravidas, the perfect Master, I met
The severed twig joined again the tree.
My Master revealed the secret of the Name,
The flame of Mira merged into the Flame.
Khub khub khub …ato.kichu itihas jante pere besh valo lagche ♥️