Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

হারিয়ে যাওয়ার পথে মথুরাপুরের ঘন শিরার রসগোল্লা

একসময় এই রসগোল্লা রাজত্ব করেছে সারা গ্রামীণ মালদা জুড়ে। উৎসবে হোক, অতিথি আপ্যায়নে হোক বা রসনাতৃপ্তির জন্য, মথুরাপুরের ঘন শিরার রসগোল্লার চাহিদা ছিল তুঙ্গে। মথুরাপুরের শনিবারের হাট বা খয়েরতলার হাট ছাড়াও চাঁচল হাট বা সামসির বৃহস্পতিবারের বড় হাটে টিনে বোঝাই করে নিয়ে যেতেন ভেন্ডরেরা। এই মিষ্টি বিক্রি হত ওজন হিসাবে। আর এখন রকমারি মিষ্টির চাপে কার্যত হারিয়ে যেতে বসেছে ঘন শিরার রসগোল্লা।

মথুরাপুর থেকে সরে নাজিরপুর স্ট্যান্ড সংলগ্ন চার-পাঁচটি দোকানে এখনও টিমটিম করে টিকে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এই মিষ্টির আঞ্চলিক ঐতিহ্য। অন্যান্য রসগোল্লার সঙ্গে কী পার্থক্য এই বিশেষ রসগোল্লার? স্থানীয় মিষ্টান্নশিল্পী তপন সাহা জানান, “এই রসগোল্লায় সুজির মিশ্রণ প্রায় নেই বললেই চলে। মোটের ওপর এককেজি ছানায় একশোগ্রাম ময়দা ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য রসগোল্লা তৈরির পর গরম জল দিয়ে তারপর চিনির শিরায় ডোবানো হয়। এক্ষেত্রে গরম জলের ব্যবহার নেই। তৈরি হওয়ার পর সরাসরি মিষ্টি ফোটানো হয় ঘন চিনির শিরায়।” আরেক মিষ্টান্নশিল্পী বিদ্যুৎ সাহা বলেন, “পাতলা রসের মিষ্টি যদি একদিন থাকে, সেখানে এই রসের মিষ্টি টিকবে কম করে চারদিন। শহুরে রসগোল্লার থেকে একটু বেশি মিষ্টি, তাই হয়তো এর চাহিদা তেমন নেই।”

এই রসগোল্লায় সুজির মিশ্রণ প্রায় নেই বললেই চলে।

এখন আর ওজনে বিক্রি হয় না এই মিষ্টি। তবুও বিক্রেতাদের অনেকেই মনে করতে পারেন সেই সোনালি দিনগুলো কথা, যখন হাটবারে পাইকার এবং ভেন্ডরদের ভিড় লেগে থাকত দোকানগুলোয়। টিনবোঝাই করে ওজন মেপে মিষ্টি নিয়ে যাওয়া হত হাটে। পাঁচশো গ্রাম আর এককেজির মাটির ভাঁড় তৈরি করা থাকত দোকানে। ওপরে পাতলা সাদা কাগজের আস্তরণ। ভাঁড়ে বাঁধা দড়ি ঝুলিয়ে নতুন পোশাক পরে গ্রামের জামাই বা নতুন অতিথি ঢুকছেন গ্রামে, এই ছবি হারিয়ে গেছে প্রায় দুই দশক হল। শহরকে আপ্রাণ নকল করতে চেয়ে গ্রামের যে ছবিগুলো বাঙালি জীবন থেকে সেই শাটার দেওয়া সাদাকালো টিভির মতই হারিয়ে গেছে, তার মধ্যে মিষ্টির হাঁড়ি হাতে ঝুলিয়ে বাড়ি ফেরার ছবি অন্যতম।

হাটবারে পাইকার এবং ভেন্ডরদের ভিড় লেগে থাকত দোকানগুলোয়।

পুরনো মানুষদের অনেকেই মনে করতে পারেন, মথুরাপুর বা নাজিরপুরের শংকরটোলা বা কালীটোলা ঘাটে দাহকার্য করে ফেরার পথে এই দোকানগুলিতে লুচি-তরকারির সঙ্গে এই বিশেষ মিষ্টির উপস্থিতি ছিল বাধ্যতামূলক, অনেকটা সামাজিক সংস্কারের মতই। মানিকচকের লালবাথানি গ্রামের বাসিন্দা সুশান্ত ঘোষ কর্মসূত্রে মালদা টাউনে থাকেন। তিনি বলেন, “আগে একটা সময় গেছে যখন বাড়ি থেকে আসছি আর মথুরাপুরের রসগোল্লা সঙ্গে আনিনি, এমন ঘটনা ঘটেনি। আস্তে আস্তে সব কেমন হারিয়ে গেল।” নূরপুরের বাসিন্দা প্রবীণ এনায়েত শেখের গলাতেও আক্ষেপের সুর, “আগে হাটবারের দিনে নাজিরপুরে সাহাদের দোকানের ঘন শিরার মিষ্টি লোকেরা লাইন দিয়ে নিয়ে যেত।”

এখনও টিমটিম করে টিকে রয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এই মিষ্টির আঞ্চলিক ঐতিহ্য।

সময় বদলায়। নতুন প্রজন্মের বেকড রসগোল্লা, চকলেট বা ম্যাংগো রসগোল্লা পিছনে ঠেলে দেয় মথুরাপুরের ঘন শিরার রসগোল্লাকে। তবু আজও গ্রামীণ মালদার অসংখ্য মানুষের মনের গোপন কুঠুরিতে এই মিষ্টি স্বপ্ন দিয়ে তৈরি, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমে হাট করার পর দুটো পরোটা-তরকারি খাওয়ার পরের আনন্দময় মুহূর্তে বা তুচ্ছ উপলক্ষের সামান্য বিলাসে এই অতি সাধারণ রসগোল্লা আজও কেমন যেন মায়াবী হয়ে ওঠে। অনেকক্ষেত্রে এই পাল্টে যাওয়া সময়ও তার ব্যাখ্যা করতে পারে না।

চিত্র: লেখক
5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
স্বপ্না অধিকাবরী
স্বপ্না অধিকাবরী
2 years ago

গল্পের স্বাদের সুনাম ছড়িয়ে পড়ুক

Recent Posts

ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব চার]

তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সঙ্গে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরিব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা। দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরিব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তাঁর লেখায়। ‘গোরা’ ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনই দু’টি উপন্যাস। গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে। ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব তিন]

সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কী, তা নিশ্চিত অজানা ছিল না তাঁর। সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে। শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী— তা কোনওভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারে না। তবে তিনি কী করছেন? এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি? অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন? বাইরের আলো, মুক্ত বাতাস কি তবে কোনওদিন প্রবেশ করবে না এদের জীবনে?

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব দুই]

১৭ বছর বয়সে প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানে ইংরেজদের বেশ কিছু সামাজিক নৃত্য তিনি শিখেছিলেন। সেদেশে সামাজিক মেলামেশায় নাচ বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকে, তা এখন আমরা একপ্রকার জানি। সদ্যযুবক রবীন্দ্রনাথ তাদেরই দেশে তাদের সাথেই নাচের ভঙ্গিতে পা মেলাচ্ছেন। যে কথা আগেও বলেছি, আমাদের দেশের শহুরে শিক্ষিত পুরুষরা নাচেন না। মূলবাসী ও গ্রামীণ পরিসর ছাড়া নারী-পুরুষ যূথবদ্ধ নৃত্যের উদাহরণ দেখা যায় না। এ তাঁর কাছে একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা এবং তা তিনি যথেষ্ট উপভোগই করছেন বলে জানা যায় তাঁরই লেখাপত্র থেকে।

Read More »
ড. সোমা দত্ত

রবীন্দ্রনৃত্যভাবনা: প্রেক্ষিত ও চলন [পর্ব এক]

প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা, উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জুড়ে থাকা গ্রামজীবনের যূথবদ্ধতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, যা তাদের শিল্পসংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে, নানান ঝড়ঝাপটা সত্ত্বেও একেবারে ভেঙে পড়েনি, তবে এই শতাব্দীর বিচ্ছিন্নতাবোধ একে গভীর সংকটে ঠেলে দিয়েছে। নগরজীবনে সংকট এসেছে আরও অনেক আগে। যত মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরেছে, যত সরে এসেছে কায়িক শ্রম থেকে, উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে যূথবদ্ধতা ততটাই সরে গেছে তাদের জীবন থেকে। সেখানে নাচ শুধুমাত্র ভোগের উপকরণ হয়ে থাকবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

Read More »
শুভদীপ রায়চৌধুরী

শুভদীপ রায়চৌধুরীর দুটি কবিতা

অন্ধকারের তুমি,/ নরম পুঁইমাচার নিচে সবজেটে বহুরূপী/ তোমাকে আলোর কণার ভেতর গড়িয়ে যেতে দেখব বলে/ আমি এই পাগলের পৃথিবী ছেড়েছি/ টিলাপায়ে বাস করি/ নাম, সমুদ্রসম্ভব।/ পাতার ইমারত আছে, আছে/ কিছু দৈনন্দিন কাজ/ মাছ ধরার নাম করে/ বালসাভেলায় অনেকদূর যাওয়া/ যতদূর ভেসে গেলে ঢেউয়ের চুম্বন থেকে/ ছোবলটুকু আলাদা করাই যায় না

Read More »
নন্দদুলাল চট্টোপাধ্যায়

অবিন্যস্ত | দ্বিতীয় পর্ব

সকালে চিড়ে নারকেল-কোরা আর গুড় খেয়ে আমি সাইকেলে চেপে ছুটিয়ে দিলাম— আট মাইল রাস্তা ঠেঙিয়ে যখন পৌঁছালাম— তখন গণগণে রোদ্দুর তেষ্টায় গলা কাঠ। ঘন্টাখানেক গাড়ি চালিয়ে একটা বাড়ি দেখে সাইকেল থেকে নেমে পড়লাম যদি একটু জল খাওয়া যায়। বাড়ির বারান্দায় একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি বসেছিলেন— তার কাছে উদ্দিষ্ট ঠিকানার কথা প্রশ্ন করতেই তিনি উঠে এসে আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে একটা পাটি পেতে বসতে দিলেন। আমি আবার জল চাইলে বললেন, “দাদাঠাকুর ব্যস্ত হবেন না— ঠিক জায়গায় এসে পড়েছেন।”

Read More »