গতমাসে প্রকাশিত একটা সংবাদ আমার হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছিল।
খবরটা এমন: মা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ভারতের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আর মেয়ে রয়েছেন বাংলাদেশে। অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সাধ্য নেই। কারণ মেয়ের পাসপোর্টই নেই। যে কারণে বৈধ পথে ভারতে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। তাই মাকে দেখতে অবৈধপথেই ভারতে প্রবেশের চেষ্টা করেন মেয়ে। কিন্তু সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-র হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। সঙ্গে ছিলেন তার শাশুড়িও। বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করলেও মানবিক কারণে ওই মেয়ে এবং শাশুড়িকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়েছে বিএসএফ। ২৯ এপ্রিল ২০২২ এ ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার জিৎপুর সীমান্তে।
কী মর্মান্তিক সংবাদ। অসুস্থ মাকে দেখতে যেতে পারছে না কন্যা ‘সীমান্ত’ নামের নির্দয় সীমারেখার জন্য। ‘সীমান্ত’ কী আসলেই এত নির্দয়! অন্যান্য দেশের সীমান্তগুলো আসলে কেমন।
সাতসকালে চিন ও লাওসের বর্ডার পোস্টগুলোতে গেলে মনে হবে একেকটা বিরাট কাঁচাবাজার বসেছে। কেউ পিঠে করে কেউ সাইকেল কেউ ঠেলাভ্যানে চাপিয়ে কৃষিজাত পণ্য নিয়ে ভিড় জমায় সেখানে। এরা বর্ডারের দুয়ার খুলে দেওয়ার অপেক্ষায় থাকে। দুয়ার খুলে দিলে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে লাওসের কৃষকদের কাফেলা। এরাই চিনের সীমান্তবর্তী বাজারগুলোকে সরগরম করে তোলে। সেখানকার মানুষ সস্তায় সতেজ কৃষিজাত পণ্য পায়। আবার এর বিপরীতে শিল্পজাত পণ্য যায় লাওসে। পাসপোর্ট-ভিসার কোনও বালাই নেই। সীমান্ত তাদের কাছে একটি রাষ্ট্রের সীমারেখা মাত্র। বিদ্বেষ ও সন্দেহের বাধা নেই।
একই চিত্র ইন্দো-চিনের দেশগুলোর পরস্পরের মধ্যে। যে চিনের সঙ্গে ১৯৭৯-তে ভিয়েতনাম যুদ্ধ করল, ৩০ হাজার ভিয়েতনামি সৈনিক মারা গেল, সেই চিনে ভিয়েতানামিরা যায় পোর্ট এন্ট্রি ভিসায়। ভিয়েতনাম রাষ্ট্রটি আদতে লাওস ও কম্বোডিয়ার বিস্তীর্ণ ভূমি দখল করে আজকের রূপ পেয়েছে। কিন্তু ভিয়েতনামের সঙ্গে লাওস ও কম্বোডিয়ার সম্পর্ক খুব স্বাভাবিক।
ইউরোপ তো অনেক আগেই তাদের নাগরিকদের অবাধ বিচরণের অধিকার দিয়ে দিয়েছে। এক সেনজেন ভিসা নিয়ে ইউরোপের ২৬টি দেশে ঘুরতে পারেন অন্য কোনও অঞ্চলের মানুষ। আফ্রিকান ইউনিয়ন ৫৫টি দেশের জন্য অভিন্ন পাসপোর্ট চালু করেছে। মেক্সিকোর শ্রমিকরা অবাধে প্রতিদিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করছেন। ল্যাটিন আমেরিকার দেশে দেশেও অবাধ ভ্রমণের সুযোগ পান সে অঞ্চলের মানুষজন।
ভিসার জটিলতা বলতে গেলে এশিয়ার কিছু দেশে। এই জটিলতা অনেক ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ির পর্যায় চলে যায় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সীমান্তে। ভারতের সঙ্গে চার-চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে পাকিস্তান। দুই দেশের মধ্যে প্রায় সর্বদা সীমান্ত উত্তেজনা থাকে। সেখানে না হয় সীমান্তে বাড়াবাড়ি মেনে নেয়া যায়। বাংলাদেশ তো কোনওদিন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায়নি। দু’দেশের সুসম্পর্ক সর্বজনবিদিত। অথচ মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশ-ভারত ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্তে ২০২০ সালে ৪৮ জন নিহত হয়েছেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে। এ সীমান্তে যে খুব বড় মাপের কোনও অপরাধ হয় তা কিন্তু নয়। মেক্সিকো-আমেরিকা সীমান্তে মাদকপাচারকারীদের দৌরাত্ম্যের তুলনায় এ কিছুই না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানব ও গোরুপাচারের জন্য ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা চড়াও হয় বাংলাদেশিদের ওপর। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে ফাঁস হওয়া বিভিন্ন কেলেংকারিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের রাজনীতিবিদ ও আমলাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এতদিন এসব হয়ে আসছে। তাহলে একতরফা সন্দেহ কেন প্রতিবেশীর ওপর?
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত করার সময় প্রধান যুক্তি ছিল, ভারত কখনওই একটি দেশ ছিল না। অনেকগুলো রাজ্যে বিভক্ত ছিল। কিন্তু সে ধারণাটাই ছিল ভুল। ভারতবর্ষ অনেক রাজ্যে বিভক্ত ছিল, অনেক রাজা-মহারাজা ছিল, কিন্তু প্রজা সাধারণের চলাচলের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অখণ্ড ভারতকে এক দেশ ভেবেই লোকজন পেশোয়ার থেকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছে। ৪৭-এ দেশভাগের সময় ধরে নেয়া হয়েছিল এভাবেই অবাধে যাতায়াতের সুযোগ পাবে জনগণ। ১৯৫২ সালে পাসপোর্ট চালুর আগে কিন্তু মানুষ অবাধেই ঘুরে বেড়িয়েছে। কাশ্মীর বিরোধ এবং পরবর্তীতে পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন পাকিস্তান সরকারকে পাসপোর্ট চালুতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা ধারণা দুই দেশের মানুষের মধ্যে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সীমান্তের ওপারের মানুষজন খারাপ। অথচ সীমান্তের ওপারে রয়ে গেছে এ পারের মানুষেরই আত্মীয়স্বজন।
সিলেটের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। ভারত বিভাগের মাত্র একমাস আগে এখানে তড়িঘড়ি করে একটা গণভোট দিয়ে সিলেটকে পাকিস্তানের অংশ করা হয়। এর আবার একটা মহকুমা (করিমগঞ্জ) ও একটি জেলা (কাছাড়) দিয়ে দেয়া হল ভারতকে। সিলেটের মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সীমান্তরেখা বসে গেল। ৫ বছর যেতে না যেতে পাশের গ্রামের আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া হল। বলা হল ওটা অন্যদেশ। ফলে সীমান্ত অতিক্রম করার প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।
আমাদের দেশে গ্রামগঞ্জে জমির বিরোধে যেমন বিবাদমান দুই পক্ষই নিঃস্ব হয়ে যায়, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তেমন হয়। এ প্রসঙ্গে সোমালিয়ার কথা বলা যায়। সেনাশাসক সাইদ বারের সময় সোমালিয়ার অর্থনীতি দারুণ উন্নতি করেছিল। শিক্ষার হারও বেড়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে। রাষ্ট্রের এ সুবিধাজনক অবস্থায় বারে দীর্ঘকাল ধরে ইথিওপিয়ার দখলে থাকা ওগাডেন অঞ্চল পুনুরুদ্ধারের চেষ্টায় নামেন। সে জন্য ১৯৭৭ সালে সেনা অভিযান শুরু করেন। তাঁর ধারণা ছিল তাঁর পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবে। শেষমেশ দেখা গেল সোভিয়েত ইউনিয়ন ইথিওপিয়ার পাশ নিয়েছে। কিউবার সৈন্যরা আফ্রিকায় এসে সরাসরি ইথিওপিয়ার পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেয়। মাত্র ৮ মাসের যুদ্ধে সোমালিয়ার ভয়াবহ পরাজয় হয়। তাদের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। এই যুদ্ধই পরবর্তীতে সোমালিয়াকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়।
ভারত-পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সীমান্ত বিরোধে জড়িয়ে আছে। এর কড়া মূল্য দিতে হচ্ছে দেশদুটোকে। অপেক্ষাকৃত ছোট অর্থনীতির দেশ পাকিস্তানকে তুলনামূলক বেশি মাশুল দিতে হচ্ছে। ২০১৯ সালে পাকিস্তান তার বাজেটের ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ভারত তার ১৩ দশমিক ৭৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে সামরিক খাতে। ভারতের মত দরিদ্র একটি দেশ এখন পৃথিবীর তৃতীয় বৃহৎ অস্ত্রের ক্রেতা।
পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সবরকম বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য চিনকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছে। ‘চিন–পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর’ প্রকল্পের আওতায় ৬২ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো তৈরি করে দেবে চিন। এর আওতায় পাকিস্তানের গদর শহরের গদর বন্দর থেকে চিনের শিনচিয়াং প্রদেশের কাশগর পর্যন্ত দুহাজার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণ করা হবে। গদরে গড়ে তোলা হয়েছে গভীর সমুদ্রবন্দর। কিন্তু এখনই সমালোচনা উঠছে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে। গদর বন্দরের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, এ বন্দরে যেসব ট্রাক আসে মাল নিয়ে ফিরে যায় খালি অবস্থায়। কারণ পাকিস্তান থেকে নেয়ার মত কোনও পণ্য নেই চিনের। ফলে চিনের সঙ্গে একপাক্ষিক বাণিজ্যে যেতে হবে পাকিস্তানকে। পক্ষান্তরে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে দুটো দেশই উপকৃত হত।
একটা রাষ্ট্র চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। কেবল তার প্রতিবেশী পাল্টাতে পারে না। তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে অযথা বিরোধে না গিয়ে, প্রতিবেশীকে সন্দেহের দৃষ্টিতে না দেখে— সম্মান ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা বুদ্ধিমানের কাজ। নিকট অতীতে ভারত ও বাংলাদেশ ছিটমহল ও বিরোধপূর্ণ সীমান্তাঞ্চল নিয়ে যে ঐতিহাসিক চুক্তি করেছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য দলিল। কোনও প্রকার সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই আলোচনার মাধ্যমে ভূমিবিনিময়ের নজির পৃথিবীতে খুব একটি নেই। কিন্তু এই উজ্জ্বল নজির প্রতি মুহূর্তে অসম্মানিত হচ্ছে সীমান্তে। সীমান্তাঞ্চলের সাধারণ জনগণ তাদের আত্মীয়স্বজনকে দেখতে ওপারে যেতে পারছেন না। তাদের পাসপোর্ট ভিসার চক্করে ফেলে দেয়া হচ্ছে। অথচ ভারতের সঙ্গে নেপাল, ভুটান কিংবা শ্রীলংকার এ সমস্যা নেই। যেকোনও একটি বৈধ পরিচয়পত্র দেখিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এক দেশের নাগরিক আর-এক দেশে যেতে পারছেন। সেখানে ফালানিদের লাশ হয়ে ঝুলে থাকতে হয় না তারকাঁটায়।
২০১৩ সাল থেকে ভারত সরকার বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীদের জন্য পোর্ট এন্ট্রি ভিসা চালু করেছে। এতে সরকারি কর্মচারীরা তাদের বিদেশ ভ্রমণের ছুটির আদেশ দেখালেই ভারতীয় ইমিগ্রেশন পোস্ট থেকে ভিসা পেয়ে যান। বিগত ২০১৫ সালের ২ থেকে ৬ আগস্ট ভারতের নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলনে বাংলাদেশি নাগরিকদের স্বল্প মেয়াদে ভারত ভ্রমণের জন্য ‘পোর্ট এন্ট্রি ভিসা’ চালুর প্রস্তাব দিয়েছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এতে ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও আজ পর্যন্ত এর কোনও বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষ ক্ষেত্রে দুই দেশই প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের জন্য পোর্ট এন্ট্রি ভিসা চালু করা উচিত। এদের নাগরিকদের মধ্যে যাতায়াত বৃদ্ধি হবে। তৈরি হবে আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ।
ভালো লেখা। ইতিবাচক লেখা।