‘আমি বিশ্বের সকল মহান ধর্মে বিশ্বাসী। যতক্ষণ না আমরা পরধর্মকে শুধু সহ্য করতেই নয়, বরং নিজের ধর্মের মতো সম্মান করতে শিখব, পৃথিবীতে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও শান্তি আসবে না। মানবজাতির বিভিন্ন শিক্ষক ও পথপ্রদর্শকের বাণীসমূহ শ্রদ্ধার সঙ্গে অধ্যয়ন করা হবে এ রকম পারস্পরিক সম্মানের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।’ —মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী (কলকাতা, ২৪ মার্চ ১৯৩৮)
অসংখ্য সমালোচক তাঁদের ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এমনকি যাঁদের নিয়ে সাধনার পথে চলেছিলেন বা চলতে চেয়েছিলেন, তাঁরাও তাঁদের ভুল বুঝেছেন। কিন্তু সমালোচকদের সমালোচনাকে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের জীবনকে এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে রেখে গেছেন সারা বিশ্বের সর্বমানবের জন্য। হ্যাঁ, প্রতিতুলনা না করেও বলা যায়, লালন ফকির ও মহাত্মা গান্ধী— দুজনেই ছিলেন উদার মানবিকতায় বিশ্বাসী সর্বজনের হিতে সমর্পিত অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব।
দলীয় পদ-পদবি গ্রহণ না করেও গান্ধী ছিলেন রাজনীতিক, যাঁর মূলব্রত ছিল দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা। অপরদিকে লালন ছিলেন চালচুলোহীন নিঃস্ব ফকির, যিনি রাগে-অভিমানে শোষণ-জর্জর তথাকথিত কুলীন সমাজ পরিত্যাগ করেছিলেন আর-একটি নতুন সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার জন্য। মত-পথ ভিন্ন হলেও দুজনেই একটি ভক্তি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অসীম শক্তিধর কর্তৃত্ববাদী শাসককুল ও সমাজপতিদের পরাস্ত করতে চেয়েছিলেন। ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে দুজনেই বৈষ্ণব ভাব, শঙ্করের মতাদর্শকে মেনে নিয়ে, বুদ্ধ ও ইসলামের ভাবাদর্শে আস্থা রেখে সর্বধর্মের প্রতি সমভাব দেখিয়ে পরাধীন ও সংস্কারগ্রস্ত সমাজ ও রাষ্ট্রকে মুক্ত ও স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন।
দুই মহামানব-ই সকল হিংসাশ্রয়ী মতাদর্শ ও শাসনকে রুখতে চেয়েছিলেন অহিংস পথে, সম্প্রীতির মন্ত্র শুনিয়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, লালন-গান্ধীর সেই সম্প্রীতিময় ভাবনার ধারাটি ক্রমশ দুর্বল যাচ্ছে। সব জায়গায় এখন হিংসা-বিভেদ আর ভাঙনের বেসুরো বাজনা। ‘মহামানবের মিলনতীর্থে’ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান করেন খুব কম সংখ্যক মানুষ, বরং এর বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদিতা ধ্বংস করার জন্য ধরাচুড়ো পরে উঠেপড়ে লেগে গেছে একদল স্বার্থান্ধ মানুষ। সবকিছুর ওপর ধর্মবিদ্বেষ, ঘৃণা আর সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে দেয়া হচ্ছে। হার্দিক আলাপ-আলোচনা, প্রাণখোলা আড্ডা, মুক্তচিন্তা চর্চার পরিবেশ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। কর্তৃত্ববাদী চিন্তার দৌরাত্ম্যে মতপ্রকাশের পরিসরটাও ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে। উপমহাদেশের সবখানে একধরনের জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংবিধানের পাতায় কালো হরফে লেখা আছে বটে, কিন্তু এর চর্চা ও প্রয়োগের সুযোগ কোথায়! হর-হামেশা মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ভিন্নমতাবলম্বী মানুষকে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রতিবাদী মানুষকে জেলে পুরে অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে, কাউকে কাউকে মেরেও ফেলা হচ্ছে। উপমহাদেশ জুড়েই মুক্তচিন্তার বিদ্রোহী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দিতে ক্ষমতাধর ও সংখ্যাগরিষ্ঠরা একধরনের ক্রুসেড ঘোষণা করেছে। অথচ ব্রিটিশ শাসনামলে রামমোহন, বিদ্যাসাগররাও এমন চাপ ও নিগ্রহের মুখোমুখি হননি। আজকের জামানায় বেঁচে থাকলে হয়তো-বা চণ্ডীদাস, লালন, নজরুলরাও নিগৃহীত ও অপমানিত হতেন। রাষ্ট্র তাদের মত সহ্য করত না। ভারতীয় উপমহাদেশের কোথাও বিরুদ্ধমত সহ্য করা হয় না। প্রবল প্রতাপের কাছে পরাস্ত হয়ে মানুষ মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভাবতে শুরু করেছে, মুক্তচিন্তা, ভিন্নমতের চর্চা না-করাই ভাল! কী হবে তর্ক করে— ভিন্নমত প্রকাশ করে কী লাভ? বরং মুখ বন্ধ রাখাই নিরাপদ।
অথচ আমাদের সমাজটা তো এমন ছিল না। ভারতীয় তথা বাঙালি সমাজ সর্বকালে, সর্বযুগে নানা বিষয় নিয়েই তর্ক করেছে, তর্ক করেছে বস্তুবাদ ও ভাববাদী মতাদর্শ নিয়ে। হিন্দু ও মুসলমান মৌলবাদের সঙ্গে যেমন তর্ক করেছে, আবার ধর্মনিরপেক্ষ ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের সঙ্গে তর্ক করতে কসুর করেনি। তর্কের মাধ্যমেই আমরা ধর্ম-সাহিত্য, রাজনীতি, দর্শন-বিজ্ঞানের সত্য আবিষ্কার করেছি। তার্কিক প্রবণতা ভারতীয় সমাজকে যুক্তিবাদী ও সহনশীল করে করেছে। সহনশীল ভাবপ্রবণতার কারণে ভারতবর্ষের মানুষ বিশ্বের সকল মহৎ ভাবনা আপন করে নিতে পেরেছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু হায়, ইতিহাসের চাকা যে উল্টো দিকে ঘুরতে শুরু করেছে! একদল ক্ষমতাধর মূঢ়মতি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগেও প্রগতির রথকে থামিয়ে দিতে চাইছে। কোনও যুক্তিতর্কই তারা মানতে চাইছে না। প্রশ্ন জাগে, হিন্দু সমাজের সংস্কারের জন্য রামমোহন, বিদ্যাসাগররা যেসব অকাট্য যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন তা কি আজকের জামানায় সম্ভব হত? ব্রিটিশ-শাসিত, ব্রাহ্মণ্যবাদ-নিয়ন্ত্রিত সমাজে দাঁড়িয়ে লালন যে-সাহস নিয়ে মুক্তচিন্তার চর্চা করেছেন, তা কি আজকের তথাকথিত সভ্যভব্য যুগে সম্ভব হত?
মহাত্মা গান্ধী নিজেকে হিন্দু বলে পরিচয় দিতে দ্বিধা করেননি, কিন্তু হিন্দুধর্মের সবকিছু যুক্তিহীনভাবে মেনেও নেননি। সবকিছু যুক্তির কষ্ঠিপাথরে যাচাই করেই গ্রহণ করেছেন। অদ্বৈত বেদান্ত মতকে মেনে নিয়েও হিন্দুধর্মের নানা বিষয় নিয়ে তিনি প্রশ্নবাণ ছুড়ে দিয়েছেন। হিন্দুধর্মকে একটি বিকাশশীল জীবনব্যবস্থা হিসেবে গ্রহণ করতেই তিনি তর্ক করেছেন। লালনও তর্ক করেছেন, নানা বিষয় নিয়ে তর্ক করেছেন, তাঁর বক্তব্যের সপক্ষে ক্ষুরধার যুক্তিও প্রদান করেছেন। তিনি উচ্চশিক্ষিত ছিলেন না বটে, তবে উচ্চস্তরের ভাবুক ছিলেন। কেতাবি শিক্ষায় শিক্ষিত পণ্ডিতরা যাই বলুন না কেন, তাঁর মধ্যে জ্ঞানমনস্কতা ও সমাজমনস্কতা দুটোই ছিল। মধ্যযুগের মানুষ হয়েও ছিলেন দারুণ সেনসিটিভ। ইসলাম সম্পর্কে লালনের বেশ মজবুত ধারণা ছিল, ইসলামধর্মটা বেশ ভালভাবেই বুঝতেন। মুসলমান-অধ্যুষিত সমাজের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠার কারণে ইসলামের ভেতর-বাহির দুই-ই নিবিড়ভাবে জানতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি আসলে গড়পড়তা ইসলামের কথা বলতে চাননি। গড়পড়তা ইসলামি কনসেপ্টটি ভেঙেচুরে নিজস্ব কনসেপ্টে তিনি ইসলামের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রচার-সর্বস্ব শরিয়তপন্থীরা সেটা বুঝতে পারেনি। এ কারণেই সম্ভবত শরিয়তপন্থীদের উদ্দেশ করে লালন বলেছেন, ‘বে-এলেম বে-মুরিদ জনা/ শরিয়তের আঁক চেনে না/ কেবল মুখে তোড় ধরে।’ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আজকের দিনে বেঁচে থাকলে তিনি কি মরমিয়া পথে হাঁটতে পারতেন? পৃথিবীর তাবৎ ধর্ম সম্পর্কে এমন মুক্তভাবে নিজ দৃষ্টিভঙ্গি কি ব্যাখ্যা করতে পারতেন? তিনি কি আক্রমণের শিকার হতেন না? অনেক ক্ষেত্রেই তো তিনি ইসলামের ভিন্নমাত্রিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন:
‘এমন দিন কি হবে রে আর/ খোদা সেই করে গেল/ রসুলরূপে অবতার।’
কিংবা,
‘আদমেতে পয়দা করে/ খোদছুরাতে পরওয়ার/ ছুরাত বিনে পয়দা কিসে হইল/ সে কি হঠাৎকার।’
উল্লিখিত গানের প্রথম পদে নবি করিম (সা.)-কে আল্লাহর অবতার হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা কোনওভাবেই ইসলামসম্মত নয়। দ্বিতীয় পদে সাকার আল্লাহর কথা বলা হয়েছে, যদিও ইসলামি বিশ্বাসে নিরাকার আল্লাহর কথাই বলা হয়েছে বারবার। তবে লালন সাকারবাদী হলেও পৌত্তলিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানুষতত্ত্বে বিশ্বাসী একজন যুক্তিবাদী, তার্কিক ব্যক্তিত্ব। নদীয়াতে এক সময় নব্য ন্যায়ের চর্চা ছিল। শ্রাদ্ধে, উপনয়নে ও ধর্মসভায় নানা বিষয় নিয়ে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা তর্ক-বিতর্ক করতেন। মুসলমান মওলানারাও তর্কযুদ্ধ বা বাহাসে অবতীর্ণ হতেন। এই তর্কযুদ্ধ মানুষ প্রাণভরে উপভোগ করত, অনুপ্রাণিত হত। তর্কযুদ্ধের ভাব-তরঙ্গ গ্রামবাংলাতে ছড়িয়ে পড়ে। লালনের মধ্যে যে তর্ক করার প্রবণতা ছিল, তা তিনি নদীয়ার ন্যায়ের চর্চা থেকে আহরণ করেন। তিনি ধর্ম কিংবা ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি বটে, তবে ধর্মের যা কিছু গ্রহণ করেছেন তা বুঝেশুনেই করেছেন, কোনও কিছু অন্ধভাবে গ্রহণ করেননি। মানুষের বানানো জাতধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য মানবতাবাদী ফকিরি ধর্ম বেছে নিয়েছিলেন। লালনের অনেক আগে, মধ্যযুগের ভারতীয় সন্ত-সাধক কবীর, রামদাস, তুলসীদাস, দুদ্দু প্রমুখও ভক্তিমান সন্ত ছিলেন, তাঁরাও জাতধর্মের বাড়াবাড়ি মেনে নেননি। প্রচলিত ধর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে এক নিরঞ্জনের উপাসনা করেছেন। কয়েকশো বছর পর লালনও বলেছেন, ‘রাম-রহিম-করিম-কালা এক আত্মা জগৎময়।’ এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের কোনও পার্থক্য খুঁজে পাননি। পূজা, নামায, হজ্ব কিংবা তীর্থদর্শনের মাধ্যমে তিনি সাঁই নিরঞ্জনকে খোঁজ করতে চাননি, খোঁজ করেছেন ভক্তি ও প্রেম দিয়ে। মনে করতেন আলেক সাঁইয়ের কাছে হিন্দু কিংবা যবন বলে কিছু নেই, তাঁর কাছে সবাই সমান। তাঁকে পাওয়া যায় কেবল ভক্তির মাধ্যমে।
লালনের মত মহাত্মা গান্ধীও ছিলেন যুক্তিবাদী মরমিয়া, যুক্তি দিয়ে হিন্দুধর্মের সত্যকে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। লালন ও গান্ধী দুজনেই ছিলেন এক বিস্ময়কর ও বিতর্কিত মানুষ, অথচ অমর। তবে গান্ধীর মত লালনের বিশ্বজোড়া পরিচিতি-খ্যাতি ছিল না। পশ্চিমা দুনিয়ায় ছেলে-বুড়ো সবাই গান্ধীজিকে চেনেন-জানেন। বিংশ শতাব্দীর যে কয়েকজনের নাম সর্বজনবিদিত তাঁদের একজন তিনি। পশ্চিমা দুনিয়ায় উচ্চস্তরের একাডেমিক পরিমণ্ডল ছাড়া লালনের তেমন পরিচিতি নেই। লালন প্রথাগত পদ্ধতিতে ধর্ম পালন করতেন না, প্রচণ্ড যুক্তিবাদী ছিলেন তিনি। গান্ধীও যুক্তিবাদী ছিলেন, কিন্তু নিরীশ্বরবাদী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বৈদিক দর্শনে আস্থাশীল নিষ্ঠাবান হিন্দু, তারপরও বলেছেন, এই ধর্মের ‘ক্ষয় ও বৃদ্ধি, ঋতুর পরিবর্তন তাকে প্রভাবিত করেছে।’ তিনি মনে করতেন, এই ধর্মের ‘শরৎ, গ্রীষ্ম, শীত ও বসন্ত আছে। বৃষ্টি তাকে পুষ্টি যোগায়, তাকে ফলন্ত করে। ধর্মগ্রন্থেও এর ভিত্তি আছে, আবার নেইও।’ তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, ‘হিন্দুধর্মের কোনও সুনির্দিষ্ট মতবাদ নেই।’ বলেছেন, সত্য আর অহিংসাই আমার ধর্মমত।— কোনও মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও নিজেকে হিন্দু বলতে পারে। অক্লান্ত সত্যেন্বষাই হিন্দুধর্ম। সকল ধর্মের চেয়ে হিন্দুধর্ম সহিষ্ণু এ তো বিনিশ্চিত। হিন্দুধর্মমত সকলকে আপন করে নেয়। (ইয়ং ইন্ডিয়া, ২৪ এপ্রিল ১৯২৪) হিন্দুধর্মের আচার-আচরণ পালনের চেয়ে প্রেম ও মানবিকতাকে তিনি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। লালনের মত গান্ধীর মন ও ভাব ছিল মরমি ছাঁচে ঢালা। দুজনেই ছিলেন জিজ্ঞাসু, দুজনেই মরমিয়া। লালন বলেছেন, ‘কি কালাম পাঠাইলেন আমার সাঁই দয়াময়/ এক এক দেশে এক এক বাণী কোন খোদা পাঠায়?’ লালনের প্রশ্ন, সব বাণী যদি খোদার হয়, তাহলে তিনি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকমের বাণী পাঠিয়েছেন কেন? এক খোদা একেক দেশে একেক রকমের বাণী পাঠাতে পারেন না। এসব যুক্তি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, লালন হিন্দু পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলেও হিন্দুধর্মের সবকিছু অন্ধভাবে মেনে নেননি। আবার মুসলমান পরিবারে জন্মালে বা ধর্মান্তরিত মুসলমান হলেও তিনি ইসলামি শরা-শরিয়ত মানতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন লোকায়ত-মানবিক ধারার স্বনির্মিত ইসলাম ধর্মে। তিনি ছিলেন নির্জন পথের এক সাহসী ও লড়াকু যোদ্ধা।
বিশ্বজোড়া খ্যাতি থাকা সত্ত্বেও মহাত্মা গান্ধী লালনের মত অত সাহসী ছিলেন না। চিন্তা-চেতনায় খানিকটা ব্যতিক্রমী হলেও গান্ধীজি নিষ্ঠাবান ধার্মিক ছিলেন। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ বিশ্বাস করতেন। অবতার, পুনর্জন্ম, বর্ণাশ্রম প্রথা ও মূর্তিপূজাকেও অবিশ্বাস করতেন না। তবে হিন্দুধর্মের জাতপাত ও অস্পৃশ্যতা মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, অস্পৃশ্যতা কেবল অপ্রয়োজনীয় নয়, অসঙ্গতও বটে। অস্পৃশ্যতার প্রতি ঘৃণা জানিয়ে বলেছেন, ‘যে-ধর্ম গরুকে পূজা করতে বলে, তা মানুষকে অমন নিষ্ঠুর ও অমানবিকভাবে বর্জন করতে পারে না। দলিত শ্রেণির মানুষদের আপনজন বলে স্বীকার করব না? তাহলে আমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হোক।’ তিনি বলেছেন, অস্পৃশ্যতা পাপ, ওটা শয়তানের চাল। শয়তান সর্বদা শাস্ত্রের দোহাই দেয়। কিন্তু শাস্ত্র তো বিবেকের চেয়ে বড় নয়। বিবেকের সত্যকে উদ্ভাসিত করার জন্য শাস্ত্র রচিত হয়েছে। তিনি নিয়মিত ভাগবৎ গীতা ও তুলসীদাসের রামায়ণ পাঠ করতেন। এগুলো থেকেই তিনি সান্ত্বনা, শান্তি ও আধ্যাত্মিক পুষ্টি সংগ্রহ করতেন। কিন্তু রামায়ণের প্রতিটি শব্দ অন্ধভাবে মেনে নিতে পারেননি, তবে গ্রন্থটির ভেতর যে আধ্যাত্মিকতা রয়েছে সেটা তাঁকে মুগ্ধ করত। ‘শূদ্রদের বেদাধ্যয়নের অধিকার নেই’, কথাটি তিনি আক্ষরিক অর্থে সমর্থন করতে পারেননি। তিনি মনে করতেন, ‘সংস্কারহীন, মূর্খ ও অজ্ঞানই শূদ্র। এমন লোকেরা বেদাধ্যয়নের অনর্থ ঘটাবে।’ অর্থাৎ শাস্ত্র বিশ্লেষণকারীকে অবশ্যই জ্ঞানী ও ভক্তিমান হতে হয়। যার ভক্তি নেই তিনি শূদ্র। ‘যতদিন আমরা ক্রীতদাস, ততদিন আমরা সবাই মূলত শূদ্র। জ্ঞান কোনও শ্রেণির বা সমাজের একচেটিয়া নয়।’ কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এখনও আমরা ভেদবুদ্ধির অচলায়তন ভেঙে উপমহাদেশের কোথাও সমতাভিত্তিক মুক্ত সমাজ গড়তে পারিনি। লালন-গান্ধী অচলায়তন ভাঙতে চেয়েছিলেন, তবে প্রবল-পরাক্রান্তের সঙ্গে লড়াই করে কুলিয়ে উঠতে পারেননি। দুজনকেই অবিশ্বাস আর সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। অথচ তাঁরা দুজনেই জগতের সব মানুষকে ভালবেসে গেছেন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরও গান্ধীজি মুসলমান-সমাজকে দূরে ঠেলে দিতে চাননি। তাঁর প্রার্থনাসভায় নিয়মিত কোরান পাঠ করা হত। দেশভাগের পর ৩১ অক্টোবর প্রার্থনাসভার প্রাক্কালে দুজন ক্ষোভ প্রকাশ করেন যে, কোনওভাবেই প্রার্থনাসভায় কোরানপাঠ করা চলবে না। গান্ধীকে তাঁরা চিঠি লিখেও জানান। কিন্তু গান্ধীজি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, প্রার্থনাসভায় কোরান পাঠ হবে, যাদের পছন্দ হবে না তারা যেন প্রার্থনাসভা থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে নেন। গোটা উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান মেরুকরণ তীব্রতর হওয়ার পরও তিনি প্রার্থনাসভা থেকে কোরান পাঠ প্রত্যাহার করতে রাজি হননি। তিনি বলেছেন, আমি হিন্দু, আমি মুসলমান, আমি খ্রিস্টান, আমি জরথ্রুষ্টবাদী, কিন্তু আমি নাস্তিক নই। গান্ধীজিকে এক নাস্তিক ভক্ত বলছেন, ‘ধর্ম না থাকলে রাজনীতি হিংসামুক্ত হতে পারে। কী হবে ধর্ম?’ গান্ধীজি তাঁকে বলছেন, ‘ঈশ্বরকে বাইরে খুঁজছ, তাই তুমি নাস্তিক। ঈশ্বরকে সোজা নিজের থেকে মানে আত্মা থেকে শুরু করো, তাহলেই আর হানাহানি থাকে না।’ কী অসাধারণ মুক্তচিন্তার পরিসর, কী উদার দৃষ্টিভঙ্গি! লালনও এমন প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ ছিলেন, তিনিও সর্বধর্মের সারকথা গ্রহণ করেছিলেন। তাই ‘এক জেতের বোঝা লয়ে’ মরতে চাননি। গান্ধীজির মত বৃহৎ পরিসরে তিনি ধর্মমত প্রচারের সুযোগ পাননি। এক ক্ষুদ্র পরিসরে গানকে হাতিয়ার করে তিনি তাঁর মতাদর্শ প্রচার করে গেছেন।
লালনের আবির্ভাবকালে অবিভক্ত বাংলাজুড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদের চোখরাঙানি ছিল, বৈষ্ণবদের মধ্যেও অবক্ষয় দেখা দেয়। খ্রিস্টান পাদরিরা কারণে-অকারণে যিশুর মহিমা আর খ্রিস্টধর্মের গৌরবগাথা প্রচারের নামে বাড়াবাড়ি করতে থাকে। নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক মানুষ ধোঁয়াশায় পড়ে খ্রিস্টধর্মের বিশাল পাখনার নিচে জড়ো হতে থাকে। হাজি শরিয়তুল্লাহ, কেরামত আলি, দুদ্দু মিয়া, মুনসি মেহেরউল্লাহর মতে মৌলভী গ্রাম-জনপদে সহজ-সরল মুসলমান সমাজকে উগ্রপন্থার দিকে চালিত করার জোর প্রচার চালিয়ে যেতে থাকে। মুসলমান সমাজ অসহিষ্ণু ও পরধর্মবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। সমাজে হিংসা-হানাহানি বাড়তে থাকে, সৃষ্টি হয় বিভেদের উঁচু পাচিল। এসব ঘটনা প্রতিহত করার সাংগঠনিক ক্ষমতা বা লোকবল লালন ও তাঁর অনুসারীদের ছিল না। তাই বোধ হয় গানকেই বেছে নিয়েছিলেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হাতিয়ার হিসেবে। তিনি একটি গানে বলছেন: ‘ব্রহ্মজ্ঞানী আর খ্রিস্টানেরা,/ নাম-ব্রহ্মসার বলেন তারা/ দরবেশ কয় বস্তু কোথায়/ দেখ নারে।’ তিনি প্রশ্ন তুলছেন: ‘নয়নে রূপ না দেখতে পায়/ নামমন্ত্র জপিলে কী হয়?’
লালন বাস্তববাদী ছিলেন, তাই আচারসর্বস্ব অন্ধ ব্রাহ্ম ও খ্রিস্টান ভক্তদের প্রশ্নবাণে পেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। কোন জাতধর্মে তাঁর জন্ম তা জানা যায় না, তবে তাঁর ধর্মভাবনা ও চিন্তাধারা ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল, এটা খুব ভালভাবেই বোঝা যায়। কিন্তু ইসলামের নামায, রোযা, হজ প্রভৃতি বিষয়গুলি ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। লালন ইসলাম বা কোনও ধর্মের-ই বিরোধী ছিলেন না, যারা তাঁকে ধর্মবিরোধী অপ-অভিধায় ভূষিত করতে চায়, তারা আসলে রাজনৈতিক-মতলববাজ। তিনি যে-ইসলামের কথা বলেছেন তা আসলে মানবিক-ইসলাম। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’ তাই তিনি স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন, মানবগুরুর কৃপা ছাড়া এবাদত-বন্দেগি হবে না। গুরু পথপ্রদর্শক, তিনি আলোর পথের দিশারি। গুরুর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হয়ে জগৎ-জীবনের ভেদরহস্য জেনে নিতে হয়, তার কৃপা-অনুকম্পা বিনা ধর্মবোধ সম্পন্ন হওয়া যায় না। তিনি বারবার বলেছেন: ‘মুর্শিদ জ্ঞানের দাতা, জ্ঞান ছাড়া ভজন কথা বৃথা/ আছে প্রেম যথাতথা গুরুর ভজন চাই।’ অথচ লালনের এই মানবিক ভাবনা অহংকারী ‘পণ্ডিত’ ‘কানা’-র দল আজও বুঝে উঠতে পারেননি। ওহাবি-ফরায়েজিদের অনুদার-প্রতিক্রিয়াশীলরা তাঁকে ‘মুতখেকো ন্যাড়ার ফকির’ অপ-অভিধায় ভূষিত করেছে। কেউ আবার বলেছেন, ‘জন্ম পরিচয়হীন জারজ সন্তান’। মওলানা আকরাম খান ‘মুসলিম সমাজের চারিত্রিক ও নৈতিক অধঃপতনে’ লালন ও তাঁর অনুসারী ন্যাড়ার ফকিরদের দায়ী করেছেন। মৌলবি আবদুল ওয়ালির সমালোচনা থেকেও লালন ও বাউলরা রক্ষা পাননি। জীবৎকালে তাঁকে পাষণ্ড, ব্রাত্য, ন্যাড়া, জারজ— এইসব গালমন্দ সইতে হয়েছে।
লালনের মত গান্ধীজিও নানাভাবে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ভি আম্বেদকর বলেছেন, ‘আমিই প্রকৃত গান্ধীকে চিনি, কারণ আমি তাঁকে শত্রু হিসেবে চিনেছি। আমাকেই তিনি বিষদাঁত দেখিয়েছিলেন।’ আরও বলেছিলেন, ‘গান্ধী স্মরণীয় কেউ নন। ভারত সরকার তাঁর স্মৃতি জিইয়ে রাখার জন্য অনেক পয়সা খরচ না করলে গান্ধীকে কেউ মনে রাখত না।’ (তর্কে-প্রতর্কে গান্ধীজি, দেশ ২ অক্টোবর ২০২০)। মার্কিন ইতিহাসবিদ লেনার্ড গর্ড তাঁর বইয়ে লিখেছেন, গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশ দশকে হিন্দু বাঙালিরা অনেকে তাঁকে ‘গেঁধে শালা’ বলতেন। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে মাওবাদীরা গান্ধীর চেয়ে মাও জে দং-কে বড় করে দেখতেন। তরুণীদের নিয়ে তাঁর আত্মসংযমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে গান্ধীভক্ত এরিক এরিকসন তাঁর ‘Gandhi’s Truth’ (১৯৬৯) গ্রন্থে সমালোচনা করেছেন। জাতপাত ও অস্পৃশ্যতাবিরোধী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা নিয়েও ইদানীং প্রশ্ন উঠছে। ইতিহাসবিদ অজয় স্কারিয়া অস্ট্রেলিয় একটি গণমাধ্যমে গান্ধীজি বর্ণবিদ্বেষী কথার ব্যবহার করতেন কিনা, সে বিষয়ে একটি হিসাব দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘গান্ধী কি কালোমানুষদের প্রতি বর্ণবিদ্বেষী ছিলেন?’ অথচ বিশ্ববরেণ্য মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা গান্ধীজিকে তাঁদের অনুপ্রেরণা বলে বর্ণনা করেছেন।
হালফিলে দেশে দেশে গান্ধীজির ভাস্কর্য ভাঙার আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় লালনের ভাস্কর্যও ভাঙা হয়েছে। বিগত শতাব্দীর সত্তরের বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্যও ভাঙা হয়েছিল। যারা বিদ্যাসাগরের ভাস্কর্য ভেঙেছিল তাদের ক’জনকে আমরা মনে রেখেছি? বরং বিদ্যাসাগর মহাশয় স্বমহিমায় বিদ্যমান। তবে হ্যাঁ, লালন-গান্ধী কোনও ত্রুটিহীন অ-বিতর্কিত মানুষ ছিলেন না। তাঁদের চিন্তা-দর্শন ও জীবনাচরণের মধ্যে ফাঁকফোকর, বিচ্যুতি থাকতে পারে। তাঁদের ভাবনাচিন্তা সেকেলে-অবাস্তব, কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রগতিবিরোধীও মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁদের উপেক্ষা করা যায় না। সারা বিশ্বের মানুষ এই দুই মানবতাবাদীকে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে। সব অভিযোগ মেনে নিয়েও বলতে হয়, আসলে তাঁরা দুজনেই ছিলেন ভয়ংকর ও অসাধারণত্বের সংমিশ্রণে গড়া অনন্য মানুষ। শেষনিশ্বাস ত্যাগের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত জীবনচর্যায় লালিত সত্য ও দর্শন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি। তাঁরা দুজনেই মানুষের মুক্তি, স্ব-সমাজের মুক্তি সর্বোপরি সামগ্রিক মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেন।