‘‘রথযাত্রার দিন কাছে।
তাই রানী রাজাকে বললে, ‘চলো, রথ দেখতে যাই।’
রাজা বললে, ‘আচ্ছা।’
ঘোড়াশাল থেকে ঘোড়া বেরোল, হাতিশাল থেকে হাতি। ময়ূরপংখি যায় সারে সারে, আর বল্লম হাতে সারে সারে সিপাইসান্ত্রি। দাসদাসী দলে দলে পিছে পিছে চলল।
কেবল বাকি রইল একজন। রাজবাড়ির ঝাঁটার কাঠি কুড়িয়ে আনা তার কাজ।
সর্দার এসে দয়া করে তাকে বললে, ‘ওরে, তুই যাবি তো আয়।’
সে হাত জোড় করে বললে, ‘আমার যাওয়া ঘটবে না।’
রাজার কানে কথা উঠল, সবাই সঙ্গে যায়, কেবল সেই দুঃখীটা যায় না।
রাজা দয়া করে মন্ত্রীকে বললে, ‘ওকেও ডেকে নিয়ো।’
রাস্তার ধারে তার বাড়ি। হাতি যখন সেইখানে পৌঁছল মন্ত্রী তাকে ডেকে বললে, ‘ওরে দুঃখী, ঠাকুর দেখবি চল্।’
সে হাত জোড় করে বলল, ‘কত চলব। ঠাকুরের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছই এমন সাধ্য কি আমার আছে।’
মন্ত্রী বললে, ‘ভয় কী রে তোর, রাজার সঙ্গে চলবি।’
সে বললে, ‘সর্বনাশ! রাজার পথ কি আমার পথ।’
মন্ত্রী বললে, ‘তবে তোর উপায়? তোর ভাগ্যে কি রথযাত্রা দেখা ঘটবে না।’
সে বললে, ‘ঘটবে বই কি। ঠাকুর তো রথে করেই আমার দুয়ারে আসেন।’
মন্ত্রী হেসে উঠল। বললে, ‘তোর দুয়ারে রথের চিহ্ন কই।’
দুঃখী বললে, ‘তাঁর রথের চিহ্ন পড়ে না।’
মন্ত্রী বললে, ‘কেন বল্ তো।’
দুঃখী বললে, ‘তিনি যে আসেন পুষ্পকরথে।’
মন্ত্রী বললে, ‘কই রে সেই রথ।’
দুঃখী দেখিয়ে দিলে, তার দুয়ারের দুই পাশে দুটি সূর্যমুখী ফুটে আছে।’’
[রথযাত্রা]
অথবা সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তি—
‘‘রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব–হাসে অন্তর্যামী।’’
[ভক্তিভাজন]
রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘লিপিকা’ ও ‘কণিকা’ গ্রন্থের এই লেখাদুটির সঙ্গে আমরা প্রায় কমবেশি সকলেই পরিচিত। ভারতের আত্মার প্রকৃত পরিচয়প্রকাশক বিশ্বকবি যে উৎসব সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন, সেই রথযাত্রার ইতিহাস ভারতবাসীদের কাছে তো অবশ্যই, বিদেশিদের কাছেও যথেষ্ট আগ্রহের বিষয় বলে মনে হয়। আর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুকে ঘিরে সবকালে, সবযুগেই নানা গল্পকথা শোনা যায়, স্বাভাবিকভাবেই রথযাত্রাও তার ব্যতিক্রম নয়। রথযাত্রাকে ঘিরে তাই নানা কাহিনি বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে।
এদের মধ্যে অনেক কাহিনি বহুচর্চিত, বহুশ্রুত। তবে একটি তুলনামূলক কিছুটা কম জানা কাহিনি হল এরকম: শোনা যায়, রোহিনীদেবীর কাছ থেকে একবার শ্রীকৃষ্ণের ৮ জন স্ত্রী একটি কাহিনি শুনতে চেয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণের বাল্যকাল ঘিরে। সেই সময় রোহিনী সুভদ্রাকে দরজা আটকে দিতে বলেন। আর দেখতে বলেন, যেন শ্রীকৃষ্ণ আর বলরামের মধ্যে কেউ ঘরে ঢুকে পড়তে না পারেন। এদিকে গল্প শুনতে শুনতে মোহিত হয়ে সুভদ্রা আর খেয়াল রাখতে পারেননি দরজার দিকে। ততক্ষণে ঢুকে পড়েন শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম। এরপর দেখা যায়, শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা নিজেদের ছোটবেলার কথা শুনে এতটাই ভাবুক ও উদাস হয়ে পড়েন যে, তাঁরা স্থবির হয়ে যান। কিছু মুহূর্তের জন্য তাঁদের হাত-পা যেন বিলুপ্ত হয়ে যায়। সেই সময় সেখানে আসেন নারদমুনি। তিন ভাইবোনের এই রূপ দেখে তিনি আশ্চর্য হয়ে যান। নারদ প্রভুর যে রূপ দেখেছেন, এবার সেই রূপ তিনি জগৎকে দেখাতে চান। এর জন্য রথযাত্রার আয়োজনের মিনতি করেন নারদ। তারপরই শুরু হয় রথযাত্রা।
আবার পুরাণের আর একটি কাহিনি অনুসারে জানা যায়: শ্রীকৃষ্ণ বারো বছর বয়সে বৃন্দাবন ছেড়ে যান। তারপর আর কখনও বৃন্দাবনে পা রাখেননি। তবে একবার তিনি রথে চেপে পাশের গ্রামে এসেছিলেন প্রিয় বৃন্দাবনবাসীদের সঙ্গে দেখা করতে। তাঁর প্রতি বৃন্দাবনবাসীর ভালবাসা দেখে নাকি নির্বাক হয়ে পড়েন শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা। তিনজনের মধ্যে অমূর্তরূপ ফুটে ওঠে। কথিত আছে, এই রূপই হয়ে বর্তমান জগন্নাথদেবের রূপ। এই রথযাত্রা উৎসবকে শাস্ত্রে ‘মহাবেদী মহোৎসব’ নামে স্বীকার করা হয়েছে। পৌরাণিক মতে, বলরাম বা বলভদ্র, শ্রীকৃষ্ণ বা জগন্নাথ এবং সুভদ্রাদেবী এই তিনজন একে অপরের ভাইবোন। তাদের তিন ভাইবোনের নিবিড় স্নেহপরায়ণ সম্পর্কের জন্যই তাঁরা উপমাসদৃশ ও পূজনীয়।
রথযাত্রা উৎসবের মূল দর্শনীয় দিকটিও হল এই তিন ভাই বোনের মাসির বাড়ি গমনের আড়ম্বরপূর্ণ শোভাযাত্রা। প্রথমে যাত্রা শুরু করে বড়ভাই বলভদ্রের রথ। এই রথের নাম তালধ্বজ। রথটির চোদ্দোটি চাকা। উচ্চতা চুয়াল্লিশ ফুট। রথের আবরণের রং নীল। তারপর যাত্রা করে বোন সুভদ্রার রথ। রথের নাম দর্পদলন। উচ্চতা প্রায় তেতাল্লিশ ফুট। এই রথের মোট বারোটি চাকা। যেহেতু রথটির ধ্বজা বা পতাকায় পদ্মচিহ্ন আঁকা রয়েছে, তাই রথটিকে পদ্মধ্বজও বলা হয়ে থাকে। রথের আবরণের রং লাল। সর্বশেষে থাকে শ্রীকৃষ্ণ বা জগন্নাথদেবের রথ। রথটির নাম নন্দীঘোষ। পতাকায় কপিরাজ হনুমানের মূর্তি আঁকা থাকে তাই এই রথের আর এক নাম কপিধ্বজ। রথটির উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ ফুট। এতে ষোলোটি চাকা আছে। রথটির আবরণের রং হলুদ। ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’-এ জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল যে যুগে, সে সময় উড়িষ্যা মালবদেশ নামে পরিচিত ছিল। সেই মালবদেশের সূর্যবংশীয় পরম বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণুর জগন্নাথরূপী মূর্তি নির্মাণ করেন এবং রথযাত্রারও স্বপ্নাদেশ পান। পরবর্তীতে তাঁর হাত ধরেই পুরীতে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ ও রথযাত্রার প্রচলন শুরু হয়।
বাংলায় রথ প্রচলনের আবার ভিন্ন প্রেক্ষাপট। পুরাবিদদের মতানুযায়ী, পুরীর জগন্নাথদেবের রথযাত্রা থেকেই বঙ্গদেশে রথযাত্রার সূচনা৷ চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলায় নিয়ে আসেন৷ চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। এখন বাংলার বহু জায়গাতেই এই রথযাত্রা অত্যন্ত জনপ্রিয়৷ অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা জেলার উপজেলা ধামরাইয়ের সুবিশাল রথযাত্রা সেই অবিভক্ত বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকেই স্মরণ করায়।
পূর্ববঙ্গ থেকে এবার আসি পশ্চিমবঙ্গের রথযাত্রার কথায়। নীলাচল থেকে চৈতন্যদেবের হাত ধরে যেহেতু অবিভক্ত বাংলাদেশে রথযাত্রার গতি সুগম হয় তাই নবদ্বীপের রথযাত্রা ভক্তদের কাছে একটা আলাদা গুরুত্ব বহন করে। কারণ নবদ্বীপ চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান ও সন্ন্যাসপূর্ব লীলাক্ষেত্রের জন্য বিখ্যাত। নবদ্বীপে আজও একশো, দেড়শো এমনকি তিনশো বছর পার করা বিভিন্ন রথ পথে নামে আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিনে। কোনও রথ রাজবাড়ির, কোনও রথ বৈষ্ণব মঠের, কোনটা আবার নিতান্তই পারিবারিক। এমনকি মণিপুরের কিছু বাসিন্দাও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নবদ্বীপে রথের রশি টেনে চলেছেন।
মণিপুররাজ ভাগ্যচন্দ্র সিংহ নবদ্বীপে আসেন ১৭৯৭ সালে। তাঁর কন্যা বিম্বাবতী মঞ্জরী মহাপ্রভু দর্শনের স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন। ১৮০৩ সালে ভাগ্যচন্দ্রের মৃত্যুর পর কুমার চৌরজিৎ সিংহ বোন বিম্বাবতী মঞ্জরীর ইচ্ছানুসারে নবদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। তারপর ১৮০৫ থেকে নবদ্বীপে মণিপুর রাজবাড়ির রথের সূচনা। রাজবাড়ির চারটি মন্দির ঘুরে রথ ফিরে আসে রাজবাড়িতেই। মাসির বাড়ির প্রথা এখানে নেই। উল্টোরথ পর্যন্ত এখানে প্রতি সন্ধ্যায় উৎসব হয়। মণিপুরি নাচের সঙ্গে জয়দেবের পদ গেয়ে জগন্নাথের সন্ধ্যারতি এই রথযাত্রাকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে।
এবার আসা যাক আরও একটি স্বতন্ত্র রথযাত্রার কথায়। বর্ধমান জেলার মানকরের কর পরিবারের গান্ধর্ব্য কর তীর্থ করতে যান। কাশীতে তিনি পান লক্ষ্মী–জনার্দনের মূর্তি। বাড়িতে নিয়ে আসার পর তিনি স্বপ্নাদেশ পান মন্দির তৈরি করে মূর্তির পুজো শুরু করার। মন্দির তৈরি করে পুজো প্রচলন করা হয়। ১৩১৮ সালের ১৩ আষাঢ় মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। কর পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, কর পরিবারের মাধবচন্দ্র কর রথ তৈরি করিয়ে রথযাত্রা উৎসবের প্রচলন করেন। মানকরের দক্ষিণ রাইপুরের গোস্বামীপাড়ার শতাব্দীপ্রাচীন রথ কর পরিবারের রথ। কর পরিবারের পিতলের রথ সাড়ে নয় ফুট উচ্চতার। এই রথ তৈরি করেন স্থানীয় শিল্পী কেদারনাথ দে। রথের দিনে কুড়ি কেজি পিতলের ঘোড়া, সারথি এবং গরুড় পক্ষী দিয়ে রথ সাজানো হয়। পরিবারের রীতি অনুসারে কর পরিবারের গৃহদেবতা লক্ষ্মী–জনার্দনের পুজো হয় এবং তাঁদের প্রথমে রথে বসানো হয়। এছাড়াও রথে থাকে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার পটচিত্র। রথ এরপর কর পরিবারের বাড়ির মন্দির থেকে বের করে মানকর হাটতলার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মাটির একটি সুসজ্জিত বেদিতে দেবতাদের বিগ্রহ ও চিত্র রাখা হয়। এই বেদিকে মাসির ঘর বলে মেনে নেওয়া হয় পরিবারের রীতি অনুসারে। কিন্তু কর পরিবারের রথ বাড়ির বাইরে থাকে না একদিনের জন্যও। তাই রীতি মেনে রাত ১১টার পর রথ ফিরে আসে কর বাড়ির নিত্যপূজার মন্দিরে। উলটো রথের দিনেও একই নিয়ম মানা হয়।
আবার পুরীর জগন্নাথ মন্দির থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের মাহেশ, গুপ্তিপাড়া, বড়িশার রথের মূল দেবতা জগন্নাথদেব হলেও নদীয়ার শান্তিপুরের রথের কেন্দ্রে রয়েছেন শ্রীরঘুনাথ। শ্রীরঘুনাথের পাশাপাশি জগন্নাথদেবও রয়েছেন, তবে রথের মূলে থাকেন শ্রীরঘুনাথই। শান্তিপুরের বড় গোস্বামীবাড়ি, মধ্যম গোস্বামীবাড়ি বা হাটখোলা গোস্বামীবাড়ি সহ প্রাচীন সমস্ত রথ উৎসবেই প্রধান দেবতা হলেন এই রঘুনাথ বা রামচন্দ্র। তাঁরই দারুমূর্তি পূজা করা হয়। নদিয়া জেলার সুপ্রাচীন জনপদ এই শান্তিপুরে রঘুনাথের বিগ্রহটিও অন্যদের থেকে একটু আলাদা, এখানে রঘুনাথ বা রামচন্দ্র পদ্মাসনে বসে আছেন, তাঁর গায়ের রং সবুজ আর ধুতি ও চাদর রয়েছে তাঁর গায়ে। কিন্তু শান্তিপুরের রথ উৎসবের কেন্দ্রে রঘুনাথ কেন? এর পূর্ণাঙ্গ সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও কেউ কেউ মনে করেন শান্তিপুরের অদূরে অবস্থিত বাংলাভাষায় রামায়ণ রচয়িতা ফুলিয়ার কৃত্তিবাসকে স্বীকৃতি দিতেই রঘুনাথের এই প্রাধান্য।
বাংলার প্রসিদ্ধ রথযাত্রাগুলির মধ্যে হুগলীর গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রায় একটি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের প্রচলন আছে। গুপ্তিপাড়া রথযাত্রার এই একান্ত নিজস্ব বিশেষ অনুষ্ঠানটি হল এখানে ভাণ্ডার লুট হয়। ভারতবর্ষের কোথাও এই ভাণ্ডার লুট হয় না। ভাণ্ডার লুটের পেছনে একটা গল্প আছে। একবার মা লক্ষ্মীর সঙ্গে মন কষাকষি হওয়ায় প্রভু জগন্নাথদেব লুকিয়ে মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেন। মা লক্ষ্মী ভাবলেন, স্বামী বোধহয় পরকীয়ায় জড়িয়েছেন। শ্রীবৃন্দাবনের কাছে জানতে পারলেন প্রভু জগন্নাথ রয়েছেন মাসির বাড়িতে। স্বামীর মতিস্থির করাতে লক্ষ্মী লুকিয়ে ওই বাড়িতে ‘সর্ষে পড়া’ ছিটিয়ে আসেন, পরে জানতে পারেন মাসির বাড়ির উপাদেয় খাদ্যসমূহের জন্যেই প্রভু জগন্নাথ নাকি আসতে পারছেন না। তখন মা লক্ষ্মীর অনুরোধে শ্রীবৃন্দাবন লোকলস্কর নিয়ে যান মাসির বাড়ি, গিয়ে দেখেন, তিনটি দরজাই বন্ধ। দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তাঁরা সারি সারি মালসার খাবার লুঠ করে নেন, শেষে প্রভু জগন্নাথ মনের দুঃখে মা লক্ষ্মীর কাছে ফিরে আসেন। উল্টোরথের দিন এই ভাণ্ডার লুট হয়। মাটির এক-একটা মালসায় প্রায় পাঁচ কিলো করে প্রসাদ রাখা হয়। আর এরকম মালসার সংখ্যা প্রায় চারশোরও বেশি হয়। এগুলো লুঠ করাই হল ভাণ্ডার লুঠ।
এবার প্রায় ছশো বছরেরও বেশি প্রাচীন হুগলী জেলার বিখ্যাত মাহেশের রথের কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা বলি। কথিত আছে, ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে জগন্নাথদেবের এক ভক্ত পুরীতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে দেবতার দর্শন না পেয়ে মনঃকষ্টে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন তিনি। পরে ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে এসে গঙ্গার ধারে বসেছিলেন। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গায় ভাসমান একটি নিমকাঠ পান ধ্রুবানন্দ। সেই নিমকাঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পুরীতে যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্যদেব মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবও এসেছিলেন মাহেশের রথে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’ উপন্যাসেও মাহেশের রথের মেলার উল্লেখ আছে। এমনই ভক্তজনপ্রিয় মাহেশের রথের একটি বিশেষত্ব হল, মাহেশে গুণ্ডিচাবাটীকে বলা হয় কুঞ্জবাটী আর জগন্নাথদেব এখানে ‘মাসির বাড়ি’ যান না, তিনি তাঁর সখী পৌর্ণমাসির কুঞ্জে যান। আর তাই রথযাত্রা উৎসবের এক দিন ‘হোড়া পঞ্চমী’ উৎসব হয়। সেই সন্ধ্যায় এলাকার ছেলেরা মশাল ও পালকি নিয়ে প্রথমে জগন্নাথদেবের মন্দিরে আসেন। তারপর লক্ষ্মীদেবীকে ওই পালকিতে করে পৌর্ণমাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে তিনি জগন্নাথদেবকে সর্ষেপোড়া দিয়ে বশ করে সখীর বাড়ি থেকে ফিরিয়ে নিতে আসতে পারেন। সেই সর্ষেপোড়া সংগ্রহ করার জন্য দূর দূর থেকে ভক্তেরা আসেন।
বাংলার আর-একটি অন্যতম ঐতিহ্যবাহী রথযাত্রা হল মেদিনীপুরের মহিষাদলের রথযাত্রা উৎসব। মহিষাদল রাজ পরিবারের কুমার দেবপ্রসাদ গর্গ মারফত জানা যায়, রানি জানকী ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে এই রথ নির্মাণ করান। তখনকার সেই চারতলা রথটির ছিল ১৭টি চূড়া এবং ৩৪টি লোহার চাকা। মহিষাদলের সেই প্রথম রথটির বেশ কয়েকবার সংস্কার হয়েছে। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজা লছমনপ্রসাদের বন্ধু রথ সংস্কারের জন্য যে প্রস্তাব দেন, সেই প্রস্তাব মেনে রথের ১৭টি চূড়া কমিয়ে ১৩টি চূড়া করা হয়। প্রত্যেক তলার চারপাশে ঘোরানো বারান্দা তৈরি করানো হয় এবং চার কোণে চারজন ঋষির মূর্তি বসানো হয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা সতীপ্রসাদ রথের সামনে দুটো শ্বেতহস্তী যোগ করেন। সেই রথই আজও চলছে। পাঁচতলা কাঠের তৈরি এই রথটি সম্ভবত বিশ্বের উচ্চতম কাঠের তৈরি রথ। এই রথের চাকার সংখ্যা ৩৬টি। এখানে রথের আগের দিন রথের সামনে হয় বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান যা ‘লেদ উৎসব’ বা ‘নেত্র উৎসব’ নামে পরিচিত। ‘লেদ উৎসব’ হল রাজ পরিবারের সদস্যদের দ্বারা রথের রশি বাঁধন প্রক্রিয়া। আগে রাজ পরিবারের কোনেও সদস্য রথের সামনে হাতির ওপর বসে রথ সঞ্চালনা করে নিয়ে যেতেন। এখন আর তা হয় না। এখন রথযাত্রার আগে রাজ পরিবারের সদস্য পালকিতে চেপে এসে রথে রশি বেঁধে (লেদ উৎসব) রথযাত্রার শুভারম্ভ করেন। রথযাত্রার এই শুভারম্ভে আকাশ বাতাস সচকিত হয় বন্দুক থেকে বেরনো গুলির শব্দে। মহিষাদলের রথযাত্রার অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই তোপধ্বনি, যা পুরো রথযাত্রা ধরেই চলতে থাকে। মহিষাদলের রথের আরও দুটো বৈশিষ্ট্য হল, রথ টেনে নিয়ে যাওয়ার চারটি রশির একটি সংরক্ষিত থাকে মহিলাদের জন্য। আর মহিষাদলের রথে জগন্নাথদেবের পাশাপাশি মদনগোপালজিউর মূর্তিও থাকে।
এবার আসি রথযাত্রার ভোগের কথায়। খাবার ছাড়া যেমন জীবনধারণ হয় না, তেমনই ভোগপ্রসাদ ছাড়া উৎসব সম্পূর্ণ হয় না। জনশ্রুতি আছে, নীলাচলধামে কেউ অভুক্ত থাকেন না, তাই সাধারণ দিনেও জগন্নাথদেবের উদ্দেশে নিবেদনের জন্যে রান্না করা হয় ১০০-র বেশি পদ। আর রথের দিন জগন্নাথদেবের ভোগে থাকে বিশেষ ৫৬টি পদ। এই বিশেষ পদগুলি হল: ১) গুড়া উখুড়া অর্থাৎ মুড়কি, ২) নাড়িয়া কোড়া অর্থাৎ নারকেল নাড়ু, ৩) খুয়া অর্থাৎ ক্ষীর, ৪) দই, ৫) পাচিলা কাঁদালি অর্থাৎ পাকা কলা, ৬) কণিকা অর্থাৎ সুগন্ধী মিষ্টি ভাত, ৭) টাটা খিঁচুড়ি অর্থাৎ শুকনো খিচুড়ি, ৮) মেন্ধা মুন্ডিয়া অর্থাৎ একপ্রকার কেক, ৯) বড়া কান্তি অর্থাৎ ভাজা কেক, ১০) মিঠা পুলি অর্থাৎ রসবড়া, ১১) হামসা কেলি অর্থাৎ একপ্রকার বিশেষ ধরনের মিষ্টি কেক, ১২) ঝিলি অর্থাৎ এক ধরনের প্যান কেক বা দোসা, ১৩) এন্ডুরি অর্থাৎ অল্প চিনি দেওয়া তৈরি বড় ইডলি, ১৪) আদাপাচেদি অর্থাৎ আদা দিয়ে তৈরি চাটনি, ১৫) শাগা অর্থাৎ শাক, ১৬) মরীচ লাড্ডু অর্থাৎ লঙ্কার লাড্ডু, ১৭) কদলি ভাজা অর্থাৎ কলাভাজা, ১৮) লবঙ্গলতিকা, ১৯) বিরি বড়া অর্থাৎ টক ও মিষ্টি স্বাদের বড়া, ২০) আরিশা অর্থাৎ চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি মিষ্টি, ২১) বুন্দিয়া অর্থাৎ বোঁদে, ২২) পাখাল অর্থাৎ পান্তা ভাত, ২৩) খিড়ি অর্থাৎ চালের ক্ষীর, ২৪) কদম্বা অর্থাৎ একজাতীয় মিষ্টি, ২৫) পাত মনোহর অর্থাৎ আর-এক ধরনের মিষ্টি, ২৬) তাকুয়া; জিহ্বা আকৃতির মিষ্টি, ২৭) ভাগা পিঠে ২৮) গোটাই অর্থাৎ নিমকি, ২৯) দলমা অর্থাৎ সবজিডাল, ৩০) বড়া কাকারা অর্থাৎ চ্যাপ্টা বড় আকৃতির ভাজা মোদক, ৩১) লুনি অর্থাৎ নোনতা বিস্কুট, ৩২) আমালু অর্থাৎ স্ফীত আকৃতির মালপোয়া, ৩৩) পোড়া পিঠা অর্থাৎ বেকড পিঠে, ৩৪) বিরিবুহা অর্থাৎ বেসন দিয়ে তৈরী কালো পিঠে, ৩৫) ঝাডাই নাড্ডা অর্থাৎ ছোট ছোট বলের মত কেক, ৩৬) কাদালি বড়া অর্থাৎ কলার বড়া, ৩৭) খাজা, ৩৮) ফেনা সাকার অর্থাৎ চিনির লজেন্স, ৩৯) পুলিপিঠে, ৪০) কাঞ্জি অর্থাৎ সব্জি সহযোগে টক ভাত, ৪১) বলসা, ৪২) দাহি পাখাল অর্থাৎ দই ভাত, ৪৩) তিপুরী অর্থাৎ ত্রিস্তরীয় পুর, ৪৪) ছেনাপোড়া অর্থাৎ ছানাপোড়া, ৪৫) সুজি খিরি অর্থাৎ সুজির ক্ষীর, ৪৬) খুরুমা অর্থাৎ ছোট ছোট দণ্ডাকৃতির ময়দা দিয়ে তৈরি মিষ্টি, ৪৭) মুগা সিজা অর্থাৎ সবুজ ছোলা সেদ্ধ, ৪৮) মনোহরা মিষ্টি, ৪৯) মাগাজা লাড়ু; এক ধরনের মিষ্টি, ৫০) নাবাতা পানা অর্থাৎ মিষ্টি পানীয়, ৫১) সাদা ভাতা অর্থাৎ অন্ন, ৫২) ঘি ভাত, ৫৩) মিঠা ডালি অর্থাৎ গুড়ের মিষ্টি ডাল, ৫৪) বেসারা অর্থাৎ সর্ষে বাটা দিয়ে পাঁচমিশেলি সবজির তরকারি, ৫৫) মাহুর অর্থাৎ গোটা সর্ষের দানা দিয়ে তৈরি সব্জি, ৫৬) সাগা নাড়িয়া অর্থাৎ নারকেলের দুধ দিয়ে মাখা ভাত।
এমনই জাকজমকপূর্ণ এক মহোৎসব হল রথযাত্রা। কথিত আছে, জগন্নাথদেবের রথযাত্রা দেখলে এবং রথের দড়ি ধরলে (রথ টানলে) পাপ খণ্ডন হয়। পাপ-পুণ্যর মত আপেক্ষিক গূঢ় জটিল তত্ত্বের ভারে রথযাত্রার মসৃণতা যাতে ব্যাহত না হয়, তাই এই লেখা শুরু যেমন তাঁর পঙ্ক্তি দিয়ে, তেমনই শেষেও আবার আসি তাঁরই ‘রথের রশি’ নাটকের সংলাপে। চিরকালের মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই নাটকে বলেছেন:
‘‘কী হবে মন্তরে।
কালের পথ হয়েছে দুর্গম।
কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও গভীর গর্ত।
করতে হবে সব সমান, তবে ঘুচবে বিপদ।’’
…আজকের মতো বলো সবাই মিলে–
যারা এতদিন মরে ছিল তারা উঠুক বেঁচে;
যারা যুগে যুগে ছিল খাটো হয়ে, তারা দাঁড়াক একবার মাথা তুলে।’’