যাদুঘর
দ্বিজেনবাবুদের পরিবারে চারজন সদস্য। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ। গত বৈশাখে তিনি আটাত্তরে পা দিলেন। তিনি ছাড়াও তার ওই শহরতলীর বাড়িতে বাস তার পুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতির। দ্বিজেনবাবুর নাতি টুবাই, বয়স বারো। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।
সেদিন টুবাইয়ের শখ হলো যাদুঘর দেখার। মাস্টারমশাইরা বলেছেন পড়বার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে দেখলে অধীত বিষয় সম্যক মনোগত হয়। যাইহোক দ্বিজেনবাবুকেই নিয়ে যেতে হবে। তিনি ঠিক করলেন খড়দা থেকে ট্রেনে করে শিয়ালদা হয়ে বাসে করে যাদুঘর যাবেন। পৌঁছলেন পরিকল্পনা অনুসারে। খুবই উপভোগ করলেন দিনটা।
অবশেষে এল ফেরার পালা। বাস ধরে এলেন শিয়ালদাতে। কোন ঝঞ্ঝাট হলো না। শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরবেন, যাবেন খড়দায়। খড়দা স্টেশন থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটাপথে তাদের বাড়ি।
শিয়ালদা স্টেশনে পা দিতেই চিত্ত চমৎকৃত হলো— গোটা স্টেশন লোকারণ্য রেকের অভাবে গাড়ি ছাড়ছে না। ঘোষণা হলো— খড়দা যাবার একটি বিশেষ ট্রেন এক্ষুণি ছাড়বে। জনসমুদ্রের মাঝখান দিয়ে ঠেলাঠেলি করে ছুটলেন গাড়ি ধরতে। কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেননি— লম্বা ভোঁ বাজিয়ে ট্রেনের প্রকাণ্ড দেহটা চলতে শুরু করে দিল। টুবাই ততক্ষণে দ্বিজেনবাবুর হাত ছেড়ে কয়েককদম ছুটে প্রথম দরজার পাশে চলে গেছে। দরজা থেকে কয়েকটি হাত বেরিয়ে এসে ঝটপট কামরার ভিতর তুলে নিল। ভিতর থেকে তার চিৎকার শোনা গেল— “ঠাকুরদা, তুমি পরের কামরায় উঠে পড়ো। খড়দায় নেমে প্ল্যাটফর্মেই দাঁড়িয়ে থাকব খুঁজে নিও।”
গাড়ি বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে। দৌড়ে তাকে ধরা কঠিন। টুবাই উঠে গেছে তাকে উঠতেই হবে। কিন্তু বৃদ্ধ শরীরটা পেরে উঠবে কেন। দ্বিজেনবাবুকে ছাড়িয়ে শেষ দরজাটাও চলে যাচ্ছে। সর্বনাশ! ছোট্ট টুবাইকে একা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না— বুকটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। এই ট্রেনই তার ধরতে হবে। তিনি বিচার বিবেচনা বিরহিত হয়ে গার্ডের দরজায় ঝুলে পড়লেন। হৈ হৈ করে গার্ড পাল্লা টেনে হেঁচকা টানে তুলে নিলেন তাকে— বকুনির চোটে তার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করলেন। দ্বিজেনবাবু নীরবে বুক চেপে জোরে জোরে হাঁপ ছাড়ছেন— মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। গার্ড ভদ্রলোক নিজের টুলটা ঠেলে দিয়ে বললেন, “বসে পড়ুন, পটল তুলে আমাকে বিপদে ফেলবেন না।”
দ্বিজেনবাবু টুলে বসে হাঁপাচ্ছেন আর গার্ডসাহেব তাকে অনর্গল জ্ঞান বিতরণ করছেন— “এমন করে কেউ ওঠে, যদি মুখ থুবড়ে পড়ে দাঁতমুখ ভাঙতেন বা ঠ্যাং ভাঙতেন, প্লাস্টার করে পড়ে থাকতে হতো— তাহলে খুব ভাল হতো, না?— তাই হওয়া উচিত আপনাদের মতো অবিবেচকের। কেন, পরের গাড়িতে গেলে ধরণী রসাতলে যেত?”
গার্ডসাহেবের অবিচ্ছিন্ন জ্ঞান বরিষণে লজ্জিত অপ্রতিভ দ্বিজেনবাবু দমদম জংশন আসতেই উঠে পড়লেন। গার্ডসাহেব চোখ পাকিয়ে বললেন, “যান কোথায়, নামবেন তো খড়দহে— বসে থাকুন চুপচাপ।”
দ্বিজেনবাবু মিনমিন করে বললেন, “না, আপনার অসুবিধা করার জন্য মাফ চাইছি— আমি পাশের কামরায় উঠছি।” গার্ডসাহেব খেঁকিয়ে উঠলেন— “অত করুণা দেখাবার দরকার নেই। কোন কামরায় এখন উঠতে পারবেন? চুপ করে বসুন খড়দহ এলে নেমে যাবেন।”
অগত্যা দ্বিজেনবাবু চুপচাপ বসে নিজের বোকামির কথা ভাবতে লাগলেন।
ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলে খড়দহে ট্রেন থামলে গার্ডসাহেব তাকে নামিয়ে দিলেন— “আস্তে আস্তে দেখে শুনে বাড়ি চলে যান।”
গার্ডসাহেব তো বললেন বাড়ি যেতে কিন্তু বাড়ি যাওয়া কী এতোই সোজা— টুবাইকে খুঁজে বের করতে হবে না। প্লাটফর্মের উত্তরপ্রান্ত দিয়ে নেমে যেতে হয় তাদের— তিনি দক্ষিণপ্রান্ত থেকে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজতে খুঁজতে আস্তে আস্তে এগিয়ে চললেন। কিন্তু কই— টুবাইকে তো দেখতে পাচ্ছেন না। হাঁটতে হাঁটতে শেষ প্রান্তে পৌঁছেও তিনি টুবাইকে পেলেন না। আবার ফিরলেন। কই, কোথায় টুবাই? সারা প্লাটফর্ম খুঁজে খুঁজে হয়রান— কোথায় যাবে সে! সে তো বলেছে তাকে খুঁজে নিতে হবে— প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকবে।
কীরকম যেন এক ঘোরের মধ্যেই তিনি ঘুরেই চলেছেন— চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে ক্রমাগত হাঁটছেন আর ভাবছেন গার্ডসাহেবের কথা— ভদ্রলোকটি একেবারে একটি ঝুনো নারকেল। যেমন চেহারা— তেমনি তার ভাষণ— সরস অন্তর থেকে অমন কটুকষায় বাক্যাবলি কেমন করে উপচে পড়ে!
কতক্ষণ চলে গেল, এদিক ওদিক আরো কিছু গাড়ি এল গেল। বেভুল ঘোরে দ্বিজেনবাবু টহল দিয়ে চলেছেন— টুবাই, টুবাই কই। সে তো প্লাটফর্মে থাকবে বলেছে— তাকে তো খুঁজে নিতে হবে। তবে খুঁজে পাচ্ছেন না কেন? তার কী চোখ খারাপ হলো— কিন্তু টুবাইও তো তাকে ঘুরতে দেখতে পাবে— সাড়া দেবে ছুটে এসে ঠাকুর্দা বলে ধমকাবে!
কী করবেন তিনি! তবে কী সে একাই বাড়ি চলে গেল। নিয়মিত যাতায়াতের ফলে পথ তো তার জানা চেনা— নিশ্চয়ই সে বাড়ি চলে গেছে। এলোমেলো মন নিয়ে তিনি সুস্থভাবে বিচারবুদ্ধিও প্রয়োগ করতে পারছেন না নিশ্চয়। তার উচিত ছিল অনেক আগেই বাড়ি ফিরে দেখা— তা না করে এত রাত পর্যন্ত তিনি প্লাটফর্মে ঘুরে বেড়াচ্ছেন— নাঃ বুদ্ধিশুদ্ধি তার সত্যিই বিগড়েছে।
***
অস্থির হয়ে চঞ্চল পদক্ষেপে চললেন তিনি বাড়ির দিকে। কী আশ্চর্য, রাস্তায় একটাও পরিচিত লোকের দেখা পেলেন না। সবাই কী এরই মাঝে ঘুমিয়ে গেল। রোজ তো গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা চলে, ছোট ছোট দলে চলে গুলতানি। মাটির ভাড়ে চা চাখতে চাখতে রাজা উজির নিয়ে কত গবেষণা। সমাজনীতি, রাজনীতি নিয়ে কত গরম গরম আলোচনা— তর্কবিতর্ক; কখনো কখনো হাতাহাতির পর্যায়ে উঠে পড়ে। কিন্তু আজ কী হলো— সব শুনশান। লোকজন নেই, কারো কোন সাড়াশব্দ নেই। এমনকী বাড়িগুলোর বাসিন্দারাও সব চুপচাপ। না, মাথাটা ঠিক আছে তো— না নাতি হারাবার শকে বেগড়বাই হয়ে গেছে।
পথ শেষ হলো— আসলে মিনিট চারেক, মনে হলো যেন চার ঘণ্টা। শেষে বাড়ির দরজায়। কী আশ্চর্য, সদর হাট করে খোলা, সব ঘরে আলো জ্বলছে কিন্তু কেন, এমন তো হবার কথা নয়। যে ঘরে লোক থাকে সেখানেই আলো জ্বলে— অন্য ঘরে আলো থাকে নেভানো। কেউ ঘরে ঢুকলে আলো জ্বেলে নেয়। আজ দেখি সব সৃষ্টিছাড়া। শুধু যে আলো জ্বলছে তাই নয়, বাড়ির সবগুলো দরজা, সবগুলো জানালা হাট করে খোলা।
বারান্দায় উঠতে উঠতে দ্বিজেনবাবু ছেলের নাম ধরে ডাকলেন যদিও সে এখনো নাও ফিরে থাকতে পারে। কিন্তু টুবাইতো তার গলা শুনে চুপ করে থাকবে না— সে তো ছুটে আসবে। বৌমা উদ্বেগমুক্ত হাসি নিয়ে এসে বলবে, “বাবা তোমার এত দেরি কেন?” কই কেউ তো আসে না। খানিকটা অকারণ বেফায়দা এদিক ওদিক করলেন। তারপর ধুপধাপ করে উঠে গেলেন দোতলায়। একই ভাব— সব ঘরের আলো জ্বলছে দরজা জানালা হাট করে খোলা। অথচ প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় মশার ভয়ে জানালা বন্ধ করা হয়। এসব কী হচ্ছে— মাথাটা একদম গেছে— আর কাজ করছে না।
***
হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল— বেশ কয়েক মাস আগে টুবাইকে নিয়ে গেছেন স্কুলে। শরীরটা সেদিন ছিল খুব দুর্বল। চার-পাঁচ দিন জ্বরে ভুগছিলেন। গাড়িতে ঝিমোতে ঝিমোতে গেছেন। শিয়ালদহে যখন সবাই হুড়মুড় করে নামছেন তখন তাদের সাথে ঘুম চোখেই তিনিও নেমে পড়েছেন। নেমে হাঁটতে শুরু করেছেন। টুবাই ঠিক তাকে ধরে নেবে। হাঁটতে হাঁটতে একী গেট কই, তিনি উলটো দিকে হেঁটেছেন। ঝাড়াতাড়া দিয়ে আবার হনহন করে ছুটলেন গেটমুখো কিন্তু সেখানেও টুবাই নেই। গেলেন অনুসন্ধান অফিসে তারাও কোন হদিস দিতে পারেন না। তাদের দিয়ে টুবাইয়ের নাম ধরে ঘোষণা করালেন। ফল কিছুই হলো না। হনহন করে ছুটলেন স্কুলে— যদি পথে দেখা হয়। দেখা পেলেন না। দুশ্চিন্তায় দিশাহারা ছুটতে ছুটতে আবার ফিরে এলেন বাড়ি। সদরে তাকে দেখেই ওপর থেকে বৌমা বলেন, “বাবা, টুবাই স্কুলে পৌঁছে গেছে। দীপঙ্কর ওকে পৌঁছে দিয়ে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে।”
দীপঙ্কর পাড়ার একটি ছেলে। টুবাইকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খোঁজ নিয়ে জানল দ্বিজেনবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না— শিয়ালদহের জনারণ্যে তিনি বেমালুম বেপাত্তা। ঘোষণা করেও তার হদিস না পেয়ে অগত্যা টুবাইকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফোন করে বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে।
এতক্ষণ দমবন্ধ করে উদ্বেগে ভুগছিলেন দ্বিজেনবাবু। বৌমা তালা খুললে ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকে বসে পড়লেন— রাজ্যের অবসাদ তাকে ভর করল। তিনি গলগল করে ঘামতে লাগলেন। বৌমা তাড়াতাড়ি পাখা খুলে দিলেন— এগিয়ে দিলেন ভর্তি জলের বোতল আর গ্লাস। পাখার হাওয়ায় ঠাণ্ডা হতে হতে জলের বোতল খালি করে আরো এক বোতল চাইলেন। দু-বোতল জল শেষ করে তড়াক করে উঠে পড়লেন— “মাগো, আমি যাচ্ছি।” হাঁই হাঁই করে উঠলেন বৌমা— “এখনি কী, ছুটি হবে তো বিকেলে— একটু জিরিয়ে নিয়ে পরে যাও।”
দ্বিজেনবাবু বললেন— “না মা, উদ্বিগ্ন মন নিয়ে ক্লাস করছে। আমি গিয়ে আমার জায়গায় বসে থাকি— বারান্দা থেকে আমাকে দেখলে স্বস্তি পাবে, সুস্থ মনে ক্লাস করতে পারবে।”
অগত্যা মা বললেন— “তোমার জন্যে চা বসিয়েছি— চা খানা অন্তত খেয়ে যাও।”
সেদিনের কথা মনে হতেই…
***
অকারণেই এঘর ওঘর খানিকক্ষণ ঘুরলেন, দুমদুম করে উঠে গেলেন ছাতে— ফাঁকা ছাত খাঁ খাঁ করছে। রাস্তার আলোর প্রতিভাসে আবছায়া ছাত যেন ভয় দেখাচ্ছে। কতক্ষণ আর বৃথা ঘোরাঘুরি করা যায়। আবার ক্লান্তপদে নেমে এলেন দোতলায়। খানিকটা এঘর ওঘর করে উৎকণ্ঠায় অবসন্ন দেহ এলিয়ে দিলেন চেয়ারে। উদ্বেগ উৎকণ্ঠা চরমে উঠে ক্রমে তাকে গ্রাস করল এক পরম নির্লিপ্তিতে। যা হবার হোক আর তিনি ভাববেন না— চেতনার জগৎ পাড়ি দিয়ে তিনি প্রবেশ করবেন নির্ভাবনার নিস্তরঙ্গ নৈঃশব্দ্যের জগতে— আর তিনি পারছেন না— এবারে তার ছুটি চাই— চাই অখণ্ড অনাবিল অবসর। সব কিছুরই তো সীমা আছে। ভাবনারও আছে পরম নিবৃত্তি।
সেই নিবৃত্তিই তাকে আচ্ছন্ন করল পরিপূর্ণ ভাবে। মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন তিনি।
কতক্ষণ তিনি বেঘোরে ছিলেন তার কোন ধারণা ছিল না। খোলামেলা দরজা জানালা, আলোকোজ্বল সারা বাড়ি তার চেতনায় ফিরল যখন কেউ তাকে হাত ধরে টেনে তুলে দিল।
তাকিয়ে দেখেন চারজন তাকে ঘিরে আছে। দ্বিজেনবাবু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন— “কী হয়েছে? কী ব্যাপার? কারা আপনারা?”
একজন বললেন, “আমরা থানা থেকে আসছি। খবর পেয়েছি আপনি আপনার ছেলে, বৌমা আর নাতিকে খুন করে তাদের মৃতদেহ লুকিয়ে রেখেছেন। আপনাকে গ্রেপ্তার করা হলো। এখন বলুন দেহগুলো কোথায়।”
দ্বিজেনবাবু শুধু হতবাক, হতভম্ব নয় একেবারেই সংজ্ঞা হারালেন— এতকাল তিনি যাদের জন্যে জীবণপাত করেছেন, যাদের একটু সুখের জন্যে, স্বস্তির জন্যে তিনি অকাতরে প্রাণ দিতে পারেন সেই তাদেরই তিনি খুন করেছেন আর সেই অভিযোগ নিয়ে পুলিশ এসেছে তাকে গ্রেপ্তার করতে!
অফিসারটি কনস্টেবলদের বললেন— “বাড়িটা খুঁজে দেখ, দেহগুলো কোথায়।” পাশের ঘর থেকে একটা পুলিশ চেঁচিয়ে বলল, “সাব, এঘরে আসুন, খাটের নীচে দেহগুলি রয়েছে।” অফিসার উঠলেন, সঙ্গে দ্বিজেনবাবুও যেতে গেলেন। একটা পুলিশ তাকে ধরে ফেলল— “কোথায় যান!”
দ্বিজেনবাবু বললেন, “কেন, ওঘরে, ওরা কোথায় দেখি!”
“পড়ে যাবেন, চলুন, আমি ধরে নিয়ে যাচ্ছি।” ওঘরে গিয়ে দ্বিজেনবাবু পড়ে যাচ্ছিলেন, পুলিশটি তাকে বসিয়ে দিল। ওদিকে তখন খাটের তলা থেকে তিনটি দেহ বেরিয়ে এসেছে। দ্বিজেনবাবু দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন—। মাথাটা একপাশে কাত হয়ে গেল।
কতক্ষণ পরে কে জানে, কে একজন চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে দ্বিজেনবাবুর সাড় এল— পুলিশ বলল, “উঠুন, চলুন আপনাকে থানায় যেতে হবে।”
দ্বিজেনবাবু উঠলেন। কেমন ঘোর লাগা দেহে শ্লথপদে চলতে লাগলেন। সঙ্গে পুলিশ, ধরে আছে। গাড়ি আসবে, দেহগুলো মর্গে যাবে পরীক্ষার জন্যে। ততক্ষণে থানায় এজাহার লিখতে হবে। দ্বিজেনবাবু চলছেন বটে কিন্তু মনের মধ্যে ভাবনার প্লাবন। তিনি আপনজনকে কোন কারণে খুন করলেন, কেমন করে খুন করলেন? অস্ত্রের ব্যবহার তো হয়নি। রক্তপাত তো হয়নি। তবে কী খাবারের সঙ্গে বিষ দিয়ে? তাই বা কী করে হবে? নাতি নিয়ে তিনি তো সকালে খাওয়াদাওয়া সেরে বেরিয়েছিলেন। তারপর ফিরেই তো দেখছেন বাড়ির ছন্নছাড়া অবস্থা। তবে কী সারাদিনই যা কিছু করেছেন সবই ঘুমন্ত অবস্থায়।
ঘুমের মধ্যেই বাড়ি ফিরেছেন। ঘুমোতে ঘুমোতেই দোকান থেকে বিষ কিনেছেন, খাবার কিনেছেন, খাবারে বিষ মিশিয়ে ওদের খেতে দিয়েছেন। আর তারপর গতপ্রাণ দেহগুলোকে লুকিয়ে রেখে পাগলের মতো খোঁজাখুঁজি করেছেন! নাকি তিনি এখনো ঘুমাচ্ছেন!
চলতে চলতেই তার মনের মধ্যে জাগছে— আহারে বিষের জ্বালায় ওরা কত না কষ্ট পেয়েছে— পেটজ্বালা বুকজ্বালা তাহলে তো কাতরানি, ছটফটানি আর্তনাদ এসব অবশ্যম্ভাবী। কিংবা পটাশিয়াম সায়ানাইডের মতো মারাত্মক বিষ টু শব্দটি করবার অবকাশ পায়নি কেউ। কিন্তু ঐ বিষ আসবে কোথা থেকে? ও তো সাধারণ ওষুধের দোকানে পাওয়া যায় না। অন্তত ধারে কাছে যে আট দশটা দোকান আছে তারা কেউ কী ও জিনিষ বিক্রি করে বা জোগাড় করে দিতে পারে। আর কেনই বা দেবে। ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া তো অনেক ওষুধই বিক্রি করা যায় না। ওটা তো ব্যবহার হয় ল্যাবরেটোরিতে। দ্বিজেনবাবু ও জিনিষ কোথায় পাবেন?
কিন্তু তিন তিনটে খুন তো হয়েছে। আর ঘটনাস্থলে একমাত্র তিনিই ছিলেন সুতরাং জবাবদিহি তো তাকেই করতে হবে। কী জবাব তার?
তাদের রাস্তায় গাড়ি ঢোকে না। পুলিশদল হেঁটেই এসেছে। তাদের ফিরতেও হবে হেঁটে। ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে দ্বিজেনবাবু ভাবছেন আর ভাবছেন। নজরে কিছুই পড়ছে না— মনশ্চক্ষে ভেসে উঠছে ছেলেকে নিয়ে তিনি আর তার স্ত্রী কী দুর্দ্দান্ত লড়াই না করেছেন। প্রত্যেক বছরেই তার একটা করে বড় ধরণের অসুখ করত— ডাক্তারে ওষুধে জেরবার হবার দাখিল। সেই ছেলেকে বড় করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। পড়াশুনায় মেধাবী ছিল কিন্তু তার মায়ের অকস্মাৎ মৃত্যুতে দ্বিজেনবাবু বড়ই মুষড়ে গেলেন, সংসারের দিকে কোন আকর্ষণই আর রইল না। ছেলেরও ঘা খেয়ে পড়াশুনায় আর আগের মতো চাড় রইল না। দ্বিজেনবাবু ভেবে দেখেছেন মায়ের তত্ত্বাবধান না থাকলে ছেলেমেয়ের মানুষ হওয়া খুবই কঠিন।
সেই ছেলে এখন দাঁড়িয়েছে। দেখে শুনে বাছাবাছি করে একটি লক্ষ্মী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। দ্বিজেনবাবু মা বলতে শতমুখ। তাদের ফসল টুবাই, দ্বিজেনবাবুর প্রাণ। টুবাই যখন বছর তিনেক তখন মায়ের খুব অসুখ করে। অজস্র খরচ করে তিনবার বড় বড় অস্ত্রোপচার করে প্রায় বছর খানেক ধরে চিকিৎসা করে তবে তাকে সুস্থ করে তোলেন।
সেই ছেলে, সেই মা, প্রাণের অধিক নাতি টুবাই, এদের কে তিনি মেরে ফেলেছেন! কেন—
কৈফিয়ত কিছুই নেই, কোন কারণ খুঁজে পান না দ্বিজেনবাবু, বহু চিন্তা করেও। অবশ্য মাঝে মাঝে তিনি ভেবেছেন এই নিরবচ্ছিন্ন সুখ শান্তি আনন্দের হাট এই চিরদিন থাকবে তো— না তাই থাকে? “চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়।” “চক্রবৎ পরিবর্ত্তন্তে সুখানি চ দুঃখানি চ।” এইসব তত্ত্বকথা মানুষ তো কম জানে না— কিন্তু কজন মনেপ্রাণে তাকে প্রণিধান করে? যুধিষ্ঠির বলেছিলেন প্রতিদিন বহুলোক কালগ্রাসে পতিত হয় কিন্তু কেউ নিজের কথা ভাবে না— ভাবে তাদের অন্ত নেই। আসলে কালসায়রে পদ্মপত্রে নীর হলো জীব— বায়ুর ক্ষীণ তাড়নে পত্রচ্যূত হয়ে সায়রে বিলীন হবে। তবে কেন অযথাই চিন্তাভাবনা— কেন বৃথা ব্যথাবেদনার কাতরতা। তার চেয়ে এই আনন্দের হাটের মাঝেই যদি সংসারের সমাপ্তি ঘটে সেইই কী লক্ষগুণ ভাল নয়।
সৎকারের ব্যবস্থার কথা ভেবে ঠিক করেছেন তাদের দেহগুলি সমাজের প্রয়োজনে যদি লাগে তার জন্যে চিকিৎসা বিভাগে দান করে যাবেন। সেই মর্মে প্রত্যেকেই নিজের দেহের জন্য উৎসর্গপত্র তৈরি করে তাদের কাছে রেখেছেন। কিন্তু ছি ছি, তিনি তো পরম পামর, ভীতু, কাপুরুষ। তার সমর্থ পুত্র ব্রত পালন করেছে। তার পরম গুণবতী পুত্রবধূ যার মুখে সর্বদাই প্রাণভরা বাবা ডাক, সে পিছিয়ে যায়নি, তাদের নয়নমণি ফুল্লকুসুমের মতো স্ফুটমান টুবাই আনন্দের সঙ্গে বিনা দ্বিধায় মানব সমাজের কল্যাণে আত্মোৎসর্গ করেছে— আর তিনি বুড়োভাম সেই সৎ সাহসটুকু দেখাতে পারেননি। ধিক তাকে, শত শত ধিক, অথবা সহস্র ধিক্কারও তার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
স্টেশনের লাউডস্পীকারে ঘোষণা হলো “দু নম্বর লাইন দিয়ে থ্রু-ট্রেন যাবে— কেউ লাইন পারাপার করবেন না।” অগ্রসরমান গাড়ির শব্দ শোনা গেল— দ্বিজেনবাবুর মনে হলো গর্জন করে প্রকৃতি তাকে তিরস্কার করছে— “মূঢ় ভীরু পলাতক, প্রায়শ্চিত্ত কর, আর সুযোগ পাবি না। অবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়, ঝাঁপিয়ে পড়।”
মর্মছেড়া আর্তনাদে নিঃশব্দ চিৎকার করে উঠলেন দ্বিজেনবাবু— “হে মহাকাল, ক্ষমা করো। পলায়নী প্রবৃত্তিকে নিশ্চিহ্ন করো, আমি তোমার কোলে শরণ নিলাম।”
ছিটকে গিয়ে দ্বিজেনবাবু উপুড় হয়ে পড়লেন পাটির ওপর, মুদিত নেত্রে উদাত্ত আমন্ত্রণ জানালেন, “হে চিরসুন্দর, এসো, এসো হে পরমা নিবৃত্তি, নিবিড় শাশ্বত সত্য প্রগাঢ় তমিস্রা এই অকিঞ্চন নৈবেদ্য গ্রহণ করো— এসো এসো—”
হঠাৎ পৃষ্ঠদেশে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করলেন, বহুদূরাগত ক্ষীণ স্বর শ্রবণপটহে মৃদু আঘাত করল। অবোধ্য আরাবপ্রবাহ; প্রবল আকর্ষণে শরীর বেঁকে গেল—
“ওঠো, ওঠো, ও ঠাকুর্দা— কত বেলা হলো। তুমি তো শেষরাতে ওঠো, আজ এখনো ঘুমাচ্ছ কেন? ও মা, মা, শিগগির এসো, বাবান তাড়াতাড়ি এসো, ঠাকুর্দা কেমন হয়ে গেছে।”
পুত্রবধূ ছুটে এল, দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে ডাকল, “বাবা, বাবা—”
সাড়া নেই, শব্দ নেই, স্পন্দন নেই, অনড় প্রস্তরসম দ্বিজেনবাবু বসে রইলেন, ছেলে এসে ডেকে সাড়া পেল না।
ছেলে বলল, “ধরো, বাথরুমে নিয়ে চলো।”
কলঘরে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে শাওয়ার খুলে দিল পূর্ণবেগে। অঝোরে জল ঝরে পড়তে লাগল প্রবল ধারায়। দৃষ্টিহীন বিস্ফারিত নয়নদুটি লক্ষ্যহারা কিছুই দেখে না, কানে প্রবেশ করলেও শব্দ বোধে পৌঁছায় না, অঙ্গে স্পন্দন নেই যেন প্রস্তর মূর্তি। কতকাল, বুঝিবা অনন্তকাল।
ধীরে নয়ন নিমীলিত হলো— অঙ্গে সাড় এল, অতি ধীরে দ্বিজেনবাবু উঠে দাঁড়ালেন। পরম মমতায় বৌমা গামছা দিয়ে মাথা গা মুছিয়ে দিলেন, গামছা চেয়ে নিয়ে এতক্ষণে দ্বিজেনবাবু মনে হয় প্রকৃতিস্থ হলেন। বেরিয়ে এলেন কলঘর থেকে। ছেলে ধরে নিয়ে গেল ওপরে ঠাকুরঘরে। টুবাইকে বললেন— “ওপরে ঠাকুরঘরের সিঁড়িতে বসে থাক। আহ্নিক শেষ হলে ঠাকুর্দাকে ধরে নামিয়ে আনবে।”
ধরতে অবশ্য হয়নি। দ্বিজেনবাবু নিজেই আস্তে আস্তে নেমে এলেন। টুবাই গ্লাস ভর্তি জল এগিয়ে দিল। আরও এক গ্লাস নিজেই ভরে নিয়ে খেলেন। চেয়ারে এলিয়ে দিলেন দেহটাকে।
টুবাই এসে দু-হাতে মুখখানি ধরে জিজ্ঞাসা করল— “ঠাকুর্দা, যাদুঘরে যাবে না— কখন যাবে?”
ধীর স্বরে দ্বিজেনবাবু বললেন— “আজ থাক দাদা— কাল বড়ই ধকল গেছে। দুদিন বিশ্রাম করে পরশুদিন নিশ্চয়ই যাব— অবশ্য যদি বেঁচে থাকি।”
[৯/০৮/১৯৯৮ (বানান অপরিবর্তিত)]