ঐতিহাসিক ভি এ স্মিথ ভারতবর্ষের অন্তর্লীন বৈশিষ্ট্যকে বোঝাতে বলেছিলেন, ‘In India, there is unity in diversity and diversity in unity.’ অর্থাৎ, ভারতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। ভারতকে সবচেয়ে বৈচিত্র্যের দেশ বোঝাতে চেয়ে এই উক্তি তাঁর। কথাটা ১০০ ভাগ খাঁটি। স্মিথই সমুদ্রগুপ্তকে ‘ভারতের নেপোলিয়ন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ১৯০৪ সালে ‘Early History of India’ নামে একটি পাঠ্যপুস্তকও প্রস্তুত করেছিলেন এই ভারতবেত্তা ব্রিটিশ ঐতিহাসিক।
যাইহোক, ভারতবর্ষ বর্তমানে ২৮টি রাজ্য আর ৮টি ইউনিয়ন টেরিটরিতে বিভক্ত। কিন্তু এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার মধ্য দিয়ে একের সঙ্গে অপরের বহিরঙ্গে পার্থক্য থাকলেও একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে, তারা হয়তো রীতিরেওয়াজের একটু হেরফেরে পৃথক কিন্তু মূল উদ্দেশ্যটা এক ও অভিন্ন। রবীন্দ্রনাথের ভাষামন্ত্রে, ‘হেথা একদিন বিরামবিহীন/ মহা ওংকারধ্বনি,/ হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে/ উঠেছিল রনরনি।/ তপস্যাবলে একের অনলে/ বহুরে আহুতি দিয়া/ বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল/ একটি বিরাট হিয়া।’
উৎসব, পার্বণ এমনই এক বিস্তৃত, মিলিত আঙিনা যেখানে একের স্বাতন্ত্র্যের বেড়াজাল ভেদ করে দেশীয় পরম্পরাই সকলের কাছে মুখ্য হয়ে ওঠে। ভারতীয়মাত্রেই উৎসবপ্রিয়, তাই তাদের প্রায় সকলের কমবেশি বারো মাসে তেরো পার্বণ অনুষ্ঠিত হয়। পার্বণ শব্দের মূল উৎসগত অর্থ পর্ব। কিন্তু ভারতবর্ষে সামাজিক অর্থে পার্বণ বলতে বোঝায় সেসব পর্ব, যা কোনও পূজা অনুষ্ঠানকে আনন্দময় করে তোলে।
পৌষপার্বণ এমনই এক পার্বণ যেখানে কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষে সম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে ধানরূপে প্রকারান্তরে পূজা করা হয়। পৌষপার্বণের এই দিনটি হিন্দু পঞ্জিকায় ‘মকর সংক্রান্তি’ বা ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত। প্রাচীন হিন্দুরা এই দিনটিতে পিতৃপুরুষ অথবা বাস্তুদেবতার উদ্দেশে তিল ও খেজুর গুড় সহযোগে তৈরি তিলুয়া এবং নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চাল থেকে তৈরি পরমান্ন ও পিঠের অর্ঘ্য প্রদান করতেন। এই কারণে পৌষসংক্রান্তির অপর নাম ছিল তিলুয়া সংক্রান্তি।
পৌষসংক্রান্তিকে মকর সংক্রান্তি বলার কারণ, ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী ‘সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। তবে জ্যোতির্বিদদের ব্যাখ্যায়, সূর্যের দক্ষিণায়নের পথচলার শেষ আর উত্তরায়ণের পথচলার শুরু এই দিনটাতেই। অর্থাৎ দিনের দৈর্ঘ্য এবার রাতের চেয়ে বড় হবার পালা। তাই সূর্যের তেজ বাড়বে, আসবে শস্যসমৃদ্ধি আর সূর্যদেব দক্ষিণ গোলার্ধের মকরক্রান্তি রেখা থেকে এবার উত্তরের দিকে যাত্রা শুরু করবেন। মানে আমাদের দেশে শীতের শেষ, বসন্তের আগমন।
আবার পৌরাণিক মতে, দেবী সংক্রান্তি এই দিনেই শঙ্করাসুরকে বধ করেছিলেন। এর পরের দিনেই তিনি সংহার করেছিলেন আরেক দুর্দান্ত দানব কিঙ্করাসুরকে। তাই সেই দিনটি কিঙ্করান্ত নামে অনেক জায়গায় পালিত হয়। পুরাণ অনুযায়ী, এই মকররাশিতে সূর্যের দৃষ্টি সূচনা করে পুণ্যকালের। সেই শুভলগ্নেই তাই দেশবাসী মেতে ওঠেন নানা মঙ্গল অনুষ্ঠানে।
প্রথমেই আসি বর্তমানের পশ্চিমবঙ্গের কথায়। কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন, ‘সুখের শিশির কাল সুখে পূর্ণ ধরা।/ এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গ ভরা।।/ ধনুর তনুর শেষ মকরের যোগ।/ সন্ধিক্ষণে তিনদিন মহা সুখভোগ।।/ ঘোর জাঁক বাজে শাঁক, যত সব রামা।/ কুটিছে তণ্ডুল সুখে করি ধামা ধামা।।/ বাউনি, আউনি, ঝড়া, পোড়া আখ্যা আর।/ মেয়েদের নব শাস্ত্র অশেষ প্রকার।’ আসলে, সুপ্রাচীনকালের পৌষপার্বণ বা বর্তমানের পিঠেপুলি উৎসব পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে পালিত একটি লোক উৎসব। বাংলা পৌষমাসের সংক্রান্তিতে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিন পিঠে প্রস্তুত করে দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করা হয়।
সেই পিঠে নিয়ে কবি সুনির্মল বসুর লেখায় ‘পৌষ-পার্বণ উৎসব’-এ একবার চোখ বোলানো যাক।
পিঠে পিঠে পিঠে,—
ভাবছি যতই খাবার কথা
লাগছে ততই মিঠে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
ঐ চড়েছে রসের ভিয়ান,
আসছে রসের ছিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
নলেন গুড়ের সৌরভে আজ
মশগুল যে ভিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
ক্ষীর-নারিকেল লাগবে আরো?
নিয়ে যা হাতচিঠে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
কম খেলে আজ হবে রে ভাই
মেজাজটা খিটখিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
পুসি বিড়াল পাতছে আড়ি,
চোখ দুটো মিট্মিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
এই রে, কেন তাড়িয়ে দিলি
একখানা থান-ইঁটে?
পিঠে পিঠে পিঠে।
রসপুলি আর গোকুল-চসির
রস যে গিঁটে গিঁটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
পিঠের লোভে হল্লা করে
কাকগুলো ডানপিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
শীতের ভোরে ঠাণ্ডা হাওয়ায়
হাত-পা হ’ল সিঁটে;
পিঠে পিঠে পিঠে।
রসের কড়াই নামাও এবার,
গুড় যে হ’ল চিটে;
পিঠে পিঠে পিঠে॥
প্রাচীনকাল থেকেই দেবতার পূজায় পিঠের অর্ঘ্য প্রদানের রীতি রয়েছে। পৌষের শীতে পিঠে, পুলি, খেজুর গুড়ের সঙ্গে জমিয়ে উৎসব পালন গ্ৰামীণ পরিবেশে আজও মনোমুগ্ধকর। আগে গ্রাম-বাংলায় পৌষপার্বণে আত্মীয়-স্বজনদের নিমন্ত্রণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। প্রতিবেশীদেরও ডাকা হত। নয়তো তাঁদের বাড়িতে পাঠানো হত থালাবোঝাই পিঠেপুলি। পাটিসাপটা, চন্দ্রকান্তা, মুগসামলি, গোকুল পিঠে, চন্দ্রপুলি, সরুচাকলি, ভাজাপিঠে, ভাপাপিঠে, রসের পিঠে, চসি পিঠে, রসপুলি, দুধপুলি, সড়াই পিঠে, আরও কত কী!
যদিও পৌষপার্বণের প্রধান কিন্তু সরা পিঠে। উৎসবের দিন মাটির সরা পোড়াতে হয়। তারপর সরার ভিতরে ধানের তুঁষ রেখে পাটকাঠির আগুনে কিছুক্ষণ পুড়িয়ে সরাকে ‘তৈরি’ করে নিতে হয়। নতুন চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি হয় সরা পিঠে। প্রথমটি দেওয়া হয় গৃহপালিত পোষ্য গরুকে। তার পর একে একে অন্যদের।
অঘ্রানে নতুন ধান উঠলেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। ঢেঁকিতে নতুন চাল গুঁড়ো করা শুরু হল মানেই পৌষপার্বণ এসে গেল। এরপর গোবর দিয়ে নিকানো হত চওড়া উঠোন আর উঠোন শুকোলে পুরো উঠোন জুড়ে পিটুলির গোলায় আঁকা হত বিশেষ আলপনা। তারপর তুলসীতলার সামনে আঁকা হত ‘নেড়ানেড়ি’ বা ‘বুড়োবুড়ি’। যাদের সামনে স্তরে স্তরে সাজানো হত রকমারি পিঠেপুলি। কোনও কোনও জেলার মানুষ আবার পৌষবুড়ি তৈরি করতেন গোবরের গোলাকৃতির ওপর ধান, দূর্বা, ফুল, চন্দন, হলুদ, সিঁদুর দিয়ে। তাকে পুজো করে প্রার্থনা করতেন, ‘এসো পৌষ যেয়ো না, জন্ম জন্ম ছেড়ো না’ বা ‘পোষ মাস লক্ষ্মী মাস না যাইও ছাড়িয়া, ছেলেপিলেকে ভাত দেব খান্দা ভরিয়া।’
পৌষসংক্রান্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালিদের আরও বেশ কয়েকটি নিয়মাচার। এই দিনে সাধারণত গৃহস্থ বাঙালি বাড়িতে তুলসীতলায় বাস্তুপুজো হয়। নতুন গুড় এবং তিলা কদমা অর্পণ করা হয় বাড়ির সদস্যদের মঙ্গলকামনায়। এই দিন দূরে কোথাও যাত্রা করা ঠিক না এবং অন্য কোথাও গেলেও রাতে বাড়ি ফিরে আসা উচিত। বাড়িঘরের মত বাসনপত্রও মেজেধুয়ে পরিষ্কার করে রাখা, দিনের আলো ফোটার আগে পুকুরে বা নদীতে পুণ্যস্নান করা, বাস্তুপূজা করা, তিলা, কদমা, পাটালি গুড় খাওয়া ইত্যাদি।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলা, ঝাড়গ্রাম জেলা, বাঁকুড়া জেলা, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় আবার অগ্রহায়ণ মাসের শেষদিনে শুরু হয় টুসু উৎসব বা মকর পরব। এটি আর একটি লোক উৎসব, যা শেষ হয় পৌষসংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তির পুণ্যলগ্নে। টুসু এক লৌকিক দেবী, যাকে কুমারী হিসেবে কল্পনা করা হয় বলে প্রধানত কুমারী মেয়েরা টুসুপূজার প্রধান ব্রতী ও উদ্যোগী হয়ে থাকেন।
পৌষ এল, পৌষ এল
খুশি খুশি রব তাই,
পৌষ-পার্বণের দিনে পিঠে
পেটভরে খাওয়া চাই।
মকর-সংক্রান্তির স্নান সেরে
তুষু পূজা করে,
সূর্যোদয়ের আগে রাখি আঙ্গিনা
আল্পনাতে ভরে।
রাতের তৈরী পিঠা দিয়ে
সূর্যদেবকে পূজা,
তারপর সারাদিন
করবো খুব মজা।
ড. বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে, তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে। আবার দীনেন্দ্রনাথ সরকারের মতে, তিষ্যা বা পুষ্যা নক্ষত্র থেকে অথবা ঊষা থেকে টুসু শব্দটি এসেছে। টুসু পুজোয় নতুন ধানের খেত থেকে আমন ধানের এক গোছা মাথায় করে এনে খামারের পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয় অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায়। এরপর গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে ধানের গুঁড়ো বা তুষ রাখেন। তারপর তুষের ওপর ধান, গোবরের মণ্ড, দূর্বা ঘাস, চাল, সর্ষে ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ পরিয়ে পাত্রটিকে পিঁড়ি বা কুলুঙ্গির ওপর স্থাপন করেন। টানা একমাস প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে একে টুসুদেবী হিসেবে পুজো করেন।
এমনিতে টুসু ঠাকুরের কোনও মূর্তি প্রচলিত না থাকলেও বর্তমানে জানা গেছে যে, পুরুলিয়া জেলার বান্দোয়ান থানা এবং বাঁকুড়া জেলার খাতড়া থানার পোরকুলে টুসু মেলায় টুসু মূর্তির প্রচলন রয়েছে। সাধারণত টুসুদেবীর উদ্দেশে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করা হয়। পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউড়ির দিনে গৃহস্থ বাড়ির মেয়েরা উঠোন গোবরমাটি দিয়ে নিকিয়ে পরিষ্কার করে, ঢেকিতে চালের গুঁড়ো তৈরি করেন, বাঁউড়ির দিন ওই চালের গুঁড়ো দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতি, ত্রিকোণাকৃতি ও চতুষ্কোণাকৃতির পিঠে তৈরি করে তাতে চাঁছি, তিল, নারকেল বা মিষ্টি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। স্থানীয়ভাবে এই পিঠে গড়গড়্যা পিঠে বা বাঁকা পিঠে বা উধি পিঠে ও পুর পিঠে নামে পরিচিত।
পৌষসংক্রান্তির দিন ভোরবেলায় মেয়েরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসুদেবীকে বাঁশ বা কাঠের তৈরি রঙিন কাগজে সজ্জিত চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসুব্রতী গান গাইতে গাইতে দেবীর বিসর্জন করে থাকেন। এই লোক উৎসবের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হল টুসু সঙ্গীত। রাঢ় অঞ্চলের মানুষের জীবনজীবিকা, তাদের সংগ্রাম, সুখ-ব্যথা এইসব কিছু দিয়েই মেয়েরা টুসুর গান বাঁধেন। টুসুর গানে যন্ত্রণা, অভিযোগ, অভিমান সবটাই ঈশ্বরের উদ্দেশে অর্থাৎ টুসুদেবীকে জানান। কুমারী মেয়ে ও বিবাহিত নারীরা তাঁদের সাংসারিক সুখদুঃখকেও এই গানের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত করেন। পৌষসংক্রান্তির আগের রাতে সন্ধেবেলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে এই সব গান করতে করতে সারা রাত তারা ‘পৌষ আগলান’, মানে ফসল আগলান।
‘তিরিশ দিন রাখলি টুসু
তিরিশটি ফুল দিঁয়ে গ
আর রাখতে লারব টুসু
মকর হইল বাদি গ।’
আবার কখনও কেউ গান…
‘লালমাটি আর শালবন
পিঠা মকর বাসি রে,
হামদের টুসু আইল ঘরে
মুখে লিয়ে হাঁসি রে।’
পৌষের সংক্রান্তির দিনে মাথায় রংবেরংয়ের ‘চৌডল’ নিয়ে, সারা গায়ে সূর্যের আদলে গোলগোল কাগজের ফুল লাগিয়ে উঁচুনিচু ঢালু পথ বেয়ে, নতুন শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে, মহিলারা চলেন নদীর তীরে। জলে দেবার আগে বিষন্ন মনে কেউ কেউ গেয়ে ওঠেন, ‘টুসু ধনকে জলে দিয়ো না/ আমার মনে বড় বেদনা।’
এবার আসি প্রতিবেশী রাজ্য আসামের কথায়। পৌষ মাসের সংক্রান্তির দিন আসামে মাঘ বিহু উদযাপন করা হয়। মাঘ বিহুর অপর নাম ভোগালি বিহু। এটি তিনদিনব্যাপী পালন করা হয়। মাঘ বিহুর প্রথম দিনে নির্দিষ্ট পুকুর, খাল বা অন্য কোনও জলাশয় থেকে সবাই একত্রে মাছ ধরেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই মাছ ধরে আনন্দ উপভোগ করেন। মাঘ বিহু চলাকালীন যুবকেরা খড় দ্বারা মেজিঘর তৈরি করেন। সবাই সেখানে একত্রে বসে আহরণ করা মৎস্য দিয়ে রাত্রের ভোজন করেন ও বিহুগীত গান।
মাঘ বিহুকে ভোগালী অর্থাৎ ভোজনের উৎসবও বলা হয়। এই বিহুর সময়ে আসামবাসীরা জলপান, পিঠা, নাড়ু ইত্যাদি প্রস্তুত করেন। তিল পিঠা মাঘ বিহুর প্রধান পিঠা। এছাড়া মাঘ বিহুর সময় প্রস্তুত করা বিভিন্ন পিঠার মধ্যে রয়েছে: চুঙ্গা পিঠা, ঘিলা পিঠা, সুতুলি পিঠা, হেঁচা পিঠা, ডেকা পিঠা, ভুরভুরি পিঠা ইত্যাদি। তাছাড়াও ভাজা চাউল, কোমল চাউল, চিঁড়া, সন্দেশ, মুড়ি, খৈ ইত্যাদি জলপানের জন্য তৈরি করা হয়।
সাধারণত ভোগালি বিহুর দ্বিতীয় দিনে বাঁশ, শুকনো খড়, শুকনো পাতা, কাঠ, কলাগাছ, কলাপাতা দিয়ে মেজিঘর বা ‘ভেলাঘর’ প্রস্তুত করা হয়। কোথাও কোথাও একে হাবলিঘরও বলা হয়। এটি সাজানো নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। কারটা কত বড় বা কারটা কত শিল্পসম্মত সেটা সবাই ঘুরে ঘুরে দেখেন। ইদানীং তিনতলা পর্যন্ত উঁচু মেজিঘরও তৈরি হয়। দুপুরে ‘ভোজভাত’ খেয়ে আড্ডা, আনন্দের পরে সাঁঝবেলায় ভেলাঘরের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাম সংকীর্তন করে তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং এসময় মেজির কাঠ জ্বললে গান গাওয়া হয় ‘‘পুহ গ’ল মাঘ হ’ল, আমাৰ মেজি জ্বলি গ’ল।’’ মেজির তলে আশীৰ্বাদ নিলে ব্যক্তির মনাকাঙ্ক্ষা পূরণ হয় বলে লোকবিশ্বাস আছে। সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকের মতে, হাতির হাত থেকে পাকা ফসল রক্ষা করার জন্য আগুন জ্বালিয়ে এই রীতি পালনের উদ্ভব হয়েছিল।
এবার আসা যাক বাঙালির প্রায় দ্বিতীয় ঘর ওড়িশায়। এই দিনে এখানে যে পার্বণ হয় তা মাঘী, ঘুঘুটি, উত্তরায়ণ বলে পরিচিত। মাঘা, ভোগী বা শুধু সংক্রান্তি নামেও দিনটি পরিচিত। ওড়িশাতে পুরাণ অনুসারে বিশ্বাস করা হয়, সূর্যদেব এই দিন তাঁর পুত্র শনিদেব, যিনি কিনা মকররাশির স্বামী, তাঁর বাড়িতে আসেন ছেলের সঙ্গে দেখা করতে। ফলত, এই দিনটি পিতাপুত্রের কাছে এক বিশেষ দিন বলে মানা হয়। আবার পুরাণের আরেক মতে, ভগবান বিষ্ণু এইদিন অসুরদের আসুরিক শক্তির বিনাশ করে তাদের কাটা মুণ্ডগুলোকে মন্দার পর্বতের নিচে মাটি চাপা দিয়েছিলেন। তাই এই পার্বণ ঋণাত্মক শক্তিকে পরাজিত করে এক আশার বার্তা সঞ্চার করে।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এই দিনটি উত্তরায়ণ যাত্রা নামে পরিচিত। ভক্তেরা এইদিন জগন্নাথকে নতুন ওঠা চাল, আখের গুড়, নারকেল কোরা, কলা, ছানা, খোওয়া ক্ষীর, দুধ এবং নানাজাতীয় টাটকা ও শুকনো ফল দিয়ে তৈরি মকরচৌলা নিবেদন করেন। জগন্নাথকে মকর সংক্রান্তির আগের দিন নবাঙ্ক বেশ পরানো হয় আর মকর সংক্রান্তির দিন মকরা চৌরাশি বেশ পরানো হয়। কোনার্কে হাজার হাজার ভক্ত এদিন আসেন সূর্যদেবকে প্রণাম জানিয়ে সুস্থ থাকার জন্য। আবার কটকে ঘুড়ি উড়িয়ে পালিত হয় দিনটি।
বিহারে মকর সংক্রান্তিকে তিল সংক্রান্তিও বলে। সূর্যদেবতা ধনু রাশি ছেড়ে মকর রাশিতে প্রবেশ করলে মকর সংক্রান্তি পালন করা হয়। মকর সংক্রান্তিতে পবিত্র নদীতে স্নান করার এবং গরিবদের কালো তিল, তিলের লাড্ডু, চাল, শাকসবজি, ডাল, হলুদ, ফল এবং অন্যান্য জিনিস দান করার প্রথা রয়েছে। রাজগীরে উষ্ণ প্রস্রবনে স্নান করে মন্দিরে ভগবানকে ফুল নিবেদনের রীতি রয়েছে এইদিনে। এছাড়া বিহারের বিভিন্ন জায়গায় এই উপলক্ষে মেলা বসে।
উত্তরপ্রদেশে এই দিনটি খিচড়ি নামে অধিক প্রসিদ্ধ। গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ মন্দিরে খিচুড়ি ভোগ দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এই দিন থেকে প্রয়াগরাজেও মাঘ মেলার আয়োজন করা হয়। মকর সংক্রান্তির অপর নাম তাই এখানে মাঘী।
ঝাড়খণ্ডের অধিবাসীরা এই দিনটিতে প্রাতস্নান করে মনে করেন সারাবছরের পাপ ধৌত হয়ে গেল। তারপর ঘরে ও মন্দিরে পূজাপাঠের পরে পরিবারের প্রতিটি সদস্য একত্রে বসে দহিচূড়া খান প্রাতরাশে। এই দহিচূড়া তৈরি হয় দই, মুড়ি, গুড় দিয়ে। এর সঙ্গে তিলকূট ও গুড়বাদাম খাওয়ারও রেওয়াজ রয়েছে। ঝাড়খণ্ডের অনেক গ্রামে শস্যরোপণ উৎসব সোহরাই পালিত হয় এই একইসময়ে।
শীতের রুক্ষ করাল থাবা থেকে এবার আস্তে আস্তে উপত্যকা ফুলে, ফলে, শস্যে রঙিন হয়ে উঠবে, বসন্ত আসবে, তাই এই দিনটিতে জম্মু-কাশ্মীরের হিন্দুরা পবিত্র নদী বা ঝর্নায় স্নান করে বাড়িতে ‘হবন’ বা যজ্ঞ করেন। এখানে মকর সংক্রান্তি শিশুর নামে পরিচিত। জম্মুর কিছু গ্রামের কিশোরবয়সী ছেলেরা রাস্তায় টহল দেয় এবং নববিবাহিত স্বামী-স্ত্রী ও সদ্যোজাত সন্তানের পিতামাতার থেকে উপহার দাবি করে। এরা রঙিন কাগজ ও ফুল দিয়ে নিজেদের সুসজ্জিত করে। পুরো পরিবেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে যখন ওরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ও গানের সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন নৃত্য পরিবেশন করে।
কৃষিপ্রধান পঞ্জাবে এই দিনটি বিশেষ করে মকর সংকান্তির আগের দিনটি লোহরী নামে সুপ্রসিদ্ধ। লোহরীর রাতে আগুন জ্বালিয়ে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবেরা গোল হয়ে বসে আগুনে মিষ্টিদ্রব্য সামগ্রী, আখের টুকরো, খই অর্পণ করেন। তারপর কোথাও ভাংড়া প্রদর্শিত হয়। পরের দিন অর্থাৎ পঞ্জাবে মাঘী ও হরিয়ানায় মাঘ সংক্রান্তিতে হাজার হাজার পুণ্যার্থী ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক গুরদোয়ারা সংলগ্ন সরোবরে যেমন মুক্তোশ্বর, ফরিদকোট, নাননাকসর, তক্তপুর, দারোলিভাইয়ে পুণ্যস্নান করে গুরদোয়ারায় প্রার্থনা করেন। খই, গুড়, তিল, চিনেবাদাম, বরফি দিয়ে প্রাতরাশ করেন।
মধ্যপ্রদেশেও ভক্তির সঙ্গে এই সংক্রান্তি পালিত হয়। ভোর হওয়ার আগে থেকে প্রচুর মানুষ শিপ্রা নদীর তীরে জমায়েত হয়ে নদীতে ডুব দিয়ে স্নান করেন এবং সূর্যদেব উদ্ভাসিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনাগীত গান এবং পরস্পরের মধ্য খিচড়ি ও তিলের লাড্ডু বিতরণ করেন। আবার জব্বলপুরের নর্মদা নদীর তীরে গোআরীঘাট নামে এক ছোট্ট শহরের পুণ্যার্থীরা প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে নর্মদা নদীতে স্নান করে দুস্থ ও অসহায় মানুষদের হাতে খাদ্যসামগ্রী তুলে দেন।
সমগ্র রাজস্থানে এই দিনটি ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়। যোধপুর এবং জয়পুরে এই ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে বড় বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়। জয়পুরের জলমহল গ্রাউন্ডে এই কাইট ফেস্টিভ্যাল এতটাই জাঁকজমকের সঙ্গে করা হয় যে, প্রচুর বিদেশি পর্যটক তা দেখতে আসেন। রাজস্থানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এই ঘুড়ি ওড়ানোকে কেন্দ্র করে সাজো সাজো রব পড়ে যায়। মাঞ্জা দেওয়া, ঘুড়ি নির্বাচনে ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও সমান আগ্রহে যুক্ত থাকেন। আর এইসব ঘুড়িগুলো যখন আকাশে ওড়ে তখন বাড়ির মহিলারা ছাদে গোল হয়ে বসে লোকগান করেন এবং কখনও কখনও হাসিমজার সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ানোতেও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। পরিবারের ছোট থেকে বড় সকল মহিলা সদস্য মিলে এই উৎসবের বিশেষ খাদ্যসামগ্রী তিলের লাড্ডু, গজক, বাদামের লাড্ডু, ডাল পকোড়ি এবং অতি অবশ্যই গাজরের হালুয়া বানান। সারা দিন ধরে শুভেচ্ছা বিনিময় চলে এবং আগত আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের পরিবেশন করা হয় এই হালুয়া।
গুজরাতে মকর সংক্রান্তি উত্তরায়ণ বলে প্রসিদ্ধ। এই পার্বণের প্রধান অঙ্গ ঘুড়ি ওড়ানো। ১৯৮৯ থেকে এখানে বিপুল আকারে কাইট ফেস্টিভ্যাল হয় এই সময়। সকাল থেকে শুরু করে অনেক রাত্রি পর্যন্ত এখানে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। উত্তরায়ণের পরের দিনটি এখানে ‘বাসি উত্তরায়ণ’ পালন করা হয়।
উত্তরায়ণের ঊষাকালে রাজস্থানের অনেক জেলায় দীর্ঘদিনকে স্বাগত জানাতে সুদৃশ্য লন্ঠন জ্বালিয়ে ফানুস ওড়ানো হয়। উত্তরায়ণের জন্যে বিশেষভাবে বানানো হয় শীতের সব সজীব সতেজ শাকসব্জি দিয়ে তৈরি উন্ধিয়ু, যা ঘিয়ে ভাজা পুরির সঙ্গে খাওয়া হয়। আর মিষ্টি হিসেবে তিল, বাদাম আর গুড় দিয়ে বানানো হয় ‘চিক্কি’।
মহারাষ্ট্রে ‘তিলগুল’ লাড্ডু বিনিময় করা হয় এইদিনে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য সম্প্রসারণের জন্য। মহারাষ্ট্রে এই নিয়ে একটা প্রচলিত কথা চালু আছে, ‘তিল গুল ঘ্যা নি, গোড গোড বোলা’, অর্থাৎ মিষ্টি খেয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলো। এইসময় মহারাষ্ট্রের বিখ্যাত পূরণপোলিও বানানো হয়। তিনদিন, ভিন্ন মতে, চারদিন ধরে মহারাষ্ট্রে মকর সংক্রান্তি পালিত হয়। প্রথমে পার্বণ শুরু হওয়ার আগে মহারাষ্ট্রের গৃহস্থরা বাড়িঘর, আসবাবপত্র সব ধুয়েমুছে পরিষ্কার করেন। পার্বণের প্রথম দিনটিকে বলে ভোগী। মহারাষ্ট্রের নিজস্ব শৈলীর পোশাক পরে ছোট থেকে বড় সবাই নিষ্ঠার সঙ্গে ঘুড়ি ওড়ান বা ঘুড়ি ওড়ানোর কাজে নিযুক্ত থাকেন সূর্যদেবকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। দ্বিতীয় দিনের সবচেয়ে বড় লোকাচার হল হলদি কুমকুম। এই দিন বিবাহিতা মহিলারা একে অপরের কপালে সিঁদুর ও হলুদের টিপ পরিয়ে দেন। পার্বণের শেষদিনকে বলে কিঙ্কারন্ত। অশুভের প্রতীক রাক্ষস কিঙ্কারাসুর বধ হয়েছিল এইদিন। এই দিন গুলাচি পোলি, রঙিন হালুয়া খেয়ে ও খাইয়ে মহারাষ্ট্রের মানুষ অতীতের মান-অভিমান, রাগ-ঝগড়া ভুলে আবার নতুন করে সুসম্পর্ক স্থাপনের বার্তা পাঠান।
মহারাষ্ট্রীয় বিবাহিতা মহিলারা একে অপরকে এই উপলক্ষে গৃহস্থালির সামগ্রী থেকে শুরু করে মুদি মাল, এমনকি গয়না পর্যন্ত একে অপরকে উপহার দেন। আর একটা বিষয় এখানে জানা যায়, নববিবাহিত মহিলাকে এই মকর সংক্রান্তির হলুদ কুমকুম অনুষ্ঠান অনেক বড় করে পালন করার রেওয়াজ রয়েছে। তারা এইদিন শ্বশুরবাড়িতে বিশেষ পূজা করেন। ‘দ্য গোয়ান এভরিডে’ পত্রিকার তথ্য অনুসারে, এই উপলক্ষ্যে বধূর বাবা-মা উপহার পাঠান। পান-সুপারি, পিঞ্জর (কুমকুমের পাত্র) হলুদ, নারকেল, মুন্নিও (৫টি সোনার পুঁতি), পিদ্দুকিও (মঙ্গলসূত্র তৈরিতে ব্যবহৃত কালো প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র পুঁতি), তিলগুল (ছোট চিনির দানা), ছোলা, নওভারি কাপড় (৯ গজ শাড়ি) এবং ফুল। গৃহদেবতা, মায়ের বাড়ি এবং তিন নিকটাত্মীয়কে সোনালি মুক্তোও দেওয়ার রীতি আছে। নববধূকে প্রথম বছরে অন্যান্য মহিলাদের কিছু জিনিস বিতরণ করতে হয়, যার মধ্যে রয়েছে বুদকুল্লো (একটি মাটির পাত্র যা ভাত রান্না করতে/ জল ভর্তি করতে ব্যবহৃত হয়) এবং অর্ধেক নারকেল। বুদকুল্লোর বাইরের অংশ পাঁচ ধরনের সুতো দিয়ে বাঁধা থাকে যার সঙ্গে যোগ করা হয় পাঁচটি পিদ্দুকিও। বুদকুল্লোতে পাঁচ ধরনের শস্য রাখা হয়: গম, মুগ (সবুজ মসুর), ধান, তিল, রাগি। উর্বরতার প্রতীক হিসেবে শস্যগুলি নির্বাচন করা হয়, কারণ এগুলি অঙ্কুরিত হওয়ার পরে বেড়ে ওঠে। পরের বছর, কনে একটি কুমকুম পাত্র এবং পরবর্তী বছরগুলিতে চুড়ি, আয়না এবং চিরুনি দেয়। পরবর্তী বছরগুলিতে, যে কোনও সমাগ্রী বিতরণ করা যেতে পারে।
দক্ষিণ গোয়ার এক মন্দিরের পুরোহিত সুকুমার বার্ভের কথায় জানা যায়, এদিন গোয়ানিজ হিন্দুরা সংযমের সঙ্গে থেকে ধূমপান, মদ্যপান, পেঁয়াজ-রসুন খাওয়া বাদ দিয়ে শুদ্ধমতে স্নান করে সূর্যদেবকে জল নিবেদন করেন মোক্ষলাভের আশায়। এছাড়া ধূপ, সুগন্ধী, তিল তেলও নিবেদন করা হয়। আর পূজার পরে অনেকে দুস্থ মানুষদের শীতবস্ত্র, কম্বল, ছোলা, ডাল বিতরণ করেন।
এবার আসি দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে। কর্ণাটকে মকর সংক্রান্তিকে সংক্রান্তিই বলে। ‘এল্লু বেল্লা থিনদু ওল্লে মাত্থাদি’, কন্নড় ভাষায় এর অর্থ সেই মহারাষ্ট্রের মত, তিল গুড় খাও আর ভাল কথা বলো। শিশু ও মহিলারা একটা প্লেটের মধ্যে একখণ্ড আখ, তিল ও গুড়ের মিশ্রণ, চিনির তৈরি মিঠাই নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে থালি বা প্লেট বিনিময় করেন, যাতে প্রতিবেশী, বন্ধুদের সঙ্গে বন্ধন দৃঢ় হয়। এছাড়া ঘরে, মন্দিরে পূজাপাঠ হয়। আমপাতা দিয়ে প্রবেশদ্বার সাজানো হয়, রঙ্গোলি দিয়ে উঠোন বা ঘরের মেঝে সাজানো হয়। গবাদি পশুদেরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সাজানো হয়।
কর্ণাটকের কিছু কিছু জায়গায় সংক্রান্তির আগে নোংরা পুরনো পোশাক বাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এই দিনেই পুরনো বাতিল কাঠের সামগ্রী, আসবাবপত্র, অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগুনে পুড়িয়ে ফেলে তারপর বাড়িঘর পরিষ্কার করে দেওয়ালে রং বা হোয়াইটওয়াশ করায়।
সংক্রান্তির দিন বাড়ির প্রতিটি সদস্য তেল মেখে স্নান করে নতুন পোশাক পরেন আর মেয়েরা নতুন পোশাকের সঙ্গে অলঙ্কারও পরেন। পূজার পরে মজা ও আনন্দের জন্য অনেক জায়গায় কুস্তি খেলা, নাচ, গানবাজনার বন্দোবস্ত করা হয়।
কেরলের সবরীমালা মন্দিরের কাছে এইদিন অগণিত ভক্ত ভিড় জমান মকরভিলাক্কুর স্বর্গীয় জ্যোতি (পোন্নাম্বালামেদু পাহাড়ের শিখা) দেখতে। ভক্তদের বিশ্বাস প্রভু আইয়াপ্পা স্বামী এই আলোর মধ্য দিয়ে ভক্তদের দেখা দেন ও আশীর্বাদ করেন। কেরলে সাধারণত গ্রামে দেখা যায়, খুব সকালে মাটির চুলার উপরে রাখা বড় মাটির হাঁড়িতে দুধ ফুটানো হয়। ফুটানো দুধ পাত্র উপচে ছিটকে পড়লে লোকেরা ‘পোঙ্গালো পোঙ্গল’ বলে চিৎকার করেন, যেখান থেকে উৎসবটির নাম ‘পোঙ্গল’ হয়েছে। মিষ্টি পোঙ্গল, নোনতা পোঙ্গল, সম্বর, রসম, অধিরসম, দুধ, দই, বড়া এসব মধ্যাহ্নভোজের জন্য বানানো হয়। এর পরের দিনকে মাট্টু পোঙ্গল বলে। এই দিনে গৃহপালিত পশুপাখিদের প্রায় পূজা করা হয়। গরু, মহিষ, বাছুর, ছাগল, ষাঁড়, ভেড়া অর্থাৎ যারা কৃষিকাজে সহায়তা করে, সেইসব পশুদের সিঁদুর, হলুদ, চন্দনের টিপ পরিয়ে ফুল, ঘণ্টা দিয়ে সাজিয়ে বিশেষ খাবার দিয়ে যেন অতিথির মত আপ্যায়িত করা হয়। চতুর্থ দিনকে বলে কান্নুম পোঙ্গল। গ্রামাঞ্চলে এই দিনে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের চাষবাসে সহায়তার জন্য শুভেচ্ছা জানানো হয়। একই দিনে থিরুভাল্লুভার দিবস বা উঝাভার থিরুন্নালও পালিত হয় দেশে কৃষকদের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য।
তামিলনাড়ুতে মকর সংক্রান্তিকে থাই পোঙ্গল বা থাই পেন্দিগাই বলা হয়। এই পোঙ্গল অনুষ্ঠান চারদিন ধরে চলে। প্রথম দিন ঘরবাড়ির যত আবর্জনা আছে সব ঝেড়ে ফেলে দেওয়া হয়। এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা। ঘরের সঙ্গে সঙ্গে মন থেকেও জঞ্জাল না সরালে আমরা উৎসবের নব আনন্দে নিজেদের পূর্ণ করব কীভাবে! এই দিনটিকে ভোগী পোঙ্গল বলে। এরপরে আসল দিন অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন সূর্যদেবকে বন্দনা করা হয় উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য। চাষবাস সুগম আর নিরুপদ্রব হবার জন্য।
অন্ধ্রপ্রদেশেও মকর সংক্রান্তি তিনদিন ধরে পালিত হয়। প্রথম দিনকে বলে ভোগী পান্ডুগা। এইদিন সব অপ্রয়োজনীয়, বাতিল জিনিস পুড়িয়ে ফেলা হয়। দ্বিতীয় দিন পেড্ডা পান্ডুগা। এই দিনটি প্রধান। সবাই নতুন জামাকাপড় পরে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন। তারপর অতিথি আপ্যায়নে মেতে ওঠেন। আগে এই দিন মুরগি লড়াই হত কিন্তু এখন তা প্রশাসনিকভাবে নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তৃতীয় বা শেষদিনকে বলে কানুমা পান্ডুগা। প্রচুর মিষ্টি খাবার খাওয়ার পর স্বাদবদলের জন্য এদিন মাংস খাওয়ার বিধি রয়েছে।
ত্রিপুরার পৌষসংক্রান্তি মেলাময়। আগরতলায় আগরতলা মেলা, অমরপুর মহকুমায় বুড়বাড়িয়া মেলা এবং বেলোনিয়ায় মহামণিপাড়া মেলা, কাঞ্চনপুরে রাধামাধবীপুরা ও মুহুরীপুর মেলা সমান উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে সংগঠিত হয়।
উত্তরাখণ্ডে মকর সংক্রান্তিকে ঘুঘুটিয়া বলা হয়। লোকজন সরযূ, গোমতী নদীতে স্নান করে খিচুড়ি বিতরণ করেন। এছাড়া একটা অদ্ভুত বিষয় তারা করেন, গমের গুঁড়ো গুড় দিয়ে মেখে ঘিতে কড়া করে ভেজে তাকে নানান আকৃতির বানিয়ে পরিযায়ী পাখিদের খাওয়ানোর জন্য বাচ্চাদের গলার নেকলেস আকৃতি দেন। শিশুরা সেটা সকালে গলায় পরে মজার ছড়া কাটে। ‘কালে কালে/ ভোল বাটে আইলে বোর পুয়া/ খালে লে কাউভা বড়া/ মাই কে দে সুনু ঘারো/ লে কাউভা ঢাল/ মাই কে দে সুনু থাই।’ এর বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘এসো প্রিয় কাক/ রোজ এসো মজা পাবে বড়া আর পুয়া খাও/ আমাকে একটা সোনাভরা ঘড়া দাও/ এই নাও ঢাল/ আর আমাকে দাও একটা সোনার থাল।’ এই গান গেয়ে কাক ও অন্য পাখি (তাদের মধ্যে পরিযায়ী পাখিও থাকে) তাদের এটা খাইয়ে দেয়। এই অঞ্চলের মানুষ কাককে এই উৎসবে সম্মান জানান, কারণ কাকেরা এই চরম ঠান্ডাতেও অন্য পাখিদের মত এই অঞ্চল ছেড়ে যায় না, কষ্ট সহ্য করে সেখানকার মানুষের সঙ্গে থেকে যায় বলে। আর পরিযায়ী পাখিরা সমতল ছেড়ে পাহাড়ে ফিরে আসে এই সময়, তাই তাদেরও ওই নেকলেসের অংশ থেকে খাওয়ানো হয় স্বাগত জানানোর জন্য।
সিকিমের জোরথাংয়ে এই সংক্রান্তি উপলক্ষে একটি বড় মেলা বসে। বসন্তকালকে স্বাগত জানাতে এই মেলায় নৃত্যগীত অনুষ্ঠিত হয়। যদিও ১৯৫৫-তে এই মেলা শুরু হওয়ার সময় কৃষিজাত দ্রব্য বিপণন মুখ্য হলেও বর্তমানে মাঘে মেলার লক্ষ্য হস্তশিল্প, শিল্পকর্ম এবং সেরাজ্যের বিভিন্ন রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও অখণ্ডতার প্রদর্শন করে উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রদর্শনী সহ দক্ষ শ্রমিকদের উজ্জ্বল নৈপুণ্যকে একটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা।
অরুণাচল প্রদেশের পরশুরাম কুণ্ডে পৌষ সংক্রান্তিতে পুণ্যস্নান করতে বহু দূর দূর থেকে পুণ্যর্থীরা আসেন আর তেজু জেলায় এই সংক্রান্তি উপলক্ষে একটি মেলা বসে।
মণিপুরে ভাপা তিলের পিঠে যাকে কাংসুবি বলা হয়, তুলসী মন্দিরে বা বাড়িতে তুলসীমঞ্চের সামনে ভগবানের উদ্দেশে নিবেদন করা হয়। মনে করা হয় তিল অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে। ইম্ফলের শ্রী গোবিন্দজি মন্দিরে এই দিন প্রচুর ভক্তের সমাগম হয়।
ভারতবর্ষে নাগাল্যান্ড ছাড়া প্রায় সমস্ত রাজ্যের মানুষই পালন করেন সংক্রান্তি। নানা রূপে, নানা নামে। সংক্রান্তি অর্থ গমন করা। এই দিনটিতেই শেষ হয় সূর্যের দক্ষিণায়ন। এবার শুরু সূর্যের উত্তরায়ণ। অর্থাৎ শীত-শেষের সূচনা হয় এই দিনে। ঋতুর পরিবর্তন হয় মকর সংক্রান্তির দিন। শীত কমে গিয়ে শুরু হয় বসন্ত। সব রাজ্যের লোকাচার মিলিয়ে দেখা যায়, প্রধানত শস্য এবং সূর্যের পুজোর দিন এটি। মহাভারতেও এই দিনটির উল্লেখ আছে। এদিন নাকি ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। অধিকাংশ ভারতবাসীর বিশ্বাস, সংক্রান্তি দেবী নাকি এই দিনই শঙ্করাসুর নামের দানবকে বধ করেন। এই দিনটিতে নাকি অশুভ শক্তির শেষ হয়ে শুভ শক্তির সূচনা হয়।
এদিন পূজিত হন সূর্যদেবতা। শাস্ত্র মতে, সূর্য হল আত্মা, পিতা, মান-সম্মান, সাফল্য, উন্নতির প্রতীক। তাঁকে তুষ্ট করতে পারলে সব কার্যে সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব। এরই সঙ্গে মকর সংক্রান্তির দিন পুণ্যলাভের জন্য পবিত্র নদীতে স্নানের রীতি বহু বছর ধরে প্রচলিত। পুণ্যলাভের আশায় লক্ষ লক্ষ মানুষ সাগরের জলেও ডুব দেন। এই সময় গঙ্গাসাগর যাত্রা করেন ভক্তরা। সেখানে সাগরে স্নান সেরে কপিল মুনির আশ্রম দর্শনের রীতি বহু যুগ ধরে প্রচলিত। পুরাণ অনুসারে, কপিল মুনি বিষ্ণুর অবতার। ব্রক্ষার পৌত্র মনুর বংশধর। তাই এইদিন তাঁর আশ্রম দর্শনে যান তীর্থযাত্রীরা। এছাড়া প্রয়াগে গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী নদীর মিলনস্থলে কুম্ভ পুণ্যস্নান করতে দেশবিদেশ থেকে বহু মানুষ ছুটে আসেন।
প্রয়োজনীয় তথ্যসমৃদ্ধ পোস্ট। পৌষ সংক্রান্তি বিষয়ক কিছু জানা ছিল সামগ্রিকভাবে জেনে ভালো লাগলো ?