দীপ শেখর চক্রবর্তীর গল্পের বই ‘হাওয়ার দুর্গ’ বারোটি গল্পের সংকলন। কিছু কিছু বই শুধু পাঠ করার নয়, এক অন্তহীন অনুভব, প্রস্তাবিত বিজারণ ও প্রশ্নাতীত অস্পষ্টতার অসমীকরণ। এই বইয়ের গল্পগুলি আপাতভাবে কাহিনিবর্জিত, কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণে পাঠকের কাছ থেকে, বা বলা ভাল, পাঠকের অন্তঃসলিলে কাহিনি সৃষ্টি করতে থাকে। বইয়ের প্রতিটি গল্প-ই প্রথম থেকেই এক অদ্ভুত বিষণ্ণ জগতের সন্ধান করে। আলাদা করে গল্পগুলি নিয়ে পৃথক বিশ্লেষণ করলে সে আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা, তাই মূলত একটি সূত্র থেকে লেখাগুলি ধরার চেষ্টা করব। আবার সতর্কীকরণ, গল্পগুলি সম্পূর্ণ আত্মস্থ বা মগজস্থ করার ভাবনা থাকলে তা থেকে বিরত থাকাই ভাল, কারণ, স্পষ্ট হতে চাওয়ার কোনও দাবি তাদের নেই। বরং, নিঃসীম নৈঃশব্দ্যে অপার অনন্তের দিকেই তাদের নৈসর্গিক যাত্রা।
দীপ শেখরের গল্পে এক বিপণ্ন জগতের কথা আছে। যে জগতে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট, যে শহরে মানুষের স্বাভাবিক চেতনার ধারাটা অনেকখানি অবলুপ্ত, যে শহরে অস্তিত্ব-সংকট ক্রমবর্ধমান, যা ধীরে ধীরে প্রত্যেক প্রথম পুরুষকে হারিয়ে যেতে দেবে আত্মার অসীম পরিব্যপ্তিতে। একটা অন্বেষণ, সে অন্বেষণে আছে সত্যের, মনের এবং শরীরের খোঁজ, আর তার মধ্যেই গল্পগুলি ডালপালা বিস্তার করেছে নগ্নভাবে। গল্পের লেখক স্বয়ং কথকের স্থান অধিগ্রহণ করেছেন, এবং এক অভাবনীয় নিস্পৃহ ঔদাসীন্যে সংকটকে পাঠকের অন্তরাত্মায় নিমজ্জিত করেছেন। গল্পগুলি প্রতিক্ষণে শরীরী থেকে অতি-শরীরী হয়ে উঠতে চেয়েছে; রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী চেহারার নগ্নতা রূপকে নয়, বরং ফ্যালিক চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপিত করেছে।
‘সিংহাসন’ গল্পে উইলিয়াম ব্লেকের ‘tyger’ ও ‘lamb’-এর মেটাফোর, ‘হাওয়ার দুর্গ’ গল্পে সামগ্রিকভাবেই দেখা যায় ‘ইমপ্ল্যান্টেড’ ডিসটোপিয়া, যার স্থিতিস্থাপকতার সুযোগ নিয়ে প্রবেশ করে সামাজিক ক্ষয়, অবরুদ্ধ আবেগ ও নিপীড়িতের আর্তনাদ। এই শোক-বিহ্বলতায় কখনও কখনও আশ্চর্যজনকভাবে উপস্থিত থাকে ‘masochism’, যা লেখককে ক্রমশ তাড়িত করে এক অহেতুক, অস্পৃশ্য নান্দনিকতা নির্মাণে।
অতিসরলীকৃত করে বললে, ‘সুলতার ফুলছাপ ছায়া’, ‘এগারোটি সংখ্যার নীরবতা’, ‘হোটেলের রেজিস্টারে যে নাম কখনও থাকে না’, ‘নর্দমা’ বা ‘খাদান’ গল্পে চোরা শরীরসন্ধান, অন্তঃসারশূন্য সময়ের বশংবদ যৌনতার আদিম অন্তঃক্ষরণ, হারিয়ে যাওয়ার ভয়, অন্বেষণের অন্তরালে প্রাপ্তিকে দূরে ঠেলে দেওয়ার যে রিভার্স এপিফ্যানি, তাকে তুলে ধরা হয়েছে। একধরনের নির্মীয়মাণ স্পৃহা, যা একবিংশ শতকের উত্তরাধুনিক বাস্তবতায় ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, তাকে প্রতিভাত করা হয়েছে তরল স্বরে, যার গভীরে নিপাতনে সিদ্ধ হয় মানবতার অকৃত্রিম আকুতি। ঠিক এই জায়গাতেই মায়াবাস্তব রচিত হয়, তার গূঢ় পাঁজর থেকে চুঁয়ে পড়তে চায় বাস্তবিক আবেগ, রুক্ষতার রোম্যান্টিসিজম; উদাহরণস্বরূপ, ‘আমার উনিশ বছরের মেয়েটি’।
‘মঞ্চে কেউ নেই’ গল্পের শেষে ‘উলঙ্গ রাজা’-র সিক্যুয়েলের ছাপ লক্ষ্যণীয়। ‘কাগজ’ ও ‘নিমগাছ’ গল্পের অস্তিত্ব-দোটানা, বেঁচে থাকার টানাপোড়েন, বিচ্ছিন্নতা-সংকট, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও স্নায়বিক, সন্তর্পণে জীবনের যে অর্ধসত্য হাতিয়ার-সংগ্রাম, তাকে দমিত করেছে সুপরিকল্পিত স্থিতাবস্থায়। দীপ শেখরের গল্পে— ‘যে কোনো উপায়ে বেঁচে থাকাই জীবন’, টিকে থাকাই অন্তিম শ্বাসের পূর্ববর্তী মিষ্টতা।
প্রতিটি গল্পের স্বতন্ত্রতাকে লেখক সূত্রাকারে গ্রথিত করেছেন, কখনও ক্ষণিকের প্রিটেনশনে, কখনও উপর্যুপরি আখ্যান-বর্জনে। এক অদ্ভুত বিপ্রতীপ অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় ক্রমশ যুদ্ধ করে চলা তৃতীয় পৃথিবীর মানুষ, নিঃসঙ্গ, বিপন্ন ও তিক্ত জীবনের সমান্তরালে অকল্পনীয় নিরাসক্তি, অস্তিত্বচেতনা ও অস্তিত্বহীনতার ছটফটানিতে অর্থশূন্য, অথবা প্রবল সদর্থক বেঁচে থাকাকে উপভোগ করা— মানবজীবনের এলোমেলো, অকারণ, তাৎক্ষণিক, বহুগামী, স্বভাবসিদ্ধ অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দিয়ে এগিয়ে চলেছে গল্পগুলি। ভাষার কাব্যিক মোচড়, গতির প্রতিকূলে মুহূর্তনির্মাণ, মেদের প্রয়োজনীয় সংযোজন— সার্বিকভাবে গল্পগুলিকে উন্নীত করেছে চেতনার পরাকাল্পনিক স্তরে, যেখান থেকে সূচিত মহাজাগতিক উত্তেজনাকে প্রতিহত করে পিছিয়ে আসার সমস্ত পথ অবরুদ্ধ।
‘মৌহারি’-র কাজ, যত্ন, পরিশীলন প্রশংসাযোগ্য। মূল্য কিঞ্চিৎ বেশি মনে হয়েছে। লেখকের স্বকৃত প্রচ্ছদেও পরিকল্পিত ও পরিচিত নান্দনিকতাতে বিনির্মাণের প্রয়াস স্পষ্ট। দীপ শেখর চক্রবর্তী আরও লিখুন, তাঁর গল্পের বাঁকে বাঁকে আবিষ্কৃত হোক অবচেতনের অযাচিত অঙ্গুলিহেলন। তাঁকে আন্তরিক শুভকামনা আর ভালবাসা জানাই।
হাওয়ার দুর্গ ।। দীপ শেখর চক্রবর্তী ।। মৌহারি ।। প্রচ্ছদ: দীপ শেখর চক্রবর্তী ।। মূল্য: ৩০০ টাকা মাত্র