Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

‘হাওয়ার দুর্গ’: মায়াবাস্তব চোরাবালিতে আত্মানুসন্ধানী অবগাহন

দীপ শেখর চক্রবর্তীর গল্পের বই ‘হাওয়ার দুর্গ’ বারোটি গল্পের সংকলন। কিছু কিছু বই শুধু পাঠ করার নয়, এক অন্তহীন অনুভব, প্রস্তাবিত বিজারণ ও প্রশ্নাতীত অস্পষ্টতার অসমীকরণ। এই বইয়ের গল্পগুলি আপাতভাবে কাহিনিবর্জিত, কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণে পাঠকের কাছ থেকে, বা বলা ভাল, পাঠকের অন্তঃসলিলে কাহিনি সৃষ্টি করতে থাকে। বইয়ের প্রতিটি গল্প-ই প্রথম থেকেই এক অদ্ভুত বিষণ্ণ জগতের সন্ধান করে। আলাদা করে গল্পগুলি নিয়ে পৃথক বিশ্লেষণ করলে সে আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার সম্ভাবনা, তাই মূলত একটি সূত্র থেকে লেখাগুলি ধরার চেষ্টা করব। আবার সতর্কীকরণ, গল্পগুলি সম্পূর্ণ আত্মস্থ বা মগজস্থ করার ভাবনা থাকলে তা থেকে বিরত থাকাই ভাল, কারণ, স্পষ্ট হতে চাওয়ার কোনও দাবি তাদের নেই। বরং, নিঃসীম নৈঃশব্দ্যে অপার অনন্তের দিকেই তাদের নৈসর্গিক যাত্রা।

দীপ শেখরের গল্পে এক বিপণ্ন জগতের কথা আছে। যে জগতে রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকট, যে শহরে মানুষের স্বাভাবিক চেতনার ধারাটা অনেকখানি অবলুপ্ত, যে শহরে অস্তিত্ব-সংকট ক্রমবর্ধমান, যা ধীরে ধীরে প্রত্যেক প্রথম পুরুষকে হারিয়ে যেতে দেবে আত্মার অসীম পরিব্যপ্তিতে। একটা অন্বেষণ, সে অন্বেষণে আছে সত্যের, মনের এবং শরীরের খোঁজ, আর তার মধ্যেই গল্পগুলি ডালপালা বিস্তার করেছে নগ্নভাবে। গল্পের লেখক স্বয়ং কথকের স্থান অধিগ্রহণ করেছেন, এবং এক অভাবনীয় নিস্পৃহ ঔদাসীন্যে সংকটকে পাঠকের অন্তরাত্মায় নিমজ্জিত করেছেন। গল্পগুলি প্রতিক্ষণে শরীরী থেকে অতি-শরীরী হয়ে উঠতে চেয়েছে; রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী চেহারার নগ্নতা রূপকে নয়, বরং ফ্যালিক চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে প্রতিস্থাপিত করেছে।

‘সিংহাসন’ গল্পে উইলিয়াম ব্লেকের ‘tyger’ ও ‘lamb’-এর মেটাফোর, ‘হাওয়ার দুর্গ’ গল্পে সামগ্রিকভাবেই দেখা যায় ‘ইমপ্ল্যান্টেড’ ডিসটোপিয়া, যার স্থিতিস্থাপকতার সুযোগ নিয়ে প্রবেশ করে সামাজিক ক্ষয়, অবরুদ্ধ আবেগ ও নিপীড়িতের আর্তনাদ। এই শোক-বিহ্বলতায় কখনও কখনও আশ্চর্যজনকভাবে উপস্থিত থাকে ‘masochism’, যা লেখককে ক্রমশ তাড়িত করে এক অহেতুক, অস্পৃশ্য নান্দনিকতা নির্মাণে।

অতিসরলীকৃত করে বললে, ‘সুলতার ফুলছাপ ছায়া’, ‘এগারোটি সংখ্যার নীরবতা’, ‘হোটেলের রেজিস্টারে যে নাম কখনও থাকে না’, ‘নর্দমা’ বা ‘খাদান’ গল্পে চোরা শরীরসন্ধান, অন্তঃসারশূন্য সময়ের বশংবদ যৌনতার আদিম অন্তঃক্ষরণ, হারিয়ে যাওয়ার ভয়, অন্বেষণের অন্তরালে প্রাপ্তিকে দূরে ঠেলে দেওয়ার যে রিভার্স এপিফ্যানি, তাকে তুলে ধরা হয়েছে। একধরনের নির্মীয়মাণ স্পৃহা, যা একবিংশ শতকের উত্তরাধুনিক বাস্তবতায় ক্রমশ যান্ত্রিক হয়ে উঠছে, তাকে প্রতিভাত করা হয়েছে তরল স্বরে, যার গভীরে নিপাতনে সিদ্ধ হয় মানবতার অকৃত্রিম আকুতি। ঠিক এই জায়গাতেই মায়াবাস্তব রচিত হয়, তার গূঢ় পাঁজর থেকে চুঁয়ে পড়তে চায় বাস্তবিক আবেগ, রুক্ষতার রোম্যান্টিসিজম; উদাহরণস্বরূপ, ‘আমার উনিশ বছরের মেয়েটি’।

‘মঞ্চে কেউ নেই’ গল্পের শেষে ‘উলঙ্গ রাজা’-র সিক্যুয়েলের ছাপ লক্ষ্যণীয়। ‘কাগজ’ ও ‘নিমগাছ’ গল্পের অস্তিত্ব-দোটানা, বেঁচে থাকার টানাপোড়েন, বিচ্ছিন্নতা-সংকট, যথাক্রমে রাজনৈতিক ও স্নায়বিক, সন্তর্পণে জীবনের যে অর্ধসত্য হাতিয়ার-সংগ্রাম, তাকে দমিত করেছে সুপরিকল্পিত স্থিতাবস্থায়। দীপ শেখরের গল্পে— ‘যে কোনো উপায়ে বেঁচে থাকাই জীবন’, টিকে থাকাই অন্তিম শ্বাসের পূর্ববর্তী মিষ্টতা।

প্রতিটি গল্পের স্বতন্ত্রতাকে লেখক সূত্রাকারে গ্রথিত করেছেন, কখনও ক্ষণিকের প্রিটেনশনে, কখনও উপর্যুপরি আখ্যান-বর্জনে। এক অদ্ভুত বিপ্রতীপ অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়। মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় ক্রমশ যুদ্ধ করে চলা তৃতীয় পৃথিবীর মানুষ, নিঃসঙ্গ, বিপন্ন ও তিক্ত জীবনের সমান্তরালে অকল্পনীয় নিরাসক্তি, অস্তিত্বচেতনা ও অস্তিত্বহীনতার ছটফটানিতে অর্থশূন্য, অথবা প্রবল সদর্থক বেঁচে থাকাকে উপভোগ করা— মানবজীবনের এলোমেলো, অকারণ, তাৎক্ষণিক, বহুগামী, স্বভাবসিদ্ধ অস্থিরতাকে প্রশ্রয় দিয়ে এগিয়ে চলেছে গল্পগুলি। ভাষার কাব্যিক মোচড়, গতির প্রতিকূলে মুহূর্তনির্মাণ, মেদের প্রয়োজনীয় সংযোজন— সার্বিকভাবে গল্পগুলিকে উন্নীত করেছে চেতনার পরাকাল্পনিক স্তরে, যেখান থেকে সূচিত মহাজাগতিক উত্তেজনাকে প্রতিহত করে পিছিয়ে আসার সমস্ত পথ অবরুদ্ধ।

‘মৌহারি’-র কাজ, যত্ন, পরিশীলন প্রশংসাযোগ্য। মূল্য কিঞ্চিৎ বেশি মনে হয়েছে। লেখকের স্বকৃত প্রচ্ছদেও পরিকল্পিত ও পরিচিত নান্দনিকতাতে বিনির্মাণের প্রয়াস স্পষ্ট। দীপ শেখর চক্রবর্তী আরও লিখুন, তাঁর গল্পের বাঁকে বাঁকে আবিষ্কৃত হোক অবচেতনের অযাচিত অঙ্গুলিহেলন। তাঁকে আন্তরিক শুভকামনা আর ভালবাসা জানাই।

হাওয়ার দুর্গ ।। দীপ শেখর চক্রবর্তী ।। মৌহারি ।। প্রচ্ছদ: দীপ শেখর চক্রবর্তী ।। মূল্য: ৩০০ টাকা মাত্র

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »