সেতলানা আলেক্সিয়েভিচ
অনুবাদ: মানব সাধন বিশ্বাস
আমি হাঁটছি, একলা। জানি আমাকে একলাই হাঁটতে হবে অনেকদিন। আমার ছেলে কোনও একজনকে মেরে ফেলেছে। যে ছুরিতে আমি রান্নাঘরে মাংস টুকরো করি, কুচো করি, সেই ছুরিটা দিয়েই সে কাজটা করেছে। কাণ্ডটা ঘটাল এখানেই, যুদ্ধ থেকে ফেরার পরে। সকালে সে ছুরিটা এনে ছোট ক্যাবার্ডে রেখে দিয়েছে, যেখানে রান্নাঘরের জিনিসপত্র রাখি, সেখানে। যদ্দুর মনে পড়ছে, ওইদিন আমি তার জন্যে পর্ক কাটলেট করেছিলাম। এর কিছু পরে ওরা টেলিভিশনে খবরটা ঘোষণা করল, আর সন্ধের খবরের কাগজেও সেই খবর ছাপা হল: কয়েকজন জেলে টাউন লেক থেকে একটা লাশ জল থেকে টেনে তুলেছে। দেহটা টুকরো করে কাটা। আমার এক বন্ধু বলল:
‘খবরটা পড়েছ? এ নির্ঘাত কোনও পেশাদার খুনির কাজ। আফগানি ছাপ ছিল।’
ছেলে বাড়িতেই ছিল। সোফায় শুয়ে বই পড়ছিল। তখন পর্যন্ত কিছুই জানতাম না, কিছু সন্দেহও করিনি। কিন্তু কোনও কারণে বন্ধু যা বলল, সেটা মনে পড়তেই ছেলের দিকে তাকালাম। মায়ের মন তো।
কুকুরগুলোর ডাক শুনতে পেয়েছ তোমরা? পাওনি? আমি কিন্তু পেয়েছি। কাউকে কিছু বলার চেষ্টা করলেই আমি ওই ডাক শুনতে পাই। কুকুরগুলো এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। জেলে যেখানে সে এখন হেফাজতে আছে, সেখানে কিছু বড়সড় কালো অ্যালসেশিয়ান কুকুর দেখেছি। ওখানে সবার গায়ে কালো পোশাক, অন্য কিচ্ছু নয়। আমি মিন্সকে ফিরে এলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। একটা লম্বা রুটি আর খানিকটা দুধ নিয়ে রুটির দোকান আর কিন্ডারগার্টেন পার হচ্ছি, তখনও সমানে কুকুর ডাকছিল। কানফাটানো ভীষণ চিৎকারে চোখে আঁধার দেখতে লাগলাম। গাড়ির নিচেই চলে যেতাম, অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচেছি।
ছেলের কবরের ঢিপি দেখার জন্যে আমি তো একেবারে তৈরি ছিলাম, ওর কবরের পাশে শুয়ে পড়তেও তৈরি ছিলাম। আমি জানি না, কেমন করে এসব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে ঢুকতেও আমার ভীষণ ভয় হয়— ক্যাবার্ডের সেই ছুরিটার দিকে চোখ চলে যায়। ওই আওয়াজ তোমরা কি শুনছ? কিছু শুনতে পাচ্ছ?
ছেলের চেহারা এখনই ঠিকঠাক মনে করতে পারি না; কে জানে, পনেরো বছর পরে সে ফিরে এলে তাকে আদৌ চিনতে পারব কিনা। ওরা ওকে পনেরো বছরের সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ঘেরাটোপে জেলে থাকার সাজা দিয়েছে। ছেলেকে আমি মানুষ করেছি কীভাবে? বলরুম নাচে ওর খুব উৎসাহ ছিল। লেলিনগ্রাদের নিরালা-নির্জন হারমিটেজে আমরা দুজন প্রায়ই চলে যেতাম। সেখানে আমরা বই পড়তাম। ছেলেকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল আফগানিস্তান।
একদিন তাস্কেন্ট থেকে একটা টেলিগ্রাম পেলাম: ‘এয়ারপোর্টে দেখা করো।’ দারুণ খুশিতে ছুটে আমি ব্যালকনিতে চলে গেলাম। উল্লাসে-উত্তেজনায় যথাশক্তি চিলচিৎকার করে বলতে চাইছিলাম— ‘আমার ছেলে বেঁচে আছে! প্রাণে বেঁচে ফিরেছে আফগানিস্তান থেকে! আমার কাছে অন্তত সেই ভয়ংকর যুদ্ধ এবার তাহলে শেষ হল!’ আমি সেদিন আনন্দে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। বলতেই হবে, আমাদের দেরি হয়েছিল। প্লেন অনেক আগেই এসে পড়েছিল। আমরা ছেলেকে পাবলিক গার্ডেনে পেলাম। বেচারা ঘাস আঁকড়ে মাটিতে শুয়েছিল। এত সবুজ দেখে সে রীতিমত তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল— বিশ্বাস করতে পারছিল না, শেষ অব্দি ফিরে আসতে পেরেছে। কিন্তু তার মুখে হাসি নেই।
সেদিন সন্ধেয় পড়শিরা ওকে দেখতে এল। তাদের একটা ছোট্ট মেয়ে ছিল— নীল ফিতেয় তার চুল বাঁধা। ছেলে তাকে হাঁটুর ওপর বসিয়ে নিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠল। চোখের জল তখন আর বাঁধ মানছিল না, সে কেঁদেই চলেছে। কারণ ওখানে তারা অনেককে শেষ করেছে। তাদের মধ্যে সেও ছিল। এসব আমি পরে বুঝতে পেরেছি।
বর্ডারে শুল্ক বিভাগের লোকেরা ওর বিদেশি হাফপ্যান্ট কেড়ে নিয়েছে, কেননা অ্যামেরিকান পোশাক পরা নিষিদ্ধ। তাকে ভেতরের পোশাক ছাড়াই দেশে ফিরতে হয়েছে। সে-বছরে আমি চল্লিশ বছরে পড়েছি। আমার জন্যে ছেলে একটা ড্রেসিংগাউন আনছিল, ওরা সেটাও কেড়ে নিয়েছে। তার ঠাম্মার জন্যে কেনা শালখানাও কেড়ে নিয়েছে। ছেলে শুধু কয়েকটা গ্লাডিওলা ফুল নিয়ে ফিরেছে। তার মুখে বিন্দুমাত্র স্বস্তির চিহ্ন ছিল না।
সকালে ঘুম থেকে উঠেও সে স্বাভাবিক ছিল; সে যেমন করে আমায় ডাকত, সেভাবেই ডাকছিল— ‘মামা! মামা!’ কিন্তু সন্ধে গড়াতেই ছেলের মুখে আঁধার নেমে এল। চোখদুটো ব্যথায় ভারি ভারি লাগল। এ যে কী অবস্থা, আমি বলে বোঝাতে পারব না। প্রথম দিকে কিছু খেতেই চাইছিল না, শুধু শূন্যদৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে চেয়ে ছিল। হঠাৎ সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে জ্যাকেট পরে নিল।
‘যাচ্ছিস কোথায়, ভ্যালিউস্কা?’ আমি দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম।
ছেলে সোজা আমার দিকে একবার শুধু ঘুরে তাকাল, তারপর বেরিয়ে গেল।
আমার কারখানা অনেক দূরে, বাড়ি ফিরতে সেদিন দেরি হয়েছিল। ডোরবেল বাজিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। ছেলে দরজা খুলল না। সে আমার গলার আওয়াজই চিনতে পারেনি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বন্ধুদের গলা হয়তো নাও চিনতে পারে, কিন্তু আমার গলাও ভুলে যাবে! বিশেষ করে, ওকে ‘ভ্যালিউস্কা’ বলে তো শুধু আমিই ডাকি। মনে হচ্ছিল, সারাক্ষণ সে কোনও বিশেষ একজনের ডাকের অপেক্ষায় ছিল, মনে হল কোনও ভয়ে ছিল। একটা নতুন শার্ট কিনেছিলাম ওর জন্যে। সেটা মাপসই হল কিনা পরখ করতে গিয়ে চোখে পড়ল, ওর সারা হাত অনেকগুলো কাটা দাগে ভরা।
‘কী এসব?’ আমি আঁতকে উঠলাম।
‘ও কিচ্ছু না, মামা।’
বিচার শেষ হওয়ার পরে সব জেনেছি। ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকার সময় একবার ছেলে নিজের কবজির শিরা কেটে ফেলেছিল। মহড়া চলার সময় সে রেডিয়ো অপারেটারের কাজে ছিল। রেডিয়োটা সময়মত উঁচু গাছে তুলে দিতে পারেনি। যেমন বলা হয়েছিল, সে তার চেয়ে বেশি সময় নিয়েছিল। এরজন্যে তার সাজা হল। মোতায়েন-থাকা সেপাইদের সামনে দাঁড়িয়ে সার্জেন্ট তাকে টয়লেট থেকে পঞ্চাশ বালতি ময়লা তোলার হুকুম করল। সে বালতি টানার ধকল সামলাতে না-পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। হাসপাতালের লোকেরা পরীক্ষা করে বলল, নার্ভের কিছু সমস্যা হয়েছে। সেদিন রাতেই সে হাতের শিরা কেটেছিল। দ্বিতীয়বার অমন হল আফগানিস্তানে থাকার সময়। সেবার এলাকায় ঝটিকা অভিযানে বেরনোর ঠিক আগে রেডিয়ো ঠিক আছে কিনা তা দেখে নিতে গিয়ে দেখা গেল সেটা বিকল হয়ে গেছে। সারানোর যন্ত্রাংশগুলোও সে খুঁজে পেল না। যোগান যা ছিল, সেগুলো নেই— সব লোপাট হয়ে গেছে। তাদেরই কেউ সেগুলো চুরি করেছিল। কমান্ডার ওকেই দোষী ঠাউরাল শুধু ভয় পাওয়ার দায়ে। কমান্ডারের মনে হয়েছে, বাকিদের সঙ্গে ডিউটিতে বেরনোর ভয়ে যন্ত্রাংশগুলো সে নিজেই লোপাট করেছে। আসলে তারা অন্যের জিনিস চুরিতে সিদ্ধহস্ত ছিল। তারা ট্রাক টুকরো করে যন্ত্রাংশ হিসেবে ‘দুকান’-এ বিক্রির জন্যে নিয়ে যেত। ওরকম জিনিস বিক্রির দোকানও ওখানে বেশ কয়েকটা ছিল। বিক্রির পয়সায় ড্রাগ কিনত। ড্রাগ, সিগারেট আর খাবার। সারাক্ষণই তাদের পেটে রাক্ষুসে খিদে লেগে থাকত।
একবার টেলিভিশনে গায়িকা এদিথ পিয়াফকে নিয়ে একটা অনুষ্ঠান হয়ে গেল। সেটা আমরা সবাই মিলে দেখেছি।
ছেলে একবার জিজ্ঞেস করল, ‘‘মামা, ‘নারকোটিক্স’ জিনিসটা কি জানো?’’
‘না।’ ছেলেকে মিথ্যে বললাম।
আমি তার ওপর নজর রাখছিলাম। সত্যিই সেরকম নেশার জিনিস সে সেবন করছিল কি না, সেটা জানার ছিল। তেমন কোনও চিহ্ন অবশ্য পাইনি। কিন্তু আমি জানতাম, সেখানে তারা ড্রাগ নিত।
‘আফগানিস্তানে তোরা কি করতিস?’ একদিন ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘চুপ করো মামা, চুপ করো!’
ছেলে বাইরে গেলে আমি ছেলের আফগানিস্তানের চিঠিগুলো বারবার পড়তাম। ব্যাপারটার গোড়ায় যেতে চাইছিলাম। সমস্যাটা আসলে কী, সেটা বুঝতে চাইছিলাম। চিঠিগুলো থেকে বিশেষ কিছু পেলাম না। একবার ছেলে লিখেছিল, সে সবুজ ঘাস দেখতে পায় না। ঠাম্মার কাছে তার আবদার ছিল, নাগাড়ে ঝুরুঝুরু তুষার-পড়া কোনও একদিনে তোলা ঠাম্মার একটা ফোটো চাই। চিঠিগুলোয় চিন্তা করার মত তেমন কিছু একেবারেই পাইনি। ওর মধ্যে সত্যিই কী চলছে, সেটা ধরতে পারিনি। ওরা যাকে পাঠাল, মনে হল সে একেবারেই অন্য মানুষ, আমার ছেলে নয়। আমি নিজে ছেলেকে আর্মিতে পাঠিয়েছি। দেরিও হয়েছিল কাজটায়। আমি তাকে একজন খাঁটি মানুষ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। আমি তাকে তো বটেই, নিজেকেও বরাবর বুঝিয়ে এসেছি যে, আর্মির তালিম তাকে আরও ভাল একজন শক্তসমর্থ মানুষ হিসেবে তৈরি করবে। আফগানিস্তানে পাঠানোর সময় ওর প্রিয় গিটারটাও সঙ্গে দিয়েছিলাম। মনে আছে, বিদায় জানানোর দিনে ভাল খাবারদাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল, ছেলে তার বন্ধুদের, বান্ধবীদের নেমন্তন্ন করেছিল। তাদের জন্যে দশ-দশটা কেক কিনেছিলাম সেদিন।
সে শুধু একবার মাত্র আফগানিস্তান নিয়ে কথা বলেছিল। তখন সবে সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। সে রান্নাঘরে এল। আমি তখন খরগোশের মাংস বানাচ্ছিলাম। বাটিতে সামান্য রক্ত ছিল। সে ওই রক্তে আঙুল ডুবিয়ে দেখতে লাগল। তারপর ভাল করে খুঁটিয়ে আঙুলটা দেখতে দেখতে নিজের মনে বলে উঠল:
‘ওরা আমার বন্ধুটাকে আফগানিস্থান থেকে এনেছিল। বেচারার পেটটায় সাংঘাতিক চোট ছিল। অসহ্য যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে বন্ধু মেরে ফেলতে বলল। আমি তাই করলাম।’
খরগোশের মাংস থেকে তার আঙুলগুলোয় রক্ত লেগে-থাকা আঙুলেই সে একটা সিগারেট ধরাল, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ব্যালকনির দিকে চলে গেল। তারপর সারা সন্ধেয় আমার সঙ্গে আর একটি কথাও বলেনি।
আমি ডাক্তারদের কাছে ছুটে গেলাম। তাদের খুলে বললাম সব। ‘আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দিন আপনারা, দয়া করে ওকে বাঁচান!’ তারা তাকে ভাল করে দেখে বলল, নার্ভের অসুখ র্যাডিকিউলিটিস ছাড়া আর কিছু তারা খুঁজে পায়নি।
আমি বাড়ি ফিরেই দেখি চারজন অচেনা জোয়ান ছেলে টেবিলে বসে আছে।
‘মামা, এরা আফগানিস্তান থেকে এসেছে। রেলস্টেশনে ওদের সঙ্গে দেখা হল। এরা কোথাও রাত কাটানোর মত কোনও জায়গা পাচ্ছিল না।’
‘ফ্রুট পাই করে দিই, তোরা খেয়ে নে। এক্ষুনি হয়ে যাবে।’ আমার কী যে ভাল লাগছিল।
ওরা সপ্তাহখানেক আমাদের সঙ্গে ছিল। আমি কিছু হিসেব করিনি। খানাপিনা ভালই চলছিল; মোটামুটি পেটি-তিনেক ভদ্কা ফুরিয়ে গেছে। রোজ সন্ধেয় পাঁচজন করে অচেনা অতিথি বাড়িতে আসত। পঞ্চমজন আমার ছেলে। তারা কী নিয়ে কথাবার্তা বলে সেসব কিছু জানতে চাইনি; তবে বড় ভয়ে থাকতাম। তাদের কিছু কিছু কথাবার্তা কানে যে আসেনি তা নয়। ওরা বলছিল, একটা অভিযানে ওদের টানা দু-সপ্তাহ লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল। তখন সাহস জিইয়ে রাখার জন্যে ওদের জোশ-বর্ধক নেশার ডোজ দেওয়া হত। তবে সবই হয়েছে লুকিয়েচুরিয়ে। খতম করার কাজে কোন বিশেষ অস্ত্র সবচেয়ে বেশি মোক্ষম, শত্রুপক্ষের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব কেমন রাখতে হবে ইত্যাদি বুঝে নিতে হত। যা ঘটার ছিল, সেসব ঘটে যাওয়ার পরে এবার সব জানতে পারলাম। পাগলের মত নানাভাবে ভাবার চেষ্টা শুরু করলাম। এর আগে মনের মধ্যে ছিল শুধুই ভয়। হা ঈশ্বর, এরা সব্বাই পাগলের দল, মাথায় একফোঁটা সুস্থ চিন্তা নেই।
সেই রাতে, যেদিন সে মানুষ খুন করল— তার আগের দিন আমি স্বপ্নের মধ্যে দেখলাম, ওর জন্যে আমি অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করছি তো করছিই, সে আর আসে না। তারপর একসময় তাকে আমার কাছে নিয়ে এল সেই চারজন ‘আফগান’। কংক্রিটের নোংরা মেঝের ওপর তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেল। আমাদের বাড়ির মেঝে কংক্রিটের, রান্নাঘরের মেঝে সেই জেলখানার মেঝেটার মত।
ওই সময় নাগাদ রেডিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাথমিক পাঠক্রম বিভাগে সে সবেমাত্র ভর্তি হয়েছে। তখন একটা ভাল প্রবন্ধও সে লিখেছিল। সবকিছু বেশ ভালই চলছিল বলে সে খুশি ছিল। আমিও ভাবতে শুরু করেছিলাম, সে নিজেকে শুধরে নিয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাবে। কলেজে যাবে, সময়ে বিয়ে করবে। কিন্তু সন্ধে হলেই, আমার বড় ভয় হতে লাগল। ছেলে দেয়ালের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে থাকে; আর্মচেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমি ছুটে চলে যেতাম ছেলের কাছে, ঝুঁকে পড়ে ওকে আদর করতাম, বাইরে যেতে দিইনি। আমি স্বপ্নে ছেলেকে দেখি সে যেন এখনও সেই একরত্তি শিশু— খিদে পেলে দুহাত বাড়িয়ে মায়ের কাছে খাবার চায়। আর বাস্তবে কী দেখলাম? ওর সঙ্গে দেখা করা যাবে প্রতি দু-মাস ছেড়ে। কথা হবে কাচের খুপরির মধ্যে দিয়ে, বরাদ্দ সময় চার ঘণ্টা।
বছরে দুবার পর্যন্ত ওর সঙ্গে দেখা করার সময় খাবার দিতে পারি। সেই কুকুরগুলো কিন্তু এখনও ডাকে। আমি স্বপ্নের মধ্যেও সেই ডাক শুনি। এসব আমাকে আর নিজের মত থাকতে দেয় না।
এর মধ্যে লোকটার মধ্যে প্রণয়-বাসনা জেগে উঠল। সে বাড়িতে ফুল আনতে লাগল। ওর ওই ফুল নিয়ে হাজির হওয়া দেখলে আমি রেগে চিৎকার করে উঠতাম: ‘আপনি দয়া করে এখান থেকে চলে যান; আমি একজন খুনের আসামির মা।’ প্রথমদিকে আমি পরিচিত কেউ দেখা করতে এলে ভয় পেতাম। বাথরুমে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকতাম। আমি চাইতাম আমার ওপর সবক’টা দেয়াল হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ুক। আমার মনে হত, রাস্তার সমস্ত লোকজন আমাকে চিনে ফেলেছে, ওরা আমার দিকে আঙুল তুলে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে বলছে— ‘হাড়-হিম-করা সেই কাণ্ডটার কথা মনে আছে? ওই দেখ— এ হল সেই খুনির মা। খুনিটা লোকটাকে ওর বাড়িতে রেখেছিল। আফগানি চিহ্ন…’। আমি বাইরে বেরতাম শুধু রাতে। রাতের পাখিদের চিনতে শিখলাম। ডাক শুনেই বলতে পারি কোন পাখি।
তদন্ত চলতে থাকল। মাসের পর মাস কাটল, সে কিছুই বলে না। অগত্যা ছুটলাম বুরদেঙ্কো মিলিটারি হাসপাতালে। সেখানে কয়েকটি ছেলেকে দেখলাম, যারা বিশেষ সক্রিয় বাহিনীতে কাজ করেছে, ঠিক আমার ছেলে যেমনটা করত। আমি ওদের বিশ্বাস করেছিলাম।
‘বাছারা, কী কারণে আমার ছেলে কাউকে খুন করবে, বলতে পারো তোমরা?’
‘যদি করেই থাকে, নিশ্চয়ই তার কিছু কারণ আছে।’
আমাকে মেনে নিতে হয়েছে যে, কাজটা সত্যিই আমার ছেলেই করেছে— সে খুনের দায়ে দোষী। অনেকদিন ধরেই ব্যাপারটা সমানে মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আমি ওদের কাছে মৃত্যুরহস্যটা জানতে চেয়েছিলাম; এটুকু অন্তত বুঝেছি যে, সে করতেই পারে একাজ! না, মৃত্যু নয়, জানতে চেয়েছিলাম এই হত্যা নিয়ে। কিন্তু এর পরেও তাদের মনে বিশেষ দাগ কাটেনি। যেকোনও খুনের ক্ষেত্রে যেসব স্বাভাবিক মানুষ জীবনে কখনও রক্তপাত দেখেনি, তাদের মনে সচরাচর যেটা হওয়ার কথা, তেমন কিছু হল না। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, যুদ্ধটাকে তারা সবাই একরকম চাকরি হিসেবে নিয়েছে, সেখানে খুনের কাজ থাকলে সেটাও করতে হয়। তারপর কয়েকজন ছেলের সঙ্গে দেখা হল যারা আফগানিস্তানেও কাজ করেছে। আর্মেনিয়ায় যখন ভূমিকম্প হল, তারা ত্রাণকর্মীদের দল নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। এর মধ্যে আমাকে যেটা কৌতূহলী করে তুলল সেটা হল, সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে-রাখা সেই প্রশ্ন: তারা কি ভয় পেয়েছিল? চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখে তাদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? না, তারা কোনও কিছুতেই ভয় পায়নি, এমনকি তাদের করুণার অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গেছে। সেখানে টুকরো টুকরো হয়ে গুঁড়িয়ে দলা পাকিয়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে পড়ে ছিল মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড়; সেখানে গোটা স্কুল-বাড়িও মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। একই রকমভাবে ক্লাসের বাচ্চারা, যারা তাদের সিটে বসে পড়াশোনা করছিল, তারা সবাই মাটির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এসব ছাড়িয়ে আরও কিছু ছিল, যা ওই ছেলেগুলোর আজও মনে আছে। তারা বলেছিল, মাটির নিচের সংরক্ষিত দামি মদের ভাণ্ডার তারা খুঁড়ে বের করেছিল। উঁচুমানের ফরাসি ব্রান্ডি কনিয়্যাক ইত্যাদি হরেক ধরনের মদ তারা খেয়ে দেখেছে। ছেলেগুলো অদ্ভুত ঠাট্টা-তামাশাও করল: ‘সব মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। অন্য জায়গাগুলোতেও এরকম হলে জমত ভাল।’ জায়গাটা ছিল উষ্ণ, আঙুর চাষ হয়, সেগুলো থেকে ভাল মদও তৈরি হয়। তাহলে প্রশ্ন হল, ওরা কি সুস্থ? সত্যিই তাদের মাথা ঠিক আছে তো?
‘সে মারা গেছে, কিন্তু এখনও তাকে ঘেন্না করি।’ হালে সে আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিল, সেই চিঠিতে সে একথা লিখেছে। আজ পাঁচ বছর কেটে গেল। কী ঘটেছিল সেখানে? সে কিছুই বলেনি। যা আমি জানি তা হল, সেই ছেলেটির নাম ইউরা। সে বেশ জোরগলায় বলছিল, সে বেরিওস্কা শপে ব্যবহার করার মত অনেকগুলো চেক পেয়েছে। বেরিওস্কা শপে যে কোনও বিদেশি টাকায় জিনিসপত্র কেনা যায়। পরে জেনেছি, যুবকটি ইথিওপিয়ায় ওয়ারেন্ট অফিসারের কাজ করত। আফগানিস্তান নিয়ে সে যা বলেছিল, সেগুলো সব মিথ্যে।
বিচারের সময় একমাত্র উকিলই বললেন যে, আমরা একজন অসুস্থ মানুষের বিচার করছি। অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী নয়। সে অসুস্থ, তার চিকিৎসার প্রয়োজন। কিন্তু এর বহু আগে— সে প্রায় বছর সাতেক হবে— আফগানিস্তানের আসল সত্যিটা কী তা কারও জানা ছিল না। ওরা ওদের সবাইকে ‘বীর’ বলত। ওরা নাকি ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী সৈনিক’। কিন্তু আমার ছেলে তো একজন খুনি; কেননা যা ওরা ওখানে করেছে, ছেলে সেটাই এখানে করেছে। কী কারণে ওদের সবাইকে মেডেল আর গুচ্ছের খেতাব-সম্মানে ভরিয়ে দেওয়া হল? কেন শুধু ছেলেরই বিচার হল? যারা তাকে সেই কাজে পাঠিয়েছিল, কেন তাদের বিচার হল না? কারাই বা তাকে মানুষ খুন করা শেখাল? আমি তো এসব শেখাইনি। নিজেকে সামলাতে না পেরে চিৎকার করে উঠেছিলাম।
আমার রান্নাঘরের মাংস-কাটার ছুরি দিয়ে ছেলে একজন মানুষকে খুন করেছে, সকালে ফিরে এসে ছুরিটা ক্যাবার্ডে রেখে দিয়েছে অন্যসব সাধারণ চামচ-কাঁটাচামচের মত।
যার ছেলে পা হারিয়ে ফিরে এসেছে, সেই মাকে আমি ঈর্ষা করি। কীইবা হত, নেশায় মত্ত হয়ে যদি সে তার মাকে গালমন্দ করত? কিংবা সারা দুনিয়াকে দুষত? যদি বুনো পশুর মত সে মাকে আক্রমণ করত? যদি সেই মা বাইরের মেয়েদের কেনে ছেলের উন্মাদ হওয়া থেকে বাঁচাতে? একবার সে নিজেই প্রেমিকার মত আচরণ করেছিল, কেননা এগারো-তলা বাড়িটা থেকে ঝাঁপ দেওয়ার জন্যে যেনতেনপ্রকারেণ হামাগুড়ি দিয়ে ব্যালকনির দিকে তিরবেগে চলে গিয়েছিল। আমি সবকিছু করতে রাজি। প্রতিটি মাকেই আমি ঈর্ষা করি। এমনকি যে-মায়েদের সন্তান কবরের নিচে শুয়ে আছে, সেই মায়েদেরও আমি ঈর্ষার চোখে দেখি। আমি ছোট্ট মাটির ঢিপির পাশে বসে থেকে শান্তি পেতে চাই। আমি সেখানে ফুল নিয়ে যেতে চাই।
কুকুরগুলোর ডাক তোমরা শুনতে পাচ্ছ? আমি কিন্তু স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি— ওরা আমার পিছু ধাওয়া করছে।
চিত্রণ: চিন্ময় মুখোপাধ্যায়
***
লেখক পরিচিতি
সেতলানা আলেক্সিয়েভিচ (১৯৪৮-) বেলারুশিয়ান সাংবাদিক, ঐতিহাসিক ও খ্যাতিমান লেখিকা। তাঁর জন্ম ১৯৪৮ সালে ইউক্রেনের স্তানিস্লাভ (অধুনা ইভানো ফ্রাঙ্ককিভ্স্ক) শহরে। বাবা বেলারুশীয়, মা ইউক্রেনের মানুষ। দুজনেই ছিলেন শিক্ষক। সেতলানা বেলারুশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতার পাঠ নেন। তারপর একইসঙ্গে শিক্ষকতা ও একটি আঞ্চলিক সংবাদপত্রের সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত শাসনকালের আফগান যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়ের চেরনোবিল পরমাণু-চুল্লি দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসা অবর্ণনীয় বিপর্যয় প্রত্যক্ষদর্শীর অভিজ্ঞতার সাহিত্যসুষমামণ্ডিত বিবরণ তাঁর লেখায় সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে। তিনি মূলত লেখেন রুশ ভাষায়।
২০১৫ সালে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। নোবেল কমিটি তাঁদের অভিজ্ঞানপত্রে বলেন, ‘তাঁর বহুধ্বনিঝঙ্কারে ঋদ্ধ লিখনশৈলী আমাদের সমসময়ের মানুষের দুঃখদুর্দশা ও তার মুখোমুখি হওয়ার সাহসিকতার এক ঐতিহাসিক অনন্য দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ ‘দ্য আনউওম্যানলি ফেইস অফ ওয়ার’ (১৯৮৫), ‘লাস্ট উইটনেসেস’ (১৯৮৫), ‘বয়েজ ইন জিঙ্ক’ (১৯৯১), ‘চেরনোবিল প্রেয়ার’ (১৯৯৭), ‘ভয়েসেস ফ্রম চেরনোবিল’ (১৯৯৭), ‘সেকেন্ডহ্যান্ড টাইম’ (২০১৩) তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।