Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

হরিনাথ দে: ৩৪টি ভাষায় সুপণ্ডিত বেঁচেছিলেন মাত্র চৌত্রিশ বছর

লর্ড কার্জন হরিনাথ দে সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি ভারতে মাত্র আড়াই জন মানুষ দেখতে পান— দুইজন পূর্ণ এবং একজন অর্ধ। এই দুইজনের একজন ছিলেন হরিনাথ দে। স্বল্পায়ু জীবনে হরিনাথ দে ১৮টি ভাষায় এমএ পাশ করেছিলেন এবং ৩৪টি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। এরকম বিস্ময়কর প্রতিভা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ আছেন বলে জানা নেই। অথচ তিনি আজ বিস্মৃতির অতল গর্ভে তলিয়ে গিয়েছেন। বাঙালি সমাজ, ভারতীয় সমাজ এবং পৃথিবীর মানবসমাজ তাঁকে আজ একেবারেই ভুলে গিয়েছে। তাই তো তাঁর নামে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। তাঁর মূর্তিও কোথাও চোখে পড়ে না। অথচ এরকম একজন মনীষীর নাম আমাদের প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করার কথা ছিল, এবং তাঁর মহান জীবনকাহিনি পাঠ করে তাঁর জীবনের আদর্শে নিজেদের জীবন গড়ে তোলার কথা ছিল।

আচার্য হরিনাথ দে জন্মেছিলেন চব্বিশ পরগনা জেলার আড়িয়াদহ গ্রামে, ১২ আগস্ট, ১৮৭৭ সালে। পিতা রায়বাহাদুর ভূতনাথ দে, মাতা এলোকেশী দেবী। হরিনাথের বাল্যকাল কেটেছিল পিতার কর্মস্থলে, মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। রায়পুরের মিশন স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা। তারপর নরম্যাল স্কুল। এখান থেকে আপার প্রাইমারি পরীক্ষায় পাশ করে ভর্তি হন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে। এই স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে মিডল্ স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। রায়পুর থেকে চলে আসেন কলকাতায়।

কলকাতায় এসে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের স্কুল বিভাগে। এখান থেকে প্রথম বিভাগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাশ করেন, এবং একই কলেজে এফএ ক্লাসে ভর্তি হলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফএ পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন। এরপর হরিনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। তিনি লাতিন এবং ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স নিয়েছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএ পরীক্ষায় এই কলেজ থেকে তিনি লাতিনে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, এবং ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে চতুর্থ হন। এরপর হরিনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাতিনে এমএ পরীক্ষা দেন, এবং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

হরিনাথ দে। কুড়িটি ইউরোপীয় এবং চোদ্দোটি ভারতীয় ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

১৮৯৭ সাল। হরিনাথ বিলাত যাত্রা করলেন, এবং কেমব্রিজের ক্রাইস্ট’স কলেজে ভর্তি হলেন। বিলাতে থেকেই একটি বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রিকে এমএ পরীক্ষা দেন, এবং প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেন। ১৯০০ সালে হরিনাথ ক্রাইস্ট’স কলেজের স্নাতক হন। এই বছরেই কেমব্রিজের ক্ল্যাসিকল ট্রাইপস, প্রথম ভাগে তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সম্মান লাভ করেন। কেমব্রিজের প্রখাত অধ্যাপক জন পিল হরিনাথকে দেওয়া শংসাপত্রে লেখেন— ইংল্যান্ডের শিক্ষাবিভাগে উচ্চপদ লাভের পক্ষেও হরিনাথের যোগ্যতা যথেষ্ট ছিল।

১৯০১ সালে হরিনাথ কেমব্রিজের মধ্যযুগীয় এবং আধুনিক ভাষাবলির ট্রাইপসে দ্বিতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন। তিনি শেকসপিয়র এবং চসার-সাহিত্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্যের স্কিট পুরস্কারও লাভ করেন। কেমব্রিজের আর একজন প্রখ্যাত অধ্যাপক, হেনরি জন এডওয়ার্ডস বলতেন— হরিনাথের মত অসাধারণ মেধাবী ছাত্র তিনি আর একটিও দেখেননি।

১৯০১ সালের শেষদিকে হরিনাথ বিলাত থেকে ভারতে ফিরে আসেন। তিনি ঢাকা সরকারি কলেজে ইংরেজি ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এর কিছুদিন পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও নিজেকে যুক্ত করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বিভিন্ন পরীক্ষার পরীক্ষক এবং প্রশ্নকর্তা ছিলেন তিনি। ১৯০৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে চলে আসেন, এবং ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করতে থাকেন। এরপরে হরিনাথ হুগলি কলেজের অধ্যক্ষের পদও অলংকৃত করেছিলেন। ১৯০৭ সালে হরিনাথ কলকাতা ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরির (বর্তমানে ভারতের জাতীয় গ্রন্থাগার) গ্রন্থাগারিক হন। প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই কৃতিত্ব তাঁরই। তাঁকে নিয়ে ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ গ্রন্থে একজায়গায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখছেন, ‘‘ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে হরিনাথ দে মস্ত ভাষাবিদ, সব ভাষাই তিনি জানতেন শুধু চীনে ছাড়া; বলতেন, ‘এবারে চীনেভাষাটা আমার শিখতে হবে।’’

হরিনাথ দে বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৪ বছর। জীবনের বেশিরভাগ সময়েই পৃথিবীর বিবিধ ভাষা নিয়ে গভীর চর্চা করেছেন। গ্রিক, লাতিন, ফরাসি, জার্মান, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, রুমানীয়, ডাচ, ড্যানিশ, প্রভঁসল, ইতালীয়, অ্যাংলো-স্যাকশন, গথিক, হিব্রু, চিনা, তুর্কি, আরবি, ফারসি, জেন্দ, তিব্বতি, সংস্কৃত, পালি, গুজরাতি, মারাঠি, ওড়িয়া, হিন্দি, উর্দু, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে কুড়িটি ইউরোপীয় এবং চোদ্দোটি ভারতীয় ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। বিশ্বের বিদ্বৎসমাজে বহুভাষাবিদরূপে তিনি স্বীকৃতিলাভ করেছিলেন।

১৯১১ সালের ৩০ আগস্ট এই মহাপ্রাণ মানুষটির জীবনাবসান হয়। কবির ভাষায়—

‘‘আজ শ্মশানে বঙ্গভূমির নিবল উজল একটি তারা,
রইল শুধু নামের স্মৃতি রইল কেবল অশ্রুধারা;
নিবে গেল অমূল্য প্রাণ, নিবে গেল বহ্নিশিখা,
বঙ্গভূমির ললাট ’পরে রইল আঁকা ভস্মটীকা।’’
[শ্মশান-শয্যায় আচার্য্য হরিনাথ দে: সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত]

চিত্র: গুগল
5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
2 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Asim Das
Asim Das
3 years ago

প্রথম এই ব্লগটি পড়লাম।এবং সমৃদ্ধ হলাম।হরিনাথ দে এর মতো পন্ডিতের কথা কখনও কেউ জানায়নি বোধ করি, এমন একজন পন্ডিত, ভাষাবিদ এত অল্প বয়সে চলে গেলেন শুধু এই রহস্যটা অধরা রয়ে গেল এই লেখায়।
থিয়েটার নিয়ে হরিনাথের কোমর আগ্রহ ছিল না অবাক লাগে! ঠাকুর বাড়িতে এত যাতায়াত, ইউরোপের এত দেশেকি থিয়েটার আকৃষ্ট করেনি!

অনুপম চক্রবর্তী
অনুপম চক্রবর্তী
3 years ago
Reply to  Asim Das

তথ্যসমৃদ্ধ লেখা।শুধু হরিনাথ দে র মতো মানুষের এমন রহস্য মৃত্যু ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা বিষয়ে একটু আলোকপাত করলে ভালো হতো।

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

কবি-কিশোর সুকান্ত: মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য

শৈশবেই জন্মস্থান কালীঘাট থেকে বেলেঘাটায় চলে আসেন। ওখানকার দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে পড়াকালীন হাতেলেখা ‘সপ্তমিকা’ বের করতেন। বরাবর ভাল ফল করতেন বার্ষিক পরীক্ষায়। তবে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারেননি, সম্ভবত অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে। বাংলার তিন বরেণ্য কবি-ই দশম মান উৎরোননি। আর আজ ম্যাট্রিকে এঁদের তিনজনের লেখা-ই পাঠ্যতালিকায় অপরিহার্য! একটি কৌতূহলী তথ্য হল, রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণে তাঁকে নিয়ে বেতারে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কাজী নজরুল এবং সুকান্ত। তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে কি আলাপ হয়েছিল?

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »