Search
Generic filters
Search
Generic filters
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on whatsapp

গুটলিমোহন: রথের দিনে মালদা মজে যে মিষ্টিতে

সারা বাংলায় যা পান্তুয়া, মালদায় সেই মিষ্টির নামই লালমোহন। আর সারা বাংলায় যা নিখুঁতি, মালদায় তাইই গুটলিমোহন। আকৃতিতে ছোট বলে লালমোহনের ছোটভাই। শতাব্দীপ্রাচীন রথযাত্রার ঐতিহ্য মেনে এখনও মালদায় শুধুমাত্র সোজারথ এবং উল্টোরথের দিনে তৈরি হয় এই মিষ্টি। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গেও ম্লান হয়ে যায়নি তার চাহিদা।

লালমোহনের সঙ্গে প্রস্তুত প্রণালীর কোনও পার্থক্য নেই। সেই ছানা, চিনি এবং ময়দার মিশ্রণ। সঙ্গে সামান্য সোডা। তারপর তেলে ভেজে হালকা রসে ডোবানো। পার্থক্য শুধু একটাই, এই মিষ্টি বিক্রি হয় ওজন হিসাবে। গৌড় রোড মোড়ে মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী নিশীথ পাল জানান, “বছরের অন্যান্য দিন এই মিষ্টির কথা লোকে ভুলেই থাকে। কিন্তু সোজারথ আর উল্টোরথের দিনে ব্যাপক চাহিদা এই মিষ্টির। এখন ২৪০-২৮০ টাকা কেজি চলছে।” সুকান্ত মোড়ের মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী শোভন ঘোষ বলেন, “এই মিষ্টিকে পুরনো দিনের মানুষরা গুটলিমোহন বলেন। অনেকে বলেন এর নাম নিখুঁতি। এখন এটা গোলাপজাম নামেও বিক্রি হয়। শুধুমাত্র বছরের দুটো দিন এই মিষ্টি বেশি পাওয়া যায়।”

গুটলিমোহন। বিক্রি হয় ওজন হিসাবে।

প্রয়াত ইতিহাসবিদ তুষারকান্তি ঘোষ তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মালদহের ইতিহাসের ধারা’-য় বলেছিলেন রথযাত্রাকালীন এই বিশেষ মিষ্টি নদীয়ার শান্তিপুর অঞ্চলের কারিগররা প্রথম মালদায় নিয়ে আসেন। প্রসঙ্গক্রমে চৈতন্যদেবের মালদায় আগমনের সঙ্গে এই মিষ্টির একটি সূক্ষ্ম যোগাযোগের দিকেও তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন।

রাধাপ্রসাদ গুপ্তের লেখা ‘বাংলার মিষ্টি’-তে নিখুঁতিকে শান্তিপুরের মিষ্টি হিসাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বলছেন, শান্তিপুরের গোভাগাড় মোড়ে ছিল বিখ্যাত মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী ইন্দ্র পরিবারের বাড়ি ও দোকান। সিপাহি বিদ্রোহের সময় গুড় দিয়ে তৈরি মিষ্টি চিনির ডেলা এই ইন্দ্র পদবিধারী ময়রাদের হাত ধরেই উঠে আসে। এই পরিবারেরই কিশোরী কন্যা নিখুঁতি। নিখুঁত রূপের জন্য তার এই নাম। একদিন বাবার অনুপস্থিতিতে দোকানে বসে ছোট ছোট হাতে পান্তুয়ার লেচি থেকে গোল্লা বানিয়ে খেলার ছলেই ভেজে ফেলে মেয়েটি। তারপর ভয় পেয়ে অন্য মিষ্টির সঙ্গে রসে ডুবিয়ে তাড়াতাড়ি ভিতর বাড়িতে পালিয়ে যায়। ইন্দ্র ময়রা অন্যান্য মিষ্টির সঙ্গে খেয়াল না করে এই মিষ্টিগুলোকেও ওজন দরে বিক্রি করে দেন। তারপর একের পর এক খদ্দের এসে এই নতুন মিষ্টির খোঁজ করতে থাকে। কালক্রমে মেয়ের নামে এই মিষ্টির নাম হয়ে যায় নিখুঁতি। সময়টা ১৮৫৬-এর আশেপাশে। সেই হিসাবে এই মিষ্টির বয়স দুশো বছরের কাছাকাছি।

১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরবর্তী সময় থেকে আরম্ভ হয় নিখুঁতির জয়যাত্রা। বর্ধমানের সীতাভোগ বা মিহিদানার সঙ্গে এক থালায়, চৈতন্যদেবের ভোগের সঙ্গে বা রথযাত্রার প্রসাদ হিসেবে এই মিষ্টি উঠে আসতে থাকে। আরম্ভ হয় ময়রাবাড়ির সেই কিশোরী মেয়েটির বাংলাজয়।

সোজারথ আর উল্টোরথের দিনে ব্যাপক চাহিদা এই মিষ্টির।

শুধু শহর নয়; পুরাতন মালদার তপন ঘোষ, মানিকচকের সুবল সরকার বা বাঙ্গিটোলার ষষ্ঠীচরণ সাহার মত প্রবীণ মিষ্টান্নশিল্পীরা একটি বিষয়ে একমত— শান্তিপুরের নিখুঁতির সঙ্গে মালদার নিখুঁতির একটা গুণগত পার্থক্য আছে। মালদার নিখুঁতি নরম পাকের, আর এতে হালকা গোলমরিচের গুঁড়োর ব্যবহার নেই। অন্যদিকে নদীয়া-শান্তিপুর অঞ্চলের নিখুঁতি কড়াপাকের, চিনির রস অনেক গাঢ়। ঠান্ডা হয়ে গেলে চিনির দানাদার ভাবটাও টের পাওয়া যায়। পরিবেশনের আগে তার ওপর ছড়ানো হয় হালকা গোলমরিচের গুঁড়ো।

উনিশ শতকের কলকাতায় নিধুবাবুর টপ্পায় উঠে এসেছে নিখুঁতি প্রসঙ্গ— “খাওয়াইবো গণ্ডা গণ্ডা নিখুঁতি আর দেদো মণ্ডা/ খেয়ে খেয়ে বলবে প্রাণটা বলবে বলিহারি যাই!” শুধু জনজীবনে নয়, বাংলা সাহিত্যেও অমর হয়ে আছে এই মিষ্টি।

নিখুঁতি বা গুটলিমোহন— যে নামেই ডাকা হোক না কেন, মালদা জেলার প্রেক্ষিতে এই মিষ্টিকে শহরকেন্দ্রিক বলেই উল্লেখ করেছেন মিষ্টান্ন বিশেষজ্ঞ ও গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিভাগের কর্মী সৌমেন্দু বাবাই রায়। তিনি বলেন, “প্রাচীনকাল থেকে মালদা টাউনে বড় রথ বলতে ইংরেজবাজারের মকদমপুরের রথঘরের রথ আর ইস্কনের রথ। প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো এই দুই রথ উপলক্ষেই মেলা বসে। তাতেই এই মিষ্টিটা পাওয়া যায়। পাপড় বা জিলিপির মত মেলা দেখতে আসা সারা জেলার মানুষ এই মিষ্টি কিনে খান। একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়: বিস্তীর্ণ গ্রামীণ মালদায় রথ বেরোলেও রথের মেলা হয় না। মানিকচক-মথুরাপুর হোক বা হবিবপুর-বামনগোলা— যত বড় রথ আজকাল বেরোয়, কোনওটারই বয়স কুড়ি-পঁচিশ বছরের বেশি নয়। এই রথগুলিকে কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ১৯৯৭-৯৮ নাগাদ প্রবর্তিত রথযাত্রার ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবে দেখা যেতে পারে। বিশেষত বরিন্দ অঞ্চলের রথগুলি।”

শান্তিপুরের নিখুঁতির সঙ্গে এর একটা গুণগত পার্থক্য আছে।

সেই যে রাধারাণী নামের এক কিশোরী ঝড়বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল মাহেশের রথ দেখতে গিয়ে, নোটের উপর লেখা নাম দেখে তার রুক্মিণীকুমারকে খুঁজে দিয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং। রথের মেলার ঝড়জলে এমন কত হারিয়ে যাওয়া আর হারিয়ে যেতে চাওয়া লুকিয়ে থাকে। হারাতে হারাতেও হারায় না নিখুঁতি।

আর সেই বাজার নেই— এই আক্ষেপ আজ ক্রেতা-বিক্রেতা সকলের মুখে। তবুও সোজারথ আর উল্টোরথের দিনে হঠাৎ নামা আকাশভাঙা বৃষ্টি আর মেঘের ডাক, তার সঙ্গে মিলে যাওয়া রথের ভেঁপুবাঁশি আর মেলার ভিড়… প্রিয়জনের হাত মেলার ভিড়ে শক্ত করে চেপে ধরা আর অন্যহাতে শালপাতার ঠোঙা থেকে একটা একটা করে নিখুঁতি মুখে তোলা এই জনপদের অনেকের কাছেই স্মৃতির ফিরতি পথ। সময় এগোয়… পথ ফুরোয় না।

চিত্র: লেখক
4.8 6 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments

Recent Posts

মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

বাঙালি রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার বিন্দুমাত্র ভেদাভেদ ছিল না। বিশ্বভারতীতে তিনি বক্তৃতা দিতে উদার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে, কাজী নজরুল ইসলাম, আলাউদ্দীন খাঁ, কাজী আবদুল ওদুদকে। গান শেখাতে আবদুল আহাদকে। বন্দে আলী মিয়া, জসীমউদ্দিন প্রমুখকে তিনি কাহিনির প্লট বলে দেন, যেমন দেন গল্পকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়কে। সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়েন তাঁর-ই বদান্যতায়। লালন শাহ্ তাঁর কল্যাণেই পরিচিতি পান ইংল্যান্ড তথা ইয়োরোপে। বঙ্গভঙ্গকালীন সময়ে কলকাতার নাখোদা মসজিদে গিয়ে তিনি মুসলমানের হাতে রাখী পরিয়ে আসেন। বেগম সুফিয়া কামাল, আবুল ফজল, আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর পত্রালাপ চলে, যেমন চলে হেমন্তবালা দেবী, বুদ্ধদেব বসু বা বনফুলের সঙ্গে। এক অখণ্ড বাঙালিয়ানায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি, জাতপাত, বর্ণ বা ধর্মের ঊর্ধ্বে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

গুড ফ্রাইডে

রাজশক্তি যখন কাউকে বিপজ্জনক মনে করে, যেমন অতীতে সক্রেটিসকে মনে করেছে, তখন তাঁকে বিনাশ করতে যাবতীয় তৎপরতা দেখাতে কুণ্ঠিত হয় না। একথা অনস্বীকার্য, বুদ্ধদেব, হজরত মুহাম্মদ বা যিশু মানবজাতির মৌল একটি পরিবর্তন চেয়েছিলেন। যিশু যা চেয়েছিলেন, তার সরলার্থ রবীন্দ্রনাথ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীর রাজার প্রতি যে উক্তি, তাতে স্পষ্ট করেছিলেন, ‘মানুষের ক্ষুধার অন্ন তোমার নয়, উদ্বৃত্ত অন্ন তোমার’। যেমন রসুলুল্লাহ সুদ বর্জনের নিদান দেন, সমাজে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য ঘোচাতে। এঁরা তাই মানবমুক্তির অগ্রদূত।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

সনজীদা খাতুন: শ্রদ্ধাঞ্জলি

সাতচল্লিশ-পরবর্তী পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংস্থা গড়ে ওঠে, যাদের মধ‍্যে ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’, ‘ক্রান্তি’, ‘উদীচী’ অন‍্যতম। রাজনৈতিক শোষণ ও পূর্ববঙ্গকে নিপীড়নের প্রতিবাদে কখনও পরোক্ষভাবে কখনও সরাসরি ভূমিকা রেখেছিল এইসব সংগঠন। ‘ছায়ানট’ এমনি আর এক আগ্নেয় প্রতিষ্ঠান, ১৯৬৭-তে জন্মে আজ পর্যন্ত যার ভূমিকা দেশের সুমহান ঐতিহ‍্যকে বাংলাদেশের গভীর থেকে গভীরতরতায় নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে সুস্থ ও সংস্কৃতিবান নাগরিক গড়ে তোলা। ওয়াহিদুল হক ও সনজীদা খাতুনের মানসসন্তান এই ছায়ানট। মূলত রবীন্দ্রনাথের আদর্শে গড়ে ওঠা সঙ্ঘ, কাজী নজরুলের প্রিয় নামটিকে জয়ধ্বজা করে এগিয়ে চলেছে বহু চড়াই-উৎরাই, উপলব‍্যথিত গতি নিয়ে।

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

ঢাকায় বিবেকানন্দ: ১২৫ বছর পূর্তি

ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তাঁর শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল দু’হাজার। পরদিন অর্থাৎ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, তিন হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’। দুটি সভাতেই শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ, আপ্লুত ও উদ্বুদ্ধ।

Read More »
সুজিত বসু

সুজিত বসুর গুচ্ছকবিতা

বিলাপ অভিসার জল আনতে চল রে সখী, জল আনতে চল নিভু নিভু আলোর সাজে সূর্য অস্তাচলে শেষবিকেলের রশ্মিমালায় বুকে ব্যথার ঢল লজ্জা আমার আবির হয়ে

Read More »
মলয়চন্দন মুখোপাধ্যায়

যত মত তত পথ

বহুদিক দিয়েই একজন স্বতন্ত্র মননের ধর্মীয় সাধক। তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ধারণাতীত, আর তা কেবল তাঁর স্বদেশ বা এই উপমহাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। এবং দিনের পর দিন তাঁর অনুগামীর সংখ্যা বাড়ছে। শ্রীরামকৃষ্ণ এবং সারদামণি ও স্বামী বিবেকানন্দকে কেন্দ্র করে যে ভাব-আন্দোলন, তার ফলশ্রুতিতে তাঁদের নিয়ে নিয়ত চর্চা ও গবেষণা হয়ে চলেছে। পৃথিবীব্যাপী দুশোর ওপর রামকৃষ্ণ মিশনের কার্যাবলি প্রমাণ করে (প্রতিবছর এর সংখ্যা বাড়ছে), আজকের এই অশান্ত বিশ্বে তাঁরা মানুষের কতখানি আশ্রয়।

Read More »